অরিন্দম চ্যাটার্জি

অরিন্দম চ্যাটার্জি
 গ্রহণ 

এ গ্রহ আজও মেঘবালিকায় গল্প শোনে। এক মনে।
আর এই নিয়নজ্বলা গ্রহের কোনো এক অন্ধকার কারখানার মাঠে-
কাঁটা ঝোপের ধারে - ছিঁড়ে, খুঁড়ে, গুটিয়ে পড়ে আছিস তুই।
ভুল বললাম - পড়ে আছে তোর খোবলানো, থ্যাঁতলানো শরীর!!
আমি তোকে কাপড়ে ঢেকে নেবো। মা শিখিয়েছিলো - 'নিজের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখতে হয়!'
আর তোর নগ্ন শরীর আসলে আমারই লজ্জাস্থান!
এখান থেকে আমি তোকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো।
তোর সাদা, রংহীন, প্রাণহীন বিছানার পাশে বসে থাকবো,
তোর চোখ মেলার আশায়!!
চারপাশের সবাই বলবে তোর বাঁচার আশা খুবই কম।

কিন্তু আমি সে কথা শুনবো না।
কিন্তু আমি সে কথা ভাববো না।

লোকে বলে এই শহরের ঝলমলে আলোয় নীরার আর অসুখ করে না!
শুধু তুইই ভাঙাচোরা। এখনো। হাসপাতালে চারদিন পরে তুই চোখ মেলবি।
সাদা ফ্যাটফেটে চোখের ডিমে তখন রক্তের ছিটে এদিক, ওদিক!
খুউউব দুর্বল তুই। হাসপাতালের খাবার মুখে দেওয়াও যায় না।
আমি পাড়ার দোকান থেকে মুরগি কিনে রান্না করবো। মশলা ছাড়া।
বাটিতে করে স্যুপ নেবো। তোর গলা অব্দি ঢেকে দেব কাপড়ে।
তারপর একটু একটু করে তোকে স্যুপ খাইয়ে দেব চামচে করে।
খাওয়া শেষ হলে নীলচে নরম তোয়ালে দিয়ে আলতো মুছে দেব তোর ঠোঁট।
খেয়াল পড়বে তোর ঠোঁটের কোন নীল হয়ে থাকা কালশিটের রং-ঠিক তোয়ালেটার মতো!!
ঐসময় আমরা কোনো ছেঁদো কথা বলবো না।
আমি তোকে জানাবো - তোর নতুন রিসার্চ পেপার পাবলিশ হয়েছে!
তুই আমাকে জিজ্ঞেস করবি - 'রণবীরের কি নতুন কিছু ফিল্ম বেরোলো?'
হাসপাতালের সবাই বলবে - এই অভিজ্ঞতার শক কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব!

কিন্তু আমি সে কথা মানব না।
কিন্তু আমি সে কথা জানব না।

শুনেছি এই গ্রামের বনলতা সেনের এখনো পাখির নীড়ের মতো চোখ - তাতে কাজল! কালশিটে না।
আমাদের হাসপাতালের সংসারে কিন্তু পরেরদিন পুলিশ আসবে। আসবে ডাক্তার।
তদন্তের স্বার্থে তারা মুখের ভিতর লালাময় জিভ লুকিয়ে তোর স্তন ছোঁবে - যা তখনো বিক্ষত, করুণ, আনত!
তদন্তের স্বার্থে তাদের চকচকে চোখ পরীক্ষা করবে তোর ধ্বস্ত যোনি - যেখান থেকে তাদের জন্ম।
এসব নিয়ে আমরা কোনো অভিযোগ করবো না।
আমি না হয় তখন তোকে 'মিঃ বীন' এর ভিডিও দেখাবো - আমার মোবাইলে।
যদিও তোর ফুলে থাকা ঠোঁটে আর পেটের সেলাইতে লাগবে, তবু তুই খুব হাসবি।
হাসতে হাসতে তোর চোখে জল চলে আসবে..........জল, কান্না নয় কিন্তু!
পরিবারের সবাই বলবে পুলিশকে এড়িয়ে চলাই ভালো, রাস্তা এড়িয়ে চলাই ভালো।

কিন্তু আমরা সে কথা শিখবো না।
কিন্তু আমরা সে কথা বুঝবো না।

কয়েকদিন পরে তোকে বাড়ি নিয়ে আসবো! আমাদের বাড়ি!!
পাড়ার গলিতে বন্ধুলোকেরা বিছিয়ে দেবে নরম কথা আর তির্যক চাউনি।
আমরা যদিও হাঁসের ডানা থেকে জলের মতো ঝেড়ে ফেলবো।
ঘরে ফিরে আমি রোজ তোকে রান্না করে খাওয়াবো।
তোর গায়ে বল দরকার! দুধ নেবো এক লিটার বেশি।
তোর উরুতে, সিঁথির কাছে রক্ত জমে ঘন সবুজ হয়ে আছে জায়গায় জায়গায়।
তোর ও অঙ্গে এখনো ব্যথা - রড, সূচ, অনেককিছুকে আশ্রয় দেবার ব্যথা!
তাই আমরা ভালোবাসাবাসি করবো না এখনো।
জানলা দিয়ে চাঁদের আলো ঝরে পড়বে, মধুক্ষরা - তোর রুক্ষ চুলে।
আমি শুধু আদর আঙ্গুল বুলিয়ে দেব কপাল জুড়ে।
দিনের পর দিন সাজিয়ে যাবো। রাতের গায়ে হেলান দিয়ে থাকবে রাত।
সমাজের সবাই বলবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া ভারী কঠিন।

কিন্তু আমরা সমব্যথা গ্রহণ করবো না।
কিন্তু আমরা করুণা গ্রহণ করবো না।

আমরা দুজনে অপেক্ষা করবো। ধৈর্য্য ধরে, বহু বহু কাল!
একদিন, কোনো একদিন, ভস্ম থেকে উঠে দাঁড়াবি তুই।
দুচোখে ধকধক তেজ। করালবদনা! লেলিহজিহ্বা! অশুভদলনী!! দিগবসনা!!
আর আমি বাঘছাল, ভস্ম, ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দাঁড়াবো তোর সামনে!
সেদিন কাশফুলের ঝোপে শরৎ খুঁজে পাওয়া যাবে। অন্য কারো টুকরো শরীর না।
সেদিন মহিষের খোলস ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা অসুর তোর পায়ের তলায় জানু পেতে বসবে।
সেদিন, সেই একদিন আগমনীর সুরে কোনো কান্না শোনা যাবে না আর।
একদিন..............কোনো একদিন নিশ্চয়ই এমনটি হবে।

আমরা সেদিনের জন্য বেঁচে থাকবো।
আমরা সেদিনের আশায় বেঁচে থাকবো!





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.