না সত্তরটা বছর খুব একটা কম কথা নয়। ব্যক্তি মানুষের জীবনে প্রায় পুরো একটি আয়ু। জাতির জীবনে সেরকম কিছু না হলেও, একটি রাষ্ট্রের জীবনে সত্তর বছর খুব একটি কম সময়ও নয়। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের গতি প্রকৃতি তার অভিমুখ এবং শক্তি ও দূর্বলতার দিকচিহ্নগুলি সাতটি দশকে বেশ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বৃটিশের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে গঠিত ভারতবর্ষ নামক এই রাষ্ট্রটির ক্ষেত্রেও সেটাই দেখা যায়। বিগত সত্তর বছরে ভারতবর্ষের ভিতর নানান রকমের পরিবর্তন বিবর্তন ইত্যাদি ঘটে চলেছে। কিন্তু তাসত্ত্বেও গণতন্ত্রের ভিতটা এখনো একই রকম রয়ে গিয়েছে। অনেকেই আশ্বস্ত হবেন সেই কথা মনে করে। যদিও এই বিষয়ে আশ্বস্ত হওয়ার মতো বিশেষ কিছুই নাই। কেন নাই কিভাবে নাই, সেই আলোচনায় আসা যাবে সময় মতো। কিন্তু তার আগে বলে নেওয়া ভালো যে বিগত সাত দশকে ভারতবর্ষ ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদের অন্যতম পীঠস্থান হয়ে উঠেছে আজ। এই কথা উল্লেখ করার কারণ এইটাই যে আজকের ভারতবর্ষের মূল গুরুত্ব ধনতান্ত্রিক পুঁজির এই অন্যতম পীঠস্থান হয়ে ওঠার মধ্যেই। যদি সত্যি করেই প্রশ্ন করা যায় যে বিগত সাত দশকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়ো অর্জন কি? তবে তার একটিই উত্তর হতে পারে। সেটি হল, এই ধনতান্ত্রিক পুঁজির অন্যতম বৃহৎ পীঠস্থান হয়ে ওঠাই। এখানেই বিগত সত্তর বছরের মূল সাফল্য।
কিন্তু এই সাফল্যে রাষ্ট্রের ভুমিকা কি? রাষ্ট্রের ভুমিকাই হল পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করা। সর্বশক্তি দিয়ে। যদিও রাষ্ট্রীয় সংবিধানে রাষ্ট্রের নাগরিকের স্বার্থরক্ষার অঙ্গীকার করা হয়েছে, কিন্তু আসলেই তা পর্যবসিত হয়েছে পুঁজির স্বার্থরক্ষা করাতেই। এখন রাজনৈতিক দলগুলি এই কথাই প্রচার করতে চায় মূলত যে; পুঁজির স্বার্থরক্ষা হলেই নগরিকের স্বার্থরক্ষা। অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে চুঁয়ে পড়া সুবিধা বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ সেই সামন্ততান্ত্রিক ধারণা। যে অঞ্চলের সামন্তপ্রভুর ধনৈশ্বর্য্য যত বেশি হবে, সেই অঞ্চলের গরীব জনসাধারণ তত বেশি ভিক্ষার ধন লাভ করবে প্রভুর প্রসাদ হিসাবে। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থারও মূল কথাও কিন্তু ঠিক সেটাই। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে। দেশের কোটিপতিরা যত বেশি ধনী হয়ে উঠতে থাকবে, দেশের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির সাথে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী জনসাধারণও তত বেশি ভিক্ষার প্রসাদ লাভে সমর্থ্য হতে থাকবে। এবং সেটিকেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে ভোটের প্রচারে কাজে লাগানো সহজ হবে। ভারতবর্ষের বিগত সাত দাশকের ইতিহাসও এর থেকে ভিন্ন কিছু নয়। ভারতবর্ষের সাফল্য এই ইতিহাসকেই একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াতেই। ঠিক সেই কারণেই এক দিকে বিপুল বৈভব ও আর একদিকে সীমাহীন দারিদ্র্য নিয়েও ভারতবর্ষ নিরুপদ্রবে দেশীয় জনগণের উপর অর্থনৈতিক শোষণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।
এখন দেখার বিষয় এই যে, ঠিক কিভাবে চলছে এই অর্থনৈতিক শোষণ প্রক্রিয়া? বিশ্বের ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি যেমন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকেই বেছে নেয় অর্থনৈতিক শোষণের পীঠস্থান হিসাবে, ভারতীয় পুঁজিপতিরা ঠিক সেইভাবেই নিজের দেশটিকেই বেছে নিয়েছে অর্থনৈতিক শোষণের পীঠস্থান হিসাবে। এবং বিশ্ব পুঁজির সাথেই হাত মিলিয়ে অত্যন্ত সুচতুর ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের এই শোষণ প্রক্রিয়া। আর ভারতীয় রাষ্ট্রকাঠামো সেই শোষণ প্রক্রিয়ার বিশ্বস্ত দারোয়াণের কাজ করে চলেছে অত্যন্ত সততার সাথে। হ্যাঁ এটাই সত্তর বছরের ভারতীয় ইতিহাসের ধারাবাহিক প্রতিচ্ছবি। এবং বিদেশী পুঁজির মতোই দেশীয় পুঁজিপতিরা দেশের সম্পদ লুন্ঠনজাত মুনাফা জমা করছে বিদেশের অর্থভাণ্ডারেই। রাষ্ট্র প্রতিবছর দেশীয় পুঁজিপতিদের লক্ষ লক্ষ কোটিটাকার অনাদায় ঋণ মকুব করে দিয়ে, এই লুন্ঠন প্রক্রিয়ায় বিশ্বস্ত অনুচরের মতো কাজ করে চলেছে। হ্যাঁ এটাই সত্তর বছরের প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস। আর এই প্রক্রিয়া সবচেয়ে বেশি গতি পেয়ে গিয়েছে বিশ্বায়ণের ঢক্কানিনাদের শুরুর পর্ব থেকেই। আর্থিক সংস্কারের নাম দিয়ে রাষ্ট্র যে কাজে পুঁজির স্বার্থে অতন্দ্র প্রহরীর মতো সদা সতর্ক!
কিন্তু প্রশ্ন হল ভারত তো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেখানে সত্তর বছর ব্যাপি এই ধারাবাহিক ইতিহাস নিরুপদ্রবে চলছেই বা কি করে? এর উত্তর প্রথমেই দেওয়া হয়েছে। বিগত সাত দশকে ভারতবর্ষের বিবর্তনের মধ্যে গণতন্ত্রের ভিতটা ঠিক একই রকম রয়ে গিয়েছে। সাধারণ ভাবে অনেকেরই কাছে যেটা সবচেয়ে বড়ো সস্তিদায়ক খবর। কিন্তু ঠিক কাদের কাছে? এই গণতন্ত্রকে যারা নিজেদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে আসছেন তাদের কাছে। আর যারা সাধারণ জনগণ, রাজনৈতিক প্রচার যন্ত্রে আপন মস্তিষ্ক বন্ধক রাখার মধ্যেই যাদের ভবিতব্য, তাদেরও কাছে। উভয়ের কাছেই গনতন্ত্রের এই ভিতটা স্বস্তিদায়ক। ফলে ভোটের বাক্সে কখন কাদের জেতাতে হবে, ও কিভাবে জেতাতে হবে, সেটি যখন যারাই ঠিক করুক না কেন, ভারতীয় জনগণের রায় তাদের পক্ষেই বিশ্বস্ত থাকবে। আর যদি রাজনৈতিক ডামাডোলে সেই রায় স্বার্থরক্ষাকারী শ্রেণীর হাত ফস্কে পিছলিয়েও যায়, তাতেও অসুবিধা নাই। ঘুর পথে সেই রায় হাইজ্যাক করে নেওয়ার মতো দরদী সংস্থান ভারতীয় সংবিধানের পাতাতেই মজুত আছে।
বস্তুত ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহনকারী সমস্ত রকমের রাজনৈতিক দলগুলির শ্রেণীচরিত্র উনিশবিশ একই রকমের। ফলে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থও যে একই মাত্রার হবে, সে আর বিচিত্র কি। তাই কথায় বলে যে যায় লংকায় সেই হয় রাবণ। অর্থাৎ ক্ষমতার মসনদে বসে রাজকোষের উপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ধনতান্ত্রিক পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করাটাই সমস্ত রকমের রাজনৈতিক শিবিরভুক্ত দলগুলির মুখ্য উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্যের জন্যে গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতিটিও এমন ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে, গণতন্ত্রের ভিতটা পুঁজিবাদী শোষণ ব্যবস্থার স্বার্থরক্ষায় যেন দৃঢ় ভাবে কাজ করে চলে। আর সেই সাফল্যকেই ভারতীয় গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ সাফল্য বলে গালভরা প্রচার যন্ত্রে ঢালাও ভাবে প্রচারিত করা হয়ে চলেছে বিগত সাতটি দশক ধরে। ভারতীয় স্বাধীনতার এটাই দ্বিতীয় সাফল্য।
অর্থাৎ মূল বিষয়টি কিন্তু আদতেই, বিশ্ব পুঁজির স্বার্থরক্ষায় দালালি করার স্বার্থেই ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল গুরুত্ব। ১৯৪৭ সালেই যার মূল অভিমুখ ঠিক করে দিয়ে তবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে গিয়েছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ। আর আজকে বিশ্বায়নের বিশ্বায়িত বিশ্বে একমেরু ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের একচেটিয়া কারবারের হাঁড়িকাঠে গলা দিয়ে বসে আছে সেই ভারতবর্ষই। স্বাধীনতার সাত দশকে ভারতবর্ষের যা শ্রেষ্ঠ অর্জন। কিন্তু কি হতে পারে এর পরিণতি? আসলেই সেটি অর্থনীতিবিদদের গবেষণার বিষয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। একটি কথাই শুধু আমরা ভেবে দেখতে পারি। আর সেটি হলো, লাতিন আমেরিকার দেশগুলির পরিণতি। মার্কীণ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে মার্কীণ পুঁজির লীলাক্ষেত্র হিসাবে এই ভুখণ্ডের দেশগুলির পরিণতিই কি ঘটতে চলছে আমাদের? একটি কথা সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়, সেটি হলো, দেশীয় সম্পদের লুণ্ঠনের পরিণতিতে একদিন ভারতবর্ষ যখন ছিবড়ে হয়ে যাবে, তখনই এই গণতন্ত্রের অবসান অবধারিত। না তার মানেই এই নয় যে সেদিনই বিশুদ্ধ আসল গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটবে ভারতীয় ভুখণ্ডে। বিষয়টি আদৌ সেরকম সহজ নয়। কিন্তু এই মেকী গণতন্ত্রের খোলসাটা খুলে গিয়ে বেআব্রু হয়ে পড়বে সমগ্র ভারতবর্ষএর আসল চেহাড়া। মানুষের চোখের সামনে থেকে উঠে যাবে মিথ্যার পর্দা। মানুষ ভাবতে শুরু করতে পারে সেইদিন, এবার কি করা? তার আগে ভারতবর্ষ যে পথে চলছে, চলবে সেই পথেই। জনগণের বুকের উপর দিয়ে ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদেরর জয়রথ হাঁকিয়।