জোরে ব্রেক কশার শব্দে সচকিত হল পরমা । অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে বড়রাস্তার মোড়ে একটা ট্যাক্সির জন্য । একটার মধ্যে এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করতে হবে, দুটো পাঁচে কলকাতা-ভুবনেশ্বর ফ্লাইট । বস মিঃ দত্ত আগেই পৌঁছে গেছেন । অনেক টাকার একটা নতুন অর্ডারের ব্যাপারে পার্টিকে প্রেজেনটেশন দিতে হবে । স্যার ওকেই সিলেক্ট করেছে সঙ্গে যাবার জন্য ।
কিন্তু এই দুপুর বারোটায় কলকাতায় ট্যাক্সি পাওয়া আর লটারি পাওয়া একই ব্যাপার । এরই মধ্যে ওই বিকট শব্দ করে একটা টাটাসুমো দাঁড়িয়ে পড়ল । সবাই গেল গেল করে দৌড়ে এল, এক বয়স্ক ভদ্রলোক রাস্তা পেরোচ্ছিলেন টাটাসুমো তাঁকে ধাক্কা দিয়েছে । পরমা দৌড়ে গেল গাড়িটার সামনে । ভদ্রলোক পড়ে আছেন, মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে । সবাই দেখছে কিন্তু কি করবে কেউ বুঝে উঠতে পারছে না । কিছু লোক গাড়িটার ড্রাইভারকে নামিয়ে মারধোর করতে লাগল । ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ বলে উঠল, অ্যাক্সিডেন্ট কেস পুলিশে খবর দিতে হবে ।
পরমা দেখল ভদ্রলোক বেশি রক্তক্ষরণে কেমন নেতিয়ে পড়ছেন । এভাবে আর কিছুক্ষণ পড়ে থাকলে খারাপ একটা কিছু হয়ে যাবে । তাই আর দেরি করে না, রাস্তায় বসে পড়ে ভদ্রলোকের মাথাটা কোলে তু্লে নিয়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে ওঁনার মুখে একটু জল দেয় । তারপর নিজের ওড়না দিয়ে ভদ্রলোকের জখম মাথা বেঁধে নেয় ।
— প্লিজ, আপনারা আমাকে সাহায্য করুন, এখুনি কোন নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে হবে ওঁনাকে । পরমার গলায় আকুলতা আর উদ্বেগ ঝরে পড়ে ।
ভিড়ের মধ্যে থেকে এক অটোওলা এগিয়ে এল ।
— না দিদি, নার্সিংহোম না, পুলিশ কেস, তাই এনাকে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে । পরে থানাকে জানাতে হবে । গাড়িটার নম্বর নিয়ে নিয়েছি, এখন চলুন আমার অটোতে কাছাকাছি একটা সরকারী হাসপাতাল আছে ।
হাসপাতালের পথে যেতে যেতে আহত ভদ্রলোকের রক্তমাখা সজ্ঞাহীন মুখের দিকে তাকিয়ে পরমার নিজের বাবার কথা মনে পড়ল । বছর তিনেক আগে হঠাৎ বিনা নোটিশে চলে গেলেন । পরমা তখন কলেজে থার্ড ইয়ারে । সবে অনার্সের ক্লাস করে লাইব্রেরীতে গিয়ে বসেছে, এমন সময় মায়ের ফোন । বাবার অফিসে কাজের মধ্যে ম্যাসিভ অ্যাটাক হয়েছে । অফিস কলীগরা ওঁনাকে নিয়ে হসপিটাল গেছে । পরমা যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসে ।
বাড়ি ফিরে মাকে নিয়ে যখন হসপিটাল গেল পরমা, ততক্ষণে বাবকে আই সি ইউ-তে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে । কাঁচঘেরা ঘরের বাইরে থেকে ওরা বাবাকে দেখল । চোখদুটো বন্ধ । মুখটা কেমন ফ্যাকাসে । ডাক্তারবাবুরা বললেন, আজ রাত না গেলে কিছুই বলা যাবে না । মাকে নিয়ে পরমা হসপিটালেই ছিল । ভোর রাতের দিকে দ্বিতীয়বার অ্যাটাক হল । সে ধাক্কা বাবা আর সামলাতে পারলেন না । তাদের অসহায় করে বিদায় নিলেন ।
হাসপাতালে নিজের রিলেটিভ পরিচয় দিয়ে ফর্ম ফিলআপ করল পরমা । ডাক্তারবাবুরা ভয় নেই বলে পেশেন্টকে আই সি ইউতে ঢুকিয়ে নিল ।
অটোওলা ছেলেটির খুব উপস্থিত বুদ্ধি । একটা ব্যাঙ্কের পাশবই তার হাতে দিয়ে বলল, দিদি, ওঁনার পকেটে ছিল, বোধহয় ব্যাঙ্কে এসেছিলেন পেনশন তুলতে । এখানে ওঁনার বাড়ির ফোন নম্বর আছে, খবর দিন । কাউকে আসতে বলুন । একটু পরে তো পুলিশ আসবে খোঁজ- খবর করবে ।
ভদ্রলোকের বাড়িতে ফোন করতে গিয়ে পরমা দেখে, অফিস বস মিঃ দত্তের মিসড কল গোটা চারেক । এতক্ষণে তার খেয়াল হয়, কোথায় তার যাবার কথা । প্লেন ছাড়তে আর মাত্র পঁচিশ মিনিট । স্যারকে ফোন করে ।
—হ্যালো, স্যার—
—কি ব্যাপার পরমা, তুমি এখন কোথায়? তোমার কি কোন দায়িত্বজ্ঞান নেই? তুমি এলে না কেন?
—আসলে স্যার, আমি এখন একটা সরকারী হসপিটালে আছি ।
—হসপিটালে কেন? কি হয়েছে তোমার? বস জানতে চান ।
—পথদুর্ঘটনায় গুরুতর আহত এক বয়স্ক ভদ্রলোককে নিয়ে…
পরমার কথা শেষ হবার আগেই ও-প্রান্ত থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর ভেসে এল, তুমি জনসেবা করছ? অত টাকার অর্ডার— জানো, তোমার এই কর্তব্যে গাফিলতির জন্য আমরা তোমাকে চাকরি থেকে স্যাক করতে পারি?
— তা তো পারেন স্যার । কিন্তু কি জানেন, আমার কাছে নিজের চাকরির থেকে এই মুহূর্তে ওই মুমূর্ষু মানুষটাকে বাঁচানো বেশি প্রয়োজন । আমার বাবাকে আমি বাঁচাতে পারিনি, কিন্তু এই ভদ্রলোকের জীবন আমি বাঁচাবই । চাকরি গেলে আবার পাবো স্যার, কিন্তু এখন এঁনার জীবনদান আমার কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ।
ফোন কেটে দিয়ে পরমা এবার জোরে একটা শ্বাস নেয়। তাকে দুটো ফোন করতে হবে। একটা ওই ভদ্রলোকের বাড়িতে আর অন্যটি মাকে ।
সুচিন্তিত মতামত দিন