আমার তৃতীয় চোখ হারিয়ে গিয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে যে উঠে আসছে আজ আমি তার মুখও দেখিনি
তোমাকে দুঃখিত করা আমার জীবনধর্ম নয়
চলে যেতে হয় বলে চলে যাচ্ছি, নাহলে তো, আরেকটু থাকতাম।'
--- ভাস্কর চক্রবর্তী
অতএব জল থেকে উঠে এলাম, মৃন্ময়ী! সান্ধ্য-কলকাতার এই গঙ্গার ঘাট নানারকমের লোকের ভিড়ে ভরে থাকে। গঙ্গা বলবো, না হুগলি? এখানে এই নদীর ডাকনাম হুগলি, আরেকটু উত্তরে গেলে ভাগীরথী, আরও উত্তরে পদ্মার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে পর্যন্ত যেতে পারলে তবে না গঙ্গা! কিন্তু নামে কী আসে-যায়! সেদিন মধ্যরাতের ধোঁয়াশায় সেই যে খুব চেনা মুখটি বলেছিল ধরে নিতে তার নাম রোহিত, তবে কেন তাকে আমার কখনও রক্তিম, কখনও রূপঙ্কর মনে হয়! অতএব গঙ্গা হোক বা হুগলি অথবা ভাগীরথী, নদীর জলে আরও একটি সুখ-স্বপ্ন-সাধ ভাসিয়ে দিয়ে উঠে এলাম, বন্যা! এই দ্যাখো, এর মধ্যেই তোমাকে দুটো নামে ডেকে ফেললাম। কখন যে আবার 'মাধবীলতা' নামেও ডেকে ফেলি, কে জানে! সত্যিই, নামে যায়-আসে না কিছু! তুমিও যে দুটো নামে চিহ্নিত করেছো আমাকে, প্রকাশ্যে অথবা গোপনে, তাতেও কি পাল্টানো গেছে কিছু, ভবিতব্য বলো বা নিয়তি!
যা বলছিলাম, বাবুঘাটের সন্ধ্যা প্রেমিক-প্রেমিকাদের ভিড়ে ডুবে থাকে। ইতিউতি ক্রেতা খুঁজে বেড়ায় দেহ-পসারিণীরা। ফুচকা-ভেলপুরি-চাট থেকে শুরু করে হাজার রকমের খাবার বিক্রির ফেরিওয়ালা ঘোরে। একটু নিরিবিলিতে ছই দেওয়া নৌকো লেগে থাকে ঘাটে। জলের দোলায় অল্প-অল্প দোলে তারা। একদিন ওই ছইয়ের নিচে বসে তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে শুষে নিতে চেয়েছিলাম জীবনের পরম। তারপর তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শুতে পারতাম। কে জানে গুনিগুনিয়ে উঠতাম কিনা, 'ও শাম কুছ আজিব থি'! কিন্তু তোমার নাকি জলে ফাঁড়া, তোমার জলে যাওয়া বারণ। অতএব সেই ইচ্ছেকে মুড়ে রেখে তোমার সাধনায় মগ্ন হয়েছি স্থলের নিরাপদ ঘেরাটোপে। এরকম প্রায় জনাকীর্ণ ঘাট থেকে জলে নেমে, নিজের একটি স্বপ্নময় সাধ বিসর্জন দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। তবুও আমি দিই। আজ আগস্টের ২৪, আমাদের প্রথম জাগতিক আদরের বর্ষপূর্তির চব্বিশ। তার সান্ধ্য-নদীজল সাক্ষী হয়ে থাকে, তোমার হাতে ঠিক কী তুলে দিতে চেয়েছিলাম এই দিনে।
আগস্টের কথায় মনে এল, এটা স্বাধীনতার মাস। আর স্বাধীনতার কথায় মনে এল, আমাদের এই সঙ্কটকালের কোনো এক রাতের কথোপকথনে তুমি প্রবল দাপটে বারবার একটা কথাই বলছিলে, 'আমি স্বাধীন নারী'। ঠিক তারপর থেকেই তোমার হাতে-পায়ে-কন্ঠে-দৃষ্টিতে একটার পর একটা বেড়ি পড়তে শুরু করলো! এতটাই যে, একটি শিশুর সঙ্গে কথা বলার জন্যও তোমায় লুকিয়ে ফোন করতে হয়! একে কী বলবে, মৃন্ময়ী? নিয়তির পরিহাস? চক্রব্যূহে তুমি ঢুকেই ছিলে আগে থেকে, সেদিন আরও আঁটোসাঁটো হলো ব্যূহ-জোট। হ্যাঁ তুমি নারী ঠিকই, কিন্তু মহাকাব্যের পুরুষ যোদ্ধাটির মতো বেরোনোর রাস্তা যে তোমারও অজানা, সে-কথা তোমাকে বলার কোনো সুযোগ সেদিনের উদ্বেল আমি পাইনি।
স্বাধীন নারী ঠিক কাকে বলে, বন্যা? প্রায়ই শুনি, আদিযুগে নারী নাকি খুব স্বাধীন ছিল। তখন তো বিবাহ ছিল না, পরিবার-প্রথা ছিল না। যখন প্রচলিত হলো এসব, তখনও তার রূপ ছিল অন্যরকম। বিশ্বাস করি না বলে চেঁচালেও মিথোলজি আমরা সবাই অন্তত একটু-আধটু ভালোবাসি। মিথোলজি কী বলে আদিযুগের নারীদের কথায়? সেই যে ইভ, যে নাকি দুনিয়ার প্রথম নারী, স্বাধীন ছিল সে? তাহলে শোনো হে মৃন্ময়ী, ইভ তো আদৌ প্রথম নারীই নয়! আদমের প্রথম সঙ্গিনী লিলিথ। ওই যে 'বুক অফ জেনেসিস'-এ বলা হয়েছে, আদমকে সৃষ্টি করে ঈশ্বর বললেন, 'ইট ইজ নট গুড ফর ম্যান টু বি অ্যালোন' আর আদমের মতোই ভূমি থেকে একটি নারীকে সৃষ্টি করে তার নাম দিলেন, লিলিথ। কিন্তু মুশকিল হলো কী, যেহেতু তারও জন্মবৃত্তান্ত আদমের সমান, তাই লিলিথ সমান অধিকার দাবি করে বসলো। যা আদমের পক্ষে মানা অসম্ভব। অতএব গার্ডেন অফ ইডেন থেকে লিলিথের নিষ্ক্রমণ। আদমের পাঁজর থেকে ইভের সৃষ্টি তো তার পরের ব্যাপার, যে কিনা কোনোদিনই আদমের সমান হতে চাইবে না!
তুমি কি লিলিথ হতে চেয়েছিলে, মৃন্ময়ী? তোমার বক্তব্যে সেই দাপট ছিল সেদিন, কাজে নয়! তাছাড়া আমি বাস্তব ও পরাবাস্তব আদরে তোমার মধ্যে লিলিথের জোশ দেখলেও, বাকি সময়ে ইভের সমর্পণ দেখেছি। যে-মনোভাব অন্যত্র অবমূল্যায়িত হয়ে তোমার ভীরুতা বলে চিহ্নিত হবে অবধারিত। অতএব তার গন্তব্য হবে সমঝোতা বা আপসের দিকে, তাদের কোনো দাবি যতই অন্যায় হোক না কেন! আজ দ্যাখো, ঠিক তাই ঘটে চলেছে একের পর এক। অভিমন্যু-ব্যূহ আরও নিশ্ছিদ্র করে ঘিরে ফেলছে তোমাকে, আর আমি তোমারই নিষেধে ওই ব্যূহ ভাঙার কৌশল জানা সত্ত্বেও দর্শক হয়ে বসে আছি অস্ত্রহীন!
কিন্তু এমন জটিল সময়ে তো আরও শক্ত করে ধরার কথা ছিল হাত। অথচ এই আমার সরে থাকতে বাধ্য হওয়া! আন্তরিক জোর থেকে বারবার ধরলেও, অজান্তেই হাতের মুঠো আলগা করে দিচ্ছ তুমি। স্বাভাবিক উৎকণ্ঠায় সতর্ক করতে চাইছি, তোমার উষ্মা জন্ম নিচ্ছে তার প্রতিক্রিয়ায়। এ এক আশ্চর্য পরিস্থিতি, বন্যা! যা তুমি বোঝো আর যা তুমি বুঝতে চাও না, যা তুমি জানো আর যা তোমার পক্ষে জানা সম্ভব নয় কোনোদিন, তার সবটুকু দেখতে পেয়েও কি তাহলে আমি চুপ করেই থাকবো! নাকি, সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে, লড়াইয়ের নিয়ম এই প্রথমবারের মতো অগ্রাহ্য করে তোমার কাছে খুলে দেবো যাবতীয় গোপন? রহস্যময় সেই মধ্যরাতে যে-কথা বলেছিল আমায় সেই খুব চেনা অচেনা আগন্তুক, তাই-ই কি মনস্থ করবো শেষে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনও আমার কাছে নেই!
Tags:
ধারাবাহিক