পিন্টু ঘোষ
অফিস থেকে বেড়িয়ে একটা চায়ের দোকানে বসল রমেন। সিগারেটটা ধরিয়ে একটা টান নিয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। সারাদিনের একটানা খাটুনিতে শরীরে ক্লান্তি আসে তার, তখন এই সামান্য ধূমপান যেন মহৌষধির কাজ করে। বেঞ্চের একধারে একটু চিন্তিত ভাবেই বসে ছিল সে। সামনেই দূর্গা পুজো ; কেনাকাটাও করতে হবে বিস্তর। অথচ এই সামান্য বেসরকারি চাকরির আয়ে সবকিছু কেনা হয়ে ওঠে না। তাছাড়া মাসের মাস ইন্সুরেন্সে টাকা দিতে হয়। এবার অবশ্য বোনাসের টাকাটা একটু বেশিই পেয়েছে, এটা দিয়ে পুজোটা ভালোই চালানো যাবে। এসব সাত-পাঁচ একভাবে ভাবছিল সে।
"এ্যা বাবু, একটা টাকা দে," বলে কে যেন তার হাত ধরে নাড়ালো,হঠাৎ অনুভব করল রমেন। পিছনে তাকাতেই দেখতে পেল দুটো কঙ্কালরূপী মানবশিশুকে।
" এ...এ বজ্জাত ! পালা ! পালা এখান থেকে ! " চা দোকানি চেঁচিয়ে উঠলো। একটা লাঠি নিয়ে তেড়ে গেল ছেলেদুটির দিকে।
" আরে, ওদের চেঁচাচ্ছেন কেন? কি দোষ করল ওরা? " রমেন দোকানিকে প্রশ্ন করে।
"আপনি জানেন না, এরা ছোটলোকের ছোটলোক। সারাদিন শুধু দাও দাও করে বেড়ায়। "
" চায়ছে তো আমাকে। আপনি অযথা রাগচ্ছেন কেন? "
" তবে জ্বালা পোয়ান ....আমার কি ! " বলে আবার নিজের কাজে মন দিল চা দোকানি।
ছেলেদুটির দিকে এবার ঘুরে বসলো রমেন। তাদেরকে দেখে একটু মায়াও হল তার।
" টাকা নিয়ে কি করবি? "
" ভাত খাব। দ্যা না, দ্যা না একটা টাকা ..."
তাদের কথা শুনে রমেনের নিজের ছেলের কথা মনে পড়লো। সে-ও তো এদেরই বয়সী। সে-ও তাকে জামা কিনে দিতে বলে, খাবার কিনে দেওয়ার জন্য বাজনা ধরে। যদি আজ এদের কোথাও খাবার দিতে পারে....না, না এদের আজ খাওয়াতেই হবে, খাওয়াতেই হবে ---রমেনের মনের ভিতর কে জেনো বলে ওঠে।
" তোরা আমার সাথে আয়। হোটেলে চল। ভাত খাবি। " রমেনের কথা শুনে ছেলেদুটো দুজনের দিকে একবার তাকায়। চোখে চোখে দুজন দুজনকে যেন প্রশ্ন করে, তারপর রমেনের সাথে হোটেলের দিকে এগিয়ে গেল।
হোটেলে দু'প্লেট ভাতের অর্ডার দেয় রমেন। ছেলেদুটোর সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে সে জিজ্ঞেস করে, " তোরা যে এই ভিক্ষা করে বেড়াস, তোদের বাবা কোনো কাজ করে না কেন? "
" বাবা ! আমাদের বাপ কেউ ন্যাই গো বাবু। "
" আর তোদের মা? "
" মা-ও ভিক্ষে করে। অত কতা বলতে লাড়বো না। তুই বাবু আমার কে টা? বলবো ক্যানে? " ছেলেটা একটু তিক্ত ভাবেই উত্তর দিল।
ছেলেটার কথাটা শুনে একটু অবাক হয়ে তাকালো রমেন। ঠিকই তো, সে ওদের কে? কেনইবা জিজ্ঞেস করছে, মনে মনে ভাবল রমেন। কিন্তু তাতে তার কৌতুহল আর বেড়ে গেল। সে শুধু বলল, " না, তোদের সম্পর্কে একটু জানছিলাম আরকি। " ছেলেদুটো এবার একটু স্বাভাবিক হল। খেতে খেতে বলল, " আমাদের বাপ নাই, মা আছে বাবু। ভিক্ষে করে। আমরাও করি। মাজিমুদ্দে ভিক্ষে করি না। "
" কেন ? তখন কি করিস? "
" মাজিমুদ্দে আমাদের বস্তিতে কিছু বাবু আসে। মা'কে লিয়ে যায়। খানিক বাদে মা টাকা লিয়ে ফিরে। তাই পরদিন আর ভিক্ষে করি না। একা থাকতি তকন ভয় লাগত আমার। তারপর এই ভাই হলো। এই ভাইকে লিয়ে তারপর থেকে থাকি। আর ভয় লাগে না। "
ব্যাপারটা বুঝতে রমেনের একটুও দেরি হল না। তাদের খাওয়া হলে সে হোটেল মালিককে টাকা মিটিয়ে দিল। তাদের নিয়ে একটা কাপড়ের দোকানে ঢুকলো। দুটো জামা-প্যান্ট কিনে তাদের দিতেই, তাদের চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ দেখতে পেল রমেন। তাদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বাড়ি যেতে বলল সে।
মোটরসাইকেলের কাছে ফিরে এলো রমেন। এখন সে নিজের মধ্যে কেমন একটা আনন্দ খুঁজে পেল। তার মনের মধ্যে একটা চিন্তা উঁকি দিল এবার। বাড়িতে এই টাকা খরচটা নিয়ে তার স্ত্রী কিছু বলবে না তো? বললেই আর কি ! সেসব সামলে নেবে খন। কিন্তু এই আনন্দ, এই আনন্দ তো সে কখন পায়নি। সে কখনও জানত না দান-ধ্যানে আনন্দ আছে। আজকেই তো সেটা প্রথম উপলব্ধি করল। এসব ভাবতে ভাবতে মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিল সে। একরাশ আনন্দ সঙ্গে নিয়ে সে এগিয়ে চললো বাড়ির দিকে।
কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন