পর্ব-৭
বাবার কেবিনে হঠাৎ তলব কেন বুঝতে পারল না ইন্দ্রনীল। আজ মন মেজাজ ভালো নেই। কালকের পার্টিতে চিরন্তনী আসবে, ওর জানা ছিল না,চিরন্তনী যে এত প্রাইভেট অ্যাফেয়ারের ফটো ফেসবুকে আপলোড করবে-সেটাই বা কে জানত? সত্যিই,মেয়েটার কোন সেন্স নেই। গৈরিকা দেখেছে ফটোটা। নিশ্চয় ভুল বুঝছে। কি না কি ভাবছে কে জানে? ফোন করার সাহস হচ্ছে না ইন্দ্রনীলের। বার্স্ট করবে। তার থেকে আজ ওর কাছে গিয়ে ওকে সামনাসামনি বোঝাবে। গৈরিকা বড্ড জেদি। যদি গোঁ ধরে ফেলে তো ওকে নিয়ে খুব সমস্যা হয়। বাবার কথাটা শুনবে না স্থির করেছে,তার মানে শুনবেই না। বাবা নিশ্চয় ব্লেমটা ইন্দ্রনীলকেই দেবেন। কেন ও গৈরিকাকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। কৈফিয়ত চাইবেন।
-আসব?
বাবার কেবিনে নক করল ইন্দ্রনীল। অনিমেষ তাকালেন।
-এসো,বসো।
-কি জন্য ডাকলেন,বলুন।
-বড্ড তাড়া দেখছি তোমার। টালিগঞ্জ যাবে নাকি?
ইন্দ্রনীল মাথা নীচু করল। বাবার মুড ভালো নেই। রেগে আছেন। অথচ কেন রেগে আছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
-গৈরিকা কি বলল,কবে উপন্যাসটা দেবে?
-লিখছে, কবে দিতে পারবে সেটা ও বলতে পারবে।
-লিখছে মানে? কোনটা? দেশভাগেরটা?
-হুম।
-ড্যাম ইট! ওটা আমার চাইনা। হিন্দু মেয়ে দেশ ভাগের সময় ইলোপড্ হয়ে মুসলমানদের ঘরের বৌ হয়ে সারাজীবন যে যন্ত্রণা ভোগ করল-তা জানতে চায় না পাঠক।
-বাট্, এটা কিন্তু খুব সেনসেটিভ টপিক।
-রাইট। একটু বেশিই সেনসেটিভ। কমিউনাল কোন লেখাকে আমরা বরদাস্ত করতে পারি না। অনেকের ঘরেই এই ঘটনা আছে। এপার বাংলাতেও আছে,ওপারেও আছে। মাইনরিটির ইমোশন আমরা হার্ট করতে পারি না। তাছাড়া বাংলাদেশ এখন আনস্টেবল। হেঁজিপেঁজি কোন লেখক এটা লিখলে কিছু হত না। কিন্তু গৈরিকা সান্যালের কলম থেকে এরকম কিছু বেরোলে ও দেশেও হইচই পড়ে যাবে। উচ্ছ্বাসের নামে ঢিঢি পড়ে যাবে।
ইন্দ্রনীল চুপ করে থাকল,বাবার সাথে এ বিষয়ে একেবারেই একমত নয় ও। হিন্দুদের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলে উচ্ছ্বাস,অথচ মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে নিশ্চুপ। স্বজাতির সমর্থনে টুঁ শব্দ কেউ করলেই তাকে উগ্র হিন্দু বলে দেগে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে এখন যে সংখ্যালঘু নিধন যজ্ঞ চলছে,তার খবর সযত্নে এড়িয়ে যায় উচ্ছ্বাস। এই ছুৎমার্গের কারণ বোঝে না ইন্দ্রনীল। ওর বন্ধুরাও ওকে ঠারেঠোরে এই নিয়ে কথা শোনায়। অথচ এটা উচ্ছ্বাসের ঘোষিত নীতি,এবং বাবার সিদ্ধান্ত। বাবার মতের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না ইন্দ্রনীল।
-চুপ করে বসে থেকো না। আরে কেমন পুরুষমানুষ তুমি? একটা মেয়েকে বশে রাখতে পারো না? এত বেয়াদপির সাহস পায় কি করে?
-গৈরিকার উপর আমার তো কোন অধিকার নেই।
-কে বলল নেই? ছাই থেকে তুলে এনেছ তুমি ওকে। রাণাঘাটের একটা কানাগলি থেকে তুলে এনে উচ্ছ্বাসে লিখিয়েছ, ফ্ল্যাট দিয়েছ, গাড়ি দিয়েছ,চাকরি দিয়েছ। তোমার কথায় আমিও ওকে চাওয়ার অতিরিক্ত পাবলিসিটি দিয়েছি। গৈরিকা সান্যাল আমাদের হাতে তৈরি। আমরা না থাকলে কি হত ও? নাথিং। কেউ চিনত না ওকে। সেই উপকারের অধিকারেই বলো ওকে। জোর করো।
-গৈরিকার সাথে আমাদের কিন্তু কোন কন্ট্রাক্ট নেই বাবা। ও এখন খুব বড় নাম। যদি বেশি জোর করলে অন্য কোথাও লেখা দেয়?
অনিমেষ বসু সজোরে ঘাড় নাড়লেন।
-প্রশ্নই ওঠে না। ও আমাদের। অন্য কোথাও লিখবে না ও। সোনার ডিম পাড়া মুরগী যখন ডিম দিতে শুরু করেছে তখন তাকে অন্য কারোর হাতে দেব কি করে? এতদিন ওর পিছনে যা কিছু ইনভেস্ট করলাম, এবার তো সুদে আসলে সেটা উশুল করব,নাকি?
-আমার মনে হয়,ও ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে লিখতে কমফর্টেবল নয়।
-কেন? চিরন্তনী লিখছে না? ফল দেখেছ। জাতির বিক্রি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। গৈরিকা তো আর তোমার আর ওর বেডরুম সিক্রেট নিয়ে লিখবে না। লিখবে অতীতকে নিয়ে। নিখিলেশ ব্যানার্জীকে নিয়ে।
ইন্দ্রনীলের কান গরম হয়ে গিয়েছিল। বাবা এই প্রথমবার এত খোলাখুলিভাবে গৈরিকা আর ইন্দ্রনীলের সম্পর্ক নিয়ে কথা বললেন।
-নিখিলেশকে ভিলেন বানিয়ে নিজে সতীসাধ্বী সাজুক। এতে সবার লাভ।
-আমার কি লাভ?
-তুমি অত্যাচারিতা একটা মেয়েকে নরক থেকে উদ্ধার করেছ,তুমি তো মহান হে!
বাবার কথায় সোজা হয়ে বসে ইন্দ্রনীল। সত্যিই তো! ও তো এভাবে ভাবেনি। এরকমটা হলে তো মন্দ হয় না। লোকের বৌ ইলোপ করার কলঙ্কটা কমে যায় অনেকটা।
-এবার বুঝলাম।
-সব কিছু একটু দেরিতেই বোঝো। যাই হোক,মেকশিওর যেন উপন্যাসটা হয়। যে করেই হোক রাজি করাও ওকে।
-ঠিক আছে।
-আর একটা খবর জানো? নিখিলেশ ব্যানার্জীর বই এবার বইমেলায় বেরোচ্ছে। ধুমধাম করেই বেরোচ্ছে।
-কে বার করেছে?
--কে আবার? প্রতিবিম্ব? কি থাকবে ঐ বইয়ে কে জানে! গৈরিকা আর তোমার শ্রাদ্ধ করে ছাড়বে হয়তো। বইটাকে জাস্ট চেপে দিতে হবে। সেটা হতে পারে, যদি গৈরিকা উচ্ছ্বাস থেকে উপন্যাসটা বার করে।
-আপনার কি মনে হয় আমাদের এতটা রিঅ্যাক্ট করা উচিৎ? কে নিখিলেশ ব্যানার্জী? লুজার একটা! এক কড়িও দাম নেই ওর।
-শত্রুকে হাল্কাভাবে নিতে নেই। হোক লুজার,ছেলেটা লেখে ভালো,কে বলতে পারে,একটা বই ওর ভাগ্যটাকেই হয়ত বদলে দিল,তখন?
-উই কান্ট টেক দ্যাট রিস্ক।
-ঠিক। গৈরিকার কাছে যাবে তো আজ?
-যাবো।
-রাজি করাও ওকে। যে করেই হোক,রাজি করাও। ও আমাদের ট্রাম্প কার্ড। এ টি এম মেশিন। ওকে হাতছাড়া করা যাবে না। বিয়ের কথা আর কিছু বলেছে?
ইন্দ্রনীল থমকাল। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে গৈরিকা,এটা মা’কে বলে ফেলেছিল। বাবা জানলেন কি করে?
-ঐ ভূতটা ছাড়িয়ে দিও। বসু বাড়ির বৌ হওয়ার যোগ্যতা ওর নেই। একটা ডাউনটাউন মিডিওকার মেয়ে। ইউজ হার অ্যাজ লং অ্যাজ শি ইজ প্রিটি। তারপর ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলো।
সিগারেটের ছাই অ্যাসট্রেতে ঝাড়লেন অনিমেষ। ইন্দ্রনীল উঠে দাঁড়াল
-চলি?
-যাও। আর হ্যাঁ,বয়স তো হল। এবার নিজের বিয়ের কথা ভাবো। নষ্টামি করে ক’দিন বেড়াবে? বসু বংশের উত্তরাধিকারী না থাকলে উচ্ছ্বাস চলবে কি করে?
-এ ব্যাপারে আমি কিছু...
-ভাবোনি তো? ভাবতেও হবে না। যা ভাবার আমি ভাবব। ইউ মে গো নাউ।
ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে ইন্দ্রনীল ভাবল বাবা কি তাহলে গৈরিকাকে ঝেড়ে ফেলার জন্যই এত কিছু করছেন? করলেও,ওর কিছু করার নেই। গৈরিকাকে ও ভালোবাসে। কিন্তু বসু এম্পায়ারের বিনিময়ে নয়। বাবার কথা না মানলে ত্যাজ্যপুত্র হতে হবে। সেই ঝুঁকি নিতে পারবে না ইন্দ্রনীল।
পর্ব-৮
একটা অদ্ভুত গ্লানিতে ডুবেছিল নিখিলেশ। কাল রাতে ঘটনা আজ সকালে ঘুম ভেঙ্গে মনে পড়েছে,নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে গেছে যেন। এ কি করল ও? গৈরিকা না হয় সারাজীবন ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি, তা বলে নিখিলেশও রাখতে পারল না? ঐ মেয়েটাকে কি করে গৈরিকা ভেবে ভুল করল কে জানে? নাকি শরীরের চাহিদাটাই বড় হয়ে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে। ঠিক,ভুল বোধ ছিল না। কিন্তু মেয়েটাকে তো ও ভালোবাসে না। তাহলে? ওকে তো ব্যবহার করে ফেলল,ঠকিয়ে ফেলল। আশার বুক বেঁধেছে শিঞ্জিনী। নিখিলেশ ওকে ভালবাসবে,বিয়ে করবে-আজ সকালেও এসেছিল। নিখিলেশকে রান্না করে খাওয়াবে বলে। খুশি হয়ে উড়তে উড়তে এসেছিল যেন। ওকে দেখতেই রাগ আর ধরে রাখতে পারেনি নিখিলেশ। যা নয় তাই বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। ওর মুখও দেখবে না আর-স্পষ্ট করে। কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিল মেয়েটা। ও চলে গেলে নিজেকেই নিজে তিরস্কার করেছিল নিখিলেশ। শিঞ্জিনীর কি দোষ? ও তো ভালোবেসেছে মাত্র। দোষ তো নিখিলেশ করেছে। শিঞ্জিনীর চাওয়ার সামনে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। নিজের উপর রাগটা ওকে আঘাত করে তুলছে। এর কোন মানে হয়? শিঞ্জিনীকে জোর করে জীবন থেকে তাড়িয়ে দিলেই কি নিখিলেশের চরিত্রের উপরের দাগটা মুছে যাবে? যাবে না,যেতে পারে না। তাহলে কি করবে নিখিলেশ? কি করার আছে ওর?
-নিখিলেশ দা না?
কলেজস্ট্রিট মেট্রো স্টেশনে ছিল নিখিলেশ,টালিগঞ্জ যাবে। আর্চিকে আনতে হবে। মেট্রোয় উঠে হঠাৎ পিছন থেকে চেনা গলার আওয়াজ পেয়ে তাকাল
-ও,সুহার্ত,তুই?
মুহূর্তে জড়িয়ে ধরল ওকে। ভারি ভালো ছেলে। যেমন ভালো লেখে,তেমন ভালো ব্যবহার। বছর সাতাশেক বয়স হবে। এই বয়সেই খুব নাম করে ফেলেছে। উচ্ছ্বাসের কবি? জাতিতে প্রায় লেখা বের হয়। অথচ কোন আত্মশ্লাঘা নেই। দেখা হলেই যেচে কথা বলে।
-এই একটু টালিগঞ্জ যাবো গো,বন্ধুর বাড়ি। তুমি কোথায় চললে?
-আর্চিকে নিতে যাব।
-ও গৈরিকার কাছে এখন?
-হুম,শনিবার আসে। রাতটা থাকে। রবিবার যায়।
-বাঃ,তোমার সাথে দেখা হয়?
-কার? গৈরিকার?
-আর আবার কার?
-হয় না। আমিই করি না। দরজা থেকেই আর্চিকে দিয়ে চলে আসি।
-ইস্!
-কি হল?
-একদিন ভাবছিলাম তোমার সাথে ওর বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসব। কিন্তু তোমারই তো নো এন্ট্রি।
নিখিলেশ অবাক হল। সুহার্তও তো উচ্ছ্বাসের লেখক। গৈরিকাকে নিশ্চয় চেনে। কথাও নিশ্চয় বলে ওরা। তাহলে ওর বাড়ি যাওয়ার জন্য এত উতলা কেন?
-তোর এন্ট্রি হয়ে যাবে। তুই ভাই জাতির লেখক।
-পাগল নাকি? গৈরিকা সান্যাল হল স্টার,আমাদের মত চুনোপুঁটিদের পাত্তা দেয় না। উপর মহলে ওঠাবসা তো। তবে মনের দিক থেকে খুব ভালো।
-কি করে জানলি?
-আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড তো। একটু আগেও চ্যাট করছিলাম। খুব ডিপ্রেসড আছে আজ।
-তোকে বলল?
-সব কি বলতে হয়? বুঝে নিলাম। ইন্দ্রনীলের সাথে ঝগড়া করেছে নিশ্চয়। সারাদিন না খেয়ে দেয়ে ঘর বন্ধ করে বসে আছে, আর স্মোক করছে। আমি মাথার দিব্যি দিতে খেতে গেল।
-তোর কথা খুব শোনে তো?
-শুনবে না? আমিও তো ওরই মতো পাগল।
-ফেসবুকে আসার সময় পায়?
-খুব কম আসে। কাউকে ইনবক্স করে না। আমার সাথে দিনে পাঁচ মিনিট হলেও কথা বলবে। ভাই পাতাতে চেয়েছিল আমায়। ‘বাবু’ বলে কথা বলে। আমি বলে দিয়েছি একদম ভাই-টাই না,আমাকে নাম ধরে ডাকবে।
নিখিলেশ মনে মনে হেসে ফেলল। সুহার্ত চ্যাটার্জীর শখ মন্দ নয়। যার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে,সে জানতে পারলে যা ঝাড় খাবে...
-ও,তাই গৈরিকা বলে ডাকিস? না হলে তো তোর থেকে বছর আটেকের বড়।
ইচ্ছা করেই খোঁচা দিল নিখিলেশ।
-রাখো তো ওসব বড়-টড়। ওর মেন্টাল এজ আমার থেকে কম। বোকা একটা। না হলে ইন্দ্রনীলের মত মেরুদন্ডহীন মাকালটাকে ভালোবাসে কেউ? তার থেকে তুমিও অনেক ভালো।
-তাই? ধন্যবাদ। এই প্রথম কেউ এই কথাটা বলল। আমি তো জানতাম আমি অপদার্থ।
-কে বলল? কি লেখো তুমি,সেটা নিজেও জানো না।
-অন্য কেউও জানল না তাই।
-জানে না মানে? সব শালারা জানে। ভয় পায় তোমায়,তাই উঠতে দেয় না। তোমার বই বেরোচ্ছে তো এবার?
-হ্যাঁ।
-প্রতিবিম্ব থেকে বার করছ,ঠিক করছ। ওরা লেখক কবিদের কদর করে।
-সে কি করে? তুই বলছিস এসব? তুই তো উচ্ছ্বাসের কবি।
-একদম নয়। আমি কবি। যে চাইবে তাকেই কবিতা দেব। উচ্ছ্বাস আমাকে কিনে রেখেছে নাকি? তুমি জাতিতে লেখা পাঠাও না কেন? পাঠাবে। আমি কবিতা বিভাগের অনেকটাই দেখি।
-আমার লেখা জাতিতে ছাপাবি তুই?
-কেন নয়? লেখার গুণমানই বিবেচ্য হওয়া উচিৎ।
-আমাকে তো ব্যান করেইছে,তোকেও ব্যান করবে তাহলে।
-বয়েই যাবে আমার। আমার কথা ভাবছি না। গৈরিকাকে নিজের মত লিখতে দিচ্ছে না,এটাই সমস্যা।
নিখিলেশ থমকাল। তাহলে ঠিকই আন্দাজ করেছিল। প্রতিবিম্বকে লেখা দেওয়াটা কাকতালীয় নয়। গৈরিকা উচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে ইচ্ছা করেই যাচ্ছে।
-কাউকে বলবে না তো একটা কথা বলি?
-বল্।
-তোমার জানা উচিৎ। তুমি গৈরিকার ভালো চাও নিশ্চয়। ওকে চিরন্তনীর সাথে কম্পিট করতে বাধ্য করছে উচ্ছ্বাস। এটা ঠিক বলো?
-কথাটা তোকে কে বলল? গৈরিকা?
-না। আমি ভেতরের খবর বললাম। গৈরিকাকে আমি না করে দিয়েছি। বলে দিয়েছি কোন মতেই যেন নিজস্বতা না হারায়।
-হুম। টালিগঞ্জ চলে এল।
-চলো।
আলচনার পরিসমাপ্তি চাইল নিখিলেশ। কোন মন্তব্য করা ঠিক হবে না। শুধু শুনে যাবে ও। সব শুনে যাবে। গৈরকার ক্ষতির আশঙ্কা করছে সুহার্ত। নিখিলেশও যে করছে না,তা নয়। তবে গৈরিকার বিচক্ষণতার উপর ভরসা আছে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে ও। উচ্ছ্বাসের চাওয়ায় হয়তো নিজের লেখার সাথে আপোস করতে হবে ওকে। তা হোক। উচ্ছ্বাসে থাকাটা জরুরী। ওদের বিরুদ্ধে গেলে ব্যান করে দেবে। অন্য প্রকাশনীর সেই ক্ষমতা নেই যে গৈরিকাকে উচ্ছ্বাসের মত মাইলেজ দেবে। তার থেকে ওদের শর্ত যতটা সম্ভব মেনে নেওয়া ভালো। সুহার্ত ছেলেটা বেশ। দারুণ মজার ছেলে। অকপট। মনের সব কথা খুলে বলে। নাটক করতে শেখেনি। আপনপর ভেদ করে না। যাওয়ার আগেও নিখিলেশকে দাদা বলে জড়িয়ে ধরল। নিখিলেশও আগে এমনি ছিল। সবাইকে আপন মনে করত। ছেলেটা খুব শিগগিরি বাঁশ খাবে। এত সৎ ছেলে এ জগৎ-এ বেমানান। গৈরিকার মন খারাপ শুনে নিখিলেশের মনটাও ভার হয়ে গেল। এমনিতেই শিঞ্জিনীর ব্যাপারটার জন্য খুঁতখুঁত করছিল,তার উপর শুনল গৈরিকা সারাদিন না খেয়ে স্মোক করেছে। ঐ জন্যই মাইগ্রেনটা বেড়েছে। এত স্মোক করলে হবে না? আর্চি ঠিকই বলে- “মামমাম সারাক্ষণ সিগারেট খায় আর রাতে উঠে বমি করে।” অন্যের রাগের সাজা নিজেকে দিলে শরীর থাকবে? অথচ নিখিলেশের ওকে বোঝাবার কি থামাবার কোন উপায় নেই। “এভাবে নিজেকে ফুরিয়ে দিলে হবে,এখনো তো অনেক লিখতে হবে,অনেকটা পথ যেতে হবে...” মনে মনে বলল নিখিলেশ।
কলিংবেল টিপল নিখিলেশ। মায়া দরজা খুলবে ভেবেছিল। দরজা খুলবে ভেবেছিল। দরজা খুলে বলবে, “দাদাবাবু,বসুন-আমি ওকে রেডি করে আনছি,” “বসব না,আমি বাইরেই ভালো আছি। তুমি আর্চিকে নিয়ে এস।” বাইরে বিরক্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকত নিখিলেশ। আজ দরজাটা গৈরিকা খুলল। ওর কোলে আর্চি। গৈরিকার চোখে চোখ পড়তেই নিখিলেশ বুঝল সুহার্ত ঠিক বলেছে। খুব মন খারাপ। কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। খুব বড় কিছু হয়েছে তাহলে,গৈরিকা চোখ নামাল। লুকাতে চাইল নিজেকে।
-মামমাম,বললাম না বাবা এসেছে?
-রেডি আর্চি? যেতে হবে আমাদের। নিখিলেশের অস্বস্তি হচ্ছিল। গৈরিকার চোখে চোখ রেখে কথা বলার ক্ষমতা আজ থেকে ওর আর নেই। নিখিলেশও সত্যভ্রষ্ট।
-বাবা,ভেতরে এসো না। মামমাম এই তো বাইরে এল। গল্প বলছে। গল্পটা শুনেই চলে যাব।
নিখিলেশ ইতস্ততঃ করছে দেখে বলল
-ভিতরে এসো নিখিল।
-ওর কথা ফেলতে পারল না নিখিলেশ। ভেতরে এল। জুতো খুলে সোফায় বসল
-এত দেরিতে লাঞ্চ করতে বেরিয়েছ যে? খুব লেখার চাপ,নাকি?
