সুশান্ত কুমার ঘোষ

লাঠি
এক।

ঘানির বলদের মত ঘুরতে ঘুরতে হাঁপিয়ে উঠলেন অবনী বাবু । মাঘের অপরাহ্নেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে । অবনী মন্ডল এখন পঁচাত্তর । যার সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায় তাঁকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে , তার পথ চলার বয়স কিন্তু পঁচাত্তর দিনও পূর্ণ হয়নি ! কিন্তু পৃথিবীর আলো দেখার এক বছর দু’মাসের মাথায় বিশ্ব সংসারে আপনাকে জাহির করার এই আশ্চর্যতম কৌশলটি আবিষ্কার করার পর গতির নেশায় সে এমন মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে , তাকে থামানোই দায় । পুতিনের গতির পুলকে বুড়ো পাখানাতেও ঝড় উঠেছে । পুতিন বৃষ্টির খুশির হাওয়ায় অবনী বাবুর পাখায় শব্দ তুলছে সাঁই সাঁই । হঠাৎ থমকে দাঁড়াল বৃষ্টি ! সামনে তার বিন্ধ্যাচল ! অবনী বাবুর মেজছেলে গদাধর বৃষ্টির সামনে এসে দাঁড়ানোয় ছন্দটা কেটে গেল । অবনী বাবুও মেরুদন্ড সোজা করে সামনে ধুমকেতুর মত মধ্যম পুত্রকে আবির্ভূত হতে দেখে চমকে উঠলেন !গদাধর তাঁর ঔরসজাত পুত্র , চোখের আরাম , মনের শান্তি । তাকে দেখে অবনী বাবুর অন্তর্দেশে বৈকুণ্ঠের শান্তি নামার কথা । কিন্তু ঘটল উল্টো।

অবনীবাবুর তিন পুত্রের দ্বিতীয় পুত্র গদাধর যৌথ পরিবারে যমের বোঝা টানতে অস্বীকার করে বছর খানেক আগে সংসার ছেড়ে বেড়িয়ে এসে পৃথক সংসার পেতেছে । পরিবারে পুত্র সন্তান একমাত্র গদাধরের । বড়দা গোলোকের তিনটি কন্যা । ছোটো ভাই বিষ্ণুর দুটি কন্যা । পরিবারের এই পঞ্চকন্যাকেই গদাধরের যমের বোঝা মনে হয়েছিল । তার যুক্তি ছিল যৌথ পরিবারে থাকলে মেয়ে বিকোতেই বিকিয়ে যাবে সব । এখন থেকে পথ না দেখলে , শেষে তার ছেলেকেই পথে বসতে হবে । পাড়াপড়শির মজলিস , কলতলা পুকুর ঘাট , চা দোকান, ক্লাবে ক্ষেত- খামার শিবতলা ষষ্ঠীতলা দুর্গা মন্দির থেকে দাম্পত্যের খুনসুটি -স্বামী স্ত্রীর যৌথ প্রচেষ্টায় পথ খোঁজার কাজটা অনেক দিন ধরেই চলছিল । সুযোগটা এল অতসীর আঁতুর বিদায়কে কেন্দ্র করে । অতসী অবনী বাবুর বড় নাতনি , বৃষ্টির মা । বৃষ্টির বয়স তখন দু’মাস সাতদিন । মাসের হিসাবে তিনমাস । অতসী সন্তান কোলে ফিরে যাবে শ্বশুর বাড়ি ।

মেয়েকে সন্তান কোলে শ্বশুর বাড়ি পাঠানোর সময় কিছু আনুসঙ্গিক উপকরণ সঙ্গে দেওয়াই নিয়ম সংসারে । গোল বাঁধল তাই নিয়ে । গদাধরের যুক্তি ছিল , বিয়ের বছর ঘুরেছে সবে । বিয়ে বাবদ ঋণের দগদগে ঘা এখনো পরিবারের সর্বাঙ্গে । আবার তাকে নতুন করে এসব দিতে যাওয়া মানে মহাজনের কাছে হাত পাতা । এতে তার মত নাই । অবনীবাবু গদাধরকে উপেক্ষা করে সামাজিকতা বজায় রাখলেন । উপেক্ষিত গদাধর আঁতুড় বিদেয়ের পরদিনই যৌথ সংসার থেকে বিদেয় হতে চাইল । অবনীবাবু বাধা দিলেননা । দশমুখে দশ রকম কথা তিনি অনেক আগে থেকেই শুনছিলেন । মুখে কিছু বলেননি । সেদিনও বললেননা । কৃষি জমির একের চার অংশ তাকে চাষ করার মৌখিক অনুমতি দখল দিলেন । গদাধর আপত্তি জানিয়ে বলেছিল- ‘ চার ভাগ কেন? পাব তো তিন ভাগের একভাগ ।‘ জবাবে অবনীবাবু বলেছিলেন – ‘ আমরা দুই বুড়ো বুড়ি এখনো মরে যাই নাই । আমাদেরও দু’বেলা দু’মুঠো দরকার । আজ তুই গেলি । কাল ওরা যাবে । আমাদের কি হবে । একটা ভাগ রইল আমাদের । মরলে নিবি ।‘ গদাধর তার নামে পাকা দলিল করার জেদ ধরেছিল । অবনীবাবু রাজি হননি । বলেছিলেন- ‘ লিখতে কেন হবে । আমি মরলে ও সব এমনিতেই তোদের হবে ।‘ গদাধর বেড়িয়ে এসেছিল সংসার থেকে । খামার বাড়িতে নতুন কোঠাবাড়ি তুলেছিল । সংসারের ঋণের দায়ও তাকে নিতে হয় নাই । এক বছরের মধ্যে সংসারটা বেশ গুছিয়ে নিয়েছিল । ওদিকে অবনীবাবু শয্যাশায়ী সহধর্মিণী , দুই পুত্র পুত্রবধু এবং নাতনিদের নিয়ে রৌদ্র-ছায়া , ঝড়- ঝঞ্ঝায় সুখ দুঃখের মধ্য দিয়ে অভাবগ্রস্ত কিন্তু সুখী পরিবারটিকে বুড়ো হাড়েও নির্ভারে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ।

সংসারের অর্ধেক আয় ব্যধিতে খেলেও ছেলেরা কখনো হাসতে ভোলেনি , গোমরা হয়নি দুই বউয়ের মুখ । নাতনিদের ত্বকের চিক্বন, চুলের বাহারে খামতি পরেনি । অবনীবাবুর স্ত্রীর হার্টের ব্যামো । এরমধ্যে তাকে দু দু’বার নিয়ে যেতে হয়েছে নার্সিং হোমে । দুই ছেলে চড়া সুদে অর্থ জোগার করে , নার্সিংহোমে রাত জেগে মাকে সুস্থ করে ঘরে এনেছে । ঘরের মধ্যে বউমা নাতনিরা দিন রাতের নিপুণ সেবায় তাকে সারিয়ে তুলেছে । রোগীর পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকলেও অবনীবাবুর যত্নে কোনো ত্রুটি হয়নি । মেজ বউমা এসেছে , দু’চারটে ছোড়াছোড়া কথা বলে দায় সেরে চলে গিয়েছে । গদাধর একবারের জন্যও দেখতে আসেনি মাকে । সেই গদাধর এতদিন পর সামনে এসে দাঁড়ানোয় ভূত দেখার মত চমকেই উঠলেন অবনীবাবু !

গদাধর কিছুমাত্র ভূমিকা না করে বাবার চোখে চোখ রেখে বলল- ‘শুনলাম সমবায়ে ধান বিক্রির টোকেন দিয়েছে আজ ?’ ‘ হ্যাঁ , গোলোক গিয়েছিল পঞ্চায়েতে । পনের বস্তার টোকেন দিয়েছে । পৌঁছে দিতে হবে ধান , চালকলে । বস্তায় পাঁচ কেজি বাদ। ধুতে বাছতেই যাবে সব । ঘুরে ফিরে দাম সেই ছ’শই !’ ধান নিয়ে চাষীরা এবার বেশ লাচারে পরেছে । ধানই ওদের পেটের ভাত , বুকের বল । সেই ধানের বাজার একেবারে তলানিতে । খোলা বাজারে হাজার টাকা কুইন্ট্যাল । তাও গরজের দাম । সারের বস্তা চোদ্দ’শ । শ্রমিকের মজুরি আড়াই’শ । খরচ ওঠেনা চাষের । সংসার চলবে কেমন করে ! মহাজনের ঋণ নিয়ে যারা চাষ করেছে , তাদের অবস্থা আরও খারাপ ।বাজার মান্দা বুঝে চাষীর খামার থেকেই মেপে নিয়েছে সাত’শ টাকা কুইন্ট্যালে । সহায়ক মুল্যে ধান কিনছে সরকার । কুইন্ট্যাল প্রতি দাম দিচ্ছে ১৪৫০ । কিন্তু তার বরাত পাওয়া চাষীদের কাছে চাতক পাখির স্ফটিক জলের থেকেও দুর্লভ । অবনীবাবু পেয়েছেন বিঘা প্রতি এক বস্তার বরাত । গদাধর সংসার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও , জমি জায়গার বন্টননামা হয়নি । জমির মালিক অবনীবাবু । তাই সহায়ক মুল্যে ধান বিক্রির টোকেন হয়েছে অবনীবাবুর নামে । সেই বরাতের ভাগ বুঝে নিতেই ছুটে এসেছে গদাধর । ‘আমিও তো ভাগ পাব কুপনের । আমার ধান নিতে হবে পাঁচ বস্তা।‘ গদাধরের কথা শুনে পড়ন্ত বিকেলেও আগ্নেয়গিরির মত জ্বলে উঠল অবনী বাবুর চোখ দুটো । ‘ভাগ ! কোন ভাগের কথা বলিস গদা ! মরতে বসা মাকে যে ছেলে একবার চোখের দেখা দেখতে আসেনা , তার আবার ভাগ কিসের ! ও জমিতেও তুই আর চাষ দিবিনা । আমি মরলে ভাগ নিস জমির ।‘ বলে , বৃষ্টিকে কোলে তুলে ঢুকে গেল ঘরে । গদাধর গুমোট মেঘের মত কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে ঝড়ের মত উড়ে গেল ।

দুই।

অবনীবাবু উঠোনেই ছিলেন । পুতিনের দৌড় তখনো শেষ হয়নি । সংসার তাপে দগ্ধ বৃদ্ধের প্রাণশক্তি নেতিয়ে পরলেও , সদ্য জগৎ সংসারে আসা নিষ্পাপ বৃষ্টির প্রাণ চঞ্চলতায় তার কোনো প্রভাব পরেনি ।বাইরের থেকে এসে বৃষ্টি দৌড়চ্ছিল উঠোনে । অবনীবাবুও ঘুরছিলেন তার পিছু পিছু ; তবে যন্ত্রের মত । পূর্বের মত সাবলীলতা আর ছিলনা । দিনু রায়ের কর্মচারীকে ঘরে ঢুকতে দেখে ঘুরে দাঁড়ালেন অবনীবাবু । ‘ আয় মোহন !’ ‘ হ্যাঁ , কাকা , এলাম একবার তোমার কাছে । দিনুদা পাঠালে ।‘ দিনু রায় গ্রামের ছেলে । লটকোনা দোকান আছে , রেশনের ডিলার শিপ আছে , কৃষি শস্যের ব্যবসাও করে । কর্জে বীজ সার দেয় , বিনিময়ে ফসল মেপে দেয় চাষীরা । এবার রবি চাষের সময়েও দিনুর কাছে কর্জে বীজ সার নিয়েছেন অবনীবাবু । কিন্তু স্ত্রী কে নিয়ে বিড়ম্বনায় পরায় , দিনুর ঋণ পরিশোধ করা হয় নাই । তাগাদাও দেয়নি দিনু । অবনীবাবুই একদিন দিনুকে বলে এলেন –‘ বাবা দিনু , তোর ধানটা দেওয়া হল না । ধানের দামও নাই ।তার উপর তোর জ্যেঠুমাকে নিয়ে বেশ ভুগছি । এতদিন যখন ফেলে রাখলি , আর দুটো মাস সবুর কর বাবা । ধানের দরটা যদি ওঠে একটু ...’ ‘সে তুমি রাখো জ্যেঠা , ধান এখন বেঁধে রাখ । আষাঢ় শ্রাবণে দিও । দাম তখন ভাল পাবে । আমি না হয় আলু মেপে নেব ।‘ সেই দিনু ......... অবনীবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে কিছু একটা ভাবলেন । তারপর কোমরে হাত রেখে বললেন-‘ হ্যাঁ বাবা মহন , বল , কি বলবি ।‘ ‘ কাল তো সমবায়ে ধান দেবে ? তাই দিনুদা বলছিল , ওর পাওয়ানাটাও...’ অবনীবাবু শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালেন একবার । তাঁর চোয়াল ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠল । গোলায় আছে ষাট বস্তা ধান । সংসারের খোরাকিতেই লাগবে তিরিশ বস্তা । পনের বস্তা যাবে কাল সমবায়ে । তাতে কতটুকু ঋণ আর শোধ করা যাবে ! দিনুর পাওনা মেটাতে মাপতে হবে কুড়ি বস্তা । তার উপর চাষের খরচ আছে । ঘরে রোগী । তার ওষুধ পথ্য । প্রতিদিনের সংসার খরচ , দায় , বিপদ ...... অবনী বাবুর মুখের বলিরেখা লৌহ শলাকার মত ঋজু হয়ে উঠল । পাথরের মত চোখ দুটো আকাশের দিকে স্থির রেখে বললেন – ‘বলিস দিনুকে , কাল মেপে নেবে ধান।‘ 

মোহন চলে গেল । দাদাঠাকুরের উদাসীনতায় বৃষ্টি উৎসাহ হারিয়ে উঠোনের একপাশে ছাগলের সদ্য ত্যক্ত বিষ্ঠার স্বাদ গ্রহনে মনোযোগ দেয় । অবনীবাবু নির্বিকার ! শূন্য দৃষ্টিতে আকাশ পানে চেয়ে কোমরে হাত রেখে পাথুরে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলেন । নাতনি অতসীর ডাকে সম্বিৎ ফিরল তার । ‘ দাদু , কে ডাকছে দেখ তোমাকে’। অবনীবাবু পিছন ফিরে দেখেন একটা আঠার উনিশ বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে । তার হাতে ভাঁজ করা একটা কাগজ । কাগজটা অবনীবাবুর হাতে দিয়ে বলল ‘ পলাশ দা সন্ধ্যায় পার্টি অফিসে ডেকেছে সালিসির জন্য । গদাই দা নালিশ করেছে । ধান আর জমির ভাগ নিয়ে ফয়সালা হবে । ঠিক সাতটায় । পলাশদার হুকুম ।‘ অবনীবাবু এতক্ষণ ঝড়ের মেঘের মত থম মেরেছিলেন । ভিতরের বাষ্প সঞ্চয়নে সেতা বিস্ফোরণের অবস্থাতেই পৌঁছে গিয়েছিল ! ছেলেটির কথার অনুঘটনে আছড়ে পড়ল টর্নেডো ! হাতের নোটিশটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন উঠোনে । ‘ বিচার ! কার বিচার ! কিসের বিচার ! আমার ধান , আমার জমি । আমি যাকে ইচ্ছা দেব । পলাশ বিচার করার কে ! বিচারের জন্য আইন আদালত আছে ;জর্জ ব্যরিস্টার আছে । বিচারের ক্ষমতা পার্টিকে কে দিয়েছে !’ বেগতিক দেখে ছেলেটি চলে গেল ।অতসী দাওয়ায় এনে বসালো দাদুকে । ছোটো বউ জল এনে দিল । পুরো একঘটি জল ঢকঢক গলায় ঢেলে তবেই স্বাভাবিক হলেন অবনীবাবু । 

তিন ।

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল । ছেলেরা যে যার কাজ সেরে ফিরে এলো ঘরে । অবনী বাবু দাওয়ায় বসে ঘটনার অদ্যপান্ত বিবরণ শোনাচ্ছিলেন দুই ছেলেকে । দুই ছেলে সালিসি সভায় যেতে চাইল । অবনীবাবু গেলেন না । ছেলেদেরও যাওয়ার অনুমতি দিলেননা । অনুমতির অবশ্য প্রয়োজন হলনা । অবণীবাবুর অনুমতি ছাড়াই পুরো পার্টি অফিসটাই উঠে এলো তাঁর উঠোনে । শুরু হল তান্ডব ! গালিগালাজ , চিৎকার চেঁচামেচি , লাঠালাঠি –হাতাহাতির দাপটে মাঘ সন্ধ্যার নক্ষত্র খোচিত আকাশের নীচে অবনী মন্ডলের আলো আঁধারি ছোট্ট উঠোনটি যেন কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠল । ধাক্কাধাক্কিতে অবনীবাবু পরে গেলেন মাটিতে । পাশেই ছিল লাঠিটা । তাঁর দাদুর হাতে তৈরি পাঁচ সের ওজনের শক্ত একটা লাঠি । অবনীবাবু উঠে দাঁড়ালেন । দুহাতের মুষ্ঠিতে শক্ত করে ধরলেন লাঠিটা । কিন্তু চালাতে পারলেননা । ওই চামুণ্ডা বাহিনীর ভিড়ে যে তার গদাই আছে ! সেই তো খালকেটে কুমীর এনেছে ঘরে । তার হাতের লাঠি যার উপর একবার পরবে , তাকে আর উঠে দাঁড়াতে হবেনা । লাঠি যদি গদাধরের উপর পরে ! কুমন্ত্রণার জালে জড়িয়ে ছেলে তার বিপথে গিয়েছে ; তাই বলে তিনি কি করে মন্দ পিতা হন !
তান্ডব থেমে গেল । চামুন্ডা বাহিনী চলে গেল সেখান থেকে । তাঁর সাজানো ঘর সংসার লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেল । বড়োর মাথা ফেটেছে । ছোটোর ভেঙেছে হাত । ছোটো বউমার পরনের শাড়িটা তিন টুকরো হয়ে পরে আছে দাওয়ায় । নাতনি চারজন সিঁড়ির দরজায় খিল দিয়ে কোঠার উপরে উঠে গিয়েছিল । তারা একে একে নেমে এল নিচে । কিন্তু অতসীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা । সে বড় ঘরের মেঝেয় বৃষ্টিকে ঘুম পাড়াচ্ছিল । বৃষ্টি সেখানে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে । অতসী নাই । চারদিক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া গেলনা । 

মাঝরাতে পুলিশ ভ্যান এসে থামল অবনীবাবুর দরজায় । বাড়ির মেয়েরা অতসীকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি নিয়ে পুলিশের কাছে ভেঙে পড়ল কান্নায় । অবনীবাবু নীরব । আকুতি মিনতি , আবেদন নিবেদন – কিছুই করলেননা তিনি । দু’চোখে আগুন জ্বেলে রুদ্রদেবের মত দাঁড়িয়ে রইলেন । বড়বাবু এগিয়ে এলেন । জানতে চাইলেন ঘটনার বিবরণ । অবনীবাবু হিংস্র নেকড়ের মত চোখ রাখলেন বড়বাবুর উপর । বললেন- ‘ জঙ্গল- বুঝলেন বড়বাবু , জঙ্গল ! লোকালয় এখন জঙ্গল হয়ে উঠেছে । এই লাঠির ঘায়ে জোতদার- মহাজনের লেঠেল ঠেঙিয়েছি ; ডাকাত মেরেছি । বাইসন – চিতাকে ফিরিয়ে দিয়েছি জঙ্গলে ! বুনো হাতির মাথা ফাটিয়ে গ্রাম বাঁচিয়েছি । সে তাকত এখন নাই । তাই বলে ফুরিয়েও যাই নাই। দু’চারটে দুপেয়েকে এখনো পেরে ফেলতে পারি । কিন্তু পারলাম না । ওখানে আমার ছেলে ছিল যে । কুলাঙ্গার হোক আর জানোয়ার হোক রক্তটা তো আমারই ! জানোয়ার পেটা করলে , আমাকেই আগে জানোয়ার হতে হয় ! তখন যদি টের পেতাম , নাতনিকে আমার...... আমি নাতনি চাই বড়বাবু ! জীবিত এবং অক্ষত ! তার কপাল যদি পোড়ে , তার চিতা যদি জ্বালতে হয় – একটা চিতা জ্বলবেনা- আমার লাঠি কিন্তু গনচিতা জ্বালবে ! তারপর নিয়ে যাবেন আমাকে । এই রইলাম দাঁড়িয়ে !’ অবনীবাবুর দুচোখ ঠিকরে বিচ্ছুরিত হওয়া তেজরশ্মির তীব্রতায় বড়বাবুর চোখ যেন ঝলসে গেল । সরিয়ে নিলেন চোখ । অবনীবাবুর নয়ন বহ্নির গনগনে আঁচে বড়বাবুর শীতঘুমে থাকা বিবেক দপ করে জ্বলে উঠল । বোধের আলো দু’চোখে ছড়িয়ে বললেন-‘ চিন্তা করবেননা অবনীবাবু ! উর্দিটা যতক্ষণ গায়ে আছে , ওটার অমর্যাদা হবেনা !’ 




Previous Post Next Post