পিয়ালী গাঙ্গুলি

কাঁটাতার
"এ...." সীমান্ত রক্ষীর গালাগালি গর্জে উঠল পেছনে। কোনোমতে প্রাণ নিয়ে দৌড়। তাড়াহুড়োয় কাঁটাতার টপকাতে গিয়ে জাভেদের বুকে আর পেটে তারের খোঁচা লেগে খাবলে খানিকটা মাংস উঠে এল। সঙ্গে ফিনকি দিয়ে রক্ত। যন্ত্রণায় মুখ কুঁকড়ে উঠল জাভেদের। কিন্তু ওসব দিকে তাকানোর এখন সময় নেই। ধরা পড়লে মারধর, গালাগালি তো আছেই কিন্তু ৩০০ টাকার (৪ ডলার) ক্ষতিটা আরো অনেক বেশি। রোজই এইভাবে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বর্ডারের এপার ওপার মাল পাচার করে জাভেদ আর তারই বয়সী আরও সঙ্গীসাথীরা। চাল, মোবাইল ফোন, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, সি এফ এল বাল্ব ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ফেনিসিডিল কফ সিরাপের। বাংলাদেশে নেশার জন্য ব্যবহার করা হয়। দাম ভারতবর্ষের চেয়ে অনেক বেশি। সীমান্ত রক্ষীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। এবার শুধু বি জি বি বা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের চোখে ধুলো দেওয়া।

আজকের মত বেঁচে গেছে জাভেদ। বাড়ি ঢোকার আগেই সালিম ভাইয়ের কাছে আজকের মাল জমা দিয়ে টাকার হিসেব বুঝে নিল জাভেদ। গায়ের ক্ষতগুলোয় মলম, পট্টির ব্যবস্থাও করে দিয়েছে ভাই। বর্ষাকাল এসে গেছে। চোরাচালানের ভরা মরশুম। সামনেই আবার ঈদ। এইসময় এই ছেলেগুলো মহা মূল্যবান সালিম ভাইয়ের কাছে। জাভেদ ভাবছে আম্মির চোখকে কিকরে ফাঁকি দেবে। জামাটাও তো ছিঁড়ে গেছে। কিছু একটা গল্প বানাতে হবে। এই মরশুমে দুহাত ভরে রোজগার করে নিতে হবে। আম্মি জানে ছেলে শহরে কোনো দোকানে কাজ করে। যেদিন বেশি রাত হয়ে যায়, সেদিন আর বাড়ি ফিরতে পারে না। কলেরায় আব্বু যখন মারা যায়, জাভেদ তখন বেশ ছোট। পরের ক্ষেতে মজদূরী করে আম্মি যা পায় তাতে মা ছেলের রোজ দুবেলা দুমুঠো জুটত না। এখন জাভেদ কিছটা হলেও সাহায্য করতে পারে। ছেলের লেখাপড়া হল না বলে আম্মির খুব আক্ষেপ। জাভেদের ওসব কিছু মনে হয় না। পড়াশুনোর চেয়ে পেটের ক্ষিদে মেটানো অনেক বেশি জরুরি।

খোকনের ছোট্ট পায়ের পাতায় তখন ভারী বুট দিয়ে মাড়াচ্ছে সীমান্ত রক্ষীর এক বীরবিক্রম জওয়ান। অনেকদিন ধরে চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে। কয়েকদিন দৌড়েও ধরতে পারেনি। আজও হয়ত ধরতে পারত না যদি না কোমড় থেকে ফেনিসিডিলের শিশিগুলো পড়ে যেত। এতদিনে বাগে পাওয়া গেছে। আজকে সব শোধ তুলে নেবে। বহুত ভুগিয়েছে ছেলেগুলো। বাবলু, কিশোর, সৌরভ, ইমরান সকলেরই দেহের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে রক্ত ঝরছে। "স্টপ ইট রাইট নাও"। বজ্রকণ্ঠটি সীমান্ত রক্ষীর সাউথ বেঙ্গলের নতুন ইন্সপেক্টর জেনেরাল বিকাশ শর্মার। মানুষটি যে তার পূর্বসূরিদের থেকে একটু আলাদা সে খবর আগেই রটে গেছিল। দক্ষিণ বঙ্গের দায়িত্ত নেওয়ার পর থেকেই হটাৎ হটাৎ এদিক ওদিক সারপ্রাইস ভিজিট , রদবদল, উন্নয়নমূলক প্রকল্পের উদ্ভাবন এসবের জন্য ইতিমধ্যেই বেশ বদনাম কুড়িয়েছেন। তবে তিনি যে আজ এই আউটপোস্টে আচমকা হানা দেবেন তা ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায় নি। "উন সাবকো ইধার ভেজো" নির্দেশ দিয়ে উনি ঘরে ঢুকে গেলেন। বাচ্চাগুলোর সাথে অনেকক্ষন সময় কাটালেন, খাবার দাবার আনালেন ওদের জন্য। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অর্ডার দিলেন ওদের প্রত্যেককে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিতে।

সীমান্ত রক্ষীর আর 'বি জি বি'র ফ্ল্যাগ মিটিং। অনুপ্রবেশ, জঙ্গি কার্যকলাপ, সীমান্তে চোরাচালান অনেক কিছুই আছে বিষয়ের তালিকায়। প্রতিবারই থাকে। আলাপ, আলোচনা হয়, ঘটা করে সাংবাদিক সম্মেলন হয়। তারপর বেশিরভাগ আলোচনা ফাইলবন্দীই পড়ে থাকে দপ্তরে দপ্তরে। মুখোমুখি যতই মিষ্টি কথা, মিষ্টি মুখ হোক সীমান্তে অনুপ্রবেশ, চোরাচালান সবই চলতে থাকে আগের মত। সর্ষের মধ্যেই যে ভুত আছে সেটা দুদেশের সরকারের কারুরই অজানা নয়। টাকার ভাগ বাটোয়ারায় সন্তুষ্ট না হলে গোলাগুলি চলে। প্রাণ যায় কিছু গরিব চোরাচালানকারীর। রাঘব বোয়ালরা চিরকাল অধরাই থেকে যায়। এমনিতেই 'ট্রিগার হ্যাপি' বলে সীমান্ত রক্ষীর একটা বদনাম আছে। শিশুদের মারধোর, কিশোরী বা যুবতীদের ওপর অন্যধরনের অত্যাচারের খবরও গোপন নয়। সাম্প্রতিককালে সীমান্ত রক্ষীর অত্যাচারের কয়েকটা ভি ডি ও ফুটেজ নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বেশ হইচই হয়েছে। সরকার বেশ চাপে। তাই আপাতত একটু নড়ে চড়ে বসেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। 'তদন্তের আশ্বাস' দিয়ে মুখরক্ষা করার চেষ্টা চলছে।

সীমান্ত রক্ষীর গাড়ি গ্রামের রাস্তায় ঢুকতেই চাঞ্চল্য। নিশ্চয়ই এবার ধরপাকড় শুরু হবে। মাঝে মাঝেই এসব চলতে থাকে। তারপর গাড়ি থেকে বাচ্চাগুলোকে নামতে দেখে সকলে আরও হতবাক। ছোটরা যে এভাবে চোরাচালান করে রোজগার করে একথা কারুর কাছে গোপন নয়। সব জেনে শুনেও বাবা মায়েরা বাঁধা দেন না। পেটের জ্বালা যে বড় জ্বালা। প্রাণের ঝুঁকি আর মান সম্মানের কথা ভুলে গিয়ে বাড়ির মেয়ে, বৌদেরও একাজে নামতে হয়। কাঁটাতারের বেড়া টপকানো ছাড়াও বর্ডার বরাবর যে বেশ কিছু বেআইনি ঘাট আছে, তার মালিকদের মাসোহারা দিয়ে জলপথেও এ কাজ হয়। জিনিসপত্র তো বটেই, এমনকি গরু পর্যন্ত জলপথে পাচার হয়। গ্রামে একটা প্রাথমিক স্কুল ছাড়া আর কোনো শিক্ষাব্যবস্থা নেই। সেই স্কুলে না আছে পর্যাপ্ত শিক্ষক, না পরিকাঠামো। সর্বশিক্ষা মিশনের টাকা আসে বটে, তবে সে টাকা কোথায় যায় তার উত্তর কেউ জানে না। এমনকি মিড ডে মিলটাও নিয়মিত চলে না।

শিক্ষাই যে একমাত্র বাচ্চাগুলোকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনতে পারে এই কথাটা সেদিন থেকেই বিকাশ শর্মার মাথায় ঘুরছিল। কিভাবে কি করা যায় এই নিয়ে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আর নির্ভরযোগ্য সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনাও করেছেন। সকলেরই অভিমত "স্ট্রাইক দা আয়রন হোয়াইল ইটস হট"। আন্তর্জাতিক মিডিয়া আর হিউম্যান রাইটসের চাপে সরকার এখন বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে। এইসময় যেকোনো মানবিক প্রকল্পের প্রস্তাব সহজেই পাশ হয়ে যাবে। সেইমত সবিস্তারে প্রোপোজাল পাঠালেন আই জি সাহেব। প্রতিটা বর্ডার আউটপোস্টে যদি একটি করে স্কুলকেও এডপ্ট করা যায় সীমান্ত রক্ষীর তরফ থেকে। বাচ্চাগুলোকে স্কুলমুখী করাতে পারলে শুধু চোরাচালানের সমস্যা কিছুটা কমবে তাই নয়, তারচেয়েও বড় কথা অনেকগুলো জীবন নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচানো যাবে। সরকার চাইলে যে কত দ্রুত কাজ করতে পারে তা আরেকবার প্রমাণিত হল। দিল্লী থেকে সবুজ সংকেত আসতে খুব বেশি দেরি হল না। এরমধ্যে শর্মা সাহেবও নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। চষে ফেলেছেন নিজের অধিক্ষেত্র। গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে চোরাচালানের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, ছোটদের শিক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি। সরকারি সই সাবুদ সব হয়ে গেছে, টাকা পয়সাও আসতে শুরু করেছে। দিনের শেষে নিজের বাংলোর বারান্দায় বসে বিকাশ শর্মা নিজেই নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিলেন বর্ডার এলাকার প্রতিটা শিশুকে শিক্ষার মুখ না দেখিয়ে এই পদ থেকে তিনি সরবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন