হাঁ করে আকাশটা দেখছিল শিবু । টানা চারদিন একভাবে জল পড়ছে । ঘর থেকে বেরুনো যায়নি । আজ একটু ধরেছে যেন সকালটায় । একহাঁটু জল জমেছে জমিতে । ধারদেনায় বীজ বুনেছিল এইবছর । আলপথগুলো অব্দি জলের নিচে। ফসল উঠলে কিছু টাকা আসত হাতে ; এট্টু উপায় হতো । কিন্তু এ যা হলো ! সাইকেলের ট্রিনট্রিন শুনে দূরে তাকালো শিবু ।
- কি গো বিষ্টি ভিজছ ক্যান ?
- ক্যান আর কও ? সব লষ্ট হইং গ্যালো রে । এট্টু আল কাটলাম তাও জল কমে কই ? সব লষ্ট ।
- সেকি তুমার একার ? সব্বার ক্ষতি হইংছে l দ্যাকোনা মাঠের পর মাঠ জলের তলে । সব দেবতার কোপ গো দাদা । দিনেমানে অনাচারের কি আর শ্যাষ আচে ? তুমি আর হেইবেলা ভিজে কি করবা শুনি ? ছাইকেলে এ্যাসো ; বাড়ি ছেড়েং দিব ।
গামছাটা মাথায় বেঁধে ক্যারিয়ারে চেপে বসে শিবু । সাইকেল গড়ায় । লালমাটি আর বৃষ্টি মিশে আঠালো কাদায় ভরে আছে পথঘাট । সাইকেল লাফাচ্ছে । কখনো কাদায় এঁটে বসছে । কাদাজল ছিটিয়ে উঠছে জামাকাপড়ে । আকাশে মেঘটা এখনো ছাইছাই রং । দুর্যোগ কাটেনি । ঝিঁঝিঁদের একটানা ডাকে ভারি হয়ে আছে বাতাস । নর্দমায় কটকটিয়ে ডাকছে ব্যাঙ । তারইমাঝে সাইকেল চলছে ।
শিবুদের দোমেটা চালাঘরটা বৃষ্টি ভিজে একসা । খড় চুঁইয়ে জল নামছে । মাটিতেও জল উঠছে । কোনমতে রান্নাটা চাপিয়েছে লক্ষী। ঘুঁটে কয়লা মজুত নেই । যেটুকু যা ডালপালা ছিল তাই পুরেছে আগুনে । কদিন এভাবে চলবে কে জানে ? ঘরে চালডাল বাড়ন্ত । টাকাপয়সার আকাল । কাত্তিকটা হাসপাতালে পড়ে আছে । অপারেশন করতে দশহাজার লাগবে । কোথা থেকে আসবে অতোটাকা ! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কোমরে গোঁজা বিড়িটা ধরায় শিবু । লক্ষী চোঙ্গায় ফুঁ দেয় । একটেরে ঘরটা ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায় ।
- তুয়ার কানেরগুলা দেকালাম । বইললেক দেড়দুই দিবে ; তারবেশি হবেংলাই । জমিনটায় একগলা জল হইংছে । জল থামলেই খুঁড়ে তুইলবোক ; যেটুকুন আচে । সব জড়িয়ে হাজার সাত হইং যাবেক । বাকিটা ধার লিব ।
লক্ষী ভাতের জ্বালটা বাড়িয়ে দিতেই পড়পড়িয়ে জ্বলে উঠলো আগুন । মাথার ঘোমটাটা সামান্য টেনে মুখ তুলে চাইল । ভাবলেশ হয়ে বলল
- দিবেং লাই । আগের দ্যানা না শুধ্লে দিবেংলাই ।
একএকসময় মিথ্যে শুনতেই আরাম লাগে ।সত্যি শুনলে বুকের ভেতরটা ফাঁকা জমিনের মতো একলা হয়ে যায় । অপারেশন না করলে কাত্তিক আর দাঁড়াবেনা দুপায়ে । ডাক্তার বলেছে শহরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করতে হবে । অনেক টাকার খরচা। মনটা তেতো হয়ে যায় শিবুর । খোঁচাখোঁচা দাঁড়িভর্তি গালে হাত বুলাতে বুলাতে সে তক্তাপোষে শুয়ে পড়ে লম্বা হয়ে ।
কাত্তিকের পায়ে মস্ত বল । এই ছুটছে এমাথা থেকে সেমাথা । তারের খাঁচায় বল ঢুকিয়ে দিল কাত্তিক। হাততালিতে চমকে গেলো শিবু ।
এখন বিকেলের শেষ । মহাজনের বাড়ি হয়ে হাসপাতালে যাবে শিবু । বৃষ্টিটা বেশ ধরে এসেছে । ফসল তুলতে হবে এইবেলা ।
- বাবু যদি তিনটা হাজার ট্যাকা দিতেন । ফসল তো সব নষ্ট হইংগ্যালো ! নইলে আর বেরোক্ত কইরতামনি আপনাগে । ছেলেটা আসপাতালে ; সবই তো জানেন কত্তা ।
- আগের পাওনা না শুধ্লে ট্যাকা পাবিনি শিবে । ট্যাকা তো আর গাছে ফলেনি । নিজে না পারিস লক্ষীকে বল । সেও তো বেশ আচেটাচে । ওকেই পাঠিয়ে দিস ; দেখবো কি পারিটারি । এখন আয় গে । বেরুতে হবে এখুনি ।
দড়াম করে কপাটটা লাগিয়ে দেয় মহাজন । ফাঁকা শেকলটা এমনি এমনি দুলতে থাকে বাতাসে । লক্ষী কি আসবে ? লক্ষী না এলে কাত্তিক কি বাঁচবে ? শিবু এখন কি করবে ? টাকা তো চাই । অনেকগুলো টাকা । কে দেবে ? লক্ষী আসবেনা ? ছেলের জন্যেও আসবেনা একবার ?
২।
খাওয়া শেষ ।লক্ষী উবু হয়ে বিছানা পাতছে তক্তাপোষে । ছেঁড়া শাড়ির আঁচল এখন আলুথালু । শরীর ভাল নেই তার । মনটাও তেতো ।কাত্তিকটা একলা পড়ে আছে । তারউপরে এই মাগী বিষ্টি !একদণ্ড থামেনি দুদিন ধরে । দেশ গাঁ ভেসে যাওয়ার জোগাড় । থু করে জানলা দিয়ে বাইরে থুতু ফেলল শিবু । নিচু হয়ে লম্ফটা নিভিয়ে দেয় লক্ষী । এখনো তার গতর আছে । আগের মতো না হলেও আছে ,পরিষ্কার দেখতে পায় শিবু । ক্ষণিকের জন্যে রক্ত গরম হয় তার । সে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ে । কতকগুলো কটকটি ব্যাঙ চেঁচিয়ে মরছে । এঁটো বাসনগুলো ডাই করে রাখা একপাশে । কিছু একটা লাফিয়ে পড়ল বাসনে ।ঠং করে শব্দ হল খানিক । ইঁদুর হবে । কদিনের বর্ষায় সে বেচারিরাও ঠাঁইনাড়া । মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই আর তারা কই যায় ! অবশ্যি জল যা বেড়েছে তেনাদের উপদ্রবও হল বলে । জলের জীব কিন্তু এই বন্যায় তারাও মানুষের সাথে বাস করতে আসে । ইঁদুর হলে ঠিক ,তেনারা হলেই ভয় । এই রাতে কে কারে দেখবে ! তিনবার হাত চাবড়ে লতা লতা করে গলা হাঁকড়ালো সে । হাতের কাছের গামছাটা নাড়িয়ে হুশহুশ শব্দ করল মুখে ইঁদুর হোক আর তারা ,পালিয়ে যাবে ভয়ে । তক্তাপোষ খাটো । দুইজনে কুলায়না । তবুও শুতে হয় মেঝেতে জল উঠেছে । শুতে গেলে গা মাথা ভিজে যায় । কোনমতে একপাশে ফিরে শুয়ে রয়েছে লক্ষী । শিবু বোধয় জেগেই আছে ঘুমোলে সে নাক ডাকায় । আজ কোন সাড়াশব্দ নেই । দুজনই পাশ ফিরে জেগে রয়েছে একা । ডাঁসডাঁস মশা পিনপিন করছে পায়ের কাছে । হাতের গামছা নাড়িয়ে তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করে লক্ষী ।অসাবধানে পায়ে পা লেগে যায় । শিবু হটাৎ পাশ ফিরে হাত রাখে লক্ষীর গায়ে । লক্ষী অবাক হয় । কাত্তিক বড় হওয়া ইস্তক এমন কখনো হয়নি ।আজ তেরোদিন হাসপাতালে পড়ে রয়েছে ছেলেটা । দুদিন বৃষ্টির জ্বালায় সেমুখো হতে পারেনি তারা। মনটা বড় ভার । গরীবের কতই জ্বালা থাকে । আর আজ শিবু হটাৎ! অবাক হয় লক্ষী ।এখন তার মন নেই এইসবে । পেটেরটা সেধারে একলা পড়ে আছে এখন এসব ভাল্লাগে ! চুপচাপ মড়ার মতো পড়ে রইলো লক্ষী ।নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টাও করলনা । শিবুর গরম নিঃশ্বাস বিরক্ত লাগছিল তার ।শিবু আরো ঘন হল ক্রমশ ।কানের কাছে মুখ এনে বলল
-লখাই ? জেগে আছিস ? লক্ষী উত্তর দিলনা । শিবু মুখ ঘুরিয়ে বলল
-লখাই ট্যাকাগুলান না পেলেং কি কইরে চিকিচ্ছে হবে বল ? তুকে যেতে বলেংছে কত্তা ।তুই গেলেং পুইসা দিবেং ! এতক্ষণ চুপ করে পড়েছিল লক্ষী ।এইবারে সোজা উঠে বসল অন্ধকারে । আগুনের মতো গলা তুলে বলল
-তুই মুর মরদটো বটে ! কি বইলছিস ,মাতার ঠিক আছে ? এই বুড়া বয়সে !ছিঃ !তুর লজ্জা করেং লাই ? অন্ধকারেও এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শিবু ।তার চোখ সয়ে গেছে । লক্ষীকে সামান্য কাছে টেনে আনে সে ।জোর করেই । লক্ষী রাগে ফুলে ওঠে ।নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায় ।অবাক হয়না শিবু । হিসহিসে গলায় বলে
-এ শরীলটায় কি আচে লখাই ? হাড়মাস গুলা পুইড়ে গ্যালে ..কিচু থাইকবেক আর ? এর লগে ছেলেডারে মারবি ? এই শরীলটো লিয়ে ধুইং জল খাবি তুই ? মু তুর মরদ ...মু বলচি তুই সতী । তুই লক্ষী টো মুর ঘরের । উ মহাজন তুকে কিচুই কইরতে লারবে । উ তুকে লষ্ট করতে লারবে । শরীলটো তো সব লয় রে ! তুই মুর লক্ষী । উ তুকে লষ্ট করতে লারবে ।তুই সুদু একবার উয়ার কাচে যা । পুইসা না পেলেং উপারেশন হবেক কি করি বল ? শরীল যদি সুদু কটা হাড়মাসই হবেক , তো তার আবার লষ্ট কি !! মুয়ে আগুন অমন শরীলের ।প্যাটেরটা ঘরে ফিরলে মুদের শান্তি । উ শরীলের লিকুচি করেচে !
৩।
উঁচু গড়ালটায় বসে মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিল শিবু । এখন দিব্যি সর্ষে লাগিয়েছে মাঠে । কচিকচি গাছগুলো হাওয়ায় দুলছে নিজের মতোন করে । এবছর ধান হয়েছে ভালো । সর্ষেও হবে । লক্ষী এখন খিচুড়িইস্কুলে কাজ করে । কত্তাই লাগিয়ে দিয়েছেন । মাস গেলেই নগদ মাইনে । ডিম , খিচুড়ি উপরি । খাওয়াদাওয়ার কষ্ট নেই । শিবুর সংসার চলে যায় । কাত্তিক বল খেলে শ দুশো যা পায় । দিন কেটে যায় । অপারেশনের পর থেকে শিবু আর আগেরমতো খাটতে পারেনা বেশি । মাঠের কাজে মুনিষ লাগায় । কাত্তিকও লেগে দেয় কখনসখন । নিজের জমির ফসল খানি দেখলে বুক ভরে যায় । একটা কিডনি বিক্রি করেও বেঁচে থাকা যায় বলেছিলেন ডাক্তার বাবু । শিবু এখন অনেকবেশি বাঁচে । মাঠের মধ্যে সর্ষেয় ফুল এলে . . . কাত্তিকের পায়ে বল ঘুরলে . . . লক্ষী রান্না সেরে ঘেমেনেয়ে ফিরলে , শিবুর বাঁচতে ইচ্ছে করে । বীজতলায় কচি চারা বেরুলে শিবু বুঝতে পারে বেঁচে উঠছে সেও আরো অনেক বেশি করেই ।
সুচিন্তিত মতামত দিন