ঝুরঝুরে মোরামের কাঁচা রাস্তার ঢাল বেয়ে নেমে গেল সোনাঝুরির বনের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চিললো রিসর্টের দিকে। গেট খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই জুড়িয়ে গেল চোখ সাজানো রিসর্টের রূপ দেখে! গেট থেকে সোজা চলে গিয়েছে মোরাম রঙের নুড়ির রাস্তা, দু’ধারে সাজানো সবুজ বাগান। মাঝে মাঝে জ্বলছে সাদা আলো। চারিদিকে সোনাঝুরি বনের মাঝে মায়াবী দেখাচ্ছে লালরঙের রিসর্টকে। মাঝের সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সামনে রিসেপশন। আমাদের ঘর দুটো ছিল বাঁদিকে। ঘরের সামনে সরু লোহার রেলিং দেওয়া ব্যালকনি। সন্ধ্যের রং ততক্ষণে বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে। বাইরের পোশাক বদলে এসে বসলাম খোলা ব্যালকনিতে। একটা নিঝুম নিঃস্তব্ধ ব্যালকনি আর আমি নিমেষেই মেতে উঠলাম নির্জনতার আরাধনায়। এই নির্জনতা পাওয়ার আশাতেই তো ছুটে আসা এখানে। মোবাইলে চলছে তখন শ্রীকান্ত আচার্য্যের গান। সবাই নিজের মন মগ্ন তখন।
নিজেকে একটু আড়াল করতে খানিক এগিয়ে আসতেই চোখে পড়লো এক নৈসর্গিক দৃশ্য! সোনাঝুরি পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে গোল হলদেটে ঝকঝকে চাঁদ। মনে পড়ে গেল এ চাঁদ পূর্ণিমার। ক্যামেরায় বন্দি করেও শান্তি এলোনা মনে। তাকিয়ে রইলাম অনন্ত সময় ধরে। একসময় দেখলাম চাঁদ মাঝ আকাশে চলে গেল। রাত গভীর হতেই চারিদিকে শুরু হলো নিঃস্তব্ধতা ভেদ করা ঝিঁঝিঁর ডাক। মন জুড়ে ছেঁয়ে রইলো এক প্রাচীন অনুভূতি।
বারান্দায় অন্ধকারে কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ওই পথে। একটা বড় অশ্বত্থ গাছের নিচটা গোল করে বাঁধানো,তাতে একটি লোক কালো পোশাক পড়ে হাত মুখ নেড়ে অভনয় করে চলেছে। সামনে দর্শক আসনে বসে গ্রামের সরল মানুষের দল। আমরাও গিয়ে বসলাম ওদের মাঝে। ক্ষণিক সময় কেটে গেল এক আদিম অনুভুতির মাঝে। এক ঝলক কল্পনার স্মৃতি উঁকি মারতে লগলো মনে। সেই টিভি, মোবাইল,টেলিফোনের যুগের আগের এক ফসিল হয়ে যাওয়া যুগের কল্পনার ছবি। নাটক শেষে ফিরে এলাম দুদিনের অস্থায়ী ঠিকানায়। সারাদিন শুধু ছুটেছি। ক্লান্ত শরীরে বিছানার হাতছানি উপেক্ষা করা দায়। পরেরদিন বেশ সকালেই বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম পায়ে হেঁটে আদিবাসী গ্রাম দেখতে। মাটির বাড়ি,খড়ের ছাঁউনি, মেঠোধুলি পথ। গ্রাম বাংলার ছবি যেন সাহিত্যের পাতা থেকে উঠে এসেছে চোখের সামনে। একটা কাঠের আগুনে উনুন পোড়ার গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে। কোথাও দাঁড়িয়ে একটি আধুনিক লোহার চাকার গরুর গাড়ি। গরু গুলো পাশে বাঁধা খড় খাচ্ছে। কালো ছাগল মাটির রোয়াকে মাথা গুঁজে শুয়ে আছে। বাঁশ গাছের পাতা গুলো হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়লো শুনেছিলাম এই গ্রামের ভিতর দিয়েই নাকি পথ আছে কোপাই নদীর কাছে যাওয়ার। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলেন কোন দিকে যেতে হবে। আমরা হেঁটে চললাম সেই পথে মনে অজানাকে জয় করবার অদম্য কৌতূহল। গ্রামের রাস্তা ছেড়ে পথ নেমে গিয়েছে মাঠের দিকে আলপথে এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম দূরে ফাঁকা সবুজ মাঠের মাঝে একটাই ঘর। চারিদিকে থমথমে নীরবতা। পথ খুঁজে না পেয়ে সেই দিকে এগিয়ে যেতে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এলো চারটে কুকুর। হঠাৎ শুনলাম কুকুরের মালিকের বৃদ্ধ গলায় ধমকের শব্দ। শান্ত হয়ে গেল কুকুর গুলো। ওই ব্যক্তিই দেখিয়ে দিলেন কোপাইয়ের পথ। আরো কিছুটা ঘেসো জঙ্গল ভেদ করে নিচের দিকে নামতেই দেখা মিললো আমদের সেই ছোটো নদীর। পায়ের পাতা ডোবা জল তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে পাথরের ফাঁক দিয়ে। কিছুটা সময় কোপাইয়ের সাথে জলে পা ভিজিয়ে। চারিপাশে চেয়ে দেখলাম চেনা এক ছবি। ছোটো বেলার আঁকার খাতার কিছু চেনা পাতা যেন আজ চোখের সামনে জীবন্ত। দুই দিকে সবুজ পাড় মাঝে বয়ে চলেছে নদী। নদীর পাড়ে রাখাল ছেলে মোষের পাল নিয়ে হেঁটে চলেছে। না, সব কিছু এখনো হারিয়ে যায়নি! আজো আছে এক টুকরো প্রকৃতি, ঠিক যেমন ছিল ছোট্ট বেলার দিন গুলিতে।