দে ব জি ৎ

মাদার টেরেজা : অলৌকিকতা ও সন্তায়ন
 "আপনার সংগৃহীত প্রমাণে যদি আমার তৃপ্তি না জন্মে, তজ্জন্য আমাকে নির্বোধ বা ভাগ্যহীন মনে করিতে পারেন; কিন্তু অনুগ্রহ করিয়া গালি দিবেন না। কেননা, এই শেষোক্ত অধিকার আপনারও যেমন আছে, আমারও তেমনই আছে। পাল্টা গালি দিতে আমাকে বাধ্য করিবেন না।"
    - রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী

যুগোস্লাভিয়ার আগনেস গঞ্জা বয়াজু নামের সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ বিশ্বজননী। আলবেনীয় ভাষায় 'গঞ্জা' শব্দের অর্থ গোলাপকুঁড়ি। সেই গোলাপকুঁড়ি সিস্টার টেরিজা হয়ে মাদার টেরিজায় প্রস্ফুটিত। সারাটা জীবন জুড়ে তাঁর সোনালি কাজগুলো আমাদের স্বপ্ন দেখায়। পৃথিবীর ঘুমন্ত বিবেকের দরজায় আঘাত করে তাঁর কর্মজীবনের ছবিগুলো।

তিনি আমার ঈশ্বর কিম্বা নবী বা পয়গম্বর নন, তিনি আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ, যে সম্পর্কের ভিত গড়ে ওঠেছে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দিয়ে। মানুষ তো অমর নয়,  যেতে হয় একদিন। ১৯৮৩ সালে প্রিয় মানুষটির হার্ট অ্যাটাক হয়, ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাক হয় ও কৃত্রিম পেসমেকার স্থাপন করা হয়। ১৯৯১ সালে তিনি আক্রান্ত হন নিউমোনিয়াতে, ফলে হৃদরোগের আরও অবনতি ঘটে। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে কলার বোন ভেঙ্গে যায় ও আগস্টে পড়েন ম্যালেরিয়ার কবলে। সেই সময়ে  তাঁর বাম হৃৎপিণ্ডের নিলয় রক্ত পরিবহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। ১৯৯৭ সালে মারা যান প্রিয় মানুষটি। তিনি হাওয়ায় মিলিয়ে যাননি অথচ কেউ কেউ মনে করেন কোনো দুষ্ট বা শয়তান তাকে আক্রমণ করে মেরে ফেলেছে।

মৃত্যুর পর ২০০৩ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল তাঁকে স্বর্গীয় আখ্যা দেন এবং কলিকাতার স্বর্গীয় টেরেজা  (Blessed Teresa of Calcutta) নামে পরিচিত হন। যে মানুষটা সারাটা জীবন সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থেকেছেন, মৃত্যুর পর সেই মানুষটিকে সাধারণ মানুষের থেকে দূরে সরাবার চক্রান্তে অনেকেই দুঃখ পেয়েছিলেন সেদিন। 'ব্লেসেড' ঘোষিত হবার ১৩ বছরের মধ্যেই ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে ২০১৬ সালে মাদার টেরিজাকে সন্ত হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন পোপ ফ্রান্সিস। 'Blessed Teresa' হয়ে গেলেন ' Saint Teresa'।

'সন্ত' -এর ইংরেজি হচ্ছে Saint । 'সেন্ট' শব্দটা এসেছে লাতিন 'স্যাংকটাস' থেকে যার অর্থ পবিত্র। প্রথমদিকে সেন্ট বলতে বোঝাতো যারা যীশুর প্রতি বিশ্বাস রেখে তাঁর উপদেশ মাথা পেতে নিয়ে জীবন যাপন করে পবিত্র হয়ে ওঠতেন। কিন্তু এখন ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মে সন্ত মানে, যিনি ধর্মপরায়ণ ও পবিত্র জীবন যাপন করে 'স্বর্গে' স্থান পেয়েছেন। ভগবানের সঙ্গে যাঁর 'ইন্টারসেশন' হয়েছে অর্থাৎ তিনি ঈশ্বর ও মানুষের Medium । মা টেরেজা সন্ত হলেন। সন্ত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বলে সন্তায়ন বা ক্যাননাইজেশন। সন্ত হওয়ার কিছু শর্ত বা পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমদিকে এটা ছিলো মূলত স্থানীয় বিশ্বাস। কাউকে মানুষ সন্ত মনে করলে ও আঞ্চলিক চার্চ তা সমর্থন করলে সন্তের স্বীকৃতি পাওয়া যেতো। এখন পদ্ধতি কিছুটা পাল্টেছে কিন্তু বর্তমানের পদ্ধতিও ত্রুটিমুক্ত নয়।

সন্তায়ন বা ক্যাননাইজেশনের আগের ধাপ হলো বিয়েটিফিকেশন। যাকে সন্ত ঘোষণা করা উচিত বলে কিছু মানুষ মনে করেন, সেখান থেকে তাঁর একটি অলৌকিক শক্তির প্রমাণসহ প্রস্তাব পাঠানো হয়। খ্রিষ্টজাগের মধ্য দিয়ে সে প্রস্তাব প্রথম উত্থাপিত হয়। স্থানীয় বিশপ বা আর্চবিশপই সেই প্রার্থনায় নেতৃত্ব দেন। তারপর ভ্যাটিকানে সেই প্রস্তাব পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রস্তাবে পাঠানো অলৌকিক ঘটনা সত্যি কিনা, ভ্যাটিকান তার তদন্ত করে। যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তখন বিয়েটিফিকেশন হয়। অর্থাৎ যাঁকে সন্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাঁকে পোপ 'ব্লেসেড' ঘোষণা করেন। এরপর পুরো প্রক্রিয়া ভ্যাটিকানের নিয়ন্ত্রণে। তারপর আরও একটি অলৌকিক ঘটনা যদি ভ্যাটিকান খুঁজে বের করতে পারে তাহলে 'ব্লেসেড' থেকে 'সেন্ট' -এ উত্তরণ  ঘটে, এতে কখনো কখনো অনেক বছর পেরিয়ে যায়।


সংক্ষেপে সন্ত হয়ে ওঠার কিছু স্টেপ -
Step one: wait 5 years - or don't
Step two: become a 'servent of God'
Step three: show proof of a life of 'heroic virtue'
Step four: verified miracles
Step five: cononisation

মাদার টেরেজার সন্ত হওয়ার শর্ত হিসেবে প্রথম ঘটনা ১৯৯৮ সালে। কেউ কেউ মনে করেন পশ্চিমবঙ্গের এক আদিবাসী মহিলা মণিকা বেসরার পেটের টিউমার বা ক্যান্সার সেরেছিলো মাদার টেরিজার নামে প্রার্থনা করে। দ্বিতীয় ঘটনা ২০০৮ সালে ব্রাজিলের এক বাসিন্দার টিউমার সারার জন্য রয়েছে মা টেরিজার করুণা। এইসব শুনলে ভুলে যাই আমিও আধুনিক পৃথিবীর একজন মানুষ। দুঃখে অভিমানে মধ্যযুগের মানসিকতায় অন্ধ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে মুখ গুঁজে রাখি শুধু মধ্যযুগের লেখায়- "খেলারাম চক্রবর্তী শণ কাটছেন বসে / ধর্ম এসে দেখা দিলেন কুষ্ঠরোগীর বেশে।" 

মণিকা বেসেরার সেরে ওঠার পেছনে মাদারের কোনোও কৃতিত্ব নেই বলে দাবি করেছেন কয়েকজন চিকিৎসক। তাঁদের দাবি মণিকা বেসেরার ক্যান্সার হয়নি। পেটে সিস্ট হয়েছিলো। ব্রজিলবাসী ওই লোকের কথা কি আর বলি, তিনি তো টেরেজাকে দেখেননি পর্যন্ত।

আমি বিশ্বাস করি না টেরেজা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, এও বিশ্বাস করি না এই দুটি ঘটনা অলৌকিক। তর্কের খাতিরে এই দুটি ঘটনার অলৌকিকতাকে সত্যি বলে মেনে নিলেও প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। মাত্র দুটো কেনো? একশত কথার মধ্যে যে পঞ্চাশটা সত্যি কথা বলে তাকে কী বলবো? সত্যবাদী না মিথ্যেবাদী? যদি  একশতটির মধ্যে পঁচানব্বইটির উপরে সত্য কথা বলে তাহলে তাকে সত্যবাদী বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো মাদার টেরেজা এতো এতো কাজ করেছেন অথচ দুটো অলৌকিক ঘটনার খোঁজ কেনো? যদিও আমার কথাগুলোতে টেরেজার কথা বেশি আসছে কিন্তু আমার মূল উদ্দেশ্য সন্তায়ন। হাজার হাজার অলৌকিক ঘটনার নিরিখে একজনের বিচার হোক,  নইলে সন্তায়নের ভন্ডামি বন্ধ হোক। একটি কথা বলে শেষ করছি,  তিনি Blessed Teresa নন, তিনি Saint Teresa নন, আমার এবং আমাদের সাধারণ হৃদয়ের ঘরে তিনি  মা টেরিজা।

তথ্যঋণ : ইন্টারনেট


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.