-বইমেলা সামনে তো।
-ও,তাই তো।
নিখিলেশকে সত্যিটা বলতে পারল না গৈরিকা। কোথাও যেন বাঁধল। ও যে অখুশি আছে সেটা নিখিলেশকে কি বলা যায়? ও জিতে যাবে যে তাহলে। অথচ সুহার্তকে বলতে পেরেছে ও। সুহার্ত ওর ফেসবুকের বন্ধু। জাতিতে কবিতা লেখে। বেশ ভালো লেখে। আর দারুণ ভালো কথা বলে। ফেসবুকে ওর সাথে কথা বললে অনেকটা ফ্রেশ লাগে নিজেকে। খুব হাসাতে পারে ও। পাগলামো করতে পারে। মন ভালো করে দিতে ওর জুড়ি নেই। ওকে তাই মনের কথা বলে ফেলে গৈরিকা। নীল বাদে এই একজনকেই মনের কথা বলে। আজ নীলের কোন পাত্তা নেই। তাই সুহার্তর সাথেই চ্যাট করেছে বহুক্ষণ।
-রিন্টু আমাকে একটা ভালো খবর দিয়েছে।
কথা ঘোরাল গৈরিকা।
-কি খবর?
-তোমার বই বেরোচ্ছে নাকি?
-ওঃ! সৌগত দা অনেক করে বলল...
-তুমি চাওনি?
-চাইব না কেন? চাই বললেই তো লিখে চলেছি। সফল হতে সবাই চাই। পথটা সবার সমান হয় না, এই আর কি।
গৈরিকা কথা বাড়াল না। নিখিলেশের সাথে ঝগড়া করার মুড নেই ওর।
-কোন পাবলিকেশন?
-প্রতিবিম্ব।
-বাঃ।
-বাঃ কিসের? উচ্ছ্বাস তো নয়।
-বড় নাম হলেই যে সবটুকু ভালো হবে,টা নয়।
-যাক,বুঝেছ তাহলে?
-না বুঝলে বলছি কেন?
-প্রতিবিম্বে তো তুমিও উপন্যাস দিচ্ছ।
গৈরিকা ঈষৎ অবাক হল
-তুমি জানলে কি করে?
-সুদেববাবু বললেন। ভালো করেছ। আমার বলা সাজে না,তবুও বলছি বড্ড মনোপলি হয়ে যাচ্ছিল ব্যাপারটা। তবে সাবধানে থেকো। এই ধৃষ্টতা করে আগে অনেকেই ব্যান হয়ে গেছেন।
-নীল আছে তো।
গৈরিকা বিশ্বাস জাহির করল। নিখিলেশের বুকে কথাটা তীরের মত বিঁধল।
-তাও ঠিক। আর্চি এবার চলো-রাত হয়ে যাবে। ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
-রিন্টু আজ থাক না,নিখিল।
গৈরিকা অনুরোধ করে ফেলেই থমকে গেল। রিন্টু আজ থাকলে খুব ভালো হয়। ও কাছে থাকলে মনখারাপটা ভিড় করবে না। কিন্তু নিখিলেশ কি রাখবে ওকে?
-কাল স্কুল আছে যে...
-ও।
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল গৈরিকা। জোর দেখাতে পারল না। জোর দেখাবার জোরটা হারিয়ে ফেলেছে ও। সেদিনই হারিয়ে ফেলেছে যেদিন ছয়মাসের দুধের শিশুটিকে ফেলে চলে এসেছিল।
-ক্লাসটেস্ট না থাকলে রেখে দিতাম।
নিখিলেশ গৈরিকার চাওয়ায় খুব বেশি খুশি হয়েছিল। মা ছেলেকে কাছে চাইবে,এটাই তো স্বাভাবিক। নিখিলেশ পারলে রেখে যেত ওকে।
-কাল ক্লাসটেস্ট রিন্টু? পড়া রেডি?
-রেডি। কিন্তু ক্লাসটেস্ট পচা।
-কেন?
-নাহলে আজ থেকে যেতাম। আরো কত স্টোরি শুনতাম। বাবা জানো,মামমাম সবচেয়ে ভালো স্টোরি বলে। তোমার থেকেও ভালো। কাল রাতে অনেক ভালো স্টোরি শুনিয়েছে আমায়,আমার কাছে শুয়ে শুয়ে অনেক আদর করেছে।
নিখিলেশ আর গৈরিকার চোখাচোখি হল। দুজনেই অরিনের খুশির পরিমাপ করতে পারল। মামমাম কে পায় না তো,পেয়ে তাই খুব খুশি।
-কিন্তু ক্লাসটেস্ট তো দিতেই হয়। নেক্সট স্যাটার ডে রিন্টু এলে অনেক গল্প বলব।
-প্রমিস?
-প্রমিস।
গৈরিকা অম্লান হেসে বলল। আর্চির সঙ্গ তাহলে খুব উপভোগ করছে ও। আর্চিকে সময় দিচ্ছে,ভালোবাসছে,কাছে চাইছে। মনে মনে খুশি হল নিখিলেশ।
সারাটা রাস্তা ফিরতে ফিরতেও মামমামের গল্প বলে চলেছে অরিন। নিখিলেশ ওকে থামায়নি। এই প্রথম ওর মামমাম ওকে এত সময় দিয়েছে,এতটা কাছে টেনেছে,এভাবে ভালবেসেছে। খুশি হওয়াই স্বাভাবিক,তার উপর নীল আঙ্কল আসেনি,আরও মজা।
-বাবা...
-বলো।
-আমি মামমামকে মিসের কথাও বলেছি।
বাইকে চড়ে বসল অরিন,
-কি বলেছিস?
-মিস কত ভালো,আমাকে কত ভালোবাসে। তুমি না থাকলে আমাকে দেখে...
-শুনে মামমাম কি বলল?
-মামমাম বলল মিস খুব সুন্দর দেখতে?
নিখিলেশ বুঝতে পারল গৈরিকা কি জানতে চেয়েছে। ও যা সন্দেহ করেছে, তাকে নিজের ভুলে ঠিক প্রমাণ করে ফেলেছে নিখিলেশ।
-তুই কি বললি?
-বললাম সুন্দর,কিন্তু মামমাম সবচেয়ে সুন্দর। ঠিক বলিনি?
নিখিলেশ কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না,ওর চোখে অন্তত গৈরিকার থেকে সুন্দর কেউ হয় না। আবার শিঞ্জিনীর প্রতিও কোন এক বিন্দুতে গিয়ে একটা দায় জন্মেছে ওর। সেই দায় কি কখনো এড়ানো যাবে না কি... উত্তর দিল না নিখিলেশ।
-ধরে বসো। বাইকটা জোরে চালাব।
-খুব জোরে বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরল নিখিলেশ। যার থেকে পালাতে চাইল,পারল কি?
পর্ব-৯
ইন্দ্রনীল এসেছিল। গৈরিকা জানত আজ ও ঠিক আসবে। কোন কথা বলেনি,কোন প্রশ্ন করেনি। নিজের ঘরে বসে চুপচাপ লিখছিল। মাথা ধরেছিল বড্ড। চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। লিখতে পারছিল না,তাও লিখছিল। ইন্দ্রনীল ঘরে এল।
-ডিনার করবে না?
-একটু পরে।
-লিখছ?
-তাই তো মনে হচ্ছে।
-ইন্দ্রনীল গৈরিকার দু কাঁধে হাত রাখল
-রাগ করেছ?
-কেন?
-কাল আসব ভেবেছিলাম। কিন্তু...
-কিন্তু? কে আটকাল? আঙ্কল না চিরন্তনী?
-ওঃ হো গৈরিকা! এই জন্য মুখ ভার তোমার? চিরন্তনীকে বাবা ডেকেছিলেন। আমি জানতাম না যে ও আসছে।
গৈরিকা ঘুরে বসল। ইন্দ্রনীলের মুখের দিকে তাকাল
-ও। তাহলে আঙ্কল চিরন্তনীকে ফ্যামিলি মেম্বার মনে করেন? বেশ। অবশ্য এখন চিরন্তনীই জাতিতে ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছে। ওর জন্যই জাতির কাটতি বাড়ছে......
-সোনা,কে চিরন্তনী? কেউ না। কোথায় তুমি আর কোথায় ও?
-স্টপ ইট নীল! ও নিশ্চয় কেউ। স্টল ওয়ার্ড বা পাইওনিয়ার বলা যায়। না হলে ওর মত করে কেন লিখতে বলছেন আমায়?
-ওর মত করে তো কেউ লিখতে বলেনি। বাবা তোমার পাস্ট লাইফের ওঠা নামা,স্ট্রাগল নিয়ে লিখতে বলেছেন,দ্যাটস্ ইট। লেখোই না। এত জেদ করছ কেন?
-জেদ নয়। আমি এত তাড়াতাড়ি আমার জীবন নিয়ে লিখব কেন? সময় আসুক। চুলগুলো পেকে যাক। ঠিক লিখব।
ইন্দ্রনীল মনে মনে বলল, “তখন পাঠকের উৎসাহ কি আর এতটা থাকবে?” বলল না। কথাটা গিলে নিল।
-বেশ। তুমি যা বলবে,তাই হবে।
-আর একটা কথা। আমাকে আমার মত করে লিখতে দেওয়া না হলে আমার খুব অস্বস্তি হয়। কেউ মুজরা করছে বলে আমাকেও কি ক্যাবারে করতে হবে?
-অফকোর্স নট। তবে কি জানো,পাঠকের রুচি বদলেছে। লেখায় যৌনতা না থাকলে পাতে দেওয়া যায় না। যাক্ গে,ভালো খবর দিই-মোহকুহকের এমাসের রয়্যালটির চেকটা এসেছে। মোটা অ্যামাউন্ট। কাল দিয়ে দেব।
-মোহকুহক এখনো এভাবে বিকোচ্ছে?
-বিকোচ্ছে মানে? এবার বইমেলাতেও বেস্টসেলার হবে। আর একটা খবর জানো?
-কি?
-নিখিলেশ ব্যানার্জীর বই বেরোচ্ছে,প্রিতিবিম্ব থেকে।
-শুনেছি।
ইন্দ্রনীল চোখ ছোট করল
-কে বলল?
-রিন্টু। কাল রাতে গল্প শুনতে শুনতে বলে ফেলেছে।
-ও। আমি ভাবলাম নিখিলেশই বুঝি বলেছে।
-না। তবে আজ ওর সাথে দেখা হয়েছিল। রিন্টুকে আনতে এসেছিল। আমিই ওর বইএর কথাটা তুললাম।
-খুব হাবভাব দেখাল,না? ঘাড় তেরামো কমেনি ওর। এতগুলো বছর গর্তে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম,তাতেও শিক্ষা হয়নি।
-থাক। বাদ দাও। ওর মত করে ও লিখছে।
-বাদ দেওয়া যাবে না। ওর বই প্রতিবিম্ব কিভাবে বিক্রি করবে জানো? বলবে গৈরিকা সান্যালের প্রাক্তন স্বামীর বই,এই বই এর সব কবিতাই গৈরিকাকে নিয়ে লেখা। ব্যাস। পাবলিসিটি কমপ্লিট।
এই আশঙ্কাটা যে গৈরিকার নেই তা নয়। তবে তার জন্য ব্যবস্থা নিয়ে ফেলেছে ও। প্রতিবিম্বকে উপন্যাস দিয়েছে একটা। নিখিলেশ ওই উপন্যাসের ভারে চাপা পড়ে যাবে। তবে প্রতিবিম্বকে উপন্যাস দেওয়ার কথা নীলকে এখনি বলবে,নাকি...
-কি ভাবছ এত? শোনো,বাবা এইজন্যই আরো তোমার আর নিখিলেশের কাহিনী নিয়ে তোমার জবানে উপন্যাস চান। না হলে,কে জানে ঐ সোয়াইনটা তোমাকে দোষ দিয়ে,আমাকে জড়িয়ে কি না কি লিখে রাখবে...
-লিখুক না।
-আমাদের ইমেজটা নষ্ট হয়ে যাবে সোনা। একবারটা ভাবো,প্লিস। আমার জন্য।
-নীলের অনুরোধ ফেলতে পারে না গৈরিকা। নীলের যুক্তিটাও ফেলার মত নয়।
-ঠিক আছে। লিখব। কিন্তু কোন অপ্রয়োজনীয় যৌনতা নয়।
-একদম নয়। সত্যিটাই লিখবে শুধু। লিখবে ওখানে থাকলে তোমার কি হাল হত... কিভাবে নিখিলেশ তোমার প্রতিভাকে নিজের ব্যর্থতার অন্ধকারে ডুবিয়ে দিচ্ছিল...আর তার সাথে একটু আধটু ইউ নো...ওকে মাতাল,দুশ্চরিত্র,লম্পট না হয় দেখালেই। এমনিতেই তো ওর তেমন কোনও সামাজিক সম্মান নেই। যেটুকু আছে,সেটুকু খোয়া গেলে কিছু হবে না।
-কিন্তু নীল,রিন্টু? ও বড় হয়ে যদি এসব পড়ে ওর বাবাকে ভুল বোঝে?
-বুঝুক না। ওটা তোমার জন্যই ভালো হবে। ও তোমার দিকে ঝুঁকে আসবে।
নীলের কথা মন থেকে মানতে পারে না গৈরিকা। নীল নিজের ইমেজ উদ্ধার করতে চাইছে,অনিমেষ আঙ্কলও তাই চাইছেন। রাতে গৈরিকাকে আদর-টাদর করে ঘুমিয়ে পড়েছে নীল। মাথাব্যথা শুনে মাথা টিপেও দিয়েছে। বিয়ের কথাটা উঠলেই সযত্নে এড়িয়ে গেছে নীল। বিয়েতে নারাজ ও। ঝামেলায় জড়াতে চায় না। আজও বেড়াতে যাওয়ার কথাটা বলা হল না। অথচ যেতে হবে। কয়েকদিনের জন্য যেতেই হবে। এত স্ট্রেস নেওয়া যাচ্ছে না। বইমেলাটা মিটলে বেড়াতে যাবে গৈরকা। লম্বা ছুটিতে যাবে। মেশিনের মত লিখতে লিখতে ক্লান্ত ও। এত লেখার চাপে পড়া হচ্ছে না। দ্রৌপদীকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার খুব ইচ্ছা ওর। লেখাই হচ্ছে না। লিখতে গেলে আগে ভালো করে মহাভারতটা পড়তে হবে। সময় লাগবে। এভাবে ধর তক্তা মার পেরেক কিছু হয় না। “রাত জাগা পাখি” আর “অল্প বিরাম” দুই বছর ধরে লিখেছিল ও। নিখিলেশের বাড়িতে বসে লিখেছিল। রিন্টু পেটে এলেও লেখা কামাই যায়নি ওর। হতে গিয়ে ঐ যে ছয়দিনের বিশ্রাম। নার্সিংহোম থেকে ফিরে কবে যে আবার লিখবে-ওখানে শুয়ে শুয়ে এটাই ভাবছিল ও। নিখিলেশকে বলেছিল, “তাড়াতাড়ি ছুটি করে নাও।” “কেন? লিখতে হবে তাই তো?” “উপন্যাসটা বাকি পড়ে আছে।” “আচ্ছা,ডাক্তারবাবুকে বলি তাহলে,তুমি লিখবে বলে ছুটি চাইছ?” “ধ্যাত,ওভাবে কেউ বলে নাকি? বলো,আমার ওয়াইফ এখন তো সুস্থ,ছুটি দেওয়া যেতে পারে?” “বলি,আর ডাক্তারবাবু ভাবুন,আমার বড্ড তাড়া তোমাকে বাড়িতে পাওয়ার।” “ভাবলেই হল? এখন আবার পাওয়াপাওয়ি কিসের? সবে তো ছেলে হল। অনেক দেরি আছে।” “কত দেরি? আজন্ম দেরি করলেও ধৈর্য হারাব না। আমার বেস্ট গিফটটা তো পেয়েই গেছি। আমার আর্চি।” “একদম না। আর্চি বলবে না ওকে। মহাপাকা ছোঁড়ার নাম। একদিকে বেটি,একদিকে ভেরোনিকা...আমার ছেলের নাম হবে অরিণ।” “ডাকনাম আর্চি?” “না রিন্টু বলে ডাকবে ওকে।” “তাই হল। তোমার রিন্টু,আর আমার আর্চি। তবে ওর কপালটা যেন আমার মত না হয়। সব জায়গায় ঘা খাওয়া,রিজেকটেড...” “উফ! নিখিল! আজ অন্তত এসব কথা থাক...” নিখিলেশ থেমে গিয়েছিল।
মোবাইলটা জ্বলে উঠল। ফেসবুকের নোটিফিকেশন। চিরন্তনী আবার কিছু বাঁধাল নাকি? ও যা মেয়ে,বলা যায় না,ভেবেই নিজেকে ধমকাল গৈরিকা। একটু বেশিই চিন্তা করছে ও। ইনসিকিওরড ফিল করছে যাকে নিয়ে যোগ্যতাই নেই গৈরিকার হাতে হাত রাখার। নাঃ! চিরন্তনী নয়। সুহার্ত। মেসেজ করেছে। কি লিখল...
-তুমি প্লিজ তোমার ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোকে বাজারে বেচো না। এতে তোমার সাথে চিরন্তনীর কোন ফারাক থাকবে না।
অবাক হল গৈরিকা। এত গোপন কথা সুহার্ত জানল কি করে?
-তুমি কি করে জানলে এসব কথা?
-জাতির কবিতা বিভাগেও এখন এই কথাটাই হট টপিক। প্লিজ তুমি এমন করবে না,বলো? আমি কষ্ট পাবো।
-আমিও তো করতে চাইনা বাবু।
-এই,বাবু বলবে না। আমি তোমার থেকে তেমন ছোট নই।
-আট বছর কি কম?
-দেখলে বোঝা যাবে না। তোমার থেকে চার ইঞ্চি লম্বা যে?
-লম্বায় বড় হলেই বুঝি বড়?
-আলবাৎ। ছোটবেলায় স্পোর্টসে যাওনি কখনো?
-তুমি কথায় খুব দড়।
--তোমার মাকাল তোমার পাশে শুয়ে আছে?
-অ্যাই! এভাবে বলে?
-বলব না কেন? বড়লোক বাবার ছেলে। তাছাড়া ওর নিজের কোন যোগ্যতাটা আছে? লন্ডন থেকে এম.বি.এ করেছে নাকি। এখনো তো বাবার আঙুল ধরে হাঁটা ছাড়তে পারল না।
কথাটা অসত্য নয়, গৈরিকা জানে। নীল নিজে এত শিক্ষিত, এত কিছু জানে, এক সুমুদ্র বই পড়েছে জীবনে ,এত স্মার্ট-তবুও অনিমেষ আঙ্কেলের ছায়ায় কোথাও ডুবে যায়। তার বাইরে বেরোতে পারে না। জীবনে একবারই আঙ্কলকে জোর দিয়ে কিছু বলেছিল-অশ্বত্থমা মিত্রকে ব্যান করার সময়। অনিমেষ আঙ্কলও মেনে নিয়েছিলেন কথাটা। তবে সুহার্ত বলে ঐ সময় অন্যান্য কাগজে লেখার জন্য এমনিতেই ব্যান হতেন অশ্বত্থমা। নীল কেবলমাত্র নাটক করে বাহবা নিয়েছিল।
-কি হল? নো রিপ্লাই?
-ঘুম পাচ্ছে।
-ও। অমনি রাগ হয়ে গেল। সত্যি বললে রাগ হয়। যাকে এত ভালোবাসো সে তোমায় বিয়ে করছে না কেন?
-ও বিয়েতে বিশ্বাস করে না।
বাব্বাঃ! খুব প্রোগ্রেসিভ তো?
-হুম। তোমার নতুন বই বেরোচ্ছে?
-তোমার হাত দিয়েই বইমেলায় বার করব।
-আমি তো কবি নই।
-কে বলল? তোমার কবিতা পড়েছি আমি। দারুণ লিখতে। ছাড়লে কেন?
-কবিতায় বড্ড ভিড়।
-নাম যশ খ্যাতি এসবের উপরে গিয়ে বলোতো-কবিতা না গদ্য?
-কবিতা। গদ্য লেখা বেশি কঠিন যদিও।
-তাহলে কবিতা লেখো।
-সময় কোথায়?
-এই তো সময়। রোজ একটা করে কবিতা আমার ইনবক্সে দেবে। নিখিলেশদার মত লিখতে পারবে একসময়।
-তুমি কি আমার গুরুঠাকুর? আর নিখিলেশের মত লিখতে চাইব কেন আমি?
-কারণ ও ভালো লেখে ডার্লিং। খুব ভালো লেখে। কে চেপে দিল ওকে? তুমি না মাকাল?
-আমি চাপতে যাবো কেন? ওর হতাশাই ওকে চেপে ধরেছিল।
-আজ দেখা হয়েছিল। মেট্রোতে। রিন্টুকে আনতে যাচ্ছিল।
-রিন্টুর নাম মনে আছে তোমার?
-থাকবে না? তোমার সব কিছু মনে থাকে আমার। রাত জাগা পাখির ৩৭৬ পাতার ষোলো নম্বর লাইনে মহুয়া ঠিক কি বলেছিল কেউ বলতে পারবে?
-না,তুমি পারবে?
-অফকোর্স। তোমাকে হয়তো অনেকেই ভালোবেসেছে, তবে আমার মত করে ভালো কেউ কোনদিন বাসেনি...ঠিক তো?
-মুখস্ত করে রেখেছ দেখছি!
-এই লাইনটা আমারও। তোমাকে এটাই বোঝাতে চাই বারবার করে।
-আবার ফ্লার্ট করা? বলেছি না তুমি খুব ভালো বন্ধু?
-সে তো তোমার দিক থেকে। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।
-তাতে আমি কি করব?
-চেষ্টা করো,ভালবাসতে পারবে।
-ভালোবাসা চেষ্টা করে হয় না।
-খুব হয়। ঐ মাকালটাকে ভালোবাসতে তো কম চেষ্টা করতে হয়নি তোমায়...
-আবার?
-ওকে। থাক থাক। এখন ঘুমোও। কাল কথা হবে। মাথাব্যথা নেই তো আর?
-না ভালো আছি। গুড নাইট।
সুহার্ত ছেলেটা অদ্ভুত। হয়তো ফ্লার্ট করে। এত সুন্দর দেখতে ছেলে কোন গার্লফ্রেন্ড নেই,তা কি হয়? তবে ও যা ভাবে তা স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দেয়। গৈরিকাকে কোনরকমের ভয় করে না ও। ওর নামকে ভয় করে না। নিখিলেশ,ইন্দ্রনীল দুজনেই গৈরিকার মুড বুঝে চলে বা চলেছে। সুহার্তর কোন কিছুতেই কিছু এসে যায় না। নিজেই রাগাবে,আবার নিজেই হাসাবে। ভারি অদ্ভুত। কিন্তু ভালো,বেশ ভালো।