জয়া চৌধুরী

আজাইরা বাজার কথন / জয়া উবাচ  ৫

বয়স বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ, জীবনের সার শূন্যতাও ধরা পড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। চুলে নুনের গুঁড়ো তেমন দৃশ্যমান না হলেও হৃদয়ে হেমন্তের চিহ্ন বুঝি এইসব ভাবনা। কলকাতা শহরে জন্ম থেকে আজ অবধি থাকা। চারপাশে কতই যে বহিরাগত মানুষের বাস। দুমুঠো অন্নের জোগাড়ে মুখ বুজে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে এ শহরে কতজনাই না। লক্ষ্য করে দেখবেন আপনার কোয়ার্টারের যে দারোয়ান রোজ সন্ধ্যে হলেই ঢোলক বাজিয়ে রামনাম করে কোনদিন সে না থাকলে কেমন একলা হয়ে যায় বাড়ির একতলাটি। মাছের বাজারে যে ফর্সা পানা লালচে ঠোঁটের রোগা পাতলা লোকটা রোজ মাছ কেনার সময় আবোল তাবোল বিষয় নিয়ে বকবক করতে থাকে কোনদিন সে না থাকলে বাজারটা কেমন কেজো জায়গা হয়ে যায়! যেখানে শিম বাঁধাকপি পোনামাছের গ্যাদগ্যাদে নৈমিত্তিকতা। আপনার বাজারের কোনের ডিম সেদ্ধ লুচি তরকারি চায়ের দোকানী নারী পুরুষ যুগল দম্পতি কি না কখনও কি জিজ্ঞেস করেছেন তাদের? করননি আমি জানি। অথচ ওরা দুজনেই আলাদা কারণে ছিন্নমূল হয়ে ভাসতে ভাসতে হেথায়। একজনের সাকিন সুন্দরবন হলে আরজনের বর্ধমান। পেটের খিদে তাদের একসাথে দোকান দিইয়েছে। ভোর ছটা থেকে তাদের সব কাজকম্মো শুরু হয়। নাগাড়ে সে পরিশ্রম চলে রাত দশটা পর্যন্ত। একজনে কাটে অন্যজনে রাঁধে। ওরই মধ্যে অন্য দোকানদারদের সঙ্গে হাসি মুখে দেশ দশের আড্ডা। রাত বাড়লে ওরা দোকানঘরে ফুটপাথটি ধুয়ে মেজে শুকিয়ে ওর ওপরেই পাতে সুখ শয্যা। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন ওটা তখন ওদের বেডরুম। তার ভেতরকার ইকুয়েশন নাই বা জানা থাকল আমাদের, মানুষ তো কতভাবেই না বেঁচে থাকে! 

সেদিন পাইস হোটেলে খেতে গেছিলাম। ও জায়গা সাধারণত মেয়েরা খেতে যায় না। কেন যে যায় না তা জানা নেই। কারণ মেয়েদেরও তো খিদে পায়। আর সব মেয়েরই তো আর এসি রেস্তোরাঁয় খাবারের রেস্ত থাকে না ট্যাঁকে। তবুও বেশি মেয়ে যেতে দেখি না পাইস হোটেলে। সে রাতে অপারগ হয়েই যেতে হল। যাওয়া মাত্রই সিনেমা দেখার সুযোগ জুটে গেল। বেশ পেশল চেহারার এক বুড়ো দেখি দোকানের উল্টো ফুটপাথেই বসে বসে হিরণ্যগর্ভ শিক্ষার সুবাদে আনসান বকে যাচ্ছে। সে হেব্বি মজা! বুড়োর হাতে পাইট নেই কিন্তু মনে হল সে অমৃত পেটের খোঁদলে গড়িয়ে গেছে গলার নালী বেয়ে। তার বড় রাগ দুনিয়ার ওপর। পাশ থেকে দুই ছোকরা তাকে খোঁচাচ্ছে – মাতাল হয়ে গেছে বলে গঞ্জনা, আর সেও পারলে ঢিল তুলে তাড়া করতে যায়, একটু পরে ক্লান্ত হয়ে বেঞ্চিতে পাছা ঠেকায়। আবার ও পাশ থেকে কেউ খোঁচা দিলে আবার তাড়া। পেশির ঢেউ দেখে বুঝি খুব মাটি কাটা জীবন কেটেছে বুড়োর। হয়ত দেশ গাঁ ছেড়ে কোন যৌবনে এ শহরে পা রেখেছিল। তারপর শুধু পাথর ভাঙা, আর দিনান্তে পেটের গর্ত বোজানো খাবার। ব্যস দেখতে দেখতে চুল পেকে গেছে। তার কোন আত্মজন দেশের ঘরে অপেক্ষা করছে কি না কে জানে! হোটেলের মালিক মেয়েছেলেদের সামনে অসভ্যতা করতে বারণ করায় বুড়ো চিতকারের স্রোত কমায় একটু। মনে পড়ে যায় আমার কোয়ার্টারের বিহারী গাড়ি ধোয়ানো পাহারা দেওয়ার কাজ করা সুরেশের কথা। মিলিটারী দের মত এগার মাস পড়ে থাকে এ শহরে। দুইবার খায়। আর দুবার তুচ্ছাতিতুচ্ছ স্ন্যাক্স। মোবাইল ফোনের সুবাদে তার হু হু করা একলা জীবনে সে সন্ধ্যে হলেই দেশে ফোন করে। ফ্রি কল হবার সুবাদে দেশের গরুটার কেমন দুধ দি, এবার থেকে লাডলা মাস্টারের কাছে পঢ়াই করতে যাচ্ছে কেমন কিংবা চুন্নী কি মাঈর নতুন নোলক কেমন লেগেছে এইসব ঘরোয়া আলাপে জমিয়ে রাখে নির্জন সন্ধ্যাগুলি। 

বহু মানুষ তো এভাবেই একলা দিন কাটায় রাত কাটায়।
মানুষ কতভাবেই না বেঁচে থাকে এ দুনিয়ার বাজারে!



Previous Post Next Post