বিবাহের পূর্ব হইতে আমোদিনী লক্ষ্মীমন্ত হইবার চেষ্টা করিত। সে যারপরনাই ধমক খাইয়াও কাহাকেও প্রত্যুতর করিত না।নীরবে চক্ষু দিয়া অশ্রু বহিয়া গাল দুই খানি আদ্র করিত। শিলনোড়া দিয়া মোলায়েম করিয়া সিদ্ধি বাটিতে পারিত। ঠাকুমার কোমরের ব্যথায় চুন হলুদ গরম করিয়া তাহার মতন উপশম আর কেহ দিতে পারিত না। আমোদিনীর অষ্টম বৎসর হইয়া গেলেও তাহার পিতা বিবাহ দিবার ব্যবস্থা করিতে পারিতেছিলেন না। আমোদিনীরা শাক্ত। বৈষ্ণব অধ্যুষিত এই অঞ্চলে উপযুক্ত শাক্ত পরিবারের খোঁজ চলিতেছিল।
আমোদিনীর মা আমোদিনীর বিবাহ দিতে হইবে এই ভাবনায় অস্থির হইয়া থাকেন। তাঁহার মৃদুভাষী কন্যা কে কাহার হাতে সম্প্রদান করিবেন।তাহার সাথে কি রূপ ব্যবহার হইবে- ভাবিয়া ভাবিয়া তাঁহার বুক শুকাইয়া যায়। কনিষ্ঠতম সন্তান টি কে কোলে লইয়া তিনি নিদ্রিত আমোদিনীর চোখের দিকে তাকাইয়া বিস্মিত হইয়া যান। মায়াময় চক্ষু দুইখানির শোভা অপরূপ। গৃহের সকল পশু গুলি তাহার এই চক্ষুর সামনে শান্ত হইয়া যায়। যত অবাধ্য গরু,মহিষ বা ছাগল হউক তারা বশ হইয়া যায়। আমোদিনী স্নেহ বিতরণ করিয়া তাদের মাতৃসমা হইয়া গিয়াছে। আমোদিনী শোল মাছের ঝোল, নিরামিষ পাঁঠার মাংস রান্না করিতে শিখিয়াছে। জ্যাঠাইমা তাহাকে আগুনের পাশে আসিলে কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ হইয়া যান। তাহার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ,ঝুলকালী হইলে পাত্র পাওয়া যাইবে না। মা কিন্তু তাহাকে সকল কাজ যত্ন সহকারে শেখায়। কোন ঘরে যাইবে। কাজ শিখা থাকিলে গঞ্জনা কিছু কম জুটিবে।
বিবাহের পর আমোদিনী বুঝিল মা তাহাকে সকল কিছু শিখাতে পারে নাই। তাহার স্বামী আর শ্মশ্রু মাতা মুখের অগ্রে হস্ত চালাইয়া থাকেন। প্রায়স তাহাকে মার খাইতে হয়। সে সম্পূর্ণ নারী হয় নাই। স্বামীর বয়স ত্রিশ বৎসর ছুঁইতে চলিল। প্রথম দুই স্ত্রীর সন্তানাদি হয় নাই। আমোদিনী কে বিবাহের কারণ সন্তান উৎপাদন। বছর ঘুরিতে চলিল গর্ভ এখন শূন্য। তাহার বাহু তে আর কোমরে মাদুলির সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। অকারন উপবাস, উপহাস আর প্রহার সহিতে সহিতে আমোদিনীর দিন কাটিয়া থাকে। যেদিন পীড়নে ক্লান্ত হইয়া পড়ে সে গোশালায় গিয়া ছাগ শিশু গুলি কে জড়াইয়া ক্রন্দন করিয়া থাকে। পশুগুলি বাক শক্তিহীন কিন্তু বোধ হীন নহে। তাহারাও আকুল হইত কিন্তু অপারক।
আমোদিনীর স্বামী লোক মুখে শুনিল সাদপুর গ্রামের পুরাতন মন্দিরে একজন অদ্ভুত তান্ত্রিক আসিয়াছে। তিনি ত্রিকালজ্ঞ। যোগমায়ার সহিত তাঁহার নিত্য যোগাযোগ হইয়া থাকে।তিনি আমোদিনীর স্বামী কে দেখিয়া আরক্ত নয়নে বলিলেন, “ বংশ রক্ষক এখনও আসে নাই। তুই তো মহাপাপী । তোর শুদ্ধি করণ লাগবে।”ইহার পর প্রচুর কথা তিনি বলিলেন যাহা কিছু বুঝিতে পারা যায় কিছু বুঝিতে পারা যায় না। তান্ত্রিক কে গুরুপদে স্থান দিয়া ধন্য হইল আমোদিনীর স্বামী। গুরুদেবকে সে সকল কিছু দান করিবে আর গুরুদেব তাহার পাপ হইতে নিস্কৃতি ঘটাইবে। চন্দ্রহীন রাতে স্ত্রী কে সালংকারা করিয়া গুরু দেবের কাছে লইয়া যাইতে হবে। সাথে একটি ছাগশিশু যোগমায়া কে দান করিতে হইবে। বংশরক্ষা হইবে। ভবিষ্যতের উজ্জ্বল চিন্তায় আমোদিনীর স্বামী আমোদিনীর কে প্রহার করার পরিশ্রম কিছুটা কমাইলেন।
আমোদিনীর কানে একখানি কথা নানা ভাবে আসিতে লাগিল- “ গুরুপ্রসাদী”। শুকনোলঙ্কা বাটিয়া হাত জ্বলিতেছে বলিয়া জলে হাত চুবাইয়া বসিয়া ছিল।তখন বৃদ্ধাদাসী আদর করিয়া পিঠে হাত দিয়া বলিল, “আহা গো মা কে আমার, একটু শান্তি দেয় না। আবার গুরু ধরেছে। ঝাঁটা মার।” আমোদিনীর পিত্রালয়ে খবর গেল। আমোদিনীর পিতা আসিয়া ফিরিয়া গেলেন কন্যার সহিত দেখা না করিয়া। আমোদিনী গোশালা গিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া চোখ মুখ ফুলাইয়া ফেলিল। সে জানিল না তাহার মা শয্যা লইয়াছে। নবীন ছাগশিশু টি তাহার কোলে পিঠে উঠিয়া আনন্দ পাইল।সে তাহাকে আদর করিল কিন্তু আমোদিনী নিজেও জানিতে পারিতেছিল না যে সে আগের ন্যায় সরল নাই তাহার কিছু পরিবর্তন হইতেছে।
সেদিