পিনাকি চক্রবর্তী

তিন সন্ন্যাসী
 If winter comes can spring be far behind    
-Shelly     
                     
 ১।

ঝির ঝির বৃষ্টির মধ্যে বিনয় বেরিয়ে  পড়ল । মাথার উপরে  প্রসারিত  আকাশের বুকে  চাপা  অন্ধকার  , আচমকাই বিদ্যুতের ঝলকানি বুক চিড়ে  নামাতে পারে মুষল বৃষ্টি , ঝম –ঝম  করে ।  চারপাশে এক ফোঁটাও আলো নেই। অক্টোবারের  মাঝামাঝি ।  নবান্নের উৎসব চলছে । মাঠে ফসলের  ঢেউ খেলছে । তার সাথে তালে তাল রেখে বেনিয়মি বৃষ্টি ।  

পূর্ববঙ্গের  ছোট্ট একটা গ্রাম ।  ইংরেজ বাহিনীর  চোখে জায়গাটা এতটা গুরুত্ব পায়নি । জায়গা বলতে -  ভাঙাচোরা রাস্তা , বর্ষায় হাঁটু ঠেলে ওঠা কাঁদা আর নদীর দু ‘পাড় ভাসিয়ে দেওয়া জল ।  পার্টি এখানে গোপন ডেরা পেতেছে ।

বিনয়ের  কাঁধে  ব্যাগ ঝুলছে । হাল্কা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল ! জলের ঝাপটায় পাতলা পাঞ্জাবি আর ফিনফিনে ধুতি ভিজছে  । রাস্তাটা বড্ড এবড়ো-খেবড়ো ।  নরম মাটির পথ , বৃষ্টিতে অনেক জায়গাই গিয়েছে  ধ্বসে ।  মুন্সিগঞ্জের  বাড়ি থেকে  বেরিয়ে   আসবার সময়  মাকে প্রনাম করে এসেছিল ।  মা  চুমু খেয়েছিল । বিনয়ের দুটো চোখের ভাষার মতন মায়ের চোখ দুটো ছিল জলে ভরা ।  বিনয় মায়ের কথা ভাবতেই  দাঁড়িয়ে পড়ল । পৃথিবীতে এই একটি মাত্র মহিলা , যার টান সে কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারেনি ।  মায়ের কথা ভাবতে গিয়ে , সময় বৃষ্টির ধারার মতনই বয়ে যাবে !   সময় এখন ভীষণ দামী । বিনয়  তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে চলল ,  সাপের মতন এঁকে বেঁকে যাওয়া কাঁচা রাস্তা ধরে  ।

দূরে কোথাও বাজ পড়ল !  কানে শব্দ এল  ।

গ্রামটার আয়তন খুব একটা নয়  ।   নদীর ধারে বলে  বর্ষায় উপচে ওঠা  স্রোত আস্তে-  আস্তে নরম মাটি মাখানো ছোট্ট ভূখণ্ডটাকে   শুষে নিচ্ছে  ! বিনয়ের হাতে রয়েছে - বাঁশের হাতলের ছাতা ,   বেয়াদপ  বৃষ্টি আজ আর  বশে  আসছে না।   সরু রাস্তার  পাশে বাঁশ ঝাড়  ।  গ্রামের  জীবন সাদা মাটা ; শান্ত , স্থির , স্রোত হারানো পুকুরের মতন । সেই গ্রামেই এই মুহূর্তে  নীলাম্বরচ্যূত জল  ধারার প্রলয় নাচন শুরু হয়ে গিয়েছে !  প্রকৃতি  কবেই বা মানুষের কথা শুনেছে !  বিনয়  কিছুটা যাওয়ার পর আচমকাই থেমে গেল । নদীর ঘাটে যাওয়ার জন্য, গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে একটা সরু আলপথ  চলে গিয়েছে । বিনয় ভাবছে সেই পথই  ধরবে । কেননা এখন প্রধান ঘাটে ব্রিটিশের নজর দারি চলছে ।  ঘুর পথে যদি অন্তত লঞ্চে ওঠা যায়, ধরা পড়বার বিপদ এড়ানো যাবে  । বিনয় কিছু না ভেবেই জঙ্গলের রাস্তাটা ধরল ।

সামনের  কাঁচা রাস্তাটা  ,  পাশে দাঁড়িয়ে থাকা  জঙ্গলে  গিয়ে মিশেছে  ।  বিনয় সেই পথটা বেয়েই  ঢালু হয়ে যাওয়া জঙ্গলের দিকটায় নেমে গেল ।   কিছুটা ভিতরে যেতে হবে ।  বিনয় চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে । এমন আবহাওয়া টিকটিকিদের কাজের পক্ষে উপযুক্ত । মাথার উপরে বৃষ্টির দুরন্তপনা  অনেকটাই কমে এসেছে  ।  সকালে যেমনটা ছিল, এখন রেষ  ততটা নেই । বিনয় বেশ জোরেই হাঁটছে । জঙ্গলটাতে ঘন  বাঁশ ঝাড়   আর সেই বাঁশের গায়ে টপাটপ বৃষ্টির শব্দ – সব মিলিয়ে বিনয়ের আজ মনে পড়ে গেল ছোটবেলার সেই ভূতের গল্প  । একেকটা গাছ আট ফুটের মতন হবে ।  চারপাশে সবুজ পাতার ঝাঁকরা নিয়ে এমন ভাবে মাটির কাছাকাছি ঝুঁকে রয়েছে , একেকটি গাছ দাঁড়িয়ে থাকা দৈত্য মনে হয় । শুধু যে বাঁশের বন তা কিন্তু নয় , পিপল আর কাঁঠাল গাছ আছে ।  জঙ্গলের মধ্যিখানে একটা ভাঙা বাড়িও রয়েছে । ওটার পিছন থেকেই  বড় বড় ঘাসের জঙ্গল শুরু হয়েছে  ।

বিনয়ের পায়ে কিছু একটা খোঁচা লাগল  । আকাশে  আলোর পাতলা  আস্তরণ  ।  আকাশের নীচে এই জঙ্গল । আর জঙ্গলের ভিতরে বিনয় দাঁড়িয়ে রয়েছে । দিক পরিবর্তন করবে । ভাঙা তিনতলা বাড়িটার ভিতরে বিনয়  ঢুকল । এখানেই দাঁড়াবার কথা ছিল । আকাশের মুখ দেখে সময়  ঠাহর করা যাচ্ছে না । বিনয় বাড়ির ভিতর একতলার একটা ভাঙা ঘরে ঢুকল । ঘরটার দুপাশের দেওয়াল ধ্বসে পড়েছে । ইঁট গুলোর দিকে তাকাতেই ,   মনে হয় -  দাঁত খিঁচিয়ে হাসছে ।  বিনয় ঘাড় ঘুরিয়ে  দেখল চারপাশে   সময় যাপনের প্রতিলিপি  অজগরের মতন , গ্রাস করেছে  বাড়ির হাড় , মাংস , অস্থি !  মালিক নিজে কল্পনাও করতে পারেনি - তার কীর্তি এমনি ভাবে সমাপ্তির শেষ ধাপে অপেক্ষা করবে ! বিনয়ের এই বাড়িটির দিকে চেয়ে ভাবল - কিছুই  থাকে না  শেষ অব্দি  , কেবল চিহ্নই রয়ে যায়  স্মৃতি বাহক হয়ে  !  

অনেকক্ষণ আগেই বৃষ্টির  এক ঘেঁয়েমি শব্দ থেমে গিয়েছে । বাইরে পাখিদের হাল্কা কোলাহল  । দরজার সামনে চাঁদর  চাপানো একজন কে দেখতে পেল বিনয়  । দাঁড়িয়ে  থাকা যুবকটি বিনয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল  । ওদের দুজনের বয়েস বেশি হবে না । ছাব্বিশ কি উনত্রিশ । বিনয় বলল – সুপতি  , দেরী হয়নি তো ?রোগাটে ছেলেটা উদ্বেগ চাপানো চোখে চেয়ে রয়েছে , বলল
-যা বৃষ্টি আমার ভয় হচ্ছিল   আজ হয়ত আর থামবে না !
 
ছেলেটির কথা শুনে বিনয় হাসল ।বলল
-থামল তো ।
-সে ঠিকাছে ভাই । এবার  ভাবো ইস্টিমারে ক্যামন ভাবে চাপবে ?
-আগে ঘাঁট অব্দি এগোই , তারপর দেখা যাবে । জিনিসটা এনেছো ?
-এক পিস আছে ব্যাগে । তাও যদি দরকার পরে ।  দল  অহেতুক রক্তপাত চায় না ।
- জানি । গণেশদার সাথে কথা হয়ে গিয়েছে এই নিয়ে  । এখানে দাঁড়িয়ে আর দেরি করা ঠিক হবেনা ।
কথা গুলো বলবার সময় , দুজনেই কিন্তু অভ্যাস বশত চারপাশে  তাকাচ্ছিল ।

বিনয় গ্রামের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে , খুব দ্রুতই তারা এই পথ পেরিয়েছে । তিরিশ মিনিটের পথ দশ মিনিটে শেষ করেছে ! কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ধীরে –ধীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে  । ওরা দু’জনেই পিছনের   দিকে তাকাল । দূরে গ্রামের সীমারেখা দেখা যায় । সরু কালো রেখা লম্বা ভাবে চলে গিয়েছে । আসলে এই সরু রেখার যায়গায় এক মাঠ ধান আর সেই ফসলের মাথায় হাল্কা আলোর আভাস    , যা এত দূর থেকে কালো রেখা বলে মনে হয় ।

বিনয়  আবার কবে  এই গ্রামে ফিরে আসতে পারবে , জানেনা  ! গ্রামের পুকুরে যে পানকৌড়ি দুটো ভেসে বেড়ায় , হয়ত আর তাদের নিজের হাতে খাওয়াতেও পারবে না । দুপুরবেলা  নকল গলায় হাঁসের দলের সাথে লুকোচুরি খেলাও হবে না । ভাবতে ভাবতে বিনয়ের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে । মানুষের বুকের কষ্ট সবসময় বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে পারেনা। মানুষ আকাশের মতন সরল নয় ।   বৃষ্টি হওয়ার পরে আকাশের চোখ মুখ যেমন রোদে ঝলমলিয়ে ওঠে ,  তেমন ভাবে কোন সকাল বিনয়ের কাছে  আসবে ? বিনয় এই মুহূর্তেটের পাচ্ছে মাটির টান ! চোখ দুটো ভারী হয়ে আসছে । মানুষ মাঝে মাঝে প্রকৃতির চেয়েও বেশি সহনশীল হয়ে ওঠে ।  

ওরা দুজনেই  পিছনের রাস্তাটায় উঠল,  এই পথ ধরেই  আগে  স্টেশনে পৌঁছানো যাবে । ওঁরা দুজনে  দোলাগঞ্জ স্টেশন থেকেই রেলগাড়িতে চাপবে ।  

খুব তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছে । অভ্যাস না থাকলে সাধারণত লোকে এমনি ভাবে হাঁটতে গেলেই হোঁচট খেত ।  উঁচু নিচু সবটাতেই চলতে ওদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছেনা   ।  

দোলাগঞ্জে ঢুকতেই  বিনয়রা ঘাবড়ে গেল । গোটা স্টেশন চত্বর ব্রিটিশ পুলিশে ছয়লাপ !  একজন অফিসার জনা পাঁচেক  সিপাইয়ের সাথে আলোচনায় মশগুল  । অফিসারদের  ভ্রূ ভঙ্গিমা দেখে আন্দাজ হয় , বিষয়টা বেশ জটিল । বিনয়রা দেখেই চোখাচুখি করল । এত আয়োজন সাধারণ  অতিথির জন্য নয় ।  বিনয় বুঝতে পেড়েছে , পুলিশের উপর মহল চুপ করে বসে নেই । সুপতি ,  বিনয়ের কনুইতে চিমটি কাটল । বিনয় চারদিকে তাকিয়ে , প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে  নিজের ছবি দেখতে পেল । হাতে আঁকা , সাদা কাগজের উপর ।  বিনয় ভাবছে , যেভাবেই হোক কলকাতা পৌঁছাতেই হবে । এমন সময় প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে , ভিড় দেখা গেল  ।   হুলুস্থূলু পড়েছে !  সিপাইরা ‘হটও হটও ’ চিৎকার ছুড়তে ছুড়তে দৌড় লাগালো ।

বিনয় বলল ‘ সুযোগ এসে গিয়েছে । চলো । ’ ওদের সামনে লাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা  ট্রেনটা  কিছুক্ষণ আগেই ছেড়ে দিয়েছে  । তাড়াহুড়ো করে তৃতীয় শ্রেনির কামরায় উঠে পড়ল, বিনয়রা  । কামরাটা  ভিড়ে ঠাসা ।   সাধারণত নিম্মমধ্যবিত্ত লোকেরাই রয়েছে । একফোঁটা বাইরের হাওয়া ঢুকতে পাচ্ছে না। উপরের  স্ল্যাপে ছয় জন ছেলে  ঠ্যাঙ ঝুলিয়ে বসে আছে  । বিনয় তাকাল , দেখে মনে হয় খুব বেশি হলে চারজন বসতে পারবে। ওদের পায়ের কাছে , দু’ তিনজন সাঁওতাল মধ্যবয়স্কা রমণীর  ঝগড়া কানে আসছে  ; কোলের উপর ময়লা পুঁটুলি ।

ট্রেন এখন মধ্যম লয়ে ছুটছে । বিনয়রা জানে বিপদ পুরোপুরি  কাটেনি । ওরা মনে মনে আগস্ট মাসের এক সকালে ফিরে গেল ।  বিনয় ধবধবে টাটকা দিনের আলোয়   , কোলকাতা পুলিশের আইজি – লঊম্যানকে(LOW MAN ) গুলি করেছিল  ।   ঢাকা  মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিল তখন । বিনয় চেষ্টা করলে নামকরা ডাক্তার হতে পারত । প্রচুর পয়সা রোজগার করত ।  কিন্তু সেই সব কখনই ওকে ভাবায়নি । দেশের মানুষের  দুঃখের জন্য যারা দায়ী   ।  যারা শুধুমাত্র গায়ের জোরে অন্যের জায়গা দখল করে রেখেছে  ।  এই দেশটাকে তছনছ করে ফেলছে  - তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতেই হবে । স্বাধীনতা চাই । ওঁর মনে একটাই প্রশ্ন - নিজেদের দেশে আমরা কেনই বা অন্যের দাখ্যিন্যে বেঁচে থাকব ?  বিনয় জানে শুধু চাইলেই হয়না । চাওয়াটাকে দখল করতে হয় । দাবি  আর প্রতিরোধ ছাড়া , হিংস্র সাম্রাজ্যবাদিরা কিছুই দেবেনা । ওদের আগে বোঝাতে হবে - যেই নেটিভ লাথি খেতে পারে , সে সমানে পা ছুঁড়তেও পারে ।

কলেজে ঢুকবার আগে থেকেই গুপ্ত সমিতির সাথে যোগাযোগ শুরু । লওম্যান তখন বিপ্লবীদের পাগলা কুকুরের মতন  ধাওয়া করছিল । বন্দী বিপ্লবীদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছিল । বিনয়দের , গুপ্ত সমিতি থেকে নির্দেশ দিল -   অত্যাচারিটাকে চিরদিনের মতন পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে  ।    

আচমকাই খবর এলো , লওম্যান ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে  আসছে । তখন আগস্ট মাস ,উনত্রিশ তারিখ ।  বিনয় সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাইল না । বেলা এগারোটা হবে ।  সাহেব সবে মাত্র হাসপাতালের  কেবিনে ঢুকেছে । পুলিশের উপর মহলে খবর ছিল  - এক বিপ্লবী রুগীর ছদ্মবেশে ভর্তি হয়েছে  । ভিজিটিং আওয়ার চলছে । রুগীদের আপনজন এই সময়টাতে দেখা করতে আসে । লওম্যান সেই সুযোগেই , বিনয়ের  বেডের কাছে এলো  । বিনয় সময় নষ্ট না করে তিনটে গুলি ছুঁড়ল  ।

বিনয় চিৎকার করে বলল ‘ বন্দে মাতরম...... ’  । পাশে থাকা হডসন কিছু করবার আগেই , আবার গুলি চালাল  । হডসন (HOD SON )  সাহেবের  বাঁ হাতের কাঁধ ঘেঁষে গুলিটা বেরিয়ে  গিয়েছিল  ।  পুরো ঘটনাটাই   এত তাড়াতাড়ি ঘটতে শুরু করেছিল  যে - কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারল না । সবার সামনে থেকে বিনয় বাঘের মতন গর্জন করতে করতে ছুটে গেল  ।  পরের দিন খবরটা গোটা দেশে স্রোতের মতন ছড়িয়ে পড়ে ছিল  । প্রকাশ্য দিবালোকে এক বাঙালি কিশোরের এমন দুঃসাহসিক আক্রমণ ;  প্রশাসনের  উপর মহলের  কাছে মাথা ব্যথার কারন হয়ে উঠল  ।

দেশপ্রেমে ফুটতে থাকা কৈশোর , আহত বাঘের চেয়েও বিপদজনক । সরকার পক্ষ  নিজেদের ভয় কায়েম রাখতে চাইল । সরকার  যদি ব্যর্থ হয়  - গোটা দেশে কোটি কোটি যুবকদের সামলানো অসম্ভব হয়ে উঠবে । যে জাতির যুবক শ্রেণী জাগ্রত , সে জাতিকে পরাধীন করা ততটাই শক্ত । তাই সরকারি ভাবে বিনয়ের মাথার মূল্য দশ হাজার টাকা ঘোষণা করা হল ।  

থেমে থাকা বগিতে উঠে পড়ল । কিছুক্ষণ পড়েই ছাড়ল ।
ট্রেনটা খুব আস্তে আস্তে চলছে । সুপ্রতিক বিনয়কে বলল –‘এখানে নেমে পড়ি ? ’
ওরা একটা ফ্ল্যাগ  স্টেশনে নামল । এখানে লোকজন খুব কম । বিনয়রা সাবধানে স্টেশনের   সিঁড়ি পেড়িয়েছে । প্রতিটা মুহূর্ত এখন ওদের কাছে দামি । বিনয় বলল –একটা জায়গায় গিয়ে একটু সাজুগুজু করা যাক ।
সুপতি  হেসে উত্তর দিল – হ্যাঁ , আমরা যে বর যাত্রী   ।

বিনয় হাসতে হাসতে বলল – ভাই , যা ছবি দেখলাম । এতক্ষনে বাড়ির সামনে নির্ঘাত মেয়ের বাবারা দাঁড়িয়ে আছে আমাদের খাতির করবে বলে ।
সুপতি পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বলল – হ্যাঁ ডাকাত জামাই । দেশের কাজ করা , ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ।
বিনয় বলল – যা বলেছো ।

দুজনেই  হেসে উঠল ;  এত স্নায়ুর চাপেও রসিকতা আসছে !  বিনয়ের মতন যুবকরা মৃত্যুকে বুড়ো আঙুলে নিয়ে চলাফেরা করে  । জীবন ওদের কাছে শুধু মাত্র দেশের স্বার্থে পাওয়া একটা মুহূর্তে । ওটা কখন শেষ হবে ,  কেউ জানে না।
                         
ওদের দেখলে  ভিখিরি মনে হচ্ছে ।  দুজনের গাল ভরা দাড়ি ।  পাঞ্জাবিটা ছেঁড়া । ধুতির বদলে লুঙ্গি পড়েছে ।
ওরা রাস্তায় নেমে পড়ল । সামনে জমিদারের সাথে বেশ কয়েকজন মুসলিম চাষিরা যাচ্ছিলেন । তাদের পিছনে বিনয়রাও ঘাটের দিকে এগোতে লাগল । রাস্তায় একজনের কাছ থেকে  মাথায় দেওয়ার জন্য  পাতলা মুসলিম টুপি চেয়ে নিল ।
নদীর ঘাট , পুলিশে ভরা ।
ওরা আস্তে আস্তে স্টিমারের দিকে এগোচ্ছে । সবার আগে জমিদার বাবু । তার পিছনে বিনয়রা ।
স্টিমারে উঠবার সময় , সেপাইদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল – কাঁহা জায়েগা ?
জমিদার বাবু বললেন – কলকাত্তা  ।
ওদের আরও কিছু জিজ্ঞেস করবার ইচ্ছা থাকলেও , অর্থবান লোককে ঘাঁটাতে সাহস হল না । ছেড়ে দিল ।

বিনয়রা ভাবতেও পারেনি এতো সহজে কোলকাতা পৌঁছাতে পারবে । মেঘনা পার হতে এখনো একঘণ্টা । স্টিমারটা যৌবনের মতন ছুটে চলেছে । বিনয়ের উপর নির্দেশ ছিল -  শিয়ালদহে না নেমে , দমদমে নামতে হবে । তারপর সেখান থেকে মধ্য কলকাতার বাসায় যাবে ।   এভাবেই তাদের প্রথম পর্বের পরিকল্পনা সফল হবে ।
বিনয়ের সাথে যে ছেলেটি রয়েছে , সে কিন্তু বেশ বড় বাড়ির ছেলে । দলের হয়ে কাজ করছে । ওর দায়িত্ব বিনয়কে নিরাপদ আস্তানায় পৌঁছিয়ে দেওয়া । আপাতত দমদমে নেমে , তারপর ওরা মধ্য কলকাতার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে ।  

 ২ ।
  
১৯৩০ সালের , আটই ডিসেম্বরের এক সকাল । আকাশে  রোদ রয়েছে ।  মুহূর্তে  রাইটার্স বিল্ডিং এর সামনে, ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল । গাড়ির ভিতরে তিন জন যুবক বসে রয়েছে । ইউরোপিয়ান পোশাকে । খাসা লাগছে দেখতে । পুলিশের চোখ এড়ানোর জন্য , বিনয়দের সাহেব সাজতে হয়েছে । তিন জন নেমে পড়ল। ওই যে যুবক  - গোল মুখ , ভাসা ভাসা চোখ আর  দৃঢ় বদ্ধ নাক ।  ওঁর নাম বিনয়কৃষ্ণ বসু । বিনয়ের  পাশে দাড়িয়ে থাকা সদ্য ২০ ছুঁই ছুঁই , গোঁফের হাল্কা রেখা উঠেছে ;  ছেলেটি -  দীনেশ গুপ্ত । পাশেই দাঁড়ানো নতুন ভোরের মতন আঠারো বছর ছুঁয়ে থাকা ছেলেটি হচ্ছে – বাদল গুপ্ত ।

এই মাসে  গোটা শহরে ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পরে   । ঘড়িতে বেলা বারোটা ।
বিনয় বলল – আমাদেরকে  রাইটার্সে  খুব সাবধানে ঢুকতে হবে ।
বাদল বলল – জানি । তাই ভিজিটিং কার্ডটা   পিওন কে দাও ।
বিনয় বলল – আমার নামটা এখানে  বি .এন.রয় লেখা ।

দীনেশ ক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কার্ডটার দিকে  । বিনয় বলল – চলো । দেরি করে লাভ নেই । বন্দে মাতরম ...।

বিনয় ভিজিটিং কার্ডটা পিওনকে দিল । পিওন ওদের দিকে একবার তাকাল , কিছু বলল না । আস্তে আস্তে ওঁরা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে । সিঁড়ির কোণায় নোংরা জমে আছে ।  পিওনের  পিছনে বিনয়রা যাচ্ছে । তিনজন একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো । পিওন পর্দা সরিয়ে , আই জি সিমসন (Simpson) কে কার্ডটা দেখালেন । সিমসন বুঝতেও অব্দি পারেননি , কি হতে চলেছে । এমন সময় বিনয় বাঘের মতন গর্জে উঠল –‘ ফায়ার , ফায়ার...।। ’

সাথে সাথে তিনজনে তিনটি রিভলভার , বিদেশি শুটের  ভিতর থেকে বেড়িয়ে পড়ল  । বিনয় আই জি সিমসনকে গুলি করল । আই জির পার্সোনাল অ্যাসিসটেনট  -  ভয়ে টেবিলের নিচে ঢুকেছে ।

ওরা তিনজন বিল্ডিংয়ের বারান্দায় ছুটছিল ।  কালো রঙের পিস্তলটা , রোদের আলোয় চকচক করছে । সাপের পিঠের মতন , তেলতেলে । বারুদের  আওয়াজ শুনে , গোটা রাইটার্স বিল্ডিংয়ের প্রহরীরা বন্দুক উঁচিয়ে ছুটে আসছে । কিছুক্ষণের ভিতরেই  ওদের ঘিরে ফেলবে  ।ওদের দেখেই বিদেশি অফিসাররা আর দেশি সিপাইরা বন্দুক তুলল ।

বিনয় বলল –নির্ভয় হয়ে লড়াই করব । আঃ  এমন সুযোগ খুব কম বিপ্লবীর ভাগ্যে জোটে ।  দেখো  -   এরা নাকি আমাদের আজীবন পরাধীন করে রাখবে !!  ব্যাটাদের চোখ মুখ গুলো দেখ ।

দীনেশ বলল – হ্যাঁ । ওদের মুখের অবস্থা দেখে করুণা হচ্ছে । আমাদের কাছে যা অস্ত্র আছে , ওরা জানে তা দিয়ে বেশিক্ষণ এ লড়াই চলবে না । তাও চাঁদুদের মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে ।

বাদল বলল –  এত ভয় কিসের জন্য  ?  ওরা নাকি শক্তিমান !

বিনয় বলল –  আছে বন্ধু ভয়ের কারন  আছে , আমাদের একজোঁট হয়ে পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণ দখেই   ইংরেজদের  মাথা ঘুরে গিয়েছে  ।  ব্যাটারা ভাবতেই পারেনি -  আধপেটা খাওয়া , নেটিভের বাচ্চারা  ওদের ক্ষমতার স্তম্ভ এই  হেডকোয়াটারকে    এমনি ভাবে তছনছ করে দেবে !

বাদল বলল – ওরা ভেবেছে ভারতবর্ষের সব তরুণরা ঘুমিয়ে পড়েছে । তারা নিজেদের দাবী আদায় করতে পারবে না  । ইংরেজরা আমাদের দেশের মানুষদের চিনলেও , ইয়ুথকে বুঝতে পারেনি । ওরা জানেনা ভারতবর্ষের যৌবন অত ঠুনকো নয় । আমাদের আবেগ আমাদের ভালোবাসা , যা কোন কিছুর বিনিময়ে বিক্রি হবেনা । দমবেও না ।

বিনয় বলল – দেশ আমাদের কাছে মা। মায়ের অপমানের বদলা নিতে কখনই আমরা পিছু পা হব না।  এইতো সবে শুরু। বন্দে মাতরম ...
দীনেশ ততক্ষণে বন্দুক চালাতে শুরু করে দিয়েছে । ইতি মধ্যে দুজন অফিসার আর তিনজন সেপাই আহত হয়েছে । পুলিশ কমিশনার  স্যার চার্লস টেগারের(Sir Charles  Tegart ) কাছে খবর পৌঁছে গেল  ।


এখন ডালহৌসি স্কোয়ার জুড়ে পুলিশের গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ । লম্বা লম্বা প্রিজম ভ্যানে , রাইটার্সের সামনের চত্বর ভরে গিয়েছে ।  দুটি এ্যাম্বুলেন্স এসে থামল । বিনয়রা একটা খালি ঘরে গিয়ে ঢুকেছে   । শীতকালে  দিন খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে আসে ।  ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল বাদল। ঘড়ি নেই ।  তিনটে বাজবে  হয়ত । ওরা জানে ধরা পড়তেই হবে । এই লড়াই   অসম লড়াই।  অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও সাম্রাজ্যবাদীদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে । বিনয়রা সামনের টেবিলটার  পাশে থাকা চেয়ার তিনটে  টেনে বসল ।

বিনয় বলল –  আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ঢুঁকে পড়বে । আমরা কিছুতেই ইংরেজদের হাতে ধরা দেবনা । চললাম । যদি আবার ফিরে আসি ,  স্বাধীন ভারতে দেখা হবে  । বন্দে মাতরম ।
ওরাও একসাথে বলল – বন্দে মাতরম ......  
নিজের বন্দুক দিয়ে , নিজের মাথায় গুলি করল -  বিনয় । চেয়ারে বসেই ।
দরজা  ভেঙে  ইংরেজ পুলিশরা  ঢুকে পড়েছে  । দীনেশ নিজেকে  গুলি করতে যাওয়ার সাথে সাথে ,  একজন সিপাই দীনেশের  থুতনিতে বুটের লাথি মারল ।
অফিসার বলল – শালা নেটিভের বাচ্চা । দ্যাখ কি করি । মার শালার তলপেটে । ওটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।  মরে   না যায় । উপরতলার নির্দেশ , সন্ত্রাসবাদী গুলো কী  কী  ছক কষেছে জানতে হবে । ব্যাটা গুলোর  বেঁচে থাকাটা জরুরি ।
বাদলের কাছে বেশ কয়েকজন সিপাই যেতেই দেখল – বাদলের নিথর দেহটা সিমেন্টের মেঝেতে পড়ে রয়েছে , মুখটা সিলিঙয়ের দিকে   । ঠোঁটের কষ বেয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়ছে । পটাশিয়াম সায়নাইডের বোতল  পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে ।
বাইরে তখন ভ্যান ভর্তি করে পুলিশ নামছে ।  সিঁড়িতে বুটের শব্দ শোনা যাচ্ছে  !  ‘ লেফট্ রাইট লেফট্ ।’      
বিনয় মেঝেতে শুয়ে  পড়েছে । ওঁর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে । খুব ঘুম পাচ্ছে । জীবনে এত শান্তি বিনয় আগে পায়নি । মায়ের কোলে মাথা রেখেছে ;  মাথাটা যেন হাল্কা হয়ে যাচ্ছে । ছোটবেলায় মা তাকে এমনি ভাবে শুয়ে রামরাবণের গল্প শোনাত । শুধু তাই নয় ছোট্ট রাজরাজাদের  বীরত্বের কাহিনীও শুনত । ছোট্ট বিনয় সেদিন জানত না , একদিন নিজেই গল্পের নায়ক হয়ে উঠবে !
ভবিষ্যৎ  এই তিন সন্ন্যাসীর জন্য আরেক গল্প গাঁথা তৈরি করছে । পরাধীন দেশের যুবকদের কাছে সেই গল্পই -  যুদ্ধের শাশ্বত আয়ুধ । কখনও কখনও দু’ তিন জন সন্ন্যাসীর আত্মত্যাগ  - ন  কোটি মানুষের লক্ষ্য ঠিক করে দেয় ।    

ওঁর ঘাড়টা যেদিকে ক্যাৎ  করা, সেদিকে  বাদল আর দীনেশ বেহুঁশ হয়ে শুয়ে  রয়েছে । বাদল মারা গেল । দীনেশ হয়ত বেঁচে যেতে পারে । অবশ্য বাঁচলেও ফাঁসি হবেই ।
অদৃশ্য  এক জায়গা থেকে  কোটি কোটি  ভারতীয় স্বাধীন সেনা ;  সাম্রাজ্যবাদীদের  সামনে বন্দুক ধরেছে ,  নিজেদের পাওনা বুঝে নিতে - বিনয় শুনতে পাচ্ছে  । বিনয়ের চোখ ক্রমশই  বন্ধ হয়ে আসছে । সেই চোখ  প্রস্তুতি নিচ্ছে - আরেক পরাধীনতা মুক্ত বসন্তকালীন ভোরে খুলবার  জন্য। তেমন একটা  ভোর আসছে ।  আর দেরী নেই । এই ভোরে পরাধীনতার  গ্লানি থাকবেনা । এই ভোর উদার আর তরুণের মতন উদ্যমী হবে ।

ওই ওদের বুটের আওয়াজ শোনা যায় !
অবসন্ন শরীরে , বুজে থাকা চোখে , বুটের ভারী আওয়াজ কানে আসে ।  বিনয় ঘোরের মধ্যে বলতে লাগল – ‘লেফট্ রাইট লেফট্  ।’

                                          

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন