জয়া চৌধুরী

আজাইরা বাজার কথন -    জয়া উবাচ ৭

লকাতায় যখন ১৫ .৯ ডিগ্রীর শীত দমদমে তখন ১৫ ডিগ্রী। আমি একে শীত লিখছি জানলে আমার ইউরোপীয়ান বন্ধুরা তেড়ে মারতে আসবেন, নিদেন আমাদের দেশের উত্তর বা পশ্চিম প্রান্তের দিকে বসবাসকারী বন্ধুরা তো বটেই। আসলে হয়েছে কি এই ধুলোয় - মাইকে , মেলায়, উৎসবে নাজেহাল কলকাতাবাসীদের চোখ প্রায় ১৩০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে ঘুরেই থাকে এট্টূখানি শীতের সন্ধানে। মানে ধূসর জীবনে একটু নতুনত্ব আর কি! টাটকা তালের রস , খেজুর পাটালির সুগন্ধ, চিতোই পিঠা থেকে পাটিসাপটা আর নাড়ুর মত ডেলিকেসীগুলো আজকাল সুদীপার রান্নাঘর ছাড়া ঐ শীতের মেলাগুলোতেই মেলে কি না! তায় আবার জিভ পর্যন্ত পৌঁছনোর কোন গ্র্যান্টি নেই আর কি! মানে আগে গতর নাড়িয়ে বাস ঠেঙিয়ে মেলায় পৌঁছব তবে তো আস্বাদন! তা যাক শীত নিয়ে রোম্যান্টিকতা করা যাবে না এখনই সেকথা বলবার সময় আসে নি। বরং অন্য কথা বলা যাক।

সেদিন হাজরা মোড়ে গিয়েছিলাম একটা কাজে। ভাবছেন এরম কত নামই তো কলকাতায় ছড়িয়ে আছে। এ তো আর বিশ্ববিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি কিম্বা সত্যজিৎ রায়ের বিশপ লেফ্রয় রোড নয় তো যে সরণীই হোক বা ধরণী মানুষ ঠিক চিনে যাবে! যাবে মশাই যাবে। হাজরা মোড়ও কম খ্যাত নয়। এখেনেই আছে সেই বিখ্যাত দোকান, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের আমলের “ক্যাফে”। যেখানকার চিকেন কবিরাজী কাটলেট পেলে আমি প্রেমিকের প্রোপজালও ঠুকরোতে পারি অনায়াসে। এখানেই সেই বি থুক্কু কুখ্যাত ইয়ে আলমের লাঠির ঘা পর্ব, এ পথ দিয়েই যেতে হয় আলিপুর জাজেস কোর্ট আর পুলিশ কোর্টের ঘুঘুর বাসায়, মায় এখানেই  মেট্রো থেকে নেমে এস্ক্যালেটরে চেপে সটান ভূমিগর্ভ থেকে ভূমিতলে উঠে আসা যায়, এমন জায়গার কি আর পরিচয় দিতে হয় মশাই? তো সেই হাজরায় চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের পাশেই আশুবাবুদের পারিবারিক মন্দিরটি আছে না? সেই মন্দিরের সামনের ফুটপাথে দেখি এক পাগড়ি শোভিত কালো সাদায় মিসি মাখানো এক মানুষ। হাতময় তার গোলাপি ধুলো। খুব তাড়ায় ছিলাম বলে হনহন করে এগিয়ে আসছি, গোলাপি রঙটাই টেনে ধরল আমায়। তাকিয়ে দেখি দু হাত ভর্তি গোলাপি ধুলো মেখে পেতলের জিনিস চকচক করছেন তিনি। জাস্ট দেখবার জন্য দাড়াতেই হাত বাড়িয়ে আমার  বাঁহাতে পরা সোনালি ডায়াল কালো বেল্টের ঘড়িটা চাইলেন। আমি সবেগে মাথা নাড়লাম।

- না না আমার লাগবে না। উহু উহু করতে করতেই তিনি জোরাজুরি করে ঘড়িটা নিয়েই ছাড়লেন। তারপরে একগাল হেসে গুড়ো মেজে চকচকে করে দিলেন। সত্যি দিলেন! অবিশ্বাসী মন চোখ কচলে দেখল ব্যান্ডটাকে ফের। সত্যি চকচকে লাগছে দেখি! তারপর শুরু হল বাংলায় কথা। বুড়োর বয়স অনেক, দেখে অবিশ্যি বোঝা যায় না। কথার ফাঁকে বুঝলাম নাম রাজ সিং, আদি বাস জলন্ধর, পাঞ্জাব। এখানে বন্ডেল গেটের কাছে বাড়ি। ৪০ বছর ধরে কলকাতায় থেকে কথার টান শুনলে বোঝার উপায় নেই বাঙালি কি না। দাড়ি আর পাগড়ি দেখেই আন্দাজ করতে হয়। স্টক অফ ওয়ার্ডস –এ বাঙাল ভাষাও  রয়েছে দেখে সত্যি বলতে চমকে গেলাম। বাড়ির কাছেই গুরদোয়ারা থাকায় বহু পাঞ্জাবী দেখে অভ্যাস যারা ভালই বাংলা বলেন। কিন্তু এমন দেশীয়করণের নমুনা আমার চোখে আগে পড়ে নি। জিজ্ঞেস করলাম এই বয়সে কাজ করেন কেন? বুড়োর তুরন্ত জবাব- বুড়ির খরচা কে চালাবে? বললাম- কেন আপনার দুই ছেলে দেখে না? - কেন? ওদের সংসার নেই? ওরা গাড়ি চালায় আর আমি এই করি। আমাদের সাথে এক নাতিও থাকে। পড়াশুনা করে। দিনে একশ টাকা খরচা আছে। সেও আমিই দিই। কাজ করব না কেন? যতদিন গায়ে ক্ষমতা আছে কাজ না করা পাপ।

মনে মনে ভাবলাম এই বাংলায় দেখি কাজের প্রতি এতটাই ঝোঁক কি দেখি? কাজ যেন নিয়মের জাঁতাকলে পড়ে করবার জিনিস। যেন ভালবাসার জিনিস নয়। বছর চল্লিশ পেরোলেই – ব্যস, ঢের পরিশ্রম হয়েছে, এবার বিশ্রামের বয়স হল...বলতে বলতে গা ঢিস ঢিস করে করে কোনরকমে পঞ্চাশ ছুঁলেই চোখ নদীর ওপারের দিকে। মানে রিটায়ার্ড লাইফের স্বর্গ সুখের কল্পবায়। দিনরাত শুধু – আর ভাল্লাগে না, কবে যে চাকরি টা শেষ হবে! আর পারি না, সারা জীবন কলুর বলদের মত ঘানি ঘুরিয়েই যাচ্ছি ইত্যাদি বচনে কান মাথা ঝিমঝিম করে। একটি কাওয়া পড়ার সংস্থান থাকলেই হল, কাজ ভাল্ললাগে না –র যত আরাধনা, ভাল লাগার কোন উদয়গ দেখি না। নতুন ধরনের কাজ শুরু করা তো বোকামীর পরিচয়। তাই হয়ত বাঙালি বদ্ধ শ্যাওলার মত হামাগুড়ি দিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে জীবন কাটায়। তাই হয়ত টাকা ফিক্সড রেখে কড়ি গুণে দিনাতিপাতের দিকে ঝোঁক। তাই হয়ত শিল্পে সাহিত্যে সর্বত্র মধ্যমেধারা পুরস্কার টাকাকড়ি পেয়ে দলেছে। কলকাতা তাই ভারতের জেরিয়াট্রিক রাজধানী। বুড়োদের গুঁতোগুঁতি। এখানে বুড়োরা বয়সের কারণে হতোদ্যম, আর জোয়ানেরা বুড়ো হবে বলে হতোদ্যম। বুড়োর কাছ থেকে ত্রিশ টাকা গচ্চা দিয়ে ব্রাসো পাউডারের এক পুঁটলি কিনে বাড়িতে ব্যাক।

ও গোলাপি গুঁড়োয় কাজ হোক না হোক, আমার আজাইরার পর্ব টি লেখা হল যে? তার দাম কি কম... পাঠক?



Previous Post Next Post