সৌমি সিনহা
তখনো 'অগাস্ট' বলতে শিখিনি, জিভে তখনো 'আগস্ট' এর ভুল মাখা আড়ষ্টতা। 'আগস্ট' এলেই শুরু হয়ে যেত দিনগোনা। প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় 'আগস্ট' মানেই ছিল রঙ্গলালের "স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায় ?" মা পাখিপড়া করে মুখস্থ করিয়েছিল। আর আমি ছিলাম বাধ্য তোতা পাখি। আরেকটু বড়ো হয়ে, কবিতার জায়গা দখল করেছিল মার লেখা দুই থেকে আড়াই পাতার প্রবন্ধ। এটুকুতেই তো বেশ খুশি ছিলাম। সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে ফুল-ধুপকাঠি নিয়ে ধবধবে সাদা স্কুল পোষাকে, সাদা ফিতের ফুল মাথায় পৌঁছে যেতাম স্কুলে। মাঝমাঠে উড়তো তিনরঙা পতাকা--এটুকুই তো! তখন স্বাধীনতা দিবস মানে ছিল এটুকুই, সাথে কেমন যেন একটা আসন্ন উৎসবের আমেজ। হুজুগে বাঙালীর বারোমাসে তেরো পার্বণ, কে জানে, সেই ছোট্ট আমার কাছেতো সক্কাল সক্কাল স্কুলে গিয়ে পালনীয় এই দিনগুলো পার্বণ বা উৎসবের থেকে কিছু কম ছিলনা!
সময়ের সাথে সাথে পাল্টেছে স্বাধীনতার মানে, তার চেহারা, তার তাৎপর্য্য। আজও নীল-সাদা আসমানে সগৌরবে পতপতিয়ে ওড়ে তিনরঙা-পতাকা। আজও সক্কাল সক্কাল স্কুল যেতে হয়, কিন্তু সেই আমেজ বোধহয় পথ হারিয়ে ফেলেছে সংসার-কর্তব্য আর হাজারো নিত্য-নৈমিত্তিক কেঠো-কেজো চিন্তার গোলকধাঁধায়। ক্যালেন্ডারে 'আগস্ট' এর পঞ্চদশতম দিন লালকালিতে রাঙানো, আক্ষরিক অর্থেই রেড-লেটারড ডে, ছুটির দিন। তারমানে একটা দিন সকাল থেকে মেয়েকে কাছে পাওয়া যাবে, তার আবদারে অতিষ্ঠ হওয়া যাবে, কচি কচি গলায় সে আদর করে বলে যাবে "আমিই তো তোমার মা বাবু!"--- সবই তো ভাবনা। ভাবনার বেলুনে পিন ফোটানোর জন্য ছুটির লিস্টে 'বিদ্যালয়ে পালনীয়' কথাটাই যথেষ্ট। হায় রে, স্বাধীনতায় তখন স্কুলের হাজিরা খাতার শিকল! তবুও, স্বাধীনতা বেঁচে থাকে নীল-সাদা স্কার্ট, ধবধবে সাদা কেড্স, আর মাথায় বাঁধা সাদা ফিতের প্রতিটি পাপড়িতে, কুচকাওয়াজ, ড্রামের ছন্দে "মুক্তির মন্দির সোপান তলে", আর অনুষ্ঠান শেষে পাওয়া একটা কেক, কিংবা দুটো বিস্কুট, অথবা নিদেনপক্ষে পাওয়া একটা লজেন্সের প্রতি ছোট্ট প্রাণের অপার ভালোবাসায়। এ ও তো স্বাধীনতারই উপহার....!
কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন