পূজা মৈত্র

পূজা মৈত্র
(পর্ব-১০)

শিঞ্জিনীকে হয়তো এড়ানো গেল না। কাল আর্চিকে নিয়ে বাড়ি ফিরেই দেখে নিখিলেশ-শিঞ্জিনী ওদের বাড়িতেই আছে। আর্চি তো মিসকে দেখেই খুব খুশি। মিস,মিস করে অস্থির। ওকে নিজে হাতে খাইয়ে,নিখিলেশকে খেতে দিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছে। নিঃশব্দে। কিছু বলেনি। কোনও অভিযোগ করেনি। ওকে অকারণে আঘাত করতে পারেনি নিখিলেশ। অকারণে কাউকে কষ্ট দেওয়া যায়? নাকি দেওয়াটা ঠিক? তবে ও এভাবে আসতে থাকলে পাড়ায় কথা রটবে। ওর মা চড়াও হবে। জল অনেক দূর গড়াবে। শিঞ্জিনী যদি সেদিন রাতের কথা বলে দেয় ওর মাকে? তাহলে তো ঐ মহিলা ছাড়বে না। পাড়া প্রতিবেশী লোকজন জুটিয়ে মস্ত সিনক্রিয়েট করবে। না,না-এখন এসব কিছু চায় না নিখিলেশ। যখন ওর কেরিয়ার উড়ান নিতে শুরু করছে-তখন যদি এসব স্ক্যান্ডাল রটে...না। ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটাকে সামলাতে হবে। শিঞ্জিনীর সাথে দুর্ব্যবহার করা চলবে না। আজকাল মিডিয়া খুব সক্রিয়। ‘বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস করে ধৃত কবি নিখিলেশ ব্যানার্জী’-এইরকম কোনখবর পেয়ে গেলে ওদের পোয়াবারো। উচ্ছ্বাস তো ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওদের পত্রিকা,চ্যানেল সব রয়েছে। ইন্দ্রনীল বসু ছাড়বে না ওকে। তার থেকে এখন চেপে থাকা ভালো। বইমেলাটা যাক,কিন্তু তারপর? বইটা খুব ভালো চললে কলকাতায় শিফট করে যাবে ভেবে রেখেছে নিখিলেশ। এখনকার পরিস্থিতিতে চলে গেলে শিঞ্জিনী ভাববে ওকে ধাপ্পা দিয়ে নিখিলেশ পালিয়ে গেল। নাহ! একটা ভুলে জীবনটা জটিল হয়ে গেল। না হলে বেশ তো ছিল লেখালিখি আর আর্চিকে নিয়ে।

       ফোনটা বেজে উঠল। স্কুলে এসেছে নিখিলেশ। আর্চি এতক্ষণে স্কুল থেকে ফিরে এসেছে। শিঞ্জিনী নিশ্চয় ওর কাছেই আছে। ফোনটা দেখল নিখিলেশ। শিঞ্জিনীই ফোন করেছে।
-হ্যালো।
-হ্যালো। বলছিলাম কি,আর্চির খুব জ্বর। খুব কাঁপছে।
-সে কি? কি করে হল?
-ঠাণ্ডা লেগে গেছে। খুব ঠাণ্ডা লেগে গেছে। কাল রাতে বাড়ি ফেরার সময় বাইকেই মনে হয় ঠাণ্ডা হাওয়া লেগে...
-ওঃ! ঠিক আছে। চাপাচুপি দাও। আমি আসছি। ডাক্তার নিয়ে আসছি।
-আচ্ছা। তাড়াতাড়ি আসুন।
ডাক্তার দেখে বলে গেলেন ভয়ের কারণ নেই। অথচ বেদম জ্বর। মেপে দেখা গেল একশো চার। কাশছে। বেহুঁশ প্রায়। জ্বরের ঘোরে ভুল বকছে। সারাক্ষণ এককথা। “মামমাম যাবো।” “মামমাম এসো।” শিঞ্জিনী জলপটি দিচ্ছিল। নিখিলেশের অস্থির অস্থির লাগছিল। বারবার ঘর বার করছিল। সিগারেট ধরাচ্ছিল ঘন ঘন। “কমল?” মিনিটে মিনিটে এসে খবর নিচ্ছিল ও। প্রতিবারই শিঞ্জিনী বলছিল, “একটু।” অসহায় লাগছিল নিখিলেশের। ওর জন্যই ছেলেটা এত কষ্ট পাচ্ছে। ঠাণ্ডার ধাত জেনেও কেন অত জোরে বাইক চালাল! যদি কিছু হয়ে যায় কি হবে? সৌগতদাকে ফোন করেছে নিখিলেশ। হাসপাতালে নিয়ে যাবে কি না ভাবছে। যতবার আর্চির ঘরে যাচ্ছে ততবারই জড়ানো গলায় একই প্রলাপ শুনছে, “মামমাম,মামমাম...” পাগল ছেলেটা এটা বোঝে না যে ওর মামমামের কানে ওর কাতর মিনতি পৌঁছবে না। সে তো উপরে,অনেকটা উপরে বসে আছে। তার রিন্টুর খোঁজ নেওয়ার সময়ই নেই তার। কোনকালে খোঁজ নিয়েছে। ছয়মাসের ছেলেকে ফেলে চলে গিয়েছিল। তখনও ছেলেটার ব্রেস্ট ফিডিং-এর প্রয়োজন ফুরায়নি। দুধের বদলে ফুড দিতে বাধ্য হয়েছে নিখিলেশ। ছেলেটার ইমিউনিটি সিস্টেমটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাই। ঘনঘন ঠাণ্ডা লাগে,তার ঠাণ্ডা লাগলেই জ্বর। জ্বর মানেই এমন জ্বর। রাতের পর রাত জাগতে হয় নিখিলেশকে। বার তিনেক নার্সিংহোমেও দিতে হয়েছিল। ওখানে সব বাচ্চাই মা সমেত ভর্তি হয় আর আর্চি থাকত সিস্টারদের জিম্মায়। কিছু করেনি গৈরিকা। মা হওয়ার কোন কর্তব্যই পালন করেনি। জন্মটাই দিয়েছে শুধু। ওর ছেলে তাও মামমামকে ভুল বোঝেনা,খুব ভালোবাসে। এত কষ্টের মধ্যেও ‘বাবা’ নয় ‘মামমাম’ বেরোচ্ছে ওর মুখ দিয়ে। এখানেও হেরে গেল নিখিলেশ। গৈরিকা না থেকেও হারিয়ে দিল ওকে। তবে এই লড়াই-এ জিততে চায় ও,আর্চিকে কোন মতেই হারাতে পারবে না নিখিলেশ। আর্চির চোখে ওর থেকে গৈরিকা বেশি প্রয়োজনীয়-এটাও মেনে নিতে পারবে না কখনো।

-কি রে নিখিলেশ,আবারো ব্যাটার জ্বর?
সৌগতদা হন্তদন্ত হয়ে চলে এসেছিল।
-আরে দ্যাখো না। ঠাণ্ডা লেগে গেছে।
-যাবেই তো। কালকেই তো দেখলাম বাইক নিয়ে উড়ে যাচ্ছিস। ঐটুকু বাচ্চাকে বসিয়ে কেউ এভাবে বাইক টানে?
-আরে রাত হয়ে গিয়েছিল ফিরতে ফিরতে। এমনিতেই ঠাণ্ডার ধাত,ঐ ভেবেই আমি...
-তুমি একটা আস্ত গান্ডু! শালা,এবার ঠ্যালা সামলা!
-সামলাতে পারব না বলেই তো তোমাকে ডাকলাম।
-ডাক্তার কি বললেন?
-চিন্তার কোন কারণ নেই,ঠিক হয়ে যাবে-যা বলে থাকেন আর কি।
-বাড়িতেই রাখ। নার্সিংহোমে টানাটানির দরকার নেই। দাঁড়া আমি গিয়ে দেখি।

সৌগতদা আর্চির ঘরে ঢুকে পড়লেন। রাত সাড়ে নটা বাজে,শিঞ্জিনী আর্চির শিয়রে ঠায় বসে আছে। জলপটি দেওয়া,ওষুধ খাওয়ানো,বাথরুমে নিয়ে যাওয়া,ঘুম পাড়ানো-সব আব্দার হাসিমুখে রাখছে। নিখিলেশ ঘণ্টাখানেক আগে একবার বলে ফেলেছিল, “রাত হল। বাড়ি চলে যাও।” এমন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল শিঞ্জিনী যে নিখিলেশ আর কথা বাড়াবার সাহস পায়নি। শিঞ্জিনী আর্চিকে কেয়ার করে,ভালোবাসে,ওর আচরণেই স্পষ্ট বোঝা যায়। শিঞ্জিনী না থাকলে আর্চিকে একহাতে মানুষ করতে পারত না নিখিলেশ। এই সরলসত্যটা মুখে না বললেও মন থেকে মানতেই হয়। আসলে এক জন পুরুষের পক্ষে একহাতে একটা বাচ্চা মানুষ করা কঠিনই নয়,অসম্ভব। নিখিলেশ আর্চিকে সুরক্ষা দিতে পারে,আশ্রয় দিতে পারে,ওর সব প্রয়োজনীয়তা অর্থ দিয়ে পূরণ করতে পারে কিন্তু মায়ের মমতা উষ্ণতা দেবে কি করে? শিঞ্জিনী আর্চিকে যেভাবে স্নেহ করে,আগলে রাখে,পড়ায়,খেলায়-ওর সবটুকু চাহিদা মুখে না বলতেও বুঝে যায়-আর্চি মায়ের অভাব বোঝার কথা নয়। অথচ শিঞ্জিনীকে আর্চি মিসের জায়গাতেই রেখে দিয়েছে। প্রত্যেক শনিবার মামমামের কাছে গিয়ে এর ছিটেফোঁটা যত্ন,মমতা,উষ্ণতা পায় না-তবুও বাবার সাথে প্রত্যেক শনিবার মামমামের কাছে যায় আর্চি। মামমামের স্নেহের খিদে ওর দুচোখে লেগে থাকে। এক আধদিন যাবে না বললেও,একটু লোভ দেখালেই চলে যায়। স্বপ্ন ভেঙ্গে ফেরার সময় গুম হয়ে বসে থাকে ছেলেটা রাতে বাবার কাছে শুয়ে অবুঝ প্রশ্ন করে মামমাম কেন সারাক্ষণ নীল আঙ্কলের সাথেই গল্প করল,ওকে কাছেই নিল না-তাহলে কি মামমাম ওকে ভালোবাসে না? এই প্রশ্নটা যে নিখিলেশের মনে নেই তা নয়। তবুও নিজের মনকে বোঝায়-একজন মা নিশ্চয় এত পাষাণ হতে পারে না যে নিজের অংশকে ভালবাসবে না। নিশ্চয় ভালোবাসে। কিন্তু গৈরিকার আবেগের প্রকাশ বরাবরই কম। লেখায় যত আবেগ ঢালতে পারে,ব্যক্তিগত জীবনে তার দশ শতাংশ আবেগও দেখায় না। রাগ হলে ঘরে বন্দী করে নেয় নিজেকে,ঝগড়া করে না। ভালোবাসার কথাও নিজে থেকে বলে না,বলাতে হয়। সেই স্বরে নারীসুলভ ন্যাকামোর লেশমাত্র থাকে না। খুব কেজো গলায় বলে কথাগুলো। সাধারণ কথাগুলো যেমনভাবে যেমন সুরে বলে, ঠিক তেমন সুরেই ভালোবাসার কথাও বলে। মাঝেমাঝে গৈরিকাকে শুষ্ক মনে হয়-মরুভূমির মত। কোথাও যেন কোনও আদ্রতা নেই। ওর কাঠিন্যের বলয় টপকে ভেতরে ঢুকলে তবেই বোঝা যায় এই নারীরও মন আছে,শরীর আছে,চাওয়া আছে,পাওয়া আছে,আগুন আছে। ক্ষমতা দেখানোর ক্ষেত্রেও ঠিক এমনি কার্পণ্য করে নিশ্চয়। মনে মনে ওর রিন্টুকে ভালো বাসলেও হামলে পড়ে সোহাগ করা,কোলে তুলে নাচানো-এসব ওর ধাতে নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবেগ প্রকাশ প্রয়োজন,খুব প্রয়োজন। না হলে সবাই তো নিখিলেশ নয়,ভুল বুঝতেই পারে। অধৈর্য হতে পারে,রাগ করতে পারে,অভিমান করতে পারে-দূরে ঠেলে দিতে পারে। এই যে এইবার আর্চি গেলে কাছে গিয়ে শুয়েছে,গল্প বলেছে,নিজে হাতে খাইয়েছে-তাতেই বেজায় খুশি ছেলেটা। রাজ্য জয় করে ফেলেছে যেন-এমন হাসি ওর চোখেমুখে লেগেছিল। এইটুকুই তো গৈরিকা-এইটুকুই করতে পারো। তার বেশি তো কিছু চায় না আর্চি,চরম অনাদরে যাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে-কি আশ্চর্য,তুমি জানতেও পারছ না,আজ শরীরের প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যেও সে তোমাকেই চাইছে। একে কি বলা যায় গৈরিকা? নাড়ির টান? না হলে জ্বরের ঘোরে আর্চি তো আমাকেই ডাকত,কিংবা শিঞ্জিনীকে। যে মা না হয়েও মায়ের মত ওকে ঘিরে রেখেছে সর্বক্ষণ। অথচ তোমার অবুঝ পাঁচবছরের অবোধ ছেলেটা তোমাকে চায়,তোমাকেই চায়। নিখিলেশের চোখ সজল হয়ে ওঠে। চশমা খুলে চোখে মোছে ও।


-কেমন দেখলে?
সৌগতদা ঘর থেকে বেরোতেই প্রশ্ন করল নিখিলেশ
-জ্বর কমেছে কিছুটা। তুই বাইরে দাঁড়িয়ে কি করছিস? ঘরে যা।
-আর্চি কষ্ট পাচ্ছে সৌগতদা। আমার দেখতে কষ্ট হবে...
-ন্যাকামো থামা। তোর এই স্বভাবটা বড্ড ইরিটেটিং। কোন বিপদ হল কি না হল,অমনি মন খারাপ করে,কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে বসে থাকিস। হাল ছেড়ে দিস। আরে মাকড়া,তোর হারাবার কি আর কিছু বাকি আছে? পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শেখ। আর্চির কাছে যা।
-হারাবার কিছু নেই বললে কি করে? আর্চির,কথা ভুলে গেলে? ও তো আমার সব।
-তা নিজের সবটাকে নিজের হাতে আগলে রাখ। ঐ মেয়েটার হাতে ছেড়ে রেখেছিস কেন? কে হয় ও তোর? রাত বাজে দশটা,ও এখানে বসে থাকলে পাড়ায় কি কেচ্ছা হবে বুঝতে পারছিস?
-কি করব বলো? আর্চির মিস। ওকে ভালোবাসে। চলে যেতে বলা যায় না এভাবে।
-ঝার থেকে বাঁশ যেচে পিছনে ডেকে আনছিস। আন। সামলাতে পরে আমাকে ডাকবি। তোর সাথে মেয়েটার কোন কেলো আছে,নাকি?
অন্যদিকে তাকাল নিখিলেশ। মিথ্যে ও বলে না। সৌগতদা তো খুব কাছের মানুষ। বাবা চলে যাওয়ার পর নিখিলেশকে একমাত্র উনিই আগলে রেখেছেন।
-অঃ কেলো করে ফেলেছ? বাঃ! বেশ ত। ব্যাপারটা এভাবেই চলবে নাকি সিঁদুর টিদুর দিয়ে সালটে নিবি?
-ওরকম কিছু নয়।
-তাহলে কিরকম? আর্চিকে বিনা পয়সায় মেয়েটার ঘাড় দিয়ে মানুষ করিয়ে নিবি হারামজাদা?
-আমি জানি না। কি করব আমি সত্যিই জানি না। খুব কনফিউসড আমি। ঘেঁটে আছি। আমি মন থেকে তো গৈরিকার বাইরে কখনো কাউকে...
-আবার ঐ খা...
-প্লিজ সৌগতদা। গালাগালি দিও না।
গৈরিকার নামে কেউ কিছু বললে এখনো কষ্ট হয় নিখিলেশের
-ঠিক আছে। কিন্তু ও তোর সাথে যা করেছে গায়ে মানুষের চামড়া থাকলে জীবনে ওর নাম মুখে আনতিস না।
-আমার সাথে খারাপ করেনি। নিজের সাথে ভালো করেছে মাত্র।
কষ্টের হাসি হাসল নিখিলেশ।
-আমি তো আর মিডিয়া ব্যারনের একমাত্র ছেলে নই সৌগতদা। হলে আমার কাছেই থাকত।
-তাহলে ভালবেসে বিয়ে করেছিল যে? বিয়ের পর,একটা বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর কি করে ছেড়ে যেতে পারে কে জানে? উপরে ওঠাটা জরুরী জানি। একদিন না একদিন তো উঠতই। এভাবে কাউকে মই করে উঠতে হবে? ভালো হবে না,ওর ভালো হবে না। মইটা একদিন কেড়ে নেবে উচ্ছ্বাস-দেখিস।
-আমি কখনোই তা চাইব না। আমি চাইব ও যেন সবসময় উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো সাহিত্যের আকাশে জ্বলতে থাকে। সফল ও। সফলই থাকুক। সাফল্য ওকে মানায়,আমাকে নয়।
-মোটেও না। তোকেও সফল হতে হবে। ঐখানেই যেতে হবে। চুড়ায়। তোর বইটা খুব সফল হবে দেখিস।
-অত আশা করি না। অখ্যাত হয়েই না হয় চলে যাব একদিন। পাণ্ডুলিপি রেখে যাব। মরেও তো অনেকেই বিখ্যাত হয়েছেন। জীবনানন্দ,সুকান্ত......
-মরে নয়। বেঁচে থাকতেই হবি।
-আমার শরীরের অবস্থা তো জানোই। রোগাভোগা মানুষ। একটু হাঁটলেই এখন হাঁফ লাগে,চিন্তা করলেই বুক ধড়ফড় করে,যা খাই কিছু পেটে সয় না...
-আবার তোর অসুখের বাতিক চেপে ধরেছে?
-বাতিক নয়,বাতিক নয়...
-বাতিক নয় তো কি? অভ্যাস। অসুখ তোর অভ্যাস। বিষাদ তোর অভ্যাস। ব্যর্থতা তোর অভ্যাস এগুলোকে ঝেড়ে ফেল,সফল হ। নাহলে জবাব দিবি কি করে?
-জবাব আমি কাউকেই দিতে চাই না। কারোর সাথে কোন যুদ্ধ নেই আমার। যাক গে,আর্চি ঘুমোচ্ছে?
-ঘোরে আছে। থেকে থেকেই গৈরিকার নাম করছে। ছেলেকে তো নেড়েই দেখে না,তাও ছেলে ওকেই চাইছে?
-মায়ের বিকল্প কেউ হতে পারে না। মা-তো মা-ই হয়। সৌগতদা কিছু বললেন না। নিখিলেশের কাঁধে হাত রাখলেন। সত্যিটাকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না।  

(পর্ব-১১)

দেশভাগের উপর যে উপন্যাসটা লিখছে তা প্রায় শেষ করে ফেলেছে গৈরিকা। উচ্ছ্বাস যখন এই উপন্যাসে আগ্রহী নয়,তখন প্রতিবিম্বকেই দিয়ে দেবে। খুব যত্ন করে উপন্যাসটা লিখেছে,তাড়াহুড়া করে নি। ছয়মাস ধরে সময় নিয়ে লিখেছে। এর জন্য কলেজ থেকে ফেরার পথে ন্যাশনাল লাইব্রেরী গেছে দিনের পর দিন। দুষ্প্রাপ্য সব বই মন্থন করে তুলে এনেছে অনেক অজানা তথ্য,যা নিয়ে কখনো কিছু বলা হয়নি। দেশভাগ নিয়ে অনেক উপন্যাস হয়েছে। তাতে বাস্তুভিটে থেকে বিচ্যুত হওয়ার যন্ত্রণা,সহায়,সম্বল,আশ্রয়,প্রতিপত্তি,সম্মান এক লহমায় হারিয়ে উদ্বাস্তু ক্যাম্পে পশুর মতো ভিক্ষার জীবনযাপনের যন্ত্রণা-এসব নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। গৈরিকা ঐ সব নিয়ে লিখতে চায় না। দেশভাগ মেয়েদের জীবনকে কি করে কতটা ছুঁয়ে গেছে-এই নিয়ে অনেক না বলা কথা আছে। ঐ না বলা কথাগুলোই এই উপন্যাসে লিখেছে। গদ্যটা শুধু লেখেই না ও। যাপন করে। লিখতে লিখতে চোখের সামনে পরের পর ঘটনাবলী ছবির মত ভেসে আসতে থাকে। সাজাতে হয় না কিছুই। কষ্ট করতে হয় না। আপনাআপনিই চরিত্ররা জন্মে যায়। গৈরিকার মনে হয় এ সমস্ত ঘটনাই বাস্তবে ঘটছে আর সবচেয়ে কাছের দর্শকাসনে বসে ও সমস্ত কিছু দেখছে। চরিত্রগুলোর সাথে আবেগের সম্পর্ক হয়ে যায় ওর। ওদের ভালো হলে ভালো লাগে,কষ্ট হলে মনখারাপ হয়। লিখতে লিখতে চোখে জল চলে আসে ওর। কি অদ্ভুত! ব্যক্তিগত জীবনের অনেক ঘাতপ্রতিঘাতেই ওর চোখ শুকনো ছিল,ভেজেনি,লাল হয় নি। ব্যক্তিগত জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই যা চায়, মুখ ফুটে বলতে পারেনি। খুব কষ্ট পেলে একলা ঘরে অন্ধকারে বসে কেঁদেছে। অথচ লিখতে লিখতে লেখার টেবিলে বসেই চোখ দিয়ে জল ঝরে ওর। নীল কয়েকবার লক্ষ্য করেছে। “কি হল,কাঁদছ কেন?” চোখ মুছেছে গৈরিকা। “নিশ্চয় কোন কষ্টের জায়গা লিখছ। গেট ওভার ইট বেবি। ইমোশনালি এভাবে চরিত্রদের সাথে অ্যাটাচড্‌ হয়ো না। এভাবে অ্যাটাচড্‌ হলে স্ট্রেস পড়বে,শরীরে,মনে। বি প্রফেশনাল। এটা তোমার পেশা।” “চেষ্টা করেও যে লেখাটাকে পেশা ভাবতে পারি না। এটা আমার যাপন। লিখতে না পারলে,পাগল পাগল মনে হয় নিজেকে। মনে হয় শ্বাস নিচ্ছি,কিন্তু বেঁচে নেই।” “লিখতে যদি না পারো কখনো?” “মরে যাব।” নীল অবাক হয়েছিল। ও অবাক হলেও কথাটা সত্যি। লেখার জন্য সব কিছু করতে পারে গৈরিকা।


সুহার্তর সাথে দেখা হয়েছিল আজ। কলেজ থেকে ফেরার পথে যতীন দাস পার্ক মেট্রোয় উঠেই সুহার্তকে দেখেছিল। আগেও দু-একটা অনুষ্ঠানে দেখেছে। দূর থেকে। কথা হয়নি। সামনাসামনি আজই প্রথম কথা হল। সুহার্তকে দেখে মনে হচ্ছিল ও আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে যেন,বেজায় খুশি। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল। এটা ওটা সেটা যা মনে আসছিল বকে চলেছিল। মেট্রো থেকে নামার পর জোর করে গৈরিকাকে ফুচকা খাওয়াল ও। বহুদিন পর খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খেল ওরা। একটা সমাপতনের কথা মনে পড়ে গেল। নিখিলেশের সাথে প্রথমবার ডেটে বেরিয়ে ফুচকা খেয়েছিল দুজনে। সেই কথা শুনে সুহার্ত একগাল হাসি হাসল, “ধরে নাও এটাও একটা ডেট।” “তাই?” “তা না তো কি? তবে নিখিলেশদার মত লাক আমার হবে কি?” “লাক কিসের?” “এমা! তোমাকে বিয়ে করতে পেরেছে,তোমার সাথে একছাদের তলায় দিন কাটাতে পেরেছে...” ‘নিখিলেশকে জিজ্ঞাসা করে দেখো,এটাকে সৌভাগ্য মানে না দুর্ভাগ্য?” “নিখিলেশদা তোমায় খুব ভালোবাসে গো,কাল আমি তোমার নাম ধরে নিয়েছে,বলে কিনা তোর থেকে আট বছরের বড়,দিদি হয়।” গৈরিকা অবাক হয়েছিল। নিখিলেশ এখনো ওর ব্যাপারে একটু হলেও পজেসিভ? কিন্তু ওতো...” এই কি হল? আবার মন খারাপ? ওসব সেন্টিভাব তোমায় মানায় না। যা করেছ,করেই ফেলেছ। ও নিয়ে ভেবে কি হবে? ফালতু মাথা ব্যথা বাড়বে। গৈরিকা,তুমি এত লেখ কি করে বলো তো?” “লিখি না,এসে যায়।” “তা বলে এত? তোমার খুরে নমস্কার। ঘাড় গুঁজে লেখ,বলো? মাকালটা তোমাকে ভাঙ্গিয়ে ভালোই খাচ্ছে। বেড়াতে-টেরাতে যাও,নাকি?” “খুব একটা যাওয়া হয় না।” “কেন,তোমার নীল নিয়ে যায় না?” “সময় কোথায় ওর?” “নিজে তো দেশ দুনিয়া চড়ে বেড়ায়,ছাড়ো,বেড়াতে যাবে,বলো?” “কোথায়? কার সাথে?” “কার সাথে আবার,আমার সাথে। আমাদের ডুয়ার্স অনেক গুলো রিসর্ট আছে। ফ্যামিলি বিজনেস। কখনো যদি মনে কর,আর পারছ না,ব্রেক দরকার-আমাকে বলবে। ওখানে গেলে তোমার সব রোগ সেরে যাবে।” “তোমার বেশ সাহস আছে দেখছি।” সুহার্ত বুঝেও বোঝেনি, “সাহসের কি আছে? ও,বাঘ হাতি গণ্ডার...ও সবের ভয় করো না। রিসর্ট একদম সুরক্ষিত।” “আমি তোমার সাথে যাবো,ভাবলে কি করে?” “বাঃ রে! মানুষ বুঝি বন্ধুর সাথে কোথাও যেতে পারে না? আর যাওয়াটা তোমার জন্য জরুরী। এত কাজের চাপ,টেনশন,স্ট্রেস...ফ্রেশ হয়ে যাবে।” “আচ্ছা,ভেবে দেখব। এখন তাড়া আছে। চলি?” পার্স খুলে ফুচকার দাম দিতে যায় গৈরিকা “কি করছ? একদম নয়। আমি দেব।” “ছোটরা কখনো দাম দেয় না। বড়রাই দেয়।” “ভারি আমার বড়! তোমাকে ডেটে নিয়ে এসেছি,আই অ্যাম দ্যা ম্যান-আমি দেব। লক্ষ্মী মেয়ের মত টাকা পার্সে রাখো।” দামটা সুহার্তই দিয়েছিল। ওকে ‘বাই’ বলে অটো ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে গৈরিকার মনে হয়েছিল ওর চোখ দুটো গৈরিকাকে দেখলেই উজ্জ্বল হয়ে যায়। ঠিক যেমন নিখিলেশের চোখ হত একসময়। এখন সেই “উজ্জ্বলতার জায়গায় স্থায়ী বিষাদ জমে রয়েছে। অথচ নীলের চোখে এই স্পার্ক কখনো দেখেনি ও,কেন?

         সারাটা বিকাল সন্ধ্যা লিখে উপন্যাসটা শেষ করল গৈরিকা। উফ! একটা বড় চাপ নামল মাথা থেকে। বেশ কয়েকদিন কিছু লেখা যাবে না। রেশ থেকে যাবে। ঘোর থেকে যাবে। উপন্যাস লেখার পর একটা হ্যাংওভার হয়। চরিত্রগুলো মাথায় ভিড় করে থাকে। গল্পটা শেষ হয়েও শেষ হয় না। চলতেই থাকে। এইসময় কয়েকটা দিন বেড়িয়ে আসতে পারলে হত। তার জো নেই। সামনে বইমেলা। নীলের দম ফেলার ফুরসৎ নেই। তাছাড়া আঙ্কল অন্য একটা উপন্যাস না নিয়ে ছাড়বেন না। যে কোন উপন্যাস হলে হত। দিন পনেরোয় ঝামেলা মিটিয়ে দিত। অথচ এমন একটা উপন্যাস দাবি করে বসে আছেন,যেটা দিতে অপারগ গৈরিকা। নীল কাল অনেক যুক্তি দিল,অনেক করে বোঝাল-হয়তো ওদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ওরা ঠিক-কিন্তু লেখায় কোনরকম অসত্যভাষণ করতে চায়না গৈরিকা। সম্পর্ক ভাঙ্গার সিদ্ধান্তটা যেহেতু গৈরিকার ছিল,তার দায় অন্য কারোর উপর চাপিয়ে নিজেকে মহান করা মিথ্যাচারেরই নামান্তর হবে। নিখিলেশ কোনদিন ওর উপর কোন কিছুই চাপিয়ে দেয়নি। কোন কটু কথা বলেনি,অত্যাচার করাতো দূরের কথা। ওদের দুজনের মানসিকগঠন সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাফল্যের খিদে গৈরিকার প্রবল। নিখিলেশ অল্পেই সন্তুষ্ট। এই মানসিক পার্থক্যই দুজনকে দূরত্বে ঠেলে দিয়েছিল। এইভাবে উপন্যাসটা সাজালে চলবে না। মশলা চাই,স্ক্যান্ডেল চাই। ঝগড়া দেখাতে হবে,মারামারি দেখাতে হবে,ইগো ক্ল্যাশ দেখাতে হবে-যা হয়নি সব কিছুই জোর করে লিখে তার দায় নিখিলেশের উপর চাপিয়ে ওর সাধারণ জীবনটাকে বিপর্যস্ত করে দিতে হবে। ঠিক হবে কি এটা? নিখিলেশ তো ওর জীবনে নাক গলাচ্ছে না। শান্ত ভাবে মেনে নিয়েছে সমস্তটা। কোন অপবাদ দিচ্ছে না,কোন আক্রমণ করছে না-তাহলে যেচে ওকে আক্রমণ করে ওর পুরনো ক্ষত রক্তাক্ত করে কি লাভ? এমনিতেই হেরে আছে যে তাকে কি আর হারানো যায়? প্রতিবিম্বে উপন্যাস দিয়েই তো নিখিলেশের সাফল্যের সমস্ত সম্ভবনা অঙ্কুরে বিনাশ করে দিয়েছে গৈরিকা। পিছনে থেকে যে লড়াই জিতে গেছে,সামনে এসে সেই লড়াই লড়া সুবুদ্ধির পরিচয় নয়। অথচ কিভাবে এড়াবে অনিমেষ আঙ্কলকে,কি করে বোঝাবে? কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ ও। উনাকে না করতে পারলেও নীলকে না করবে কি করে?

        সন্ধ্যার দিকে বোর লাগছিল। নীল ফিরতে ফিরতে রাত হবে। রিন্টুটাকে আজ রাখতে চেয়েছিল গৈরিকা। কোনদিন চায়নি,কোনদিন ইচ্ছাই করেনি। কাল হঠাৎ কেন যে ইচ্ছা করল? আসলে কালকের মন খারাপটা সুহার্ত কিছুটা মিটিয়ে দিলেও রিন্টুর সাথে গল্প করে প্রায় পুরোটাই ভালো হয়ে গিয়েছিল। মন খারাপ বড্ড খারাপ রোগ। একবার হলে বেশ কয়েকদিন রয়ে যায়। মেলানকোলিয়া,অরুণিমা বলছিল। ওর বর ডাক্তার। সাইকিয়াট্রিস্ট। ও এসব ব্যাপারে অনেককিছুই জানে। মেলানকোলিয়ার রেশ কয়েকদিন থাকলে লেখাটা শেষ হত না। আজ রিন্টু থাকলে ওকে অনেকটা সময় দিতে পারত। আজ কোন অনুষ্ঠান নেই,চ্যানেলে যাওয়া নেই,লেখা শেষ,হাতে তেমন কাজও নেই। রিন্টুর সাথে জমিয়ে গল্প করা যেত। ওকে রূপকথা,ভুতের গল্প শোনাতে শোনাতে মনে হচ্ছিল-একবার ঐ জরনারটা ট্রাই করলেও হয়। এতদিন তো বড়দের জন্যই লিখে এল,এবার ছোটদের জন্য লিখবে। বেশ কয়েকটা গল্প লিখবে। বই করবে একটা। নামটাও ভেবে রেখেছে, “রিন্টু আর মামমামের গপ্পোসপ্প।” তবে তার জন্য রিন্টুর সাথে অনেকবেশি করে সময় কাটাতে হবে ওকে। আজকালকার বাচ্চারা কি চায়,না চায়-রিন্টুই শেখাবে ওকে। দুনিয়াটা বড্ড এগিয়ে গেছে। বাচ্চারা সব তুখোড় আর স্মার্ট। সব কিছুই ওদের চোখে পড়ে। না হলে ঐটুকু ছোট ছেলে এটাও বোঝে,নীল আঙ্কেলের সাথে থাকে বলেই মামমাম ওর কাছে আসতে পারে না। ওর কাছে এবার থেকে যাবে গৈরিকা। ওর সব অভিমান,ক্ষোভ,অভিযোগ মিটিয়ে দেবে। কথাবলা পুতুলের মত এমন সুন্দর খেলনাটা থাকতেও আগে কেন দেখেনি কে জানে? খেলনাটার সাথে খেলতে ইচ্ছে করছে ওর। আজ,এখনি ভীষণ ইচ্ছা করছে। কেন যেন মনে হচ্ছে রিন্টুটা ওর কথা মনে করছে। ওকে কাছে চাইছে। ওর বাবাকে বলতে পারছে কি? বললেও সে কি শুনছে? যেনতেন প্রকারেণ ওর মনটা ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। ফোন করতেও তো পারে। ফোন করে তো একটাবার কথা বলাতেও পারে। না। বলাবে না। বড্ড জেদ ওর। বড্ড ইগো। ছেলেকে একা হাতে মানুষ করে বলে বড্ড অহংকার। রিন্টুর শরীর খারাপ হলেও কোন খবর দেয়না ওকে। এই তো বছর খানেক আগে এক শনিবার এল না বলে ফোন করে গৈরিকা,খবর নিয়ে দেখে,প্রায় এক সপ্তাহ নার্সিংহোমে ছিল ছেলেটা। নিউমোনিয়া হয়েছিল। গৈরিকাকে খবরটা দেওয়ার প্রয়োজনটুকুও বোধ করেনি নিখিলেশ। গৈরিকারও সেদিন যাওয়ার উপায় ছিল না। উচ্ছ্বাস পুরস্কার দেওয়ার দিন ছিল ওটা। ওর উপস্থিতি জরুরী ছিল। তবুও বলেছিল, “আমি যাব?” “তুমি? না। আজ তো খুব ব্যস্ত তুমি,তাই না? আর তোমার রিন্টু তো ভালো আছে। নার্সিংহোম থেকে ফিরে এসেছে। তুমি তোমার কাজ করো। আজ হঠাৎ করে আর্চিকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হতে হবে না।” ফোনটা কেটে দিয়েছিল নিখিলেশ। খারাপ লেগেছিল গৈরিকার। অপমানিত বোধ হয়েছিল। হ্যাঁ,ও ছয়মাসের ছেলেকে ফেলে ফিরে এসেছিল। তা বলে ও তো রিন্টুর মা। ভালোমন্দ জানার অধিকারটুকু কি ওর নেই? কাস্টডি নেয় নি ও,ইচ্ছে করেই নেয়নি। সময় দিতে পারবে না,যত্ন হবে না ভেবে নেয়নি। তা বলে রিন্টুকে কি ভালোবাসে না? বাসে,কেন বাসবে না? আত্মজকে ভালবাসবে না কেন? খুব ভালোবাসে রিন্টুর সাথে কথা বলতে আজ ইচ্ছা করছে খুব। ফোনে ওর গলাটা শুনতে ইচ্ছা করছে। একা লাগছে হঠাৎ। একা লাগছে খুব। কিছু ভালো লাগছে না। আঃ! আবার মাথাটা ধরে গেল। ফোনটা হাতে নিল গৈরিকা। একটা ফোন করবে নিখিলেশকে? নম্বরটা বার করেও ফোনটা করল না। নিখিলেশ শীতলতা দেখাবে। আঘাত করবে। ঠারেঠোরে বলতে চাইবে ওর ছেলের ব্যাপারে জানতে চেয়ে গৈরিকা অনধিকার চর্চা করছে,থাক। ছেলেটাকে নিয়ে টানাটানি করে কি হবে? তার থেকে রিন্টু যেমন আছে তেমন থাক। নিউমোনিয়ার খবর শুনে নীল রেগে গিয়েছিল, “কাস্টডি নিয়েছে,অথচ এত কেয়ারলেস? শালা অকম্মার ঢেঁকি একটা! একটা বাচ্চাকেও দেখে রাখতে পারে না!” এই আশঙ্কাটা যে গৈরিকারও হয় না,তা নয়। এত অগোছালো একটা লোক কি করে ঐটুকু ছেলেকে যত্নে রাখে কে জানে? তবে সেদিন রিন্টুর মুখে মিসের গল্প শুনে রহস্যটা অনেকটা কেটে গেছে। কে এই মিস? কেন রিন্টুকে এত কেয়ার করে? নিখিলেশের সাথে ওর সম্পর্কটা ঠিক কেমন? নিখিলেশ কি ভালোবাসে ওকে? না-তা কি হয়? নিখিলেশের চোখ দেখেই বোঝা যায় ওর মনে এখনো গৈরিকার স্থান রয়েছে। নাকি নেই? গৈরিকার প্রতি ওর ভালোবাসার অনুভুতিতা মরে গেছে,গৈরিকা নিখিলেশের চোখে যা দেখেছে তা ভ্রম মাত্র। আসলে ঐ মেয়েটাকেই...তাহলে বিয়ে করে নিক। রিন্টুর চোখে সাধু সাজার জন্য ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে কেন? তবে এই মেয়েটা কি রিন্টুকে দেখবে? এখন হয়তো নিখিলেশকে বোকা বানাবার জন্য ভালোবাসার নাটক করছে,বিয়ের পর দূরছাই করবে। তাহলে গৈরিকা চুপ  করে থাকবে না। রিন্টুকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। নীল নিশ্চয় আপত্তি করবে না। ধুর! এতসব উল্টোপাল্টা ভাবছে কেন? হয়তো মিস আর নিখিলেশের মধ্যে তেমন কিছুই নেই। তবুও ওর মন খারাপ লাগছে,কেন? 

নীলের ফোন পেয়ে খুশি হল গৈরিকা। বাড়ি ফিরছে তাহলে।
-কখন ফিরছ?
-গৈরিকা তুমি প্রতিবিম্বকে উপন্যাস দিয়েছ?
সরাসরি প্রশ্নে চমকে উঠল গৈরিকা। সত্যিটা লুকাল না
-দেব বলেছি। দিইনি এখনও।
-হাউ ডেয়ার ইউ? হ্যাভ ইন গান নাটস্‌?
নীল গর্জন করে উঠল যেন।
-মানে বুঝলাম না। আমি একজন লেখিকা। আমি যাকে খুশি লেখা দিতেই পারি। এতে রাগ করার কি আছে?
-না পারো না। কারণ তুমি উচ্ছ্বাসের। উচ্ছ্বাস তোমাকে তৈরী করেছে। তুমি এখন যা সবটুকুই উচ্ছ্বাসের জন্য। না হলে কে চিনত তোমায়? একটা মফস্বলে পচে মরতে।
ইন্দ্রনীলের মাথায় আগুন জ্বলছিল। বাবার কাছে লেফট অ্যান্ড রাইট ঝাড় খেয়েছে এই মাত্র। বড্ড উড়ছে গৈরিকা,এত সাহস পেল কি করে?
-আমি লিখতে না জানলে তোমরা পারতে কি?
-তোমার মত অন্য কাউকে পেয়ে যেতাম। শোনো,উচ্ছ্বাস লেখক তৈরি করে,লেখকরা উচ্ছ্বাসকে তৈরি করেনি।
এতক্ষণ শান্ত ভাবে কথা বললেও এবার গৈরিকাও রেগে গেল।
-মানছি তোমরা আমাকে প্রজেক্ট করেছ। তার মানে কি এই,যে আমি তোমাদের দাসখত দিয়ে রেখেছি?
-গৈরিকা...
-স্টপ ইট,জাস্ট লিসন টু মি। আমি গত পাঁচ বছরে আমার হাড় মাস কালি করে রাত জেগে না খেয়ে শরীরকে কষ্ট দিয়ে শুধু তোমাদের জন্য লিখে গেছি। বেস্ট সেলার হয়েছে সে সব লেখা। তা দিয়ে আমার কৃতজ্ঞতার ঋণ কি শোধ হয় নি?
-না। দেখো এই জেদাজেদির খেলায় নেমো না। বাবা কিন্তু চাইলে তোমার ডানা ছেঁটে দিতে পারেন।
-ধমকাচ্ছ?
না। সত্যিটা বলছি। প্রতিবিম্বকে তুমি উপন্যাস দেবে না। এই আমার শেষ কথা।
-অর্ডার করছ আমায় নীল?
-করছি।
-কিসের জোরে অর্ডার করছ? ভালোবাসি তোমায় বলে তোমার হাতের পুতুল ভাবো আমায়? কে আমি? তোমার বিবাহিতা স্ত্রী নই। বিয়ে করার কথা শুনলেই এড়িয়ে যাও। উচ্ছ্বাসের সাথে আমার কোন লিখিত চুক্তি নেই। তাহলে কিসের জোরে অর্ডার করছ আমায়?
-চুক্তি চাও তুমি? ওকে। ডান। চুক্তি হবে। কাল সকাল দশটায় অফিসে এসো। বাবাকে বলে কালকেই চুক্তি করে নেব। তোমাকে লাম্পসাম দেব পার অ্যানাম। কিন্তু তুমি অন্য কারোর জন্য লিখতে পারবে না।
-আমার স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাও? অন্যের জন্য যদি লিখি তাতে তোমাদের সমস্যা কোথায়? আমি নিজের সেরা লেখাটা উচ্ছ্বাসেই দেব।
-প্রশ্নটা লয়ালটির। বাবা লয়ালটি খুব পছন্দ করেন। তুমি দেখোনি কত জনকে ব্যান করে দিয়েছি আমরা?
-অন্য কাউকে লেখা দিলে আমাকেও ব্যান করে দেবেন তোমার বাবা?
-মে বি। আমি জানি না।
-তাহলে তাই দিন। শোনো, গৈরিকা সান্যাল এখন একটা ব্র্যান্ড। ঐ নামটা না থাকলে তোমাদের বই কেউ খুলেও পড়বে না। আই হ্যাভ মেনি টেকারস তুমি যদি তোমার ভালোবাসার মানুষকে ব্যান খাওয়া থেকেও বাঁচাতে না পারো,তাহলে আমার অন্যত্র লেখাই ভালো।

ফোনটা কেটে সুইচ অফ করে দিল গৈরিকা। এ কোন নীল? একে তো ও চেনে না। মার্জিত ভাষায় কথা বলা তো দূরের কথা,রীতিমত চোখ রাঙাচ্ছে! তাহলে কি সুহার্তই ঠিক বলে? নীল প্রকৃতপক্ষে ওর বাবার হাতের ক্রীড়নক। ওর হাতে কিছুই নেই। না হলে যাকে ভালোবাসে তার ভালোবাসার জন্য বাবাকে বোঝাতে পারে না? এদিকে গৈরিকার উপর জোর ফলাচ্ছে! বিয়ের কথা আজকেও নীল তুলল না। উল্টে চুক্তির কথা বলল। টাকা দিয়ে কিনতে চাইল ওকে। ছিঃ! এত ইনসিকিওড় কেন ওরা? এই উপন্যাস ওদের ছাপার সাহস নেই বলেই  তো অন্যদের দিচ্ছে গৈরিকা। নিজেরাও ছাপাবে না,অন্যকেও ছাপাতে দেবে না,এ কেমন দাদাগিরি? গা জোয়ারি করে কি সাহিত্য অঙ্গনে থাকা যায়? “মনোপলি হয়ো না।” সুহার্ত বারবার বলে,ও নিজে সবাইকে লেখা দেয়,এমনকি লিটিল ম্যাগাজিনেও। তাহলে গৈরিকা কি ভুল করে ফেলেছে? নিজের সবটুকু উচ্ছ্বাসকে দিয়ে দিয়ে মস্ত বড় ভুল টি করে ফেলেছে ও? শুধরাতে হবে তো তাহলে,কি করে শুধরাবে? আর যদি এসবের মধ্যে নীলকে হারিয়ে ফেলে? নীল না আত্মসম্মান-বাছতে হলে কাকে বাছবে গৈরিকা?

(পর্ব-১২)

আর্চির জ্বরটা অনেকটা কমেছে। কাশিও কম। একটা জিনিস শুধু কমেনি, “মামমাম যাবো” বায়নাটা। শিঞ্জিনী সকালে উঠেই চলে এসেছে। আর্চির মন ভোলানোর জন্য  নানা রকমের আয়োজন করেছে নিখিলেশ। বাবা স্কুলে যাবে না আজ,গল্প বলবে,কার্টুন দেখতে দেবে-এতসব লোভ দেখানোর পরেও ছেলের ঠোঁট ফুলছে,চোখ দিয়ে জল পড়ছে আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলছে “মামমাম যাবো।” ধৈর্য রাখতে পারল না নিখিলেশ। ধমক লাগাল
-চুপ,একদম চুপ। শরীর খারাপ। কাঁদলে আরো শরীর খারাপ হবে।
-মামমাম...
-কোথাও যাবে না তুমি। জানো না মামমামের কত কাজ? তুমি গেলে তোমার দিকে ফিরেও তাকাবে না।
-মামমামকে ডাকো এখানে।
-কেন? মামমাম থাকে এখানে? যে ডাকব? আর ডাকলে আসবে? তোমার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। যা দরকার আমাকে বলবে খবরদার মামমামকে ডাকার কথা বলবে না।
আর্চি চুপ করে গেল। ফোঁপাচ্ছিল ও।
-আবার? কান্না বন্ধ। একদম বন্ধ বলছি না?
শিঞ্জিনী ঘরে চলে এসেছিল
-এভাবে বকছেন কেন? অসুস্থ ছেলে,কাঁদলে আরো কষ্ট পাবে যে।
-তুমি জানো না কি জেদ করছে ও...
-জানি। অন্যায় জেদ কি? শরীর খারাপ করলে সবাই মাকে চায়। আপনি একবার ফোনে কথা বলিয়ে দিন না।
-একদম না। ওর জেদকে প্রশ্রয় দেব না আমি।
-জেদটা এবার কিন্তু আপনি করছেন।
শিঞ্জিনীর কথায় থমকে গেল নিখিলেশ। সত্যিই কি ও জেদ করছে? আর্চিকে নিয়ে জেদাজেদি করছে? গৈরিকাকে একটা ফোন করলে কি খুব অসম্মানের কাজ হয়ে যাবে? নাকি আর্চিকে একটাবার ওর মামমামের সাথে কথা বলিয়ে দিয়ে ওকে শান্ত করিয়ে নেওয়াই ভালো?

        গৈরিকা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিল। সকালে উঠতে উঠতে প্রায় ন’টা বেজে গেছিল,ফোন খুলতেই নীলের অজস্র এস.এম.এস ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ‘আই অ্যাম সরি’ ‘আই লাভ ইউ সোনা’,প্লিজ কথা বলো’...আরো অনেক মেসেজ। উচ্ছ্বাসের অফিসে যাবে ঠিক করেছে গৈরিকা। ওদের অফারটা শুনে আসবে। অনিমেষ আঙ্কলের সামনাসামনি বসে উনার প্রকৃত উদ্দেশ্যটা মেপে আসতে চায় গৈরিকা। কেন এভাবে নীলকে ব্যবহার করে ওকে বারবার ফোর্স করছেন উনি? প্রশ্নটা আজ না হয় সরাসরিই করবে। গৈরিকার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে কে বা কারা ওর পিছনে ভীষণ বড় ষড়যন্ত্র করছে। ওরা ওকে শীর্ষে থাকতে দেবে না বলে বদ্ধপরিকর। একটা সামান্য ইস্যু নিয়ে সমস্যাটাকে ঘোরালো করে তুলছে। কি চায় ওরা? গৈরিকা উচ্ছ্বাস থেকে ব্যান হয়ে যাক আর চিরন্তনী সেই জায়গাটা নিক। হতে পারে। কিন্তু তারা কারা? জানতে হবে গৈরিকাকে। জানতেই হবে। না হলে মাথার মধ্যের অস্বস্তিটা যাবে না। নাকি এটা এমন কেউ করছে যে চায় না গৈরিকা আর নীল সুখে থাকুক। সে যেই হোক,তার মুখোমুখি হবে গৈরিকা। ও হারতে চায় না,হারতে পারে না। পায়ের তলায় মাটি এভাবে আলগা হয়ে যেতে দেবে না ও। নীলকে একান্তে চাই ওর। তাহলে ওকে দিয়ে সবকিছু কনফেস করিয়ে নিতে পারবে।

          কলেজে আজ একটা ক্লাস নিতে হবে। তাও দুপুর দুটো থেকে। তার আগেই উচ্ছ্বাসের সমস্যাটা মিটিয়ে ফেলবে ও। নীলকে মেসেজ করে দিয়েছে যে,ও আসছে। আজ সুন্দর করে সাজতে হবে। ডেনিম জিন্সের উপর সি গ্রিন কুর্তি পরল গৈরিকা। নীল সি গ্রিন রংটা খুব পছন্দ করে। পরিপাটি প্রসাধন করে,চুল বাঁধল। নীলের নজর যাতে ওর থেকে না সরতে পারে আজ-এনশিওর করতে চাইল গৈরিকা। কাল রাতে অনেক ভেবেছে। আত্মসম্মানের বিনিময়ে নীলকে চায় না ও। তবে যদি দুটোকেই একসাথে বজায় রাখা যায়,ক্ষতি কি? উচ্ছ্বাস যদি এই উপন্যাসটা ছাপে আর ওর অপছন্দের উপন্যাস লিখতে জোর না করে,তাহলে প্রতিবিম্বকে লেখা দেবে কেন? আর প্রতিবিম্বকে লেখা দেওয়ার পিছনে যে লজিকটা আছে,সেটা যদি ওদের বোঝানো যায়? ধুর! বড্ড ঘেঁটে গেছে ব্যাপারটা। মনটা স্থির নেই গৈরিকার। একদম স্থির নেই। মনে হচ্ছে কোথাও কিছু খারাপ হতে চলেছে। কিন্তু কি খারাপ হতে চলেছে বুঝতে পারছে না ও।

          ফোনটা বেজে উঠল। ট্যাক্সি করে অফিসের দিকে যাচ্ছিল গৈরিকা। কে ফোন করল,নীল নিশ্চয়। দশটা বেজে গেছে? ফোনের দিকে তাকিয়ে অবাক হল। নিখিলেশ? হঠাৎ...কি হল?
-হ্যালো...
-মন খারাপ?
গৈরিকা চুপ করে গেল। ওর উচ্চারিত একটা শব্দ শুনেই নিখিলেশ এখনো ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারে। গৈরিকা লুকাতে চাইল।
-না,বলো।
-যদি বিরক্ত করে ফেলি,তাহলে দুঃখিত। খুব জরুরী বলেই ফোন করলাম।
-বলো,শুনছি।
-আর্চির শরীরটা ভালো নেই।
বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল গৈরিকার। সে কি! তাই ওর মন কু গাইছিল। রিন্টুর কথা বারবার মনে পড়ছিল। খুব শরীর খারাপ নিশ্চয়। না হলে নিখিলেশ তো ফোন করবে না।
-কি হয়েছে?  
-খুব জ্বর,কাশি।
-নিউমোনিয়া আবার?
-জানি না।
-কি করে এত ঠাণ্ডা লাগে নিখিল? উফ!
-বিরক্ত হচ্ছ?
-না। রাগ হচ্ছে আমার। নার্সিংহোমে দিয়েছ,নাকি?
-না। বাড়িতেই আছে।
-ঘুমোচ্ছে?
-না জেগে,তোমার কথা খুব বলছিল। কাল সারারাত জ্বরে বেহুঁশ পড়ে ছিল। জলপটি দিয়ে,ওষুধ খাইয়েও জ্বর ক্মছিল না। জ্বরের ঘোরে সবসময় তোমার কথাই বলে গেছে। সকালে উঠেও তোমাকে খুব চাইছে...
চুপ করে গেল গৈরিকা। ওর দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল সানগ্লাসটা খুলে চোখ মুছল ও। ওর কাল কেন রিন্টুর জন্য মন কেমন করছিল,এবার বুঝতে পারল ও। ছেলেটা যে ওকে চাইছিল...
-আমি অনেক করে বুঝিয়েছি,তুমি ব্যস্ত। তাও কান্না থামছে না। বাধ্য হয়েই ফোন করতে হল আমায়।
নিখিলেশ সহজে ফোন করেনি,এটা জানে গৈরিকা,গত পাঁচ বছরে এই প্রথম ছেলের শরীর খারাপের  জন্য গৈরিকাকে ফোন করল ও।
-ওকে ফোন দাও।
নিখিলেশ বুঝতে পারল গৈরিকার স্বর কান্না ভেজা। কাঁদছে ও? আর্চির কণ্ঠ ওকে ছোঁয় তাহলে? আর্চিকে ফোন দিল নিখিলেশ। ছেলেও কাঁদছে।
-মামমাম...
-কি হয়েছে রিন্টু? খুব কষ্ট হচ্ছে?
-খুব।
-কেঁদো না। চুপ হয়ে যাও। এই তো মামমাম।
-কই?
-এই যে,ফোনে।
-তুমি এসো না মামমাম। তুমি এলেই আমার কষ্ট কমে যাবে।
নিখিলেশের চোখে জল। ছেলেটা যে আব্দার করে ফেলেছে,ওর মা তা রাখতে পারবে না।
-আমি এলে তুমি ভালো হয়ে যাবে?
-হ্যাঁ।
একমুহূর্ত ভাবল গৈরিকা। মিটিং টা ক্যানসেল করতে হবে,কলেজ যাওয়া হবে না,তার থেকে বড় কথা ফেলে চলে আসা শহরে যেতে হবে। কিন্তু এত সব জটিল হিসাবের বাইরে গিয়ে ওর মন কি চাইছে?
-আসছি আমি রিন্টু।
-কখন?
-যত তাড়াতাড়ি পারি আসছি। কাঁদবে না কিন্তু আর। বাবাকে ফোন দাও। নিখিলেশ অবাক হয়ে ফোনটা হাতে নিল।
-বলো।
-রিন্টুকে বলো,আমি আসছি। ও যেন না কষ্ট পায়।
-তুমি আসবে?
আকাশ থেকে পড়ল নিখিলেশ। এ-ও কি সম্ভব? গৈরিকা ছেলের আব্দার রাখতে সব কাজ ফেলে আসছে...কেন?
-আসছি। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাবো।
ফোনটা কেটে দিল গৈরিকা। যেতে হবে ওকে,যেতেই হবে। রিন্টু কষ্ট পাচ্ছে। আর কষ্টের মধ্যেও মামমামকেই চাইছে। না গিয়ে কি করে পারবে ও? ট্যাক্সিকে বলল, “দাদা,শিয়ালদা চলুন।”
-আসছ না মানে? বাবা ওয়েট করছেন। কন্ট্র্যাকট নিয়ে কথা বলে নাও। কত কি চাও না চাও...
নীল গম্ভীর গলায় বলল।
-ওসব পরে শুনে নেব নীল। এখন আমায় যেতে হবে।
-কোথায়? কোথায় যাচ্ছ তুমি?
-রিন্টুর ভীষণ জ্বর,খুব কাশি-হয়তো নিউমোনিয়া...
-কাম অন! তার জন্য মিটিং ক্যানসেল করবে? নিখিলেশ আছে তো ও সামলে নেবে সব। যেচে কাস্টডি নিয়েছিল যখন ওসব হ্যাপা ওকেই করতে দাও।
গৈরিকার কানে ‘হ্যাপা’ শব্দটা বিঁধল। নীল রিন্টুকে হ্যাপা বলল?
-রিন্টু আমাকে চাইছে।
-তাহলে ওকে তোমার কাছে আসতে বলো।
-অসুস্থ ছেলেকে কই করে নিয়ে আসবে?
অ্যাম্বুলেন্সে। যেভাবে আনে। এনে বেস্ট নার্সিংহোমে দিয়ে দিও। ক’দিন থাকবে,সেরে যাবে। তোমার ওখানে যাওয়ার দরকার নেই।
অ্যাম্বুলেন্স,নার্সিংহোম...এতসব কঠিন শব্দ এক নিঃশ্বাসে কিভাবে বলে যাচ্ছে নীল? রিন্টুকে নার্সিংহোমে দেবে,এটা তো ভাবতেও পারে না গৈরিকা। তার আগে চেষ্টা করে দেখবে না? দেখবে তো,একশবার দেখবে।
-আমাকে যেতেই হবে নীল,জোর করো না।
-ঐ লুজারটার জন্য খুব দরদ দেখছি! তাই বলি প্রতিবিম্বে লেখা দেওয়া কেন? দুজনের বই একসাথে বার হবে। সব বুঝি আমি। সব বুঝি। ইউ ডার্টি হোর! সবাইকে ঠকাতে পারো তুমি। সবাইকে...

নীল রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গৈরিকা নিখিলেশকে ওর জন্য ছেড়ে আসতে যখন পেরেছিল,তাহলে নিখিলেশের জন্য ইন্দ্রনীলকেই বা ছাড়তে পারবে না কেন? এইসব মেয়েদের কোন চরিত্র হয় না। বাবা ঠিকই বলেন। এরা অযোগ্য। ক্যারেকটারলেস বিচ! এইসব মেয়েদের কোন চরিত্র হয় না। গোল্ডডিকার একটা।
-তুমি প্রকৃতিস্থ নেই। আমি রাখলাম।

ফোনটা কেটে দিল গৈরিকা পাগলের মত আবার ফোন করল ইন্দ্রনীল। সুইচড্‌ অফ! এত সাহস ওর? কি ভাবছে? ইন্দ্রনীল বসুকে মই করে উঠে,তাকেই লাথি মারবে? এটা হতে দেবে না ইন্দ্রনীল। ও নিখিলেশ নয় যে মুখ বুজে সব মেনে নেবে। ডানা ছাঁটবে ও। গৈরিকা সান্যালের ডানা ছাঁটবে। আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনে সম্রাজ্ঞী করেছিল তো,আবার ওকে মাটিতে মিশিয়ে দেবে। এই ঔদ্ধত্যের সমুচিত জবাব পাবে গৈরিকা,পাবেই।

Previous Post Next Post