মিঠুর বউ নারকেল গাছের কোটরে তিনটে ডিম পেড়েছে। শীত কালের মাঝামাঝি সময়। সবেমাত্র দুইদিন হ’ল ডিম পেড়েছে সে। মিঠুর বউ-এর উপর গুরুদায়িত্বঃ ডিমে ‘তা’ দিতে হ’বে। তবেই তো ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুবে। মিঠুরও দায়িত্ব কম নয়, যতদিন তার বউ ডিমের উপর বসে ‘তা’ দেবে – ততদিন তার খাওয়া-দাওয়া এবং অন্যান্য পরিচর্যা করতে হ’বে মিঠুকে।
মিঠু জীবনে প্রথমবার এইপ্রকার দায়িত্ব পালন করছে। দু’দিন হ’ল মিঠুর বউ ডিম পেড়েছে – তাই কাজের চাপ সম্বন্ধে এখনও পুরোপুরি অভিজ্ঞতা জন্মায়নি মিঠুর। যাইহোক, খাবার তো সে আগেও জোগার করেছে – বন-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে। এ’বারও না হয় সেই কাজটা করে ফেলবে সে – এটুকু আত্মবিশ্বাস তার আছে!
সেদিনও সে খাবার জোগার করার জন্যই বনে বনে ঘুরছিল। একটা উঁচু জায়গায় বসল সে। কিন্তু, উড়ে যাওয়ার সময় – হটাৎ ই অনুভব করলঃ তার পা কোনো আঠালো বস্তুতে আটকে গিয়েছে। কিছুতেই সে উড়ে পালাতে পারছে না। যেটাতে সে বসেছিল – সেটা হ’ল একটা লম্বা বাঁশের উপরিভাগ।
হটাৎ ই মিঠুর মাথায় আসলঃ সর্বনাশ! এ যে ফাঁদ! তার জন্যই পাতা হয়েছিল হয়তো! প্রচন্ড চেঁচামেচি জুড়ে দিল সে। প্রচন্ড পরিমাণে ডানা ঝাপ্টাতে শুরু করল।
মিঠুর চেঁচামেচি শুনে – কোত্থেকে বেড়িয়ে এল একটা মানুষ। এসেই সোজা বাঁশটিকে নামিয়ে ফেলল এবং একটানে বাঁশের ডগায় লাগানো আঠা থেকে মিঠুর পা ছাড়িয়ে ফেলল। প্রচন্ড কষ্ট হয়েছিল মিঠুর। এক করুন আর্তনাদ করল সে। কিন্তু লোকটার তাতে যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! সে নিজের কাজ চালিয়ে গেল। মিঠুর পা এবং ডানাগুলি একটা সুতোর মাধ্যমে বেঁধে ফেলল লোকটি। তারপর, কোনো অন্ধকার ঘরে নিয়ে গিয়ে আটকে ফেলল মিঠুকে। এমনকি, খেতেও দিল না তাকে।
সম্ভবত পরেরদিন, লোকটি মিঠুকে নতুন একটা খাঁচায় ভরে – নিয়ে গেল একটা পাখির দোকানে। রঙ-বেরঙের নানা রকম পাখি রাখা রয়েছে সেই জায়গায়। এত পাখির সমাগম যে – দেখলেই মন ভরে যায়। কিন্তু সবই খাঁচাবন্দী। খাঁচাসমেত মিঠুকে সেখানে রেখে – পরিবর্তে দোকানীর থেকে কয়েকটা কাগজের টুকরো নিয়ে বেড়িয়ে গেল লোকটা।
এরপর প্রায় একসপ্তাহ কেটে গিয়েছে। মিঠুও তারপর থেকে সেখানেই রয়ে গিয়েছে। সেখানে প্রতিদিন সে ভালো ভালো খাবার খায় বটে – কিন্তু তার বউ-এর জন্য মন কেমন করে! তাদের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হ’ল কিনা! কটা ছেলে আর কটা মেয়ে হ’ল! –এইসব ভাবতে থাকে সে।
এরই মধ্যে আরেকটা মানুষ এল সেই দোকানে, একটি বাচ্চা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। মানুষটাকে দেখে খুব গম্ভীর লোক মনে হয়! সে দোকানীকে বলল, “একটা ভালো পাখি দেখাও তো, আমার ছেলে জেদ্ ধরেছে – এ’বারের জন্মদিনে ওকে পাখি কিনেই দিতে হ’বে।”
দোকানী সোজা বাচ্চাটিকে সঙ্গে করে নিয়ে এল মিঠুর কাছে। বাচ্চাটি তো মিঠুকে দেখেই যেন আনন্দে নেচে উঠল।
দোকানী এবং বাচ্চাটির বাবার – কিছু কাগজের টুকরোর আদান প্রদান হ’ল। তারপর, খাঁচা শুদ্ধ মিঠুকে তুলে বাচ্চাটি নাচতে নাচতে নিয়ে চলল তার বাড়ীতে।
বহুদিন কেটে গিয়েছে মিঠু ওদের বাড়িতেই থাকে। এখানেও মিঠু ভালো ভালো খাবার পায়। একদিকে তার ভালোই লাগে – কষ্ট করে তাকে খাবার খুঁজতে হয় না! কিন্তু অন্যদিকে, তার বউ-বাচ্চার জন্য মন কেমন করে! তাকে খাবার দিতে আসার সময় – সে প্রতিদিন বলে, “আমাকে ছেড়ে দাও, আমি বউ-বাচ্চার সাথে দেখা করতে যাব।”
কিন্তু তাতে ওই বাড়ির লোকের কোনো হেলদোল নেই। তারা মিঠুর এই অনুরোধ অবজ্ঞায় উড়িয়ে দেয় এবং তার কথারই পুনঃ উচ্চারন করে। তারা হয়তো আনন্দ পায় এ’টা করে! কিন্তু মিঠু নিজের মনের কথা বার বার বলে যায়, “আমাকে ছেড়ে দাও, আমি বউ-বাচ্চার সাথে দেখা করতে যাব।”
এরমধ্যে হটাৎ ই একদিন মিঠু দেখলঃ ঘরের জানালার বাইরে তার বউ বসে রয়েছে। করুণ দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে তার বউ। জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে।
মিঠু সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেঃ যেমন করে হোক – আজ সে এ’খান থেকে পালাবে! তার বউ যদি তাকে খুঁজতে খুঁজতে এতদূরে তার কাছে চলে আসতে পারে। তাহলে সে কেন এক পা বাড়িয়ে তার বউএর কাছে যেতে পারবে না?!
আজ খাবার দেওয়ার সময় যেইমাত্র বাচ্চাটি খাঁচার ভিতরে হাত ঢুকিয়েছে – তেমনি মিঠু তার ধারালো ঠোঁটের এক কামড়ে বাচ্চাটির হাত ফুটো করে দিয়েছে। যন্ত্রনায় ছট্ফট্ করতে করতে বাচ্চাটি খাঁচা থেকে হাত বের করে নেয়, খাঁচার দরজা খোলা রেখেই। এই সুযোগেই মিঠু ফুড়ুত্ করে উড়ে পালিয়ে যায় তার বউএর কাছে।
একবার পিছন ঘুরে সে বলল, “আমাকে ক্ষমা কোরো…”। তারপর তারা দু’জনেই উড়ে পালিয়ে যায়, জঙ্গলের দিকে।
উড়তে উড়তে মিঠু তার বউকে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের বাচ্চারা কেমন আছে?”
মিঠুর বউ অনেকক্ষন চুপচাপ থেকে বলে, “তারা কেউ নেই।”
“নেই মানে?”
“তুমি খাবার নিয়ে আসছিলেনা দেখে – আমি খুঁজতে বেড়োই। অনেক খুঁজেও তোমাকে না পেয়ে, ফিরে এসে দেখিঃ একটা বড় সাপ আমাদের ডিমগুলো খেয়ে ফিরে যাচ্ছে।”
মিঠু যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে! তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোচ্ছে না। শুধুমাত্র দু’ফোঁটা জল বেরোল তার চোখ থেকে।
কিছুক্ষন পর, শান্ত হয়ে মিঠু তার বউকে শান্তনা দিয়ে বলল, “তুমি দুঃখ কোরো না। আমরা আবার চেষ্টা করব। আর এই মানুষ মানুষ সমাজের সীমানা থেকে অনেক অনেক দূরে – আমরা একটা নতুন সংসার বানাবো।”
সুচিন্তিত মতামত দিন