কিন্তু উৎসবে আপামর বাঙালি এক হয় কিনা বা আদৌ হতে পারে কিনা তাতে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকেই যায়। আসলে এই তেরো পার্বণ হলো কিছু গন্ডিবদ্ধ আর গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের নিজস্ব কায়দায় আনন্দ উদযাপন যেখানে সমগ্র বাংলার বাঙালি কোনোদিন এক হতে পারেনা। বাংলার সমাজে হিন্দু ,মুসলিম,উচ্চবর্ণ,নিম্নবর্ণ,ধনী,নির্ধন প্রত্যেকের নিজস্ব বৃত্ত, নিজস্ব আলাদাকৃষ্টি ও তার প্রকরণ রয়েছে তাই বাঙালির আজও কোনো জাতীয় উৎসব নেই। যে দুর্গাপুজো নিয়ে বাঙালির এতো গৌরব, সেই পুজোর ইতিহাস সন্ধান করতে গেলে দেখা যায় একসময় সাবেকি ঠাকুরদালানগুলোয় নিম্নবর্ণ অন্ত্যজ শ্রেণীর প্রবেশাধিকার ছিলোনা। এমনকি তাদের ছায়াতেও অশুচি হতো মণ্ডপ। যে দশটি স্থানের মাটি দিয়ে দুর্গাপ্রতিমা গড়বার বিধান তার একটি হলো গণিকাবাড়ির মৃত্তিকা। তবুও কোনো গণিকা কখনো পুজো উদ্বোধনে আমন্ত্রিত হয়েছেন বলে এযাবৎ শোনা যায়নি। উৎসবের আলোকসজ্জায় অবশ্য শহরের ফুটপাথে বাস করা মানুষগুলোর মাথার ওপরের বিবর্ণ ত্রিপলগু লোকে রঙীন করে তোলে আর ছেঁড়া-ফুটোগুলো ঢাকা পড়ে যায় বেশ। ওদের শিশুদের মলিন জামাগুলো ও অদ্ভুত উজ্জ্বল দেখায়। ঢাকের আওয়াজে ক্ষুধার্ত শিশুগুলোর কান্নাও শোনা যায়না আর!
কালপ্রবাহে বর্ণভেদের কঠোর নিয়ম কিছুটা শিথিল হলেও উৎসবে রয়ে গিয়েছে অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজনের সেই অদৃশ্য লক্ষ্মণরেখা, সে ঈদেই হোক কিংবা দুর্গাপুজোয়। এই বাংলার ইতিহাস তথা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস-ই বর্ণভেদের ইতিহাস যে কারণে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীবদ্ধতা, ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতা এবং ভিন্ন ভিন্ন উদযাপন। সব বাঙালির কাছেই তাই তাদের নিজের নিয়ম-কানুন আর উদযাপন-ই সেরা সংস্কৃতি। সেই কারণেই বোধহয় আত্মগরিমায় ভরপুর তথাকথিত শিক্ষিত শহুরে বাঙালির এক বিরাট অংশ পুজোর দিনগুলোয় ইতি-উতি বিরিয়ানি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ভাবেন কোটিটাকার বাজেটের থিমপুজোর দ্বারা কত গরিবের কর্মসংস্থান করছেন তাঁরা। প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি মূল্যের সোনার শাড়ি বানানোর বরাত পাওয়া উদ্ধত বাঙালি ডিজাইনার করুণারসমিশ্রিত কণ্ঠে সিটিগোল্ড পরিহিত বেচারা বাঙালিদের দের সম্বোধন করেন "পাবলিক" । তাঁকেই বা দোষ দি কেন! এ ঐতিহ্য তো সেই আদিকাল থেকেই বহমান। অবিভক্ত বাংলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণের ষোড়শ শতাব্দীতে আটলাখি দুগ্গিপুজোর কথা যদি বাদ -ও দি, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং কলকাতায় রাজা নবকৃষ্ণের পুজো উপলক্ষে আড়ম্বর, বিলাস-ব্যসন এবং আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল সামাজিক প্রতিপত্তি, ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য প্রদর্শনেরই মাধ্যম । সেই সময়ে শুরু হয় বাই-নাচ, খেউড় , ভাঁড়ামো ইত্যাদি। অত ঐশ্বর্য প্রদর্শনের ক্ষমতা সাধারণ বা নিম্নবিত্তদের মধ্যে ছিলনা কিন্তু ভোগ বিলাস আমোদ প্রমোদের অন্তর্নিহিত সুপ্ত বাসনা ছিল। আর সমাজের নিয়মই হলো সুস্বাস্থ্যের চেয়ে অসুখ সংক্রামিত হয় সহজে, কাজেই উঁচুতলার ভোগবিলাসের আমোদ-প্রমোদের সেইসব অসুস্থতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মধ্যে এবং প্রধানত: আমাদের উদ্দেশ্যেই জায়গায় জায়গায় বারোজন ইয়ার-বন্ধু বা তার বেশিজন মিলে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চাঁদা তুলে শুরু হয় বারোয়ারি পুজো।
সেই আদ্যিকাল থেকে মাঝে সাবেকিয়ানার মোড়ক আর থিম-উদ্গীরণ পেরিয়ে এখন কনসেপ্টের যুগ। স্বপ্নের জগত ছোঁয়ার এক দুরন্ত প্রতিযোগিতা। ব্যক্তিস্তর থেকে উত্তীর্ণ উৎসব আজ বিশ্বজনীন। কিন্তু তবুও আমাদের এই উৎসবের মূল সুর যে সকলকে সমানভাবে স্পর্শ করেনা, সকলের আত্মা এক সুরে মিলিত হয়না সেটা স্বীকার করবার মতো শিক্ষিত যতদিন না আমরা হয়ে উঠতে পারবো ততদিন সব উৎসব-ই কোনো না কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের উৎসব হয়ে থেকে যাবে সমাজে । প্রকৃত উৎসব আর হুল্লোড়-হুজুগের মাঝে কোথায় যেন একটা মনোজাগতিক দূরত্ব রয়েই যায় ।