রাহুল ঘোষ

বিজন সরণির দিকে
।।ষষ্ঠ পর্ব।।

'নিঃসঙ্গতাই ব্যর্থতা নয় ---
প্রচলিত সামাজিক প্রাণী জেনে রাখো
একা থাকা মানে অন্ধ পরাজয় নয়,
পরাজয় ভিন্ন কিছু।'
--- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

ডাইনিং স্পেসে একটা টেবিল আছে। মাঝেমাঝে ওটাই রাইটিং টেবিল হয়ে যায়। সেখানে বসেই দিনলিপির পরের পাতায় লিখছে রোহিত। এক অন্তহীন স্বরলিপি যেন, সুর লাগুক আর না-লাগুক, লিখে যেতে হয় সময়ের নিয়মে! রোহিত এখন একা। তার জীবনের বেশিটাই একাই কাটে। কিন্তু সেটা অনেকদিন আর তেমন কোনো বড়ো কথা মনে হতো না তার। সেই কবে তো শক্তি চাটুজ্জে লিখে গেছেন, 'সকলে প্রত্যেকে একা'! কেউ স্বীকার করে, কেউ করে না। আসলে কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না। এই যেমন সেদিন শুক্লার সঙ্গে রাস্তায় হঠাৎ দেখা। কলেজের ক্লাসমেট। একথা-সেকথায় লোনলিনেস নিয়েও কথা উঠলো। শুক্লা বললো, 'তোর তো স্বাভাবিক, রোহিত। আমারই হয় ভয়ানক! অথচ আমার তো হওয়ার কথা না!' থার্ড ইয়ারে থাকতেই নিজের পছন্দে বিয়ে শুক্লার। জমজমাট নেমন্তন্ন খেয়েছিল রোহিতরা। এখন স্বামী-পুত্র নিয়ে যাকে বলে, ছন্দময় সংসার শুক্লার। কোনোদিকে কোনো অভাব নেই। ভরাট। ওরও কেন একলা লাগে তবে!

একা হওয়াটা আসলে বিরাট কোনো অঘটন নয়। বরং একা হওয়াটাই নিয়ম হয়তো! মাঝেমাঝে মনে হয়, যে একা হয়ে যাচ্ছে আর যে একা করে দিচ্ছে, তাদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই! আসলে পৃথিবীটাই ভালো নেই আর! তবু মানুষ একা হতে ভীষণ ভয় পায় কেন! এই যে রোহিত, সে কেবল কোনোভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে একা থাকতে ভয় পেতো। কারণ, অন্যান্য সময়ের জন্য তার নিজস্ব সারভাইভ্যাল স্ট্র্যাটেজি ছিল। যেমন, যেদিন সে খুব মনমরা থাকে, সেদিন সে স্বভাববিরুদ্ধ প্রগলভ আর বাচাল হয়ে ওঠে! রাস্তায় অল্পচেনা লোকের সঙ্গে ডেকে ডেকে কথা বলে। মেট্রোতে অচেনা সহযাত্রীর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়। অফিসেও কলিগদের সঙ্গে একটু বেশি আদিরসাত্মক ঠাট্টা-তামাশা। যেদিন সে মুষড়ে পড়ে, সেদিনই তার ফেভারিট খাবারগুলো খাওয়া চাই! আরসালানে যাওয়া হয়তো হয় না, তবে বাড়ির কাছের হাজি বা আজাদের বিরিয়ানি তো আনতেই হবে সেদিনের জন্য! অথবা গোলবাড়ির মাটন কষা। মনে করতেই মন হালকা হতে থাকে অদ্ভুতভাবে! আসলে টোটকার মতো কাজ দিত এগুলো। ইদানীং আর কাজ হয় না এসবে। এতদিনে রোহিত নিজের অবস্থা ও অবস্থান জানে। মৃন্ময়ীর চারপাশের পরিবেশ ও পরিস্থিতি জানে। তবু এই আশ্চর্য মেয়েটি আসার দিন থেকে আজ পর্যন্ত একইভাবে সে শুধুই ডুবতে থাকা নৌকোর সাঁতার না-জানা যাত্রীর মতো আঁকড়ে ধরতে চায় কেন তাকে! এর কোনো উত্তর হয় না!

যেমন উত্তর হয় না এরকমই একটি একলা রাতে অচেনা ফোন নম্বর থেকে অচেনা পুরুষকন্ঠ যখন আচমকা মৃন্ময়ীর জীবন থেকে তাকে সরে যেতে বলে, সে-কথার। কারণ, কোনো প্রশ্নই ওঠে না সরে যাওয়ার। তবু রোহিত উত্তর দেয়। দেয়, কারণ তার কাছে শব্দগুলি হুমকির মতো স্পষ্ট হয়। এই এক মুশকিল যে, কেউ ধমক-চমক দিলে রোহিতের ভয় নয়, হাসি পায় বিস্তর! কলেজে থাকতে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ইলেকশনের সময় তাকে কেউ একবার কালো নলওয়ালা একটা ছোট্ট যন্ত্র দেখিয়ে চমকাতে এসেছিল। ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে রোহিত তার গালে সপাটে একটা চড় মেরে বলেছিল, 'শুয়োরের বাচ্চা'! আজও ফোনের ওপারের ওই বরাহনন্দনটিকে ঠাসিয়ে একটা থাপ্পড় কষাতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব! কিন্তু ভালোবাসার মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে কাউকেই ভার্চুয়ালি আদর বা আঘাত, কোনোটাই করা যায় না! অতএব যতদূর সম্ভব ভাবলেশহীন থাকে সে। তাছাড়া, যে-কন্ঠ সাবধান করে দেওয়ার সময় নিজের পরিচয় দিতেই ভয় পায়, তাকে আর কতটা গুরুত্ব দেওয়া যায়!

তবু গুরুত্ব দিতে হয়, কারণ এর সঙ্গে মৃন্ময়ী জড়িয়ে আছে। তাকে না-জানানোর শর্ত দিয়েছিল অচেনা কন্ঠ। তারপরে সে বা তারা নাকি দেখে নেবে, কীভাবে মেয়েটি যোগাযোগ বজায় রাখতে পারে! শর্ত মেনেই লড়তে রাজি হয়েছিল রোহিত। এ-লড়াই তাকে একাই লড়তে হবে। কারণ সে দেখতে পাচ্ছিল, কীভাবে অভিমন্যুর মতো ক্রমশ চক্রব্যূহে বন্দি হয়ে যাচ্ছিল মৃন্ময়ী। কীভাবে তার চারপাশের একটার পর একটা দরজা ও জানালা বন্ধ করে দিচ্ছিল এক ও একাধিক যৌথ প্রকল্পের চরিত্ররা। তবু যে তাকে মাঝেমাঝে বলতে ইচ্ছে হয়নি, তা নয়। কিন্তু ওই যে শর্ত! অন্তরালবর্তী ঘটনা বলে দিয়ে কোনোরকম অ্যাডভান্টেজ নেওয়া চলবে না। তাহলে নাকি বিপদই বাড়বে মেয়েটির! অতএব রোহিত চুপই থাকে, আবার একদম চুপ থাকতেও পারে না! কথা অথবা টুকরো লেখার ফাঁকে ইঙ্গিত রাখে, যেন বলতে চায়, 'এবার তো বুঝে যাও, বন্যা!' কিন্তু ফল হয় উল্টো। তার বন্যা ওরফে মৃন্ময়ী ক্রমশ অবিশ্বাসী ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে তার উপর!

একটা রূপকথাতেও কালো সময় আসে এভাবে, যখন আর কিছুই আগের মতো থাকে না! তখন তুমি অনায়াসে লিখতে পারো, 'এত অভিযোগ নিয়ে থাকতে কে বলে! আমি কি বলেছি থাকতে? কাউকেই জোর করি না...' ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো আগুনের মতো পুড়িয়ে দিতে থাকে আমার চোখ, আর মনে হয় এই তুমিই কি সে, যে একদিন লিখতো, 'আমি একদম ভাঙাচোরা একটা মানুষ, আর নিতে পারবো না গো! কখনও যেন ছেড়ো না আমায়!' অথবা ধরো এই সেদিনও তো, বিসর্জনের আড়ালে বোধনের পরে ঠিক আমাদের আগের মতো দুটো দিনের মধ্যেই 'আমার জীবন জটিলতায় ভরা। কিন্তু যাই হোক, তুমি থেকো, কখনও ছেড়ে যেয়ো না!' এসব কথা তো তোমার মুখেই উচ্চারিত হতে শুনলাম! সেই তুমিই যখন অম্লানবদনে লিখতে পারো, 'থাকতে কে বলে', তখন স্তম্ভিত হতেও ভুলে যাই মাঝেমাঝে। ভাবতে ভুলে যাই, আমার কি আর থাকা ও না-থাকার মধ্যে ফারাক আছে কিছু! তোমার আশপাশে ঠিক কোথায় আছি আমি! মনে হয় তোমাকে ডেকে বলি, 'একে তুমি থাকা বলো, বন্যা!'

Previous Post Next Post