পূজা মৈত্র

পাপসমীক্ষা-
 প্রথম সংখ্যা   মেট্রো করে কলেজস্ট্রীটে নামল নিখিলেশ। প্রতিবিম্বে যাবে। বইএর প্রথম প্রুফটা রেডি হয়ে গেছে। সুদেববাবু ফোন করেছিলেন কাল। কালকেই আসতে বলছিলেন,অথচ কাল আসার উপায় ছিল না। স্কুল ছিল। ছুটি হতে হতে চারটে বেজে যায়। বিকালের ট্রেন ধরে রাণাঘাট থেকে কলকাতা এসে প্রুফ নিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যেত। আর্চি বাড়িতে একা থাকতে পারত না। শিঞ্জিনীকে অনুরোধ করলে ও হাসিমুখেই এসে আর্চির দেখভাল করত,কিন্তু নিখিলেশের ওকে বারবার অনুরোধ করতে সংকোচ বোধ হয়। সন্ধ্যায় ওর অনেক ক’টা টিউশন পড়ানো থাকে। আর্চিকে পাহারা দিতে গেলে সে সব কামাই হয়ে যেত। শিঞ্জিনী আগেও অনেকদিন আর্চিকে দেখার জন্য টিউশন কামাই করেছে, হাসিমুখেই করেছে-অথচ নিখিলেশ এখন ওকে একটু দূরত্বে রাখতে চায়। শিঞ্জিনীর মায়ের কথাটা কানে বাজে, “আমার মেয়েটাকে দিয়ে তোমার ছেলের আয়ার কাজটা করিয়ে নিচ্ছ,আরো না জানি কত আশা দেখাচ্ছ,তাই আমার মেয়ে এভাবে একটার পর একটা বিয়ের সম্বন্ধ বাতিল করে দিচ্ছে। দেখো বাপু-স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, হয় বিয়ে করো, না হয় ওকে ছাড়ো। ওর জীবনটা নষ্ট করো না।” অভিযোগের তীব্রতায় অবাক হয়েছিল নিখিলেশ। শিঞ্জিনীকে জ্ঞানত ও কোনরকমের আশা দেয়নি। আর্চিকে পড়ায় মেয়েটা, বছর বাইশেক বয়স, পাড়ার মেয়ে-নিখিলেশের থেকে বছর তেরোর ছোট। ওর সম্বন্ধে বিয়ে-থা এইসব কথা ভাববে কি করে? তবে মেয়েটা ভদ্র,নম্র। সর্বোপরি আর্চিকে খুব ভালোবাসে। আর্চিও ‘শিঞ্জিনী মিস্‌’ বলতে অজ্ঞান। ওদের মধ্যে স্নেহের একটা সুন্দর সম্পর্ক আছে। সেই ভরসাতেই আগে কয়েকবার শিঞ্জিনীকে অনুরোধ করেছিল নিখিলেশ,ওর অনুপস্থিতিতে আর্চির কাছে থাকতে। অনুরোধটা দিদিকেও করতে পারত। কিন্তু আর্চি পিসিমণির চেয়ে মিসের সাথেই বেশি স্বচ্ছন্দ। তাছাড়া দিদিকে বললে দিদি চারটে কথা শুনিয়ে দেবে,একগাদা কাজের ফিরিস্তি দেবে-শেষে বলবে আর্চিকে ওদের বাড়িতে দিয়ে যেতে। আর্চি বাড়ির বাইরে যেতে চায়না,এইসব ভেবেই শিঞ্জিনীকে ডাকত নিখিলেশ। এখন আর ডাকে না। আর্চিকে পড়ানো ছাড়িয়ে দেবে ভেবেছিল। ছেলেকে বলতেই সে কেঁদেকেটে অস্থির। নিখিলেশ ওর মুখ চেয়ে শিঞ্জিনীকে ছাড়াতে পারেনি। নিজের মায়ের ঐ কীর্তির পর মেয়েটা নিখিলেশের চোখে চোখ রাখতে পারে না, গুটিয়ে থাকে। আমতা আমতা করে,একবার ক্ষমাও চেয়েছিল-নিখিলেশ কান করেনি। তবে সব মিলিয়ে নিখিলেশের বেশ অসুবিধাই হচ্ছে। আর্চিকে শিঞ্জিনীর জিম্মায় রেখে আগে যেমন নিশ্চিন্তে কবি সম্মেলনে যেতে পারত, প্রেসের কাজে কলকাতায় আসতে পারত, এখন সেটা হচ্ছে না। শনিবার ছাড়া সেটা হবেও না। শনিবার স্কুল থেকে ফিরে আর্চিকে নিয়ে এমনিতেই কলকাতা আসতে হয়। ফেরার পথে প্রেসে ঘুরে যাবে এবার থেকে। রবিবার কোথাও কবিতা পাঠে আমন্ত্রণ থাকলে পাঠ করে সন্ধ্যার দিকে আর্চিকে নিয়ে ফেরার ট্রেন ধরে। নভেম্বরের শেষ হয়নি এখন। পাঁচটার মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে যায়। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পড়ছে। আর্চির আবার ঠাণ্ডার ধাত। যে করেই হোক ওকে নিয়ে সাতটার আগের ট্রেন ধরতে চায় নিখিলেশ। ন’টার আগে রাণাঘাট না পৌঁছালে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। রাতের দিকে খুব ঠাণ্ডা পড়ে ওখানে। ওদের বাড়িটাও চূর্ণীর ধারে। সেখানে ঠাণ্ডাটা অন্য জায়গার থেকে বেশ বেশি। উত্তরে হাওয়া চলে সন্ধ্যা থেকেই। আর্চিকে সোয়েটার,টুপি,গ্লাভস পরিয়ে তবে বাইকে তোলে নিখিলেশ। ঠাণ্ডা লেগে জ্বর এলে খুব কষ্ট পায় ছেলেটা। নিখিলেশের সব কাজ মাথায় উঠে যায়। স্কুলেও যাওয়া হয়না। টানা চার পাঁচদিন ছুটি নিতে হয়। এবার জ্বরটা যে কারণেই হোক ঠেকাতে চায় নিখিলেশ। হাতে প্রচুর কাজ। নিজের ম্যাগাজিনের বইমেলা সংখ্যার কাজ তো আছেই,তার উপর প্রতিবিম্ব থেকে ওর বই বেরোচ্ছে এবারের বই মেলায়। বহুবছরের অপেক্ষার ফল ফলেছে অবশেষে। নিজের মনের গহনে যে স্বপ্নটাকে সযত্নে লালন করে চলেছিল লেখালিখি শুরু করার পর থেকেই,সেই স্বপ্নটার খুব কাছাকাছি আজ নিখিলেশ। মাঝে বছর পনেরো পার হয়ে গেছে। এই পনেরো বছরে অনেক ওঠানামা দেখেছে ও। অনেকটাই চড়াই উৎরাই পার হয়েছে। নিজের প্রতিভা বলে কবিতা লেখা শুরু করার বছর দুয়েকের মধ্যেই যেমন তরুণ প্রতিভাবান কবিদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছিল, তেমনই যথাযথ সুযোগ না পেতে পেতে বিস্মৃতির অতল অন্ধকারে তলিয়েও গিয়েছিল। মাঝে বছর দেড়েক লেখা বন্ধ করে দিয়েছিল নিখিলেশ। ব্যক্তিগত কষ্ট,দুঃখ,সমস্যাগুলো গ্রাস করে নিয়েছিল ওকে। সৌগতদা অনুপ্রেরণা না দিলে আবার কবিতায় ফিরতে পারত না কোনদিন। কবিতায় ফেরাটাকে পুরনো শুভাকাঙ্ক্ষীরা স্বাগত জানিয়েছেন। লিটিল ম্যাগাজিনগুলো আবার লেখা চাইছে,কবি সম্মেলনগুলো থেকে আমন্ত্রণ আসছে। যা আসছে, সবই স্বতঃস্ফুর্তভাবে আসছে। কাউকে কখনোই লেখার ব্যাপারে অনুরোধ করেনি নিখিলেশ। অতি পরিচিত সম্পাদক, যাকে ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করে থাকে, যার বাড়িতে যাতায়াত রয়েছে, তাকেও ‘একটু দেখো’ বলতে পারেনি কখনো। এই না পারাটার জন্য নিজের সমসাময়িকদের থেকে পিছিয়ে পড়েছে অনেকটাই। একসময় যারা বন্ধু ছিল,‘ভাই’ ছিল, কবিতা লিখে দেখাত, মত নিত,যাদের অনেককেই নিজের পত্রিকায় লিখিয়েছে নিখিলেশ তারা এখন প্রথম সারির কবি,বাণিজ্যিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখে। কবি সম্মেলনে মঞ্চ আলো করে বসে থাকে। এখন তারা নিখিলেশকে চিনতেও পারেনা। চোখে চোখ পড়ে গেলে, অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ভাবে আর সবার মত নিখিলেশও হয়তো পুরনো আলাপের জোরে সুযোগ নিতে চাইবে,ওদের সেলিব্রিটি স্ট্যাটাসটা ভাঙাতে চাইবে। নিখিলেশ মনে মনে হাসে। ওরা এতগুলো বছর দেখেও নিখিলেশকে বিন্দুমাত্র চেনেনি। চ্যানেল করতে পারলে,ব্যক্তিগত সম্পর্ক ব্যবহার করতে পারলে,তোষামোদ করতে পারলে,গডফাদার ধরতে পারলে আজ নিখিলেশ ব্যানার্জীর নামটাও ওদের সাথে একসাথে উচ্চারিত হত। সেসব কোনকালেই করতে পারেনি। কেউ যদি যেচে বলে, ‘লেখা দিস’ বা ‘লেখা দিও’ বা ‘লেখা দেবেন’ তাহলেই লেখা দেয়। লেখা দিয়েও তদ্বির করে না। ফোন করে জানতে চায়না লেখাটা ছাপা হবে কি না, হলে কবে হবে? লেখা দিয়ে ভুলে যায়। পত্রিকা বেরোলে সম্পাদক যখন ফোন করে জানান-তখন ওর মনে পড়ে সে লেখা দিয়েছিল ওখানে। অগোছালো,বড্ড অগোছালো ও, সৌগত দা বলে, “তুই যতটা ভালো লিখিস,তার এক শতাংশও যদি নিজের পাবলিসিটি করতে জানতিস তাহলে...” কথাটা শুনে আগে অবাক হত নিখিলেশ,কবিতা কি কোন পেশা নাকি? যাকে বেচতে জানতে হবে, সুন্দর মোড়কে মুড়ে তাকে মার্কেটিং করতে হবে? কবিতা আর নিজের সম্পর্কটাকে আত্মার সম্পর্ক বলে মনে হয় ওর। কবিতা যেন নিজের সন্তানের মত, তাদের জন্ম দেয় নিখিলেশ,লালন করে,আদর করে-সন্তানদের নিয়ে ব্যবসা করা যায় নাকি? গত পনেরো বছরে ওর ধারনা অনেকটাই বদলেছে। নিজের কবিতাদের বারংবার পণ্য হিসাবে ব্যবহার করতে দেখেছে অনেককে। সৌগতদার উপর সব ছেড়ে দিয়েছে এখন। নিখিলেশের কবিতা নিয়ে নিজের মত করে প্রচার করছেন সৌগতদা। গত একবছরে বেশ কয়েকটা বড় পত্রিকায় লেখা বেড়িয়েছে ওর। ব্যাসদেবের লেখাটা পড়েই সুদেববাবু বই করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। খুব বড় ব্রেক থ্রু। কিন্তু এক পয়সা পকেট থেকে দিয়ে বই করবে না, এই ধনুকভাঙা পণের কথা সুদেববাবুকে কিভাবে জানাবে,ভেবে ইতস্ততঃ করছিল ও। প্রত্যেকেই প্রথম কবিতার বই গ্যাঁটের কড়ি দিয়ে করে থাকে। নিখিলেশ এই নিয়মের ব্যতিক্রম হতে চেয়েছিল। সেই অভিজাত কবিদের তালিকায় নাম লেখাতে চেয়েছিল, যাদের কখনো অর্থের বিনিময়ে বই ছাপাতে হয়নি। সৌগতদা শুনে বলেছিল, “পাগলামি করিস না। নিজে না পারিস আমাকে বল্‌ আমি ফাইন্যান্স করব।” সুদেববাবুকে ইনিয়ে বিনিয়ে টাকার কথাটা বলে ফেলেছিল নিখিলেশ। শুনে চশমার উপর দিয়ে তাকিয়েছিলেন, “আমন্ত্রণ করেছি আপনাকে। এক পয়সাও লাগবে না।” অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিতে নিখিলেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল। মুখ দিয়ে কথা সরে নি। “আপনার কলমের জোর আছে,বুঝলেন? জহুরী জহর চিনতে ভুল করে না। ঠিকমত পাবলিসিটি হলে বেস্ট সেলার হবে।” সুদেববাবুর চোখে প্রত্যয় দেখেছিল নিখিলেশ। সেই থেকে মন দিয়ে বইয়ের কাজটা করছে। একাত্ম হয়ে গেছে কাজটার সাথে। এত বছর পর সুযোগ পেয়েছে ও। একে কোন মূল্যেই হারাতে পারবে না। সমস্ত উপেক্ষা,অবজ্ঞা,অপবাদ,অপমান,লাঞ্ছনার জবাব এই বইয়েই দিতে হবে। মুখে কখনো জবাব দিতে পারেনি। কলমের উপর আস্থা রেখেছিল। কলম ওকে ঠকায়নি। সাফল্যের প্রথম সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে ও। সিঁড়িটা চড়তে হবে। উপরে উঠতে হবে। সৌগতদা ঠিকই বলে,হারিয়ে যেতে আসেনি ও,হেরে যেতে আসেনি। বছরখানেক আগেও সবাই ভাবত নিখিলেশ ব্যানার্জী ফুরিয়ে গেছে। প্রকৃত কবি যে কখনো ফুরায় না,তা প্রমাণ করার সময় চলে এসেছে।


-প্রুফটা আমরা দেখে দিয়েছি,তাও আপনি দেখে নিন একবার নিখিলেশ বাবু সুদেববাবুর কেবিনে উনার উল্টোদিকের চেয়ারে বসেছিল। এয়ার কন্ডিশন কেবিন। প্রতিবিম্ব বেশ বড় প্রকাশনা। দশবছর আগে এই সংস্থার জন্ম হয়েছিল। দশ বছরেই ধুমকেতুর মত উত্থান হয়েছে প্রতিবিম্বের। এখন প্রথম তিনটি প্রকাশনার একটি। নতুন প্রতিভাকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য প্রতিবিম্ব বিখ্যাত। নতুনদের খুব বড় ভরসার জায়গা প্রতিবিম্ব। তবে প্রতিবিম্ব যাদের প্রথম সুযোগ করে দিয়েছিল তাদের মধ্যে অনেককেই হাইজ্যাক করে নিয়েছে উচ্ছ্বাস। বাংলা সাহিত্যের অবিসংবাদী এক নম্বর প্রকাশনী।

-ঠিক আছে। কাল দিয়ে যাব।

-কাল কলকাতা আসছেন? ওঃ হো। কাল তো ধারাপাতের অনুষ্ঠান রয়েছে অ্যাকাডেমিতে।

-তাই? আমি আমন্ত্রিত নই। ব্যক্তিগত কাজে আসব।

-সে কি? আমন্ত্রণ পাননি? দাঁড়ান,আমি শৈবাল কে ফোন করে বলে দিচ্ছি।

কাউকে ইনফ্লুয়েন্স করে আমন্ত্রণ নিতে চায়না নিখিলেশ। কেউ আমন্ত্রণ করলে তবেই যায়। গিয়ে এক কোণায় বসে থাকে। দূরে বাড়ি বলে যে কাউকে অনুরোধ করবে আগে সুযোগ করে দেওয়ার-সেটাও ঠিক হয়ে ওঠে না। আর্চিকে আনার তারায় বহুবার কবিতা পাঠ না করেই চলে আসতে হয়েছে।

-না,থাক। কাল একটু জরুরী কাজ আছে।

-তাহলে থাক। শৈবালকে আমি বললে হয়ে যেত। ওর প্রথম তিনটে বই আমরাই করেছি।

-এখন তো উচ্ছ্বাস থেকে বের হয়।

-সুদেববাবু চশমা খোলেন। ইঙ্গিতপূর্ণ হাসেন।

-সবাই বড় গাছেই নৌকা বাঁধতে চায় মশাই। গ্ল্যামারের পিছনে ছোটে। ভুলে যায়,কে প্রথম প্লাটফর্ম দিয়েছিল।

-কেউ কেউ ব্যতিক্রম হতে পারেন।

-অবশ্যই। তবে ব্যতিক্রম নিয়মকেই প্রমাণ করে।

দরজায় নক শুনে তাকালেন সুদেববাবু।

-ভেতরে আসুন।

যে ভেতরে এল তাকে নিখিলেশ চেনে। চন্দন অধিকারী। সুদেববাবুর পি.এ।

-বসুন চন্দন দা।

সুদেববাবুর মধ্য চল্লিশের। সুঠাম চেহারা। ফর্সা গায়ের রং,চশমার পেছনে দুটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ ঝলমল করে। অর্থনীতি নিয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক। সবাইকে আপনি করে বলেন।

-আজ্ঞে,বলব?

-বলুন। ইতস্তত করছেন কেন? নিখিলেশ বাবু ঘরের লোক।

-আপনাদের অসুবিধা হলে আমি না হয় বাইরে যাই?

-না,থাকুন।

থামিয়ে দিলেন সুদেববাবু।

-বলুন এবার।

-ম্যাডাম রাজি হয়েছেন।

-কি?

সুদেববাবুর চোখেমুখে খুশির ছাপ দেখা গেল

-দারুণ খবর। কত নেবেন?

-আপনাকে ফোন করতে বলেছেন,কাল ফোন করে জেনে নিতে বলেছেন।

-গ্রেট!

নিখিলেশ অত্যন্ত অবাক হলেও মুখে সেটা প্রকাশ করল না। ভাবলেশহীন মুখে বলল

-কিন্তু শুধু উচ্ছ্বাসের হয়ে লেখে শুনেছিলাম যেন।

-ঠিকই শুনেছিলেন। বিক্রি হয়ে গিয়েছিলেন উচ্ছ্বাসের কাছে। গত তিনবছর ওদের পাবলিকেশনের বাইরে কোথাও লেখেননি। উচ্ছ্বাসও প্রতিদান দিয়েছে। টালিগঞ্জে ফ্ল্যাট,মোটা টাকার কন্ট্র্যাকট...

-আর ইন্দ্রনীল বসুর সাথে সম্পর্কের কথাটা বললেন না?

চন্দন যোগ করলেন। ইন্দ্রনীল বসু উচ্ছ্বাসের মালিক অনিমেষ বসুর ছেলে। উচ্ছ্বাসের একমাত্র উত্তরাধিকারী। তার সাথে গৈরিকা সান্যালের সম্পর্কটা ওপেন সিক্রেট। অস্বস্তি বোধ করল নিখিলেশ। এসব নোংরা ঘাঁটাঘাঁটিতে ওর রুচি নেই।

-আরে ইন্দ্রনীলকে ধরেই তো উপরে উঠলেন। ইন্দ্রনীল নিজে হাতে গৈরিকা সান্যালকে স্টার বানিয়েছে। আর তিনবছর ধরে ভাঙিয়ে খাচ্ছে। এবার ওর মনোপলি শেষ হবে, কি বলেন?

-ঠিক বলেছেন স্যার। তবে না আঁচালে বিশ্বাস নেই। গৈরিকা সান্যাল যা মুডি। আজ দেবে বলেছেন, কালকেই হয় তো বলে দিলেন দেবেন না।

সুদেববাবু ঘাড় নাড়লেন।

-না,তেমন হবে না। নিশ্চয় অনেক ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। ব্যাকস্টেপ নেবেন না। উচ্ছ্বাস তো ম্যাডামের স্বাধীনতার কেড়ে নিচ্ছিল। নিজেদের মত করে লেখাচ্ছিল এতদিন। আপনি বলুন নিখিলেশ “রাত জাগা পাখি” আর “অল্প বিরামের” পরের উপন্যাস দু’টো পড়া যায়?

নিখিলেশ নিরুত্তর থাকল। এ প্রসঙ্গে মত দেওয়া ঠিক হবে না। যদিও সুদেববাবু ঠিক বলছেন। শেষ দুটো উপন্যাসে গৈরিকার ছোঁয়া কোথাও পাওয়া যায় নি। অন্য কারোর মত করে লিখছে এখন। বাজারের চাহিদার মত করে লিখছে। না হলে এত আরোপিত যৌনতা কেন ওর লেখায়?

-চিরন্তনী কুন্ডুর সাথে ছায়া যুদ্ধে নেমেছেন যেন। সস্তার চটক দিয়ে বাজার কিনতে চাইছেন।

-ওসব চটপটে লেখা চটপট বাজারে আসে, আবার চলেও যায়। কালের গায়ে দাগ কাটে না। বুঝলেন চন্দন? গৈরিকা সান্যাল ইজ ফার মোর ট্যালেন্টেড দ্যান দ্যাট। দুটো ক্লাসিক লেখার পর কেন যে এভাবে নিজে কে নষ্ট করছেন,বুঝতে পারছিলাম না।

-আমি উঠি...

নিখিলেশ আর বসতে পারছিল না। গৈরিকার ক্ষমতা,যোগ্যতা সম্পর্কে ওর থেকে ভালো কেউ জানে না। অন্যের মুখ থেকে এসব কথা শুনতে ভালো লাগছিল না।

-চললেন? কফি হাউস যাবেন এখন?

-নাঃ। ওখানে বড্ড ভিড়।

হ্যাঁ। আজ শনিবার। সবাই আড্ডা জমিয়েছে ওখানে।

-আড্ডা নয়। গসিপ। গঠনমূলক আলোচনা ছাড়া অন্য কিছুতে আমার রুচি নেই। আমি নিজের কাজটুকু করতে ভালোবাসি। নিজের বৃত্তে খুশি আছি। ওসবে জড়াই না তাই।

নিখিলেশ চলে গেলে চন্দন হাসল। ব্যাঙ্গের হাসি।

-এখনো ভালোই টান রয়ে গেছে।

-আঃ চন্দন! ওভাবে বলবেন না। নিখিলেশ ব্যানার্জী আমাদের ট্রাম্পকার্ড।

-মানে?

বুঝলেন না? গৈরিকা সান্যালের প্রাক্তন স্বামীর কবিতা পড়তে সবাই হামলে পড়বে। প্রত্যেক কবিতায় তন্নতন্ন করে খুঁজতে চাইবে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ। দুজনের ভালোবাসার এমন বাজারি পোস্টমর্টেম হবে। আপনি ভাবতেও পারবেন না।

-সম্পর্কটা গৈরিকা সান্যালের উচ্চাভিলাষের জন্য ভেঙেছিল? নাকি...

-উত্তরটা কেউ জানে না। গৈরিকা কোথাও এ নিয়ে একটা কথাও বলেনি। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ছায়া কোন উপন্যাসে পড়তে দেয়নি এযাবৎ। নিখিলেশও এমন ভাব করেন যে গৈরিকাকে চেনেন না। এইজন্যই তো পাঠক আরো উৎসুক হবে নিখিলেশের বইটা পড়তে। কোন সঙ্গত কারণ,কোন অভিশাপ,কোন উষ্মা যদি পেয়ে যায়...

চন্দন বুঝতে পারলেন সুদেববাবু ঠিক কোনদিকের কোন দিকের কথা ভেবে নিখিলেশ ব্যানার্জীর মত প্রায় বিস্মৃত এক কবির কবিতার বই নিখরচায় ছাপাতে রাজি হয়েছেন। বিতর্ক চান তিনি। নিখিলেশ আর গৈরিকা সম্পর্কটা কফিন থেকে থেকে বেরিয়ে আসুক, তাকে মাইক্রোস্কোপের তলায় রেখে গবেষণা করা হোক-এটাই চান সুদেববাবু। এতে নিখিলেশের বইয়ের কাটতি হবে, আবার উচ্ছ্বাসও বিব্রত হবে। বিশেষ করে ইন্দ্রনীল। সে বেচারা পড়বে মারাত্মক অস্বস্তিতে। নিখিলেশের লেখায় যদি তাকে ভিলেন বানানো হয়-তবেই কেল্লাফতে।

-ম্যাডামকে জানিয়েছিলেন বইমেলায় প্রতিবিম্ব কার কার বই বার করছে?

-জানিয়েছি।

-নিখিলেশ ব্যানার্জীর নাম শুনে কি বললেন?

-কোন প্রতিক্রিয়া দিলেন না। তবে চটজলদি রাজি হয়ে গেলেন,উপন্যাস দিতে।

সুদেববাবু মুচকি হাসলেন। এটা যে হবে-অঙ্ক কষে জানতেন উনি। গৈরিকা সান্যাল কখনই চাইবেন না নিখিলেশ ব্যানার্জীর বেশি প্রচার পাক। প্রতিবিম্ব থেকে উনার উপন্যাস বেরোলে উনার দীপ্তিতে বাকিদের বইগুলো ঢেকে যাবে। এই চিন্তা করেই রাজি হয়েছেন ম্যাডাম। অথচ সুদেববাবুর অঙ্কটা অন্যখানে। দুটো বই-ই বেস্টসেলার হবে। অঙ্কটা মিললে হয়।


পর্ব-দুই

প্রেসক্লাবের সামনেটায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল গৈরিকা। আজ অশ্বত্থমা মিত্রর নতুন উপন্যাসের প্রকাশ হল। উচ্ছ্বাস থেকে প্রায় বছর পাঁচেক পর উনার বই বেরোল। মাঝের বছরগুলোতে উচ্ছ্বাস একেবারে কোণঠাসা করে রেখেছিল উনাকে। বই বার করা তো দূরের কথা অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত এই লেখককে শারদীয়াতেও স্থান দিত না উচ্ছ্বাস। এর পিছনে ইন্দ্রনীলের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। গৈরিকা কখনো ইন্দ্রনীলকে বলেনি উনাকে কর্নার করে রাখতে। ইন্দ্রনীলই নিজে থেকে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল। কারণটা একান্ত ব্যক্তিগত। বছর সাতেক আগে ভদ্রলোক গৈরিকাকে ফেসবুকের ইনবক্সে বেশ কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ মেসেজ দিয়েছিলেন। তখন গৈরিকা ‘গৈরিকাসান্যাল’ হয়ে ওঠেনি। নিখিলেশের সাথে বিয়েও হয়নি। নিখিলেশ শুনে রেগে গিয়েছিল খুব। “বুড়োভামের রস হয়েছে খুব। কচি মেয়েদের সাথে ইনবক্সে ফ্লার্ট করা। শালাকে ব্লক করে দেবে।” ব্লক করেনি গৈরিকা। নিখিলেশের মত অমন হঠকারী সিদ্ধান্তও নেয় না। হিসাব কষে জীবনটাকে চালায় ও। ওনাকে এড়িয়ে যেত,প্রশ্রয় দিত না। অশ্বত্থমা মিত্রের সেই ক্ষমতা ছিল না,যা গৈরিকাকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারত। আর ভস্মে ঘি ঢেলে লাভ নেই-কথাটা অক্ষরে অক্ষরে মানে গৈরিকা। ফ্লার্ট করলে তার সাথেই করতে হয়,যার হাতে ক্ষমতা আছে। ইন্দ্রনীল বসুর মতো প্রবল ক্ষমতাবান পুরুষ ছাড়া অপাত্রে কিছু দান করতে চায়নি গৈরিকা। না,ভুল হল। অপাত্রে জীবনে একবারই ভালোবাসা দিয়ে ফেলেছিল। তার জের এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। পুরনো জীবনটাকে,নিখিলেশের অধ্যায়টাকে যতই জীবন থেকে মুছে ফেলতে চাক গৈরিকা-মোছা যাচ্ছে না। ছায়া থেকে যাচ্ছে। অথচ নিখিলেশ কখনো প্রকাশ্যে ওদের সম্পর্কের ভাঙনের কথা বলেনি। বিশেষত নিখিলেশ আবার নতুন করে লেখালিখি শুরু করায় ওদের পুরনো বিস্মৃতপ্রায় দাম্পত্যকে কফিন থেকে তুলে এনে আবার পোস্টমর্টেম করা হবে। প্রতিবিম্বকে তাই উপন্যাস দিতে রাজি হয়েছে গৈরিকা। নিখিলেশকে চেপে দিতে হবে। তবে নীল মানে ইন্দ্রনীল যে এতে বিলক্ষণ বিরূপ হবে,এটা জানতে ওর বাকি নেই। নীল চায়না গৈরিকা উচ্ছ্বাসের বাইরে কোথাও লিখুক। ওর কথা গত পাঁচবছর ধরে মেনে এসেছে গৈরিকা। এবার একটু বাইরে পা ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তি দিয়ে বোঝালে নীল বুঝবে,এ ভরসা ওর আছে।

নভেম্বরের শেষ। ঠাণ্ডা পড়েছে। শালের চুড়িদারে বেশ শীত করছে। একটা শাল বা সোয়েটার আনতে হত। শাড়ি পড়তে পছন্দ করে না গৈরিকা। ও চুড়িদারেই স্বচ্ছন্দ। সমস্ত অনুষ্ঠানে তাই চুড়িদার পরে যায়। এখন অনুষ্ঠান খুব একটা অ্যাটেন্ড করে না গৈরিকা। লেখার এত চাপ,তার উপর গদ্যকার,ঔপন্যাসিকদের কবিদের মত সপ্তাহে গণ্ডাখানেক কবিসম্মেলনে সভামঞ্চ আলোকিত করে বসে থাকার দায় নেই। সামনে বইমেলার মরসুম। প্রায় গোটা কুড়ি জায়গা থেকে ওকে দিয়ে মেলা উদ্বোধন করাতে চাইছে। তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ অবধিও দর দিচ্ছে। গৈরিকা সান্যাল একটা ব্র্যান্ড। ওকে আনলে মেলার গ্ল্যামার দশগুণ হয়ে যাবে। ওর জন্যই উপন্যাসবিমুখ,বইবিমুখ,সিরিয়ালে মুখ গুঁজে থাকা পাঠক গত কয়েক বছরে বইমুখী হয়েছে। “রাতজাগা পাখি” “অল্পবিরামের” পর “মোহকুহক” “নিশিযাপন”ও বেস্ট সেলার। বিশেষ করে “মোহকুহক”তো টিনএজারদের হট ফেভারিট। মেলায় গেলেই কলেজপড়ুয়ারা ঘিরে ধরে ওকে। হাতে সদ্য কেনা “মোহকুহক”। অটোগ্রাফ চায়,সবাই। বইটার ইউ.এস.পি যৌনতা। সমকামিতা নিয়ে এত ভালো উপন্যাস এর আগে বাংলা সাহিত্যে লেখা হয়নি। বইটা নিয়ে গৈরিকা নিজে যে গর্বিত,তা নয়। ওর অনেক বেশি কাছের উপন্যাস “রাত জাগা পাখি”। তবে নীল বলে বাজারের চাহিদা বুঝে লেখককেও নিজেকে ভাঙ্গতে হয়। ভেঙ্গেছে গৈরিকা। খোলাখুলিভাবে যৌনতা নিয়ে লিখেছে এই প্রথমবার । তবে আরোপিত যৌনতা নয়। লেখার প্রয়োজনেই যৌনতা এসেছে । চিরন্তনী কুণ্ডুর মত পর্ণোগ্রাফি ও লিখবে না কোনদিন। নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও। কলেজে পড়ায় গৈরিকা। কখনো যেন ওর ছাত্রছাত্রীরা ওকে না বলতে পারে, “ম্যাডাম,আপনি পর্ণোগ্রাফি লেখেন কেন?”-এই চিন্তাটা ওর মাথায় থাকে সবসময়।

সবক’টা বইমেলায় যাওয়া হবে না। গোটা আটেক কি দশেক বইমেলায় যাবে গৈরিকা। যেগুলো কাছে,যেগুলো প্রসিদ্ধ এবং যাদের পারিতোষিকের অঙ্কটা মোটা-এইভাবেই লিস্টটা বানাবে। অশ্বত্থমা মিত্র এখন গৈরিকার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেননা। পুরোনো ধৃষ্টতার কথা মনে পড়ে যায় হয়তো। তবে ভদ্রলোকের কাছে একদিক থেকে কৃতজ্ঞ গৈরিকা। উনিই প্রথম গৈরিকাকে বলেছিলেন, “কবিতা লেখা ছাড়ো,গদ্য লিখতে জন্মেছ তুমি,উপন্যাস লিখতে জন্মেছ। সমাজকে নিয়ে লেখো,মানুষকে নিয়ে লেখো।” গদ্য লিখলে চটজলদি নাম করা যায়। এটাও অনেকে বলেছিল। তাই কবিতা প্রথম প্রেম হওয়া সত্ত্বেও গদ্যে চলে এসেছিল গৈরিকা। হাতেনাতে ফল পেয়েছে। কবিতা নিয়ে বোকা বোকা রোম্যান্টিসিজম দেখালে নিখিলেশ ব্যানার্জীর মত ফেলিওর হয়ে থাকতে হত। ব্যর্থ হতে চায়নি গৈরিকা। সফল হতে চেয়েছিল। ওর আর ওর সাফল্যের মধ্যে আর কেউ কখনো আসতে পারেনি। বাকিদের চিরদিনই এক্স,ওয়াই,জেড ভেবে এসেছে। তবে নীলের ব্যাপারটা আলাদা। ওর প্রতি কৃতজ্ঞতা,আকর্ষণ,অনুরাগ এখন ভালোলাগার ধাপ পেরিয়ে ভালোবাসায় এসে ঠেকেছে। ইন্দ্রনীলকে ভালোবেসে ফেলেছে গৈরিকা। ভালোবাসা,মন জেতার অভিনয় করতে করতে ভালোবেসে ফেলেছে। ইন্দ্রনীলের মত সমর্থ পুরুষকে ভালো না বেসে উপায় ছিল না। অন্যদের মতো ইন্দ্রনীল সিঁড়ির মত ব্যবহার করে ছেড়ে দেওয়া যায়না। ঐ ভবানা মাথায় আসার আগেই শরীরে মনে নীলের ভালোবাসার শৃঙ্খল অনুভব করেছিল গৈরিকা। ছটফট করেনি তাই। উড়তে চায়নি। সমর্পণ করেছে নিজেকে। আর পূর্ণ হয়েছে সাথেসাথেই। সম্পর্কটাকে এবার একটা নাম দিতে চায় গৈরিকা। নীল চায় না। বিয়েতে বিশ্বাস করে না ও। বলে, “বাঁধনে জড়িয়ে লাভ কি? আমি যেমন জানি তুমি শুধু আমার,তুমিও জানো শরীরে মনে আমি তোমারই।” তবুও...একটা সংস্কার ঘিরে ধরে গৈরিকাকে। স্বীকৃতির লোভ পেয়ে বসে। তাছাড়া ওর আর নীলের সম্পর্কটা নিয়ে গসিপ। লোকজনের বাঁকা হাসি,সমস্ত নোংরা কথা-এই একটাভাবেই থামানো যায়। নীলকে আজ না হোক কাল রাজি করাবেই। মনে মনে জেদ ধরেছে গৈরিকা।

