একখানি নিষ্কলুষ প্রাতঃকাল। গঙ্গার ঘাট এখনো জনহীন। সদ্য আবির্ভূত সূর্যের আলোয় আমোদিনী মলত্যাগের উপযুক্ত স্থান খুঁজিতেছে। নদীর তীরবর্তী জঙ্গল অধ্যুষিত স্থানে সে পূর্বে আসে নাই। গতকল্য তাহাকে শ্বশুর ঘর হইতে পলায়ন করিয়া চলিয়া আসিতে হইয়াছে। গৃহস্থ ঘরের বধূকে নদীর ধারের অন্ধকারে রাত্রি যাপন করিতে হইয়াছে। আমোদিনী এই স্থানে আত্মগোপন করিয়া আছে, যাহাতে নৌকা পারাপার আরুম্ভ হইলে সে নদীর অপর তীরবর্তী রেলস্টেশনে গিয়া পিত্রালয়ে যাত্রা করিতে পারিবে। শৌচকর্ম করিবার জন্যে নদীর জলরাশি তে পা ডুবাইয়া তাহার মনে আনন্দ হইল। শিশুকালের সন্তরণ করিবার স্মৃতি জাগরূক হইল। গত সপ্তাহব্যাপি বিকট টানাপড়েন হেতু তাহার মন আর শরীর উভয় ক্লান্ত। বস্ত্র ভিজিয়া গেলে আর শুষ্ক বস্ত্র নাই তাহা লইয়া কোন দ্বিধা না করিয়া, জলে শরীর ভাসাইয়া দিল। নদী তিরস্থ দেবালয়ে মঙ্গলারতি শুরু হইল। ঘণ্টাধ্বনির আকস্মিক শব্দে কবুতর গুলি উড়িয়া গেল। আর পূর্বাকাশে সূর্য পূর্ণ রূপ ধারণ করিয়াছে। পর্যাপ্ত সন্তরণ করিয়া মনের মালিন্য ধুইয়া গেল আমোদিনীর। আঘাটায় উঠিয়া চুল খুলিয়া দিল। সারা অঙ্গ হইতে জল ফোঁটায় ফোঁটায় পড়িয়া পায়ের পাতা ভিজাইয়া দিতেছে।
আমোদিনীর শ্বশুরালয়ে সকলে ক্লান্ত হইয়া নিদ্রার আশ্রয় লইতে যাইলো।তাহারা সারা রাত্রি তাহাদের উন্মাদিনী বধূ টিকে খুঁজিয়া ফিরিতেছে। বয়স্থা মহিলা দিগের চোখে ঘুম নাই। তাহারা হতবাক হইয়া কেবল বাক্যালাপ করিতেছে। তাহাদের মনে হইতেছে যেন টিভির সিরিয়ালের ন্যায় ঘটনা ঘটিতেছে। আমোদিনীর শ্বশ্রূমাতা শয্যাগ্রহণ করেছেন। সাশ্রু নয়নে তিনি বলে চলেছেন “ কত বড় ঘর দেখে মেয়ে আনলাম গো, একটুকুও বুঝতে পারিনি। তাও ভাগ্যি ছেলে পিলে হয়নি।এখন কোথায় গেল কি হল ...বাড়িতে যদি পুলিস আসে? হায় বাসুদেব এও আমার কপালে ছিল”।একটি দুটি প্রতিবেশিনী অতি কৌতুহলে দেখিতে আসিয়াছে কি হইয়াছে? এতো গোলযোগের হেতুকি? কর্তব্য পরায়ণা বয়স্থা মহিলারা জানাইলেন সপ্তাহধিক সময় হইতে বধূমাতা উন্মাদিনী হইয়াছে। সে গ্যাস জ্বালাইয়া অগ্নির নীলবর্ণ দর্শন করিয়া সানন্দে তাকাইয়া সময় অতিবাহিত করিতেছিল। কখনো আবার স্নান করিয়া উপযুক্ত বেশবাস না করিয়া সকলের সামনে আসিয়া উপস্থিত হইতেছিল। মারাত্মক রূপ ধারণ করিল পূর্ণিমার রাত্রি কালে।সারা রাত ছাদে উঠিয়া উচ্চ স্বরে বেসুরে গান গাহিয়া সকলের নিদ্রা হরণ করিয়াছে। উহার পিত্রালয়ে সবিস্তারে বিষয় টি জানানো হইয়াছে। উহার অগ্রজ ভ্রাতা অবিলম্বে চিকিৎসকের কাছে লইয়া যাইতে বলিয়াছে। আমোদিনীর স্বামী আমোদিনীর চিকিৎসার নিমিত্ত অর্থ চাহিয়া থাকায় অগ্রজ ভ্রাতা নিরুত্তর রহিয়াছে। আমোদিনীর স্বামী দূরভাষ নাবাইয়া যখন আমোদিনী কে বেশ উপযুক্ত কথা কহিতেছিল তখন আমোদিনী মেঝেতে চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। স্বামীর কথা শুনিতে শুনিতে ধীর পায়ে স্থান পরিত্যাগ করিয়াছে।পরিবারের সকলে মিলিয়া সান্ধ্যকালীন সিরিয়াল দেখিতে ব্যস্ত ছিল। আমোদিনীর শব্দহীন প্রস্থান কেহ বুঝিতে পারে নাই।
শরীর উৎফুল্ল হইয়াছে আমোদিনীর । তাহার ক্ষুধা পাইয়াছে। কিন্তু সে কি সত্যই উন্মাদ হইয়াছে। চারিমাস অতিবাহিত হল তার স্বামীকে সে এখনো বুঝিতে পাড়িতেছে না। শান্ত হইয়া বসিল আমোদিনী। পিত্রালয়ে ফিরিয়া যাইলে সে কি আশ্রয় পাইবে? পিতাগত হইয়াছেন।সদা রুগ্ন মা শয্যাশায়ী।তাহার বিবাহ হইতেছিল না। সে দেখিতে কুৎসিত। দন্ত পংতি মুখ হইতে বাহির হইয়া থাকে। দেহকান্তি তে কোনরূপ শ্রী নাই। কেশ পাস অপর্যাপ্ত হইলেও তাহার কোন শোভা নাই। আজ অবধি তাহার স্বামী সঙ্গম কালে তাহাকে চুম্বন করে নাই। কিন্তু নিজেকে ‘উন্মাদ’ বলিয়া ভাবিতে তাহার প্রতীতি হইতেছেনা। পূর্ণচন্দ্রের রাতে কোন কালেই তাহার ঘুম আসিতে চাহে না।শিশুকালে সে তাহাদের সামনের উঠানে চাঁদের আলোয় ছুটিয়া ছুটিয়া বেড়াইত।একটি বৃদ্ধ গানের মাস্টার তাহাকে সংগীত শিক্ষার জন্যে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি খুব চেষ্টা করিয়া ছিলেন আমোদিনীর গলায় সুর আনিবার। কৈশোরের শেষের দিন গুলিতে পূর্ণিমার রাতে আর ছুটিয়া বেড়াইত না সে। সুরহীন গান গাহিত উল্লাস করিতে করিতে।তাহার নিজেকে উন্মাদ বলিয়া মানিয়া লওয়া অর্থ হীন বলিয়া মনে হইল। পিত্রালয়ে সে কি বলিয়া ফিরিয়া যাইবে। ‘উন্মাদিনী’ পরিচয়ে।
এখনো নির্জন চারিধার। আমোদিনী গঙ্গার তীর ধরিয়া উত্তর দিক অভিমুখে হাঁটিতে লাগিল। ফেরিঘাট কে পেছনে রাখিয়া সে অজানা পথে অগ্রসর হইল। সিক্ত বস্ত্র সারা শরীর কে জড়াইয়া ধরিয়া রাখিয়াছে। হাঁটিতে অসুবিধা হইতেছে। তাহার বাম দিক দিয়া নদী প্রবাহিত। ডানদিকে একখানি নিম্নবিত্ত উঠান। উঠানে কিছু পোশাক দড়িতে ঝুলিতেছে। আমোদিনীর মস্তিস্কে স্ফুরণ ঘটিল।
আমোদিনীর স্বামীর লোকজন আর পুলিস বহু স্থান অন্বেষণ করিল।
আমোদিনীর পিত্রালয় হইতে অগ্রজ আসিলেন। সবিস্তারে শুনিয়া নিম্নস্বরে স্বীকার করিলেন আমোদিনীর আচরণ পূর্ণ চন্দ্রের রাতে অস্বাভাবিক হইয়া থাকে। অকারণ স্নেহের কারনে পিতা মাতা কেহ চিকিৎসা করেন নাই। কিছু দিন পরে নদীর তীর হইতে পুলিস কিছু পোশাক লইয়া আসিল। সকলেই বুঝিল আমোদিনীর জলে ডুবিয়া মৃতু হইয়াছে। কেবল জাল ফেলিয়া , ডুবুরি জলে নাবাইয়া ও দেহখানি উদ্ধার হইল না। প্রায় ছয় মাস অতিক্রান্ত হইল। আমোদিনীর স্বামীর এক সহকর্মী দূরভাষ মারফৎ জানাইল , সে হাওড়া স্টেশনে নাইটি পড়া এক ভিখারিনী কে দেখিয়াছে। সে রেলগাড়িতেও গান গাহিয়া ভিখখা করিয়া থাকে।সে অবশ্যই আমোদিনী। উত্তরে আমোদিনীর স্বামী জানাইল, “ ওরে আমোদিনী কবে মরে ভুত হয়ে গিয়েছে”।
Tags:
ধারাবাহিক