'আমি যাকে ভালোবাসি সে অন্তত আমাকে গোপনে মেরেছে সহস্রবার
কিন্তু আমি মরিনি একাকী
দৃশ্যত নিস্তব্ধ হয়ে, তাকেও মুখর করে রাখি
ক্রন্দনে, মরিনি বলে তাকেও মুখর করে রাখি।'
--- শক্তি চট্টোপাধ্যায়
আদরের বহুবিধ রূপ ও বিস্তার আছে। এই যে রাত্রি জানে মৃন্ময়ীর হঠাৎ ডাক। অতএব গন্তব্য এক, কিন্তু রাস্তা বদলে যায় রোহিতের। বাঁকবদলের সাক্ষী থাকে মডেল স্টেশন। ভোরবেলাতেই দাড়িটাড়ি কেটে ফিটফাট! আড়াই মাসের অদর্শনজনিত অদ্ভুত একটা টান। চাকায় হাওয়া কেটে যাচ্ছে জাতীয় সড়ক। রাধাগ্রাম, রাধাগ্রাম, তুমি আবার আরশিনগর। তুমি আবার দেবীর দেউল, তুমিই আবার মিলনসাগর। এইসব ছোটোখাটো অন্ত্যমিল নিয়ে সকাল-সকাল ছুঁয়ে ফেলা। তারপর 'এই পথ যদি না শেষ হয়', লক্ষ্য থাকুক বালুকাবেলা।
ঝুলবারান্দায় রোহিতের সিগারেটের ধোঁয়া। ঝুলবারান্দায় ব্যস্ত মৃন্ময়ীর ফ্রন্ট ক্যামেরা। ঝুলবারান্দায় সময়ের গর্ভে বন্দি হয়ে যাচ্ছে দু'জন। তারপরে অভ্যন্তরীণ হতেই ঝলসে ওঠে মৃন্ময়ীর চোখ। সে তখন নিয়তিনির্দিষ্ট প্রতিমা, বিদ্যুতের গতি নিয়ে নিকটবর্তিনী। তারপরে আলিঙ্গনের আশ্লেষ। চুম্বনও এত দীর্ঘ হতে পারে ঈশ্বরী! অদর্শনে জমে থাকে এত প্রেমভার! হাতের আঙুলেরা এভাবেই খুঁজে নেয় আদরের ভূগোল!
এভাবেই ফাঁকেফাঁকে মাঝখানে জেগে ওঠে একফালি নো-ম্যান'স ল্যান্ড। যে-কোনোদিকে যাওয়ার একমাত্র পাসপোর্টের নাম, একনিষ্ঠ তাগিদ। অতএব সীমানায় দাঁড়িয়ে বা তার এপারে-ওপারে রঙিন অক্ষরে লেখা হতে থাকে প্রেমগ্রন্থ। অনেকটা সময় পরে মৃন্ময়ীর ঠোঁট থেকে বিযুক্ত হয়ে তার স্তনের নিবিড়ে গিয়ে ছবি আঁকতে থাকে রোহিতের ঠোঁট। শিউরে উঠতে-উঠতেও মৃন্ময়ী অর্ধেক পিছন ফিরে দেওয়ালের আয়নায় দেখে নেয় নিজের আশ্চর্য রূপ। আর তার গলার ভাঁজ ও কানের লতি হয়ে গালের উপরে আদরের তাপ ছড়িয়ে উঠে আসা রোহিতও সেখানে নিজের প্রতিচ্ছবিতে চিনে নেয় প্রকৃত মগ্ন সাধক।
তবুও সাঁকোটা নড়ে গেল, বন্যা! ভেঙে গেল বলবো না; তবে যা হলো, তা ভাঙনের অধিক। অথচ সাঁকোটা থাকতে পারতো নিরুপদ্রব। প্রকাশ্য না-হোক, গোপন অন্তরায়, নেপথ্য সঙ্গীতের মতো রিনঝিন। শুধু একটু আশিস ছাড়া আর কী চাওয়ার ছিল তাঁর কাছে! আমি তো তোমার মুখ হয়ে স্পষ্ট শুনেছি ওঁর উদ্বেগ! আমি তো ভুলবো না আমাকে লেখা ওঁর দুই-একটি আক্ষেপ, সে-সব অকথিত প্রাপ্তি হয়ে থাকুক আমার ঝুলিতে।
সাঁকো আসলে ছিল দু'টি। একটি নীরব হলো; আরেকটি, সব বুঝে, নিস্তব্ধতর। আর আমার কানে পরিহাসের মতো বাজতে থাকলো তোমার একদা উচ্ছ্বাস, 'জানো তো, দুই মা-ই!' হ্যাঁ, দু'জনেই সাঁকো ছিলেন নিজের নিজের মতো করে। কিন্তু ওই যে নিয়তি! সে তোমাকে আমার থেকে দূরতর করে দিল কোনো এক দ্বীপে, আর এইসব বিরুদ্ধতার প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া তোমারই অসহিষ্ণুতা আটকে দিল আমার অবাধ সন্তরণ।
তুমি হয়তো ভাববে, দ্বীপান্তর অগ্রাহ্য করে তুমি কি আসোনি আবার! এই তো অনেকটাই আগের মতো! ঠিকই তো, তবেই-না দশমীর বিসর্জন আমার কাছে বোধন হয়ে এল! কতদিন পরে যে সংলাপ ও সমর্পণে রাত গড়িয়ে ভোর! কিন্তু একথাও তো ঠিক, সেই আলোটা আর আসে না। তোমার ডাকে আর সকাল হওয়া নেই। কর্মব্যস্ত দুপুরেও অবকাশ খুঁজে নেওয়া নেই। গোধূলী আর ততটা রঙিন নয়। সান্ধ্য-অবসরের বিনিময়ও বড়ো চুপচাপ। এবং রাত! হ্যাঁ রাত! এইসব বেদর্দ বেরহম রাত! ভাসানেই তো ইদানীং ডুবেছে আমার অধিকাংশ নিশিযাপন!
একে কি তুমি আবার আগের মতো নেহাতই অভিযোগ বলবে, মৃন্ময়ী! নাকি এবার অন্তত বুঝবে এইসব আকুলতা আসলে অনুযোগ হয়ে ঝরে পড়ে মনের গভীরে? যা তুমি বলো আর যা তুমি বলতে পারো না, অথচ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টি প্রবলতর হয়ে বুঝে নেয়। ঘোর অসম্মানের ভিতরে যা কোথাও সমঝোতা হয়ে বাজতে দেখেছি তোমার এক-একটি মুহূর্তের অসতর্ক-কথনের হাহাকারে, তার মধ্যে একটি করাতকল আছে। সেই করাত আমাকে যেতে এবং আসতে, দু'দিকেই কাটে! রাত এলে, প্রকৃতির নিয়মে চরাচরে অন্ধকার নামবেই। কিন্তু আগে কোনো রাতেরই এমন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার দেখিনি! তবুও যে তুমি বন্দিনীর কারাগারে সময় চুরি করে নিয়ে মাঝেমাঝে ডেকে আনো দিন, তাকে আমার মরাল ভিকট্রি ছাড়া আর কী বলা যায়, বন্যা! শুভ বিজয়ার রাতে, অবশেষে যখন দেবীর দেউল থেকে ছুটে এল আলোকরেখা, তোমার অশ্রুচাঞ্চল্যে আমি তো সেই বিজয়ের ছবিই স্পষ্ট দেখলাম!
(ক্রমশ)
Tags:
ধারাবাহিক