If winter comes can spring be far behind
-Shelly
১।
ঝির ঝির বৃষ্টির মধ্যে বিনয় বেরিয়ে পড়ল । মাথার উপরে প্রসারিত আকাশের বুকে চাপা অন্ধকার , আচমকাই বিদ্যুতের ঝলকানি বুক চিড়ে নামাতে পারে মুষল বৃষ্টি , ঝম –ঝম করে । চারপাশে এক ফোঁটাও আলো নেই। অক্টোবারের মাঝামাঝি । নবান্নের উৎসব চলছে । মাঠে ফসলের ঢেউ খেলছে । তার সাথে তালে তাল রেখে বেনিয়মি বৃষ্টি ।
পূর্ববঙ্গের ছোট্ট একটা গ্রাম । ইংরেজ বাহিনীর চোখে জায়গাটা এতটা গুরুত্ব পায়নি । জায়গা বলতে - ভাঙাচোরা রাস্তা , বর্ষায় হাঁটু ঠেলে ওঠা কাঁদা আর নদীর দু ‘পাড় ভাসিয়ে দেওয়া জল । পার্টি এখানে গোপন ডেরা পেতেছে ।
বিনয়ের কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে । হাল্কা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল ! জলের ঝাপটায় পাতলা পাঞ্জাবি আর ফিনফিনে ধুতি ভিজছে । রাস্তাটা বড্ড এবড়ো-খেবড়ো । নরম মাটির পথ , বৃষ্টিতে অনেক জায়গাই গিয়েছে ধ্বসে । মুন্সিগঞ্জের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবার সময় মাকে প্রনাম করে এসেছিল । মা চুমু খেয়েছিল । বিনয়ের দুটো চোখের ভাষার মতন মায়ের চোখ দুটো ছিল জলে ভরা । বিনয় মায়ের কথা ভাবতেই দাঁড়িয়ে পড়ল । পৃথিবীতে এই একটি মাত্র মহিলা , যার টান সে কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারেনি । মায়ের কথা ভাবতে গিয়ে , সময় বৃষ্টির ধারার মতনই বয়ে যাবে ! সময় এখন ভীষণ দামী । বিনয় তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে চলল , সাপের মতন এঁকে বেঁকে যাওয়া কাঁচা রাস্তা ধরে ।
দূরে কোথাও বাজ পড়ল ! কানে শব্দ এল ।
গ্রামটার আয়তন খুব একটা নয় । নদীর ধারে বলে বর্ষায় উপচে ওঠা স্রোত আস্তে- আস্তে নরম মাটি মাখানো ছোট্ট ভূখণ্ডটাকে শুষে নিচ্ছে ! বিনয়ের হাতে রয়েছে - বাঁশের হাতলের ছাতা , বেয়াদপ বৃষ্টি আজ আর বশে আসছে না। সরু রাস্তার পাশে বাঁশ ঝাড় । গ্রামের জীবন সাদা মাটা ; শান্ত , স্থির , স্রোত হারানো পুকুরের মতন । সেই গ্রামেই এই মুহূর্তে নীলাম্বরচ্যূত জল ধারার প্রলয় নাচন শুরু হয়ে গিয়েছে ! প্রকৃতি কবেই বা মানুষের কথা শুনেছে ! বিনয় কিছুটা যাওয়ার পর আচমকাই থেমে গেল । নদীর ঘাটে যাওয়ার জন্য, গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে একটা সরু আলপথ চলে গিয়েছে । বিনয় ভাবছে সেই পথই ধরবে । কেননা এখন প্রধান ঘাটে ব্রিটিশের নজর দারি চলছে । ঘুর পথে যদি অন্তত লঞ্চে ওঠা যায়, ধরা পড়বার বিপদ এড়ানো যাবে । বিনয় কিছু না ভেবেই জঙ্গলের রাস্তাটা ধরল ।
সামনের কাঁচা রাস্তাটা , পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে । বিনয় সেই পথটা বেয়েই ঢালু হয়ে যাওয়া জঙ্গলের দিকটায় নেমে গেল । কিছুটা ভিতরে যেতে হবে । বিনয় চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে । এমন আবহাওয়া টিকটিকিদের কাজের পক্ষে উপযুক্ত । মাথার উপরে বৃষ্টির দুরন্তপনা অনেকটাই কমে এসেছে । সকালে যেমনটা ছিল, এখন রেষ ততটা নেই । বিনয় বেশ জোরেই হাঁটছে । জঙ্গলটাতে ঘন বাঁশ ঝাড় আর সেই বাঁশের গায়ে টপাটপ বৃষ্টির শব্দ – সব মিলিয়ে বিনয়ের আজ মনে পড়ে গেল ছোটবেলার সেই ভূতের গল্প । একেকটা গাছ আট ফুটের মতন হবে । চারপাশে সবুজ পাতার ঝাঁকরা নিয়ে এমন ভাবে মাটির কাছাকাছি ঝুঁকে রয়েছে , একেকটি গাছ দাঁড়িয়ে থাকা দৈত্য মনে হয় । শুধু যে বাঁশের বন তা কিন্তু নয় , পিপল আর কাঁঠাল গাছ আছে । জঙ্গলের মধ্যিখানে একটা ভাঙা বাড়িও রয়েছে । ওটার পিছন থেকেই বড় বড় ঘাসের জঙ্গল শুরু হয়েছে ।
বিনয়ের পায়ে কিছু একটা খোঁচা লাগল । আকাশে আলোর পাতলা আস্তরণ । আকাশের নীচে এই জঙ্গল । আর জঙ্গলের ভিতরে বিনয় দাঁড়িয়ে রয়েছে । দিক পরিবর্তন করবে । ভাঙা তিনতলা বাড়িটার ভিতরে বিনয় ঢুকল । এখানেই দাঁড়াবার কথা ছিল । আকাশের মুখ দেখে সময় ঠাহর করা যাচ্ছে না । বিনয় বাড়ির ভিতর একতলার একটা ভাঙা ঘরে ঢুকল । ঘরটার দুপাশের দেওয়াল ধ্বসে পড়েছে । ইঁট গুলোর দিকে তাকাতেই , মনে হয় - দাঁত খিঁচিয়ে হাসছে । বিনয় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল চারপাশে সময় যাপনের প্রতিলিপি অজগরের মতন , গ্রাস করেছে বাড়ির হাড় , মাংস , অস্থি ! মালিক নিজে কল্পনাও করতে পারেনি - তার কীর্তি এমনি ভাবে সমাপ্তির শেষ ধাপে অপেক্ষা করবে ! বিনয়ের এই বাড়িটির দিকে চেয়ে ভাবল - কিছুই থাকে না শেষ অব্দি , কেবল চিহ্নই রয়ে যায় স্মৃতি বাহক হয়ে !
অনেকক্ষণ আগেই বৃষ্টির এক ঘেঁয়েমি শব্দ থেমে গিয়েছে । বাইরে পাখিদের হাল্কা কোলাহল । দরজার সামনে চাঁদর চাপানো একজন কে দেখতে পেল বিনয় । দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটি বিনয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল । ওদের দুজনের বয়েস বেশি হবে না । ছাব্বিশ কি উনত্রিশ । বিনয় বলল – সুপতি , দেরী হয়নি তো ?রোগাটে ছেলেটা উদ্বেগ চাপানো চোখে চেয়ে রয়েছে , বলল
-যা বৃষ্টি আমার ভয় হচ্ছিল আজ হয়ত আর থামবে না !
ছেলেটির কথা শুনে বিনয় হাসল ।বলল
-থামল তো ।
-সে ঠিকাছে ভাই । এবার ভাবো ইস্টিমারে ক্যামন ভাবে চাপবে ?
-আগে ঘাঁট অব্দি এগোই , তারপর দেখা যাবে । জিনিসটা এনেছো ?
-এক পিস আছে ব্যাগে । তাও যদি দরকার পরে । দল অহেতুক রক্তপাত চায় না ।
- জানি । গণেশদার সাথে কথা হয়ে গিয়েছে এই নিয়ে । এখানে দাঁড়িয়ে আর দেরি করা ঠিক হবেনা ।
কথা গুলো বলবার সময় , দুজনেই কিন্তু অভ্যাস বশত চারপাশে তাকাচ্ছিল ।
বিনয় গ্রামের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে , খুব দ্রুতই তারা এই পথ পেরিয়েছে । তিরিশ মিনিটের পথ দশ মিনিটে শেষ করেছে ! কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ধীরে –ধীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে । ওরা দু’জনেই পিছনের দিকে তাকাল । দূরে গ্রামের সীমারেখা দেখা যায় । সরু কালো রেখা লম্বা ভাবে চলে গিয়েছে । আসলে এই সরু রেখার যায়গায় এক মাঠ ধান আর সেই ফসলের মাথায় হাল্কা আলোর আভাস , যা এত দূর থেকে কালো রেখা বলে মনে হয় ।
বিনয় আবার কবে এই গ্রামে ফিরে আসতে পারবে , জানেনা ! গ্রামের পুকুরে যে পানকৌড়ি দুটো ভেসে বেড়ায় , হয়ত আর তাদের নিজের হাতে খাওয়াতেও পারবে না । দুপুরবেলা নকল গলায় হাঁসের দলের সাথে লুকোচুরি খেলাও হবে না । ভাবতে ভাবতে বিনয়ের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে । মানুষের বুকের কষ্ট সবসময় বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে পারেনা। মানুষ আকাশের মতন সরল নয় । বৃষ্টি হওয়ার পরে আকাশের চোখ মুখ যেমন রোদে ঝলমলিয়ে ওঠে , তেমন ভাবে কোন সকাল বিনয়ের কাছে আসবে ? বিনয় এই মুহূর্তেটের পাচ্ছে মাটির টান ! চোখ দুটো ভারী হয়ে আসছে । মানুষ মাঝে মাঝে প্রকৃতির চেয়েও বেশি সহনশীল হয়ে ওঠে ।
ওরা দুজনেই পিছনের রাস্তাটায় উঠল, এই পথ ধরেই আগে স্টেশনে পৌঁছানো যাবে । ওঁরা দুজনে দোলাগঞ্জ স্টেশন থেকেই রেলগাড়িতে চাপবে ।
খুব তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছে । অভ্যাস না থাকলে সাধারণত লোকে এমনি ভাবে হাঁটতে গেলেই হোঁচট খেত । উঁচু নিচু সবটাতেই চলতে ওদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছেনা ।
দোলাগঞ্জে ঢুকতেই বিনয়রা ঘাবড়ে গেল । গোটা স্টেশন চত্বর ব্রিটিশ পুলিশে ছয়লাপ ! একজন অফিসার জনা পাঁচেক সিপাইয়ের সাথে আলোচনায় মশগুল । অফিসারদের ভ্রূ ভঙ্গিমা দেখে আন্দাজ হয় , বিষয়টা বেশ জটিল । বিনয়রা দেখেই চোখাচুখি করল । এত আয়োজন সাধারণ অতিথির জন্য নয় । বিনয় বুঝতে পেড়েছে , পুলিশের উপর মহল চুপ করে বসে নেই । সুপতি , বিনয়ের কনুইতে চিমটি কাটল । বিনয় চারদিকে তাকিয়ে , প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে নিজের ছবি দেখতে পেল । হাতে আঁকা , সাদা কাগজের উপর । বিনয় ভাবছে , যেভাবেই হোক কলকাতা পৌঁছাতেই হবে । এমন সময় প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে , ভিড় দেখা গেল । হুলুস্থূলু পড়েছে ! সিপাইরা ‘হটও হটও ’ চিৎকার ছুড়তে ছুড়তে দৌড় লাগালো ।
বিনয় বলল ‘ সুযোগ এসে গিয়েছে । চলো । ’ ওদের সামনে লাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটা কিছুক্ষণ আগেই ছেড়ে দিয়েছে । তাড়াহুড়ো করে তৃতীয় শ্রেনির কামরায় উঠে পড়ল, বিনয়রা । কামরাটা ভিড়ে ঠাসা । সাধারণত নিম্মমধ্যবিত্ত লোকেরাই রয়েছে । একফোঁটা বাইরের হাওয়া ঢুকতে পাচ্ছে না। উপরের স্ল্যাপে ছয় জন ছেলে ঠ্যাঙ ঝুলিয়ে বসে আছে । বিনয় তাকাল , দেখে মনে হয় খুব বেশি হলে চারজন বসতে পারবে। ওদের পায়ের কাছে , দু’ তিনজন সাঁওতাল মধ্যবয়স্কা রমণীর ঝগড়া কানে আসছে ; কোলের উপর ময়লা পুঁটুলি ।
ট্রেন এখন মধ্যম লয়ে ছুটছে । বিনয়রা জানে বিপদ পুরোপুরি কাটেনি । ওরা মনে মনে আগস্ট মাসের এক সকালে ফিরে গেল । বিনয় ধবধবে টাটকা দিনের আলোয় , কোলকাতা পুলিশের আইজি – লঊম্যানকে(LOW MAN ) গুলি করেছিল । ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিল তখন । বিনয় চেষ্টা করলে নামকরা ডাক্তার হতে পারত । প্রচুর পয়সা রোজগার করত । কিন্তু সেই সব কখনই ওকে ভাবায়নি । দেশের মানুষের দুঃখের জন্য যারা দায়ী । যারা শুধুমাত্র গায়ের জোরে অন্যের জায়গা দখল করে রেখেছে । এই দেশটাকে তছনছ করে ফেলছে - তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতেই হবে । স্বাধীনতা চাই । ওঁর মনে একটাই প্রশ্ন - নিজেদের দেশে আমরা কেনই বা অন্যের দাখ্যিন্যে বেঁচে থাকব ? বিনয় জানে শুধু চাইলেই হয়না । চাওয়াটাকে দখল করতে হয় । দাবি আর প্রতিরোধ ছাড়া , হিংস্র সাম্রাজ্যবাদিরা কিছুই দেবেনা । ওদের আগে বোঝাতে হবে - যেই নেটিভ লাথি খেতে পারে , সে সমানে পা ছুঁড়তেও পারে ।
কলেজে ঢুকবার আগে থেকেই গুপ্ত সমিতির সাথে যোগাযোগ শুরু । লওম্যান তখন বিপ্লবীদের পাগলা কুকুরের মতন ধাওয়া করছিল । বন্দী বিপ্লবীদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছিল । বিনয়দের , গুপ্ত সমিতি থেকে নির্দেশ দিল - অত্যাচারিটাকে চিরদিনের মতন পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে ।
আচমকাই খবর এলো , লওম্যান ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে আসছে । তখন আগস্ট মাস ,উনত্রিশ তারিখ । বিনয় সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাইল না । বেলা এগারোটা হবে । সাহেব সবে মাত্র হাসপাতালের কেবিনে ঢুকেছে । পুলিশের উপর মহলে খবর ছিল - এক বিপ্লবী রুগীর ছদ্মবেশে ভর্তি হয়েছে । ভিজিটিং আওয়ার চলছে । রুগীদের আপনজন এই সময়টাতে দেখা করতে আসে । লওম্যান সেই সুযোগেই , বিনয়ের বেডের কাছে এলো । বিনয় সময় নষ্ট না করে তিনটে গুলি ছুঁড়ল ।
বিনয় চিৎকার করে বলল ‘ বন্দে মাতরম...... ’ । পাশে থাকা হডসন কিছু করবার আগেই , আবার গুলি চালাল । হডসন (HOD SON ) সাহেবের বাঁ হাতের কাঁধ ঘেঁষে গুলিটা বেরিয়ে গিয়েছিল । পুরো ঘটনাটাই এত তাড়াতাড়ি ঘটতে শুরু করেছিল যে - কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারল না । সবার সামনে থেকে বিনয় বাঘের মতন গর্জন করতে করতে ছুটে গেল । পরের দিন খবরটা গোটা দেশে স্রোতের মতন ছড়িয়ে পড়ে ছিল । প্রকাশ্য দিবালোকে এক বাঙালি কিশোরের এমন দুঃসাহসিক আক্রমণ ; প্রশাসনের উপর মহলের কাছে মাথা ব্যথার কারন হয়ে উঠল ।
দেশপ্রেমে ফুটতে থাকা কৈশোর , আহত বাঘের চেয়েও বিপদজনক । সরকার পক্ষ নিজেদের ভয় কায়েম রাখতে চাইল । সরকার যদি ব্যর্থ হয় - গোটা দেশে কোটি কোটি যুবকদের সামলানো অসম্ভব হয়ে উঠবে । যে জাতির যুবক শ্রেণী জাগ্রত , সে জাতিকে পরাধীন করা ততটাই শক্ত । তাই সরকারি ভাবে বিনয়ের মাথার মূল্য দশ হাজার টাকা ঘোষণা করা হল ।
থেমে থাকা বগিতে উঠে পড়ল । কিছুক্ষণ পড়েই ছাড়ল ।
ট্রেনটা খুব আস্তে আস্তে চলছে । সুপ্রতিক বিনয়কে বলল –‘এখানে নেমে পড়ি ? ’
ওরা একটা ফ্ল্যাগ স্টেশনে নামল । এখানে লোকজন খুব কম । বিনয়রা সাবধানে স্টেশনের সিঁড়ি পেড়িয়েছে । প্রতিটা মুহূর্ত এখন ওদের কাছে দামি । বিনয় বলল –একটা জায়গায় গিয়ে একটু সাজুগুজু করা যাক ।
সুপতি হেসে উত্তর দিল – হ্যাঁ , আমরা যে বর যাত্রী ।
বিনয় হাসতে হাসতে বলল – ভাই , যা ছবি দেখলাম । এতক্ষনে বাড়ির সামনে নির্ঘাত মেয়ের বাবারা দাঁড়িয়ে আছে আমাদের খাতির করবে বলে ।
সুপতি পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বলল – হ্যাঁ ডাকাত জামাই । দেশের কাজ করা , ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ।
বিনয় বলল – যা বলেছো ।
দুজনেই হেসে উঠল ; এত স্নায়ুর চাপেও রসিকতা আসছে ! বিনয়ের মতন যুবকরা মৃত্যুকে বুড়ো আঙুলে নিয়ে চলাফেরা করে । জীবন ওদের কাছে শুধু মাত্র দেশের স্বার্থে পাওয়া একটা মুহূর্তে । ওটা কখন শেষ হবে , কেউ জানে না।
ওদের দেখলে ভিখিরি মনে হচ্ছে । দুজনের গাল ভরা দাড়ি । পাঞ্জাবিটা ছেঁড়া । ধুতির বদলে লুঙ্গি পড়েছে ।
ওরা রাস্তায় নেমে পড়ল । সামনে জমিদারের সাথে বেশ কয়েকজন মুসলিম চাষিরা যাচ্ছিলেন । তাদের পিছনে বিনয়রাও ঘাটের দিকে এগোতে লাগল । রাস্তায় একজনের কাছ থেকে মাথায় দেওয়ার জন্য পাতলা মুসলিম টুপি চেয়ে নিল ।
নদীর ঘাট , পুলিশে ভরা ।
ওরা আস্তে আস্তে স্টিমারের দিকে এগোচ্ছে । সবার আগে জমিদার বাবু । তার পিছনে বিনয়রা ।
স্টিমারে উঠবার সময় , সেপাইদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল – কাঁহা জায়েগা ?
জমিদার বাবু বললেন – কলকাত্তা ।
ওদের আরও কিছু জিজ্ঞেস করবার ইচ্ছা থাকলেও , অর্থবান লোককে ঘাঁটাতে সাহস হল না । ছেড়ে দিল ।
বিনয়রা ভাবতেও পারেনি এতো সহজে কোলকাতা পৌঁছাতে পারবে । মেঘনা পার হতে এখনো একঘণ্টা । স্টিমারটা যৌবনের মতন ছুটে চলেছে । বিনয়ের উপর নির্দেশ ছিল - শিয়ালদহে না নেমে , দমদমে নামতে হবে । তারপর সেখান থেকে মধ্য কলকাতার বাসায় যাবে । এভাবেই তাদের প্রথম পর্বের পরিকল্পনা সফল হবে ।
বিনয়ের সাথে যে ছেলেটি রয়েছে , সে কিন্তু বেশ বড় বাড়ির ছেলে । দলের হয়ে কাজ করছে । ওর দায়িত্ব বিনয়কে নিরাপদ আস্তানায় পৌঁছিয়ে দেওয়া । আপাতত দমদমে নেমে , তারপর ওরা মধ্য কলকাতার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে ।
২ ।
১৯৩০ সালের , আটই ডিসেম্বরের এক সকাল । আকাশে রোদ রয়েছে । মুহূর্তে রাইটার্স বিল্ডিং এর সামনে, ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল । গাড়ির ভিতরে তিন জন যুবক বসে রয়েছে । ইউরোপিয়ান পোশাকে । খাসা লাগছে দেখতে । পুলিশের চোখ এড়ানোর জন্য , বিনয়দের সাহেব সাজতে হয়েছে । তিন জন নেমে পড়ল। ওই যে যুবক - গোল মুখ , ভাসা ভাসা চোখ আর দৃঢ় বদ্ধ নাক । ওঁর নাম বিনয়কৃষ্ণ বসু । বিনয়ের পাশে দাড়িয়ে থাকা সদ্য ২০ ছুঁই ছুঁই , গোঁফের হাল্কা রেখা উঠেছে ; ছেলেটি - দীনেশ গুপ্ত । পাশেই দাঁড়ানো নতুন ভোরের মতন আঠারো বছর ছুঁয়ে থাকা ছেলেটি হচ্ছে – বাদল গুপ্ত ।
এই মাসে গোটা শহরে ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পরে । ঘড়িতে বেলা বারোটা ।
বিনয় বলল – আমাদেরকে রাইটার্সে খুব সাবধানে ঢুকতে হবে ।
বাদল বলল – জানি । তাই ভিজিটিং কার্ডটা পিওন কে দাও ।
বিনয় বলল – আমার নামটা এখানে বি .এন.রয় লেখা ।
দীনেশ ক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কার্ডটার দিকে । বিনয় বলল – চলো । দেরি করে লাভ নেই । বন্দে মাতরম ...।
বিনয় ভিজিটিং কার্ডটা পিওনকে দিল । পিওন ওদের দিকে একবার তাকাল , কিছু বলল না । আস্তে আস্তে ওঁরা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে । সিঁড়ির কোণায় নোংরা জমে আছে । পিওনের পিছনে বিনয়রা যাচ্ছে । তিনজন একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো । পিওন পর্দা সরিয়ে , আই জি সিমসন (Simpson) কে কার্ডটা দেখালেন । সিমসন বুঝতেও অব্দি পারেননি , কি হতে চলেছে । এমন সময় বিনয় বাঘের মতন গর্জে উঠল –‘ ফায়ার , ফায়ার...।। ’
সাথে সাথে তিনজনে তিনটি রিভলভার , বিদেশি শুটের ভিতর থেকে বেড়িয়ে পড়ল । বিনয় আই জি সিমসনকে গুলি করল । আই জির পার্সোনাল অ্যাসিসটেনট - ভয়ে টেবিলের নিচে ঢুকেছে ।
ওরা তিনজন বিল্ডিংয়ের বারান্দায় ছুটছিল । কালো রঙের পিস্তলটা , রোদের আলোয় চকচক করছে । সাপের পিঠের মতন , তেলতেলে । বারুদের আওয়াজ শুনে , গোটা রাইটার্স বিল্ডিংয়ের প্রহরীরা বন্দুক উঁচিয়ে ছুটে আসছে । কিছুক্ষণের ভিতরেই ওদের ঘিরে ফেলবে ।ওদের দেখেই বিদেশি অফিসাররা আর দেশি সিপাইরা বন্দুক তুলল ।
বিনয় বলল –নির্ভয় হয়ে লড়াই করব । আঃ এমন সুযোগ খুব কম বিপ্লবীর ভাগ্যে জোটে । দেখো - এরা নাকি আমাদের আজীবন পরাধীন করে রাখবে !! ব্যাটাদের চোখ মুখ গুলো দেখ ।
দীনেশ বলল – হ্যাঁ । ওদের মুখের অবস্থা দেখে করুণা হচ্ছে । আমাদের কাছে যা অস্ত্র আছে , ওরা জানে তা দিয়ে বেশিক্ষণ এ লড়াই চলবে না । তাও চাঁদুদের মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে ।
বাদল বলল – এত ভয় কিসের জন্য ? ওরা নাকি শক্তিমান !
বিনয় বলল – আছে বন্ধু ভয়ের কারন আছে , আমাদের একজোঁট হয়ে পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণ দখেই ইংরেজদের মাথা ঘুরে গিয়েছে । ব্যাটারা ভাবতেই পারেনি - আধপেটা খাওয়া , নেটিভের বাচ্চারা ওদের ক্ষমতার স্তম্ভ এই হেডকোয়াটারকে এমনি ভাবে তছনছ করে দেবে !
বাদল বলল – ওরা ভেবেছে ভারতবর্ষের সব তরুণরা ঘুমিয়ে পড়েছে । তারা নিজেদের দাবী আদায় করতে পারবে না । ইংরেজরা আমাদের দেশের মানুষদের চিনলেও , ইয়ুথকে বুঝতে পারেনি । ওরা জানেনা ভারতবর্ষের যৌবন অত ঠুনকো নয় । আমাদের আবেগ আমাদের ভালোবাসা , যা কোন কিছুর বিনিময়ে বিক্রি হবেনা । দমবেও না ।
বিনয় বলল – দেশ আমাদের কাছে মা। মায়ের অপমানের বদলা নিতে কখনই আমরা পিছু পা হব না। এইতো সবে শুরু। বন্দে মাতরম ...
দীনেশ ততক্ষণে বন্দুক চালাতে শুরু করে দিয়েছে । ইতি মধ্যে দুজন অফিসার আর তিনজন সেপাই আহত হয়েছে । পুলিশ কমিশনার স্যার চার্লস টেগারের(Sir Charles Tegart ) কাছে খবর পৌঁছে গেল ।
এখন ডালহৌসি স্কোয়ার জুড়ে পুলিশের গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ । লম্বা লম্বা প্রিজম ভ্যানে , রাইটার্সের সামনের চত্বর ভরে গিয়েছে । দুটি এ্যাম্বুলেন্স এসে থামল । বিনয়রা একটা খালি ঘরে গিয়ে ঢুকেছে । শীতকালে দিন খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে আসে । ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল বাদল। ঘড়ি নেই । তিনটে বাজবে হয়ত । ওরা জানে ধরা পড়তেই হবে । এই লড়াই অসম লড়াই। অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও সাম্রাজ্যবাদীদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে । বিনয়রা সামনের টেবিলটার পাশে থাকা চেয়ার তিনটে টেনে বসল ।
বিনয় বলল – আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ঢুঁকে পড়বে । আমরা কিছুতেই ইংরেজদের হাতে ধরা দেবনা । চললাম । যদি আবার ফিরে আসি , স্বাধীন ভারতে দেখা হবে । বন্দে মাতরম ।
ওরাও একসাথে বলল – বন্দে মাতরম ......
নিজের বন্দুক দিয়ে , নিজের মাথায় গুলি করল - বিনয় । চেয়ারে বসেই ।
দরজা ভেঙে ইংরেজ পুলিশরা ঢুকে পড়েছে । দীনেশ নিজেকে গুলি করতে যাওয়ার সাথে সাথে , একজন সিপাই দীনেশের থুতনিতে বুটের লাথি মারল ।
অফিসার বলল – শালা নেটিভের বাচ্চা । দ্যাখ কি করি । মার শালার তলপেটে । ওটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মরে না যায় । উপরতলার নির্দেশ , সন্ত্রাসবাদী গুলো কী কী ছক কষেছে জানতে হবে । ব্যাটা গুলোর বেঁচে থাকাটা জরুরি ।
বাদলের কাছে বেশ কয়েকজন সিপাই যেতেই দেখল – বাদলের নিথর দেহটা সিমেন্টের মেঝেতে পড়ে রয়েছে , মুখটা সিলিঙয়ের দিকে । ঠোঁটের কষ বেয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়ছে । পটাশিয়াম সায়নাইডের বোতল পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে ।
বাইরে তখন ভ্যান ভর্তি করে পুলিশ নামছে । সিঁড়িতে বুটের শব্দ শোনা যাচ্ছে ! ‘ লেফট্ রাইট লেফট্ ।’
বিনয় মেঝেতে শুয়ে পড়েছে । ওঁর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে । খুব ঘুম পাচ্ছে । জীবনে এত শান্তি বিনয় আগে পায়নি । মায়ের কোলে মাথা রেখেছে ; মাথাটা যেন হাল্কা হয়ে যাচ্ছে । ছোটবেলায় মা তাকে এমনি ভাবে শুয়ে রামরাবণের গল্প শোনাত । শুধু তাই নয় ছোট্ট রাজরাজাদের বীরত্বের কাহিনীও শুনত । ছোট্ট বিনয় সেদিন জানত না , একদিন নিজেই গল্পের নায়ক হয়ে উঠবে !
ভবিষ্যৎ এই তিন সন্ন্যাসীর জন্য আরেক গল্প গাঁথা তৈরি করছে । পরাধীন দেশের যুবকদের কাছে সেই গল্পই - যুদ্ধের শাশ্বত আয়ুধ । কখনও কখনও দু’ তিন জন সন্ন্যাসীর আত্মত্যাগ - ন কোটি মানুষের লক্ষ্য ঠিক করে দেয় ।
ওঁর ঘাড়টা যেদিকে ক্যাৎ করা, সেদিকে বাদল আর দীনেশ বেহুঁশ হয়ে শুয়ে রয়েছে । বাদল মারা গেল । দীনেশ হয়ত বেঁচে যেতে পারে । অবশ্য বাঁচলেও ফাঁসি হবেই ।
অদৃশ্য এক জায়গা থেকে কোটি কোটি ভারতীয় স্বাধীন সেনা ; সাম্রাজ্যবাদীদের সামনে বন্দুক ধরেছে , নিজেদের পাওনা বুঝে নিতে - বিনয় শুনতে পাচ্ছে । বিনয়ের চোখ ক্রমশই বন্ধ হয়ে আসছে । সেই চোখ প্রস্তুতি নিচ্ছে - আরেক পরাধীনতা মুক্ত বসন্তকালীন ভোরে খুলবার জন্য। তেমন একটা ভোর আসছে । আর দেরী নেই । এই ভোরে পরাধীনতার গ্লানি থাকবেনা । এই ভোর উদার আর তরুণের মতন উদ্যমী হবে ।
ওই ওদের বুটের আওয়াজ শোনা যায় !
অবসন্ন শরীরে , বুজে থাকা চোখে , বুটের ভারী আওয়াজ কানে আসে । বিনয় ঘোরের মধ্যে বলতে লাগল – ‘লেফট্ রাইট লেফট্ ।’
Tags:
গল্প