জয়া চৌধুরী

আজাইরা বাজার কথন /  জয়া উবাচ ৪

রাম /দুই/ দশরথ/ ভগীরথ/ মর্ত্যে/ গঙ্গা/ আনলেন... ছন্দে ছন্দে কবিতাটা বলতে বলতে খসখস করে একশ আর পঞ্চাশ টাকার নোটগুলো গুণে নিল স্বপন। মানে ক্রেতার দেওয়া পাঁচশ টাকার বাকী অংশের ফেরত। তো আর সবাই যা করে তিনি তা কক্ষণো করেন না। আর ঠিক সেজন্যই কড়াকিয়া গণ্ডাকিয়া বাতিল বলে পৌরাণিক তথ্যে গোণাগুণির কাজ চালালেন। আসল ব্যাপারটা হল নজর কাড়া। ভাল করে ভেবে দেখলে নজর কাড়াকাড়ি না হোক নেকনজরে অনেকেই থাকতে চান, আর সব সময় নজরের কেন্দ্রে থাকা একদল মানুষের তো জন্মগত দুর্বলতাই। যদি ভাবেন ফিল্ম স্টারদের একচেটিয়া তাহলে প্রতিবাদ করতেই হয় আমার। মনে আছে বিষেণ সিং বেদীর কথা? আশির দশকে গাভাসকারদের সময়ের মাঝগগনে যিনি প্রাক্তন বোলার হয়ে গিয়েছিলেন? সেই বেদী বিসিসিআই যে পদক্ষেপই নিক না কেন সবেতেই বিরুদ্ধে মত দিতেন। আজকের পাঠকদের কাল্পনিক উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি। ধরুন জাতীয় দলে বিরাট ক্যাপ্টেন। তা কোন ম্যাচ তিনি ব্যথার জন্য খেলতে পারলেন না। তখন নমন ওঝা সুযোগ পেয়ে গেলেন টিমে। সে ম্যাচে তিনি যদি কোনক্রমে ৩০/৪০ রান ঠুকে দেন ব্যস। পরের ম্যাচেই বিরাট কোহলির ব্যথা সেরে গেলে টিমে ফের মনোনয়ন পেলেই বেদী সংবাদপত্রে কোট দেবেন- “নমন বিরাটের চেয়ে ঢের বড় খেলোয়াড়। ওর প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। অবিলম্বে বিনোদ রাই পদত্যাগ করুন। ডালমিয়াকে ফের প্রেসিডেন্ট করা হোক” কেউ যদি মনে করাতে যান ওঁকে যে ডালমিয়া স্বর্গে বোর্ড অফ ক্রিকেট কন্ট্রোল করছেন ইদানীং, বেদী কিন্তু তর্ক চালিয়েই যাবেন। মোদ্দা কথা হল নজর কাড়া। 

তারপর ধরুন গে রাজনীতিকদের কথা। এমনিতে তারা দুই প্রকারের দেখি। একদল গোপনে সিঁদ কাটেন থুক্কু জনগণের মাল হেফাজত করেন আর অন্যদল নজর কাড়তে কাড়তে জনগণকে ফকির বানান। আহা কত মহৎ কাজ বলুন দেখি! টাকা পয়সার কি আদৌ কোন পারমার্থিক মূল্য আছে? তাই ওঁরা টাকা কেড়ে ফকির বানিয়ে জনতাকে ধর্মপথে ঠেলে দেন। নজর কাড়ার উদাহরণ দিতে গিয়ে সাম্প্রতিক কাল থেকেই বেছে নেওয়া যায়। ধরুন দিন রাত শুনছেন দেশে কালো টাকা প্রচুর। সমান্তরাল অর্থনীতিই চলছে কালো টাকায়। মুদ্রাস্ফীতি, বেকারী ব্লা ব্লা ব্লা সব সমস্যার কারণ ওই কালো টাকা। আপনার বাড়িতে কষ্টের জমানো সাদা টাকা আছে আর আপনার প্রতিবেশীর আছে পায়খানার সিস্টার্ন ভর্তি কালো টাকা। যত নষ্টের গোড়া ওই কালো টাকা সরকার উদ্ধার করতে পারছে না কোনভাবেই। কি করবে তাহলে? যাঃ ত্তেরি। দুম করে ঘোষণা হয়ে গেল ব্যাঙ্কে টাকা না থাকলেই তা কালো টাকা। সিম্পিল ব্যাপার। সরকারকে পুলিশ পাঠিয়ে ট্যাঙ্ক ভাঙতেও হল না অথচ কেমন ব্যাঙ্কে কড়কড়ে সাদা টাকা ভরে গেল। অর্থনীতির জটিল সমস্যার কেমন নজর কাড়া সমাধান হল! তারপর বছর ঘুরতেই যদি জিডিপি কম দেখায়, ব্যাঙ্কের সুদের হার কম দেখায়, আবাসন শিল্প সহ বেশ কিছু শিল্পে মন্দা দেখা দেয়, কৃষক ঘটি ঘটি আত্মহত্যা করতে থাকে তাহলে আবার নজর কাড়ুন বুলেট ট্রেন চেপে। মহা ধুমধামে বুলেট ট্রেন এর শিলান্যাস করা হয়ে গেল। চোখ থেকে নজর সরতেই চাইবে না যে জনগণের। মানুষ যেন কোনভাবেই ভুলতে না পারে তারা এক নজর কাড়া দেশচালকের অধীনে প্রজা হয়ে আছে। 

লিখতে গিয়ে মনে পড়ে গেল সেই পঁচাত্তর বছর বয়সী অভিনেতার কথা। তা সে সে রাগী যুবক সময়ের সাথে সাথে আর রাগী যুবক নেই তিনি হয়েছেন সরল নিপাট বৃদ্ধ অভিনেতা । দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিস্ময়কর নীরবতা পালন করলেও যিনি মাঝে মাঝেই নিরাপদ বিষয়গুলি নিয়ে টুইটারে বাণী দেন। এই যেমন আজই পত্রিকায় পড়লাম তাঁর টুইটার বাণী “মেয়েরা আজকাল কত কাজই না করে!”। এই যে যে কোন কারণেই হোক নজরে থাকতে হবে এসব অভ্যেস বরাবরই ছিল। এখন তাতে ধুনোর ধোঁয়া জুগিয়েছে ফেসবুক। বলিষ্ঠ দেশনেতাদের কারণে স্বাধীনতার সত্তর বছর পরে এক কিলো মুরগীর দাম ১৮০ টাকা আর গড়িয়াহাট মোড়ে একটি সুতির কুর্তিও ওই এক দাম। মুড়ি মিছরির একদরের এই যে সাম্যবাদ দেখা দিয়েছে এখানে গরীব মানুষ ক্ষেতে না পাক মোবাইল হাতে রাখছে। আর মোবাইল থাকলেই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। সেখানে “আজ অনেকদিন পরে শশা মুড়ি খেলাম টিফিনে” কিংবা “আত্মীয়ের শেষযাত্রায় আমি ও আমার বৌ” অথবা “রোজ মার্তণ্ড ঠাকুরের ১০৮ বার জপ করবেন ও ছবিটি ১০৮ বার শেয়ার করুন। নইলেই ভস্ম হয়ে যাবেন” ইত্যাদি পোষ্ট আমাদের মনে করিয়ে দেয় “নজর কাড়া” সবার হক। স্বপন করলেই দোষ!!! 

আমার এই লেখাটিও যে ওই উদ্দেশ্যেই! জয় গুরু!




Previous Post Next Post