অশ্বত্থমা মিত্র সসংকোচে বলেছিলেন খড়গপুর বইমেলায় যাওয়ার কথা। “দেখছি” বলে এড়িয়ে গেছে গৈরিকা। মনে মনে নিজেও একটা সংকোচ অনুভব করে। কথার ছলে ইন্দ্রনীলকে বলে ফেলেছিল অশ্বত্থমাবাবুর গোপন কীর্তির কথা। তার ফলে যে নীল এতটাই রেগে যাবে,ভাবেনি। এই পাঁচবছরে বহুবার নীলকে বলেছে, “উনি একজন সক্ষম লেখক। ব্যক্তিগত রাগে এভাবে উনাকে আটকাতে পারো না তুমি। তাছাড়া উনি ফেসবুক নিয়ে পরপর তিনটে উপন্যাস লিখেছেন। হতে পারে, উপন্যাসের রসদ সংগ্রহের জন্য এভাবে অল্পবয়সী মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করেছিলেন।” “তাহলে সোনাগাছির বেশ্যাদের নিয়ে কাউকে লিখতে গেলে ওখানে খদ্দের হয়ে যেতে হবে, এটাই তোমার মত?” রাগত স্বরে বলেছিল নীল। নীল রাগলে তাকে না ঘাঁটানোই ভালো। হাইপার হয়ে যায়। চুপ করে যেত গৌরিকা। অনিমেষ আঙ্কল অনেক বলে কয়ে এবার ওনাকে একটা সুযোগ করে দিয়েছেন। ইন্দ্রনীল তাতে খুব একটা খুশি নয়,তবে বাবার কথার উপর কথা বলে না ও। আজকের অনুষ্ঠানে আসতে গৈরিকা খুব একটা উৎসাহী ছিল না। নীলের কথায় ওকে আসতে হয়েছে। নীল বলে, “তুমি আমার লাকি চার্ম। তুমি এলে তবেই বইটার ভাগ্য খুলবে।” এখানে এসে গোপাল সরকারকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে গিয়েছিল গৈরিকা। একটা উপন্যাসের উদ্বোধন ওনার মত কবি কি করেছেন? হতে পারে বছর ছয়েক আগে অ্যাকাডেমি পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন তো উনি শেষ। লিটিল ম্যাগাজিন ছাড়া কোথাও ওনার লেখা ছাপা হয় না। অসংযমী জীবনযাপনের জন্য স্বাস্থ্যটাও ভেঙ্গে পড়েছে। এটা হাওয়ারই ছিল। নিজের পদাধিকারকে মিসইউজ করলে এইরকম হয়। যখন ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন,কাউকে উঠতে দেননি। যার মধ্যেই লেখার সম্ভবনা দেখতেন,তাকেই চেপে দিতেন। কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান থেকে তার নাম কেটে দিতেন, তার কবিতা ম্যাগাজিনে নির্বাচিত জানানোর পরেও, কাঠি করে বাদ দিয়ে দিতেন। গৈরিকার সাথেই বহুবার এরকম করেছেন। হিংসা করলে সরস্বতী ছেড়ে চলে যায়। ঠিক তাই হয়েছে। এখন আর লিখতে পারেন না ভদ্রলোক। সরস্বতী ছেড়ে চলে গেলে সম্পাদকেরাও সরে যায়। চ্যালাচামুন্ডারাও পিঠটান দেয়। যেসব সুসজ্জিত নারী একসময় ঘিরে রাখত ওনাকে, একটা লেখে ছেপে দেওয়ার আশায়-আর যাদের সাথে কবিতা ছাপানোর বিনিময়ে প্রতিনিয়ত রতিক্রিয়া করতেন উনি-তারা আজ ওনাকে এড়িয়ে চলে যায়। অন্য কবিকে ঘিরে ধরে,যার হাতে ক্ষমতা আছে। উনি লোল চোখে তাকিয়ে দেখেন। তীব্র জ্বালা ভরা চোখে গৈরিকাকে দেখেন গোপাল। গৈরিকাই সম্ভবত একমাত্র মেয়ে যে ওনার একান্তে দেখা করার অনুরোধ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিল। হিসাব কষেই করেছিল। যেকোনো তরুণীর একটি,দুটি বা বড়জোর তিনটি কবিতা বড় বড় ম্যাগাজিনে ছাপিয়ে দিতেন গোপাল। তারপর তাকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। চিনতেও পারতেন না আর। একটা,দুটো,তিনটে কবিতা গৈরিকার লক্ষ্য ছিল না। তাই গোপালকে এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেছিল। তার ফল বেশ কবারই পেয়েছে। তীব্র বিদ্বেষে কোন বড় কবিতার কাগজে গৈরিকাকে লিখতে দেয়নি উনি। গৈরিকা যখন ভেঙ্গে পড়ছিল,লেখা ছেড়ে দেবে ভাবছিল-তখনি নীল আসে ওর জীবনে। জীবনটা বদলে যায়,রূপকথার মত।


“উনি আসবেন,আমি জানতাম না। ট্রাস্ট মি। অশ্বত্থমা বাবুর খুব কাছের বন্ধু তাই...” নীল ওর অস্বস্তি দেখে অজুহাত দিয়েছিল। গৈরিকাকে শান্ত করতে চেয়েছিল। কথা বাড়ায়নি গৈরিকা। অশ্বত্থমা আর গোপাল দুজনের কাছেই কোন না কোনভাবে কৃতজ্ঞ ও। একজন উৎসাহ দিয়েছিলেন,অন্যজন বারবার বাতিল করে জেদটাকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। গৈরিকার স্বামী হিসাবে গোপালের প্রত্যাখ্যানের খাঁড়া নিখিলেশের উপরেও গিয়ে পড়েছিল,নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল ও। অমেরুদন্ডী সরীসৃপের মত হার স্বীকার করে কোটরে ডুবে গিয়েছিল। আসলে জিততে শেখেইনি নিখিলেশ,হেরেই ওর আনন্দ। হারার অপমানের নীলজলে আকণ্ঠ ডুবে থেকে নিজেকে ট্র্যাজিক হিরো প্রমাণ করতে চায়। লোকের সিমপ্যাথি কুড়িয়ে ভাবে কত কি পেলাম! ওদের সম্পর্কে,ওদের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য সবাই গৈরিকাকে দোষ দেয়। গৈরিকা নিজের উচ্চাভিলাষের জন্য বেচারা নিখিলেশকে ছেড়ে ইন্দ্রনীল বসুর শয্যাসঙ্গিনী হয়েছে। বলে গৈরিকা মন্দ,আর নিখিলেশ ভালো। এই সহজ সমীকরণে বিশ্বাস করে অধিকাংশ মানুষ,করুক। তাতে গৈরিকার কিছু মাত্র যায় আসে না। কালের স্রোতে নিখিলেশকে ছেড়েছিল। রানাঘাটের মত মফঃস্বল শহরে একটা ভাঙ্গাচোরা বাড়ির স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘরে অখ্যাতির গাঢ় কুয়াশায় ডুবে যেত চায়নিও। আলোয় আসতে চেয়েছিল, বাঁচতে চেয়েছিল। নিখিলেশের সাথে থাকলে যা অসম্ভব ছিল। প্রত্যেকটা প্রত্যাখ্যান নিখিলেশকে আরো বেশি করে হতাশ করে তুলছিল। "এর জন্য আমার হল না। ঐ শালা আমায় কাঠি করল...।" অজুহাত দিতে পছন্দ করত ও। সমস্ত দুনিয়া ওর মত মহান প্রতিভার প্রতি ষড়যন্ত্রে মেতে রয়েছে-এটাই ছিল ওর দৃঢ় ধারনা। আরও ভালো লেখার বদলে,সবার সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করল। যারা ভালো চাইত,বন্ধু ছিল-তারাও বুঝল না অবসাদগ্রস্ততার জন্য নিখিলেশ এমন খেঁকতুরে হয়ে উঠেছে। সবার থেকে ভালো লেখে ও-এই ধারনা আগে গৈরিকার উপরেই জাহির করত-পরে সবার মুখের উপর বলতে থাকল। একঘরে হয়ে গেল। লেখা আসত না তেমন। মদে ডুবে গেল। সন্ধ্যা হতে না হতেই আকণ্ঠ মদ গিলে নিত। আর তারপর সারারাত প্রলাপ বকত। নিজের অবসাদ দিয়ে গৈরিকাকেও গ্রাস করতে চাইছিল-ক্রমশ। ওখানে আর কয়েকমাস থাকলে গৈরিকাও লিখতে পারত না কোনদিন। অন্যদিকে নীল ওকে রাণাঘাট থেকে উদ্ধার করে এনে কলকাতায় চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিল। ওর থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। বিনিময়ে কিছু চায়নি। কিছু না। শুধু গৈরিকা ভালো লিখুক এটাই ওর চাওয়া ছিল। ভালোবাসা ছিল,তবে নীল সোচ্চার হয়নি কখনোই। “রাত জাগা পাখি”র অভাবনীয় সাফল্যের পর গৈরিকা নিজেকে আটকায়নি। নীলকে সবকিছুই দিয়েছিল-যা ও দিতে পারে। নীল খুশি হয়েছিল,ভালোবেসেছিল প্রাণ ভরে। নিখিলেশের কাছ থেকে ডিভোর্স পেতেও গৈরিকাকে খুব সাহায্য করেছে ইন্দ্রনীল। সুতরাং ইন্দ্রনীল বসুর শয্যাসঙ্গিনী হয়েই যে গৈরিকার এই উত্থান-প্রচলিত এই ধারণাও সম্পূর্ণ অসত্য। নীল বলে এসব নিয়ে মন খারাপ না করতে। কেউ সফল হলে তবেই তাকে নিয়ে গুজব ছড়ায়।

-গাড়ি আসেনি?

নীলের গলা পেয়ে তাকাল গৈরিকা। নীলকে আজ দারুণ দেখাচ্ছে। এমনিতেই সুন্দর নীল। ছয়ফুটের উপর লম্বা,সুঠাম চেহারা,একমাথা চুল,গালে চাপ দাড়ি,গায়ের রং বেশ ফর্সা। আজ ট্র্যাডিশনাল পাঞ্জাবি,পায়জামায় আরো ভালো লাগছে যেন। কাছে যেতে ইচ্ছা করল গৈরিকার। ভালোবাসতে ইচ্ছা করল।

-না। ড্রাইভার আনতে গেছে। এসে পড়বে। তুমি কখন আসছ?

-আমি হয়তো আজ আসতে পারব না।

-মানে? গত তিনদিন তুমি আসোনি। কাজের বাহানা দিয়েছ। বারবার বলেছ যে শনিবার আসবে...

গৈরিকা রেগে গেল। এরকম করছে কেন নীল? এই সপ্তাহে মাত্র একদিন এসেছিল। গত সপ্তাহে দু’দিন। মাসখানেক ধরেই দেখেছে নীল সময় দিয়েও আসতে পারছে না। এড়িয়ে যাচ্ছে কেন?

-সোনা,কাম ডাউন। আসতে কি আমিও চাইনা? কিন্তু আজ বাড়ি ফিরতেই হবে। বাবার হুকুম আজ বাবার আদরের ভাইঝি মিমির বার্থডে। পার্টি আছে।

কথাটা শুনে একটু থমকাল গৈরিকা। অনিমেষ আঙ্কলের একমাত্র বোন মৃত্তিকা পিসিমণি নীলদের বাড়িতেই থাকেন, ডিভোর্সী। অনিমেষ আঙ্কল মিমি অন্ত প্রাণ। ওর জন্মদিনটা বড় অকেশন তাই নীলের হাজিরা প্রয়োজন। কিন্তু ব্যাপারটা কি এতটাই সহজ? নাকি অনিমেষ আঙ্কল ঠাণ্ডা মাথায় নীলকে নানান অছিলায় গৈরিকার থেকে দূরে রাখছেন। হতে পারে।

-চলো,তাহলে আমিও যাই।

নীলের মুখের রঙ বদলে গেল যেন। গৈরিকা এরকম প্রস্তাব দেবে ও ভাবতে পারেনি। তবে দক্ষ ব্যবসায়ী যে কোন পরিস্থিতিই সামলাতে পারে।

-নিয়ে যেতে পারলে তো ভালোই হত। কিতু এটা তো ফ্যামিলি অ্যাফেয়ার।

-তাতে কি? আমি কি তোমার ফ্যামিলি নই?

-অফকোর্স ডিয়ার। ইউ আর মাই ওয়ার্ল্ড। কিন্তু আমি চাই না তোমাকে কোন অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে পড়তে হোক।

-কেন? গেলে আঙ্কল কি তাড়িয়ে দেবেন?

--তা কেন? তবে...

-তবে?

-তুমি জানো। বাবা তোমার কাছ থেকে যা চেয়েছিলেন তুমি তা দিচ্ছ না। এই নিয়ে বেশ অসন্তুষ্ট উনি...

-হোল্ড অন। অসন্তুষ্ট হবেন কেন? উনি যা চান, যেমনটা চান তেমনভাবেই আমি লিখে এসেছি। এখন যদি আমি একটা বিষয় নিয়ে লিখতে না চাই তাহলে উনি অসন্তুষ্ট হয়ে যাবেন? উচ্ছ্বাসের জন্য লিখি বলে কি আমার নিজস্ব মতামত নেই?

-মতামত থাকবে না কেন? তুমি স্বাধীন মানুষ। তোমাকে তো আমরা কিনে রাখিনি। তবে বাবা তোমার জন্য যা যা করেছেন,তারপর উনিও কিছু চাইতেই পারেন।

-ওনার চাওয়াতেই তো ‘মোহকুহক’ আর ‘নিশিযাপন’ লিখলাম। এবারের উপন্যাসটা আমার স্বপ্নের উপন্যাস। অনেক খেটেছি আমি উপন্যাসটার জন্য...

-আই নো! ওটা একটা ক্লাসিক উপন্যাস হবে। বাট সোনা, তোমার কি মনে হয় না দেশভাগ নিয়ে উপন্যাস বড্ড ক্লিশে হয়ে গেছে। নয় নয় করে শ খানেক উপন্যাস লেখা হয়ে গেছে ঐ টপিকে। আর আজকের জেনারেশনকে দেশভাগ কি আর ততটা ছুঁতে পারে?

-আমার পূর্বপুরুষের ইতিহাস আমাকে ছোঁবে না? সে কি? তাছাড়া আমি সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিকে...

-হবে ওটাও হবে। তবে বাবার কথাটাও একটু ভেবে দেখো। আমি জোর করব না। বাবা পঞ্চাশ বছর এই লাইনে আছেন। উনি বোঝেন, কোন জিনিসটা বিকোবে, আর কোনটা বিকোবে না। গৈরিকা সান্যালের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেকের প্রবল উৎসুক্য। বিশেষ করে তোমার আর ঐ লুজারটার সম্পর্ক নিয়ে। এটার উপর উপন্যাস হলে...

গাড়ি চলে এসেছিল। গৈরিকা ইন্দ্রনীলকে থামিয়ে দিল। ও এবিষয়ে আর কোন তর্ক চায়না।


পর্ব-তিন

কলেজস্ট্রীটের ফুটপাত দিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরছিল নিখিলেশ। অনেক পুরনো কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিল আজ। সুদেববাবু এমনভাবে গৈরিকার কথা তুললেন-উনি কি জানেন না গৈরিকা নিখিলেশের প্রাক্তন স্ত্রী,ওর সন্তানের মা? নাকি জেনেও ডেলিবারেটলি এটা করলেন? নিখিলেশের প্রতিক্রিয়া দেখতে চেয়েছিলেন হয়তো। কোন প্রতিক্রিয়া দেয়নি নিখিলেশ। অত সফল মানুষের প্রতি কোন প্রতিক্রিয়া দেওয়ার অবস্থায় নেই ও। গৈরিকা প্রতিবিম্বে লিখবে শুনে,বেশ অবাক লাগছে। উচ্ছ্বাসের বাইরে তো কখনো লেখেনি ও। তাহলে হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত? খুব মুডি মেয়ে। ইন্দ্রনীলের সাথে কোন মনোমালিন্য হয়নি তো? তার জেরেই হয়তো দুম করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হতেও পারে। তবে আর্চি যে বলে নীল আঙ্কল রোজই মামমামের কাছে আসে? অঙ্কটা মিলছে না। মেলাতেও চায় না নিখিলেশ। গৈরিকা যা খুশি করুক। ও ভালো আছে এটাই যথেষ্ট। প্রতিবিম্বে লেখা দেওয়ার সিদ্ধান্তকেও মনে মনে তারিফ করল নিখিলেশ। উচ্ছ্বাসের মাইনে করা লেখিকার তকমাটা ঝেড়ে ফেলার সময় চলে এসেছে। গৈরিকা সান্যাল এখন সেলেব্রিটি। খুব বড় নাম। এখনি তো সময় পাবলিকেশনদের নিজেদের মত চালনা করার। গৈরিকা ঠিক সময় ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জানে। তাই আজ ও শীর্ষে উঠেছে। সে যেভাবেই হোক না কেন। নিখিলেশ ব্যক্তিগত ভাবে যদিও এভাবে উপরে ওঠাকে মেনে নিতে পারে না,তবুও আজকের দুনিয়ায় সাফল্যটাই গুরুত্বপূর্ণ। সফল হতে নিখিলেশও চায়। তার জন্য নিজেকে অনেকটা বদলেছে ও। লোকের কথা গায়ে মাখে না। কে কি বলবে না বলবে ভেবে নিজেকে গুটিয়ে রাখে না। কারোর সমালোচনা করে না। কেউ লেখার অক্ষম প্রচেষ্টা করছে দেখেও তাকে থামায় না-আত্মতৃপ্ত হতে দেয়। কারোর উপকার করে না। আজ অবধি যার উপকার করেছে,সে-ই গুছিয়ে বাঁশ দিয়েছে। শুধু নিজের কাজটা করে যায়। ফলের আশা আগে করত না। প্রতিবিম্ব থেকে সুযোগটা পেয়ে মনে একটু হলেও আশা জেগেছে। গৈরিকার সাথে একসাথে পত্রিকার সম্পাদনা করার সময় স্বপ্ন দেখত ওরা-কোন এক বইমেলায় তাদের দুজনের বই একই প্রকাশনা থেকে বার হচ্ছে। স্বপ্নটা এতদিন পর সফল হচ্ছে তাহলে। ভাবতে বেশ ভালো লাগছিল নিখলেশের। গৈরিকার উপন্যাসের পাশে ওর বইটা খেলো হয়ে যাবে-এ ভাবে ভাববে হয়তো অনেকেই। নিখিলেশ সেভাবে ভাবছে না। নিজের লেখার উপর আস্থা আছে ওর। দুজনের বই-ই সফল হোক,ও চায়। হতাশা আর অবসাদকে অনেকটাই ঝেড়ে ফেলেছে নিখিলেশ। মদটাও তেমন খায় না আর। আগোছালোভাবটাও কাটিয়ে উঠেছে। নিখিলেশও যে সফল হতে পারে,এটা প্রমাণ করার তাগিদ প্রত্যহ অনুভব করে ও। গৈরিকার কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে চায় না। নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে চায়। এই কলেজস্ট্রীট,কফি হাউস,পাতিরাম-ওর বড় চেনা। গৈরিকার হাত ধরে প্রত্যেক শনিবার এখানে আসত। কফি হাউসে বসত,আড্ডা দিত,তর্ক বিতর্ক করত,খোঁজখবর করে ভালো বই কিনত,ওদের ম্যাগাজিনটা বিক্রি হল কিনা খোঁজ নিত। আজও শনিবার। নিখিলেশ আবার এসেছে কলেজস্ট্রীটে,কিন্তু একা। ওর হাতে গৈরিকার হাত নেই। অবশ্য একাকীত্বের অভ্যাস হয়ে গেছে ওর। পাঁচবছর হল গৈরিকা চলে গেছে। ছয়মাসের ছোট্ট আর্চিকে ফেলে চলে গেছে। এভাবে না বলে চলে না-ও যেতে পারত। যোগ্যতার কাউকে ভালোবেসেছে বলে গেলে কি ক্ষতি হত? নিখিলেশ কি আটকাত? নাঃ,আটকাত না। ভালোবাসা মরে গেলে তাকে জোর করে বাঁচানো যায় না। মৃত ভালোবাসার লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়ার থেকে-এই বেশ ভালো হয়েছে। আর্চিকে রেখে গিয়েছিল ভাগ্যিস। না হলে একেবারে একা হয়ে যেত নিখিলেশ। গৈরিকা চলে যাওয়ার মাস ছয়েকের মধ্যেই নিখিলেশের মা মারা গেলেন। বাবা তো ওদের বিয়ের আগেই গত হয়েছিলেন। বছর খানেকের আর্চিকে একা হাতে সাড়ে পাঁচ বছরের করেছে নিখিলেশ। ওর কাস্টডি চায়নি গৈরিকা। শুধু শনিবার,রবিবার ওকে ওর মায়ের কাছে রাখার আদেশ দিয়েছে কোর্ট। গৈরিকার প্রয়োজন ছিল না। কোর্টের আদেশ অমান্য করতে পারে না বলেই আর্চিকে প্রতি শনিবার ওর মায়ের কাছে দিয়ে আসে নিখিলেশ। আর্চি যেতে চায়না।মামমাম কথা বলে না,গল্প করে না,খেলে না-হয় সারাদিন বসে বসে লেখে কিংবা সেজেগুজে বাইরে যায়। রাতেও আর্চির কাছে শোয় না। ওকে ঘুম পারায় না। নীল আঙ্কলের সাথে গল্প করে। আর্চি ওখানে নিজেকে লেফট্‌ আউট মনে করে। বাবা কখন নিয়ে যাবে ভাবে। ওকে এই টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই থাকে না নিখিলেশের। কিন্তু আইনের হাতে বন্দী ও। মাঝে মাঝে মনে হয়,এই শনিবার নিয়ে যাবে না। ওর মায়ের কাছে থাকাটা ওর মানসিক বিকাশের জন্য জরুরী ভেবে জজসাহেব এই আদেশ দিয়েছেন। ওখানে গিয়ে মাকে কতক্ষণ পায় ও? একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে প্রত্যেক বার যায়,নিখিলেশই ভুলিয়েভালিয়ে পাঠায়, “এবার চল দেখবি মামমাম কত্ত আদর করবে।”-প্রতিবারই খালি হাতে ঠোঁট ফোলাতে ফোলাতে ফেরে। আর্চির কষ্টে নিখিলেশও কষ্ট পায়। মনে হয় গৈরিকাকে বলে-অনেক তো হল,এবার এই সাপ্তাহিক নাটক বন্ধ করে দাও। বলতে পারে না। গৈরিকাকে চোখের দেখাটুকু তো দেখতে পায় আর্চি। ওর জন্য এটাই যথেষ্ট-সবার কপালে তো আর মা থাকে না।

-তুই আর কাজ পেলি না, মোহকুহক কিনলি?

সামনের সিটে বসা কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েদুটোর বাড়ি কৃষ্ণনগর। ওরা একটা লিটল ম্যাগাজিন করে। সদ্য শুরু করেছে, তাই উৎসাহ খুব বেশি। ওদের আজকে কলেজস্ট্রিটেও দেখেছে নিখিলেশ। কৃষ্ণনগর লোকালে ওর উল্টোদিকের সিটে বসেছে দুজনে। হাওয়ার বিপরীত দিকে ওরা,হাওয়ার দিকে নিখিলেশ। দুই পক্ষই জানলার ধারে। নিখিলেশ ট্রেনে বসেই প্রুফটায় চোখ বোলাচ্ছিল। খুব একটা ভুল নেই। মন দিয়ে নিজের কাজ করছিল,হঠাৎ ওদের কথায় ওর তন্ময়তা ভাঙল। ছেলেটা মেয়েটাকে কথাটা বলল। বেশ বিরক্ত ওর স্বর।

-কেন? বেস্টসেলার এখন। সবাই পড়ছে।

-ছাতার মাথা বেস্টসেলার! রাবিশ বই একটা।

-দ্যাখ ঋজু,বাড়াবাড়ি করিস না। গৈরিকা সান্যালের লেখা বই কখনোই রাবিশ হতে পারে না।

-অরে থাম! গৈরিকার ফ্যান তুই জানি, আমিও ফ্যান। রাত জাগা পাখি আর অল্পবিরাম-এর মত উপন্যাস হয় না। কিন্তু তা বলে মোহকুহক? নিজেকে এইভাবে নীচে নামাচ্ছেন কেন উনি?

-সমকামিতা নিয়ে লিখেছেন যখন যৌনতা আসবেই।

-সুপর্ণা,আমি জানি আসবে। তা বলে এত খোলাখুলি ভাবে? রাতজাগা পাখিতেও যৌনতা ছিল। মহুয়া আর কুন্তলের মধ্যেকার যৌনতা কত রেখে ঢেকে বলেছিলেন খেয়াল আছে?

কিন্তু যৌনতারেই দিকটা মানে সমকামিতা নিয়ে তো অনেকেই অন্ধকারে,পাঠকের জানার প্রয়োজনেই হয়ত উনি লিখতে বাধ্য হয়েছেন।

-উনি কি জীবনশৈলী শিক্ষিকা নাকি? পড়ান তো ইংরাজি সাহিত্য তাহলে লেখায় এত বায়োলজি কেন? আসল কথা হল উচ্ছ্বাসের কথায় এখন উনি ওঠেন বসেন। উচ্ছ্বাস যেভাবে ওনাকে দিয়ে লেখাতে চায়,সে ভাবে লেখেন।

-শুধু ওনাকে দোষ দিচ্ছিস কেন? চিরন্তনী কি লিখছে এখন?

-ঐটা এসেই তো রসাতলে দিল সব। আর ওর সাথে পাল্লা দিতে গিয়েই গৈরিকার অধঃপতন হল। উচ্ছ্বাসেরই ভালো এতে। দুজনে পাল্লা দিয়ে পর্ণো লিখছে-আর হু হু করে বই বিকিয়ে যাচ্ছে।

-পাঠকের চাহিদাটাই হয়তো এখন এইরকম।

-হতে পারে। তবে সাহিত্য বাজার ধরার জন্য নিজেকে বদলাবে,এটা মানতেও কেমন যেন লাগে।

মেয়েটা আড়চোখে নিখিলেশের দিকে তাকাল। নিখিলেশ চোখ সরিয়ে নিল। ওদের কথা যে ও শুনছে বুঝতে দেওয়া যাবে না।

-কাকু,আপনি লেখেন?

-বেশ কয়েকটা স্টেশন পার হওয়ার পর ছেলেটা প্রশ্ন করল। হাতে কবিতার প্রুফটা লক্ষ্য করেছে ওরা। নিখিলেশ কাকু সম্বোধন একটু অবাক হলেও পরে ভাবল ঠিক আছে। সাঁইত্রিশ বছর বয়স হল। চুলে পাক ধরেছে বহুদিন আগেই। দাড়িও পাকা। এদের বয়স বছর আঠারো হবে। কাকু হতেই পারে।

-ঐ অল্প স্বল্প।

-আজ আপনাকে কলেজস্ট্রীটেও দেখলাম। বই বেরোবে আপনার?

-হুম। তোমরা ম্যাগাজিন কর?

-হ্যাঁ,লিখিও।

-কি নাম তোমাদের ম্যাগাজিনের?

-রোদ্দুর।

-বাহ। দুজনেই কবিতা লেখ?

-হ্যাঁ।

-কবিতা কেন? গল্প লেখ। চটজলদি বিখ্যাত হয়ে যাবে।

-আমিও সুপর্ণাকে তাই বলি। এত গৈরিকা সান্যাল পড়িস,তো গল্প লেখ। উনিও তো আমাদের জেলারই মেয়ে ছিলেন,তাই না?

নিখিলেশ মৃদু হাসে

-ঠিক।

-আপনি গল্প লেখেন?

-গল্প? নাহ। আমি বড্ড কুঁড়ে বাবু। গপ্পো আমার দ্বারা হয় না। কবিতা লিখি।

-বাড়ি কোথায় আপনার?

-রাণাঘাট।

-তাই? সত্যি? তাহলে গৈরিকা ম্যাডামকে চেনেন?

-সুপর্ণা! কি রে তুই! হ্যাংলামো করিস না। রাণাঘাটের লোক হলেই কি গৈরিকা ম্যাডামকে চিনবে? তাছাড়া উনি রাণাঘাটে আসেন না। ওনার ডিভোর্সের পর থেকেই ওমুখো হন না।

-নাই আসতে পারেন। ওনার কোন দায় পড়েনি ঐ মফস্বলে পড়ে থাকার। আচ্ছা কাকু,ওনার ছেলে আছে না? কি যেন নাম-অরিন। একটা লেখায় লিখেছিলেন।

নিখিলেশ জানে কোন লেখাটায় গৈরিকা আর্চির নাম লিখেছিল। এবার মাদারস্‌ ডের কলামে। উচ্ছ্বাসের পত্রিকায় বেরিয়েছিল লেখাটা। গৈরিকার মাতৃত্বকে আলোকিত করতে চেয়েছিল ওরা। আর্চিকে সপ্তাহে মাত্র দেড়দিন পায় বলে ওর মামমামের মন খারাপ হয়-এমনও লিখেছিল গৈরিকা। অবশ্য আর্চি নয়। রিন্টু। অরিনকে ওর মামমাম রিন্টু বলে ডাকে। ঐ লেখাটার পর অজস্র পাঠক চিঠি পাঠিয়েছিলেন পত্রিকা দপ্তরে। বেশিরভাগই নিখিলেশের শ্রাদ্ধ করে লিখেছিলেন। নিখিলেশের জেদের জন্য অরিন তার মায়ের থেকে দূরে থাকে এটা তাদের মতে অমার্জনীয় অপরাধ। সৌগত দা চিঠিগুলো পড়িয়েছিল নিখিলেশকে। “দ্যাখ! কি চাল দিল গৈরিকা দেখলি? রাণাঘাটের মানুষ ছাড়া কেউ ওর আসল রূপ জানে না। নিজেকে আর্চির জন্য হাপিত্যেশ করা বেচারি মা প্রমাণ করার জন্য এতবড় নাটক! ছিঃ!” নিখিলেশ থামিয়ে দিয়েছিল, “থাক না। ও বললেই তো সত্যি বদলে যাবে না। তাছাড়া ও কোথাও দোষ দেয়নি। নিজে পায় না-এটাই বলেছে। এখন পাঠক যদি ব্যাপারটাকে এভাবে নেয়...” “নেবেই। ক’টা দিন যাক,তুই মাতাল,চরিত্রহীন,সন্দেহবাতিক...” নিখিলেশ কথাটার কোন উত্তর দেয় নি। ওর মনে কোথাও একটা বিশ্বাস আছে,গৈরিকা এমনটা অন্তত করবে না। ব্যক্তিগত জীবনকে এভাবে পাবলিক করার মত রুচি নেই ওর।

-হ্যাঁ। অরিন। ডাক নাম আর্চি।

-না,না-রিন্টু।

-তুমি তো বেশ খুঁটিয়ে পড় দেখছি।

-গৈরিকা সান্যালের সব লেখা পড়ি আমি,মোহকুহক কিনলাম আজ।

-কৃতিত্ব করেছ যেন। কাকু, আপনিই বলুন,এমন থার্ড গ্রেড উপন্যাস ওনাকে মানায়?

-কেন মানাবে না? বেস্টসেলার তো। আজকেও কলেজস্ট্রীটে দেখলাম তোমাদের বয়সের ছেলেমেয়েদের ভিড়।

-দেখেছিস তো? কাকুও আমার সাথে একমত।

-মোটেও না। আচ্ছা আপনি বলুন,চিরন্তনী কুণ্ডুর সাথে রেষারেষি করে কি লাভ হচ্ছে ওনার?

-ক্ষতিও তো হচ্ছে না। প্রচুর টাকা পাচ্ছেন। ওনারও অনেক বাধ্যবাধকতা আছে। উচ্ছ্বাসের জন্য লেখেন, ওরা যেমনটা চায় তেমনি লিখতে হয়।

-তাহলে উচ্ছ্বাস ছেড়ে দিন। অন্য পাবলিকেশনও আছে।

-সেখানে তো গ্ল্যামার নেই।

-স্বাধীনতা তো আছে।

-ওদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগছিল নিখিলেশের। কথায় কবিতার কথা উঠল। ওরা কবিতা শোনাল। নিখিলেশকেও অনুরোধ করল। ডালমুট খেতে খেতে কবিতা শোনাল নিখিলেশ। কবিতার কাটাছেঁড়া করতে করতে পায়রাডাঙ্গা চলে এল। নিখিলেশ প্রুফটা ব্যাগে পুরে উঠে দাঁড়াল।

-কাকু,আবার দেখা হবে।

-অবশ্যই। বইমেলায় এসো।

-আপনার বই কোথা থেকে বেরোচ্ছে যেন?

-প্রতিবিম্ব।

-ওরে বাবা। বড় প্রকাশনী তো।

-তা একটু। তোমার গৈরিকা ম্যাডামের উচ্ছ্বাসের মত নয়।

-আপনার বাড়ি আসতে পারি,রাণাঘাটে?

-আসবে? এসো। ফোন করে নিও একবার। নাম্বারটা তো দিয়েই দিয়েছি।

-হ্যাঁ। আপনার পত্রিকার নাম কি যেন?

নিখিলেশ এতক্ষণ আড়ালে ছিল। ভালোই ছিল। বিখ্যাত না হওয়ার এটাই সুবিধা। এবার পরিচয় দিতেই হবে।

-পত্রিকার নামে সেভ করবে? না আমার নামে?

-দুটোই বলুন।

-পত্রিকার নাম পুনর্জন্ম। আমার নাম বলতে হবে?

সুপর্ণা আর ঋজু থ হয়ে গিয়েছিল। পুনর্জন্ম মানে গৈরিকা সান্যালের পুরনো পত্রিকা। তাহলে ইনিই কি নিখিলেশ ব্যানার্জী? তাহলে ওনার সামনে এসব বলে তো বড্ড ভুল করে ফেলেছে ওরা

-কাকু,আমরা ওভাবে...

-না,না। ইটস্‌ ওকে। একদিন এসো। আড্ডা হবে। আর্চিকেও পেয়ে যাবে বাড়িতে,মানে তোমাদের গৈরিকা ম্যাডামের রিন্টুকে আর কি...



রাণাঘাট এলে ট্রেন থেকে নেমে গেল নিখিলেশ। ওরা দুজনে নিজেদের মধ্যে এখন কত কিছুই না আলোচনা করবে। ভাববে নিখিলেশ ব্যানার্জীকে দেখে তো বোঝা যায় না উনি কতটা মাতাল,কতটা দুশ্চরিত্র,লম্পট,সুপর্ণা বলবে, “ লোকটাকে দেখে বোঝা যায়না,এর মানসিক অত্যাচারেই গৈরিকা ম্যাডাম লেখা ছেড়ে দিচ্ছিলেন।” ঋজু বলবে, “ওসব ঢপের গল্প। আসলে ইন্দ্রনীল বসুর মত গাছ দেখেছিল,তাই নৌকা বেঁধেছে।” তর্ক চলবে ওদের মধ্যে। নিখিলেশ স্টেশনের গ্যারেজ থেকে বাইকটা নিল, আজ আর্চি বাড়ি নেই। মদ খাওয়া যেতেই পারে। ও থাকলে খায়না নিখিলেশ। বড় চৌখস ছেলে। বলে কিনা, “বাবা তোমার মুখে পচা গন্ধ যে?” মদ খেতে হবে আজকে। সারাদিন যা চলল-ঘুম আসবে না।

ক্রমশঃ


Previous Post Next Post