নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

আমোদিনী  পর্ব-অবীরা
বাতাস সুখাদ্যের গন্ধে ভরিয়া আছে। সিঁড়ি দিয়া চতুর্থ তলে উঠিয়া আসিতে আসিতে আমোদিনী ক্ষুধা অনুভব করিতে লাগিল। সেও কোনও এক কালে উৎসবের রাত্রি তে এই রূপ রন্ধন করিত। তাহার প্রতিবেশীগণ সেই সুগন্ধে লোভাতুর হইতো। তাহার দু কামরার ফ্ল্যাটটির সন্মুখস্থ পাপোষ টি তে একটি ক্ষীণজীবী সারমেয় বিশ্রাম লইয়া থাকে। তাহাকে দেখিয়া পূর্বে ঘৃনা হইত। এখন জীবটি চাহিয়া দেখে সরিয়া বসিয়া আমোদিনী কে প্রবেশের সুযোগ করিয়া দেয়। সেই প্রাতঃকাল আট ঘটিকায় আমোদিনী অফিসের উদ্দেশে বাহির হইয়া ইস্তক কেহ তাহার ফ্ল্যাটটির সন্মুখে আসে নাই। সারমেয় টি এই নির্জনতার উপযুক্ত সদব্যাবহার করিয়া থাকে। আমোদিনীর প্রতিবেশীগণ নাগরিক বৈদগ্ধতা হেতু সারমেয় টির উপস্থিতি উপেক্ষা করিয়া থাকে ।চাবি ঘুরাইয়া দিবালোক হীন বদ্ধ ঘর টিকে খুলিল আমোদিনী। নিত্য চেনা আসবাব গুলি মূক হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। সকল জানালা খুলিল। বাতাসের সহিত শারদ উৎসবের মাইকের স্রোত তাহার ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। কাল হইতে ছুটি। 

এই ছুটি লইয়া কি করিবে আমোদিনী খুঁজিয়া পায় না। মধ্য পঞ্চাশে আসিয়া তাহার বাপের বাড়ি বলিয়া আর কিছু নাই। স্বামী আর সন্তান ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হইলে তাহার শ্বশুরকূলের সহিত বন্ধন টি ও ধীরে ধীরে মুছিয়া গিয়াছে। বন্ধু বান্ধব সকলের সাথে অধুনা সোশ্যাল মিডিয়া মারফৎ যোগাযোগ রহিয়াছে। কিন্তু ছুটি তে তাহারা পরিবারের সহিত আনন্দ করিবে। তাহাই তো করিত আমোদিনী এককালে।দশ বছর হইল আমোদিনী এই ছুটি আর তাহার সহ্য হয় না।সেই দিন টিও তো ছুটি কাটাইতে ছিল। অধুনা অনিয়ম শরীর গ্রহন করিতে পারে না। কিছু হইলে কেহ দেখিবার নাই। তাই নিয়ম মানিয়া সুস্থ থাকিবার চেষ্টা করিয়া থাকে।আজ এই উৎসব মুখর সন্ধ্যাকালে আচমকা তাহার মনে হইল, তাহার এই নিত্য নিয়ম মানিয়া বাঁচিয়া কি হইবে। যাহা তাঁকে সেদিন কষ্ট দিয়াছিল তাহা আবার স্মৃতিপটে আসিল।কেন তিনি বাঁচিয়া গেলেন? ছেলে আর স্বামীর পার্শে তো তিনিও ছিলেন।তাহাদের গাড়িটি তে বিরাট ট্রাক টি সজোরে আঘাত করিল। তিনি জ্ঞান হারাইলেন। জ্ঞান ফিরিলে দেখিলেন সামনে বসা পিতা আর পুত্র রক্তাক্ত আর প্রানহীন। মধ্য রাত্রি থেকে দুই শবদেহ লইয়া ভোর অবধি অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। চিৎকার করিয়া সাহায্য ভিক্ষা করিতে ছিলেন।তাহার কপালে সামান্য আঘাত হইয়া ছিল। এতো কষ্টে আর সেই স্থানে ব্যাথা বোধ তাহার ছিল না। আমোদিনী সেই সময় কালের স্মৃতি ভাবিয়া আজো শিহরিত হইলেন। তিনি কাঁদিবার বিলাসিতা করিতে পারেন নাই। তিনি বীভৎস অবস্থা দেখিয়া পুনরায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন নাই। উন্মাদ হইয়া যান নাই। কেবল বাঁচিয়া ছিলেন। দেহাতি লোকগুলো শবদেহ বাহির করিবার পূর্বে তাঁকে বাহির করিয়া গাছ তলায় বসাইয়া রাখিয়া ছিল। দুই পরান প্রিয় মানুষ কে অতি দক্ষতার সহিত তাহারা উপশম দিবার চেষ্টা করিতেছিল।তাহাদের নতুন কেনা দামী ক্যামেরা টি পুত্রের পায়ের কাছ হইতে তুলিয়া লইয়া তাহার হাতে আনিয়া দিয়াছিল একটি ছেলে। সেই ক্যামেরা তে তখন তাহাদের অজস্র ছবি। দেওয়ালে বিংশতি বর্ষের পুত্র আর তাহার পিতার সহাস্য মুখের ছবিটি তাহাকে আজ আরও একা করিয়া দিল।

স্নানঘরের দরজা টি বন্ধ করিবার আর প্রয়োজন নাই।ঝর্না বহুদিন যাবৎ খারাপ হইয়াছে। প্ল্যাস্টিকের মগ টিও বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে।অন্যদিন দ্রুত স্নান সারিয়া রান্না করিতে লাগিয়া যায়।আজ কিছু করিতে ভালো লাগিতেছে না। অন্যদিন এক খানি সিরিয়াল দেখিয়া থাকেন। আজ তাহাও ইচ্ছা করিল না। তিনি স্বামী আর পুত্রের জামাকাপর বইখাতা সব একখানি আলমারি তে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছেন। আজ সেই টি খুলিলেন।পুত্রের বইখাতা গুলি নামাইলেন। 

পুত্রের প্রিয় পারফিউমের ফাঁকা বোতল, সিডি, সায়েন্স ম্যাগাজিন, সুইমিং ক্যাপ সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখিলেন। বাঁচিয়া রইলে আজ বিবাহ হইয়া সন্তানের জনক হইত। কি অপরূপ পুরুষ দেহ ছিল তার। পিতার হলুদ হইয়া যাওয়া সাদা শার্ট, দামী বেল্ট,প্রচুর প্যান্ট ,বই আর একটি বাঁশী। বাঁশের বাঁশী । ইহা এখন ও আছে? বিস্মিত হইলেন আমোদিনী। দেশের বাড়ি হইতে মেলায় কিনিয়া লইয়া আসিয়া ছিলেন। জ্যোৎস্না উচ্ছসিত রাত টির কথা মনে পড়িল। নতুন বধূ তখন ঘুমাইয়া পড়িয়া ছিলেন। হঠাৎ বাইরের জানালা দিয়া কে যেন তাহাকে খোঁচা মারিল। সর্ব দেহে অলংকার। হতচকিত হইয়া তাকাইয়া দেখিলেন জানালার অপর পাশে তিনি সাইকেল লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন । 

-“পায়ের নুপুর খুলে চুপচাপ চলে এসো ... চলো বেরিয়ে আসি”।

- “ এতো রাতে”। 

-“আরে আমি বেঁচে থাকতে যম তোমাকে ছুটে পারবে না”

নদীর তীরে একটি আঘাটায় উনি আর আমোদিনী জ্যোৎস্নায় ডুব দিয়াছিলেন। বাঁশী বাজিয়ে ছিলেন বহুক্ষণ। আমোদিনী পুত্রবতী হন তাহার পরে। 

ছুটিতে আমোদিনী কাঁদিল আর আবার ভালোবাসিল।তিনি বাঁচিয়া থাকিতে যমে তাঁকে স্পর্শ করিতে পারে নাই। 




Previous Post Next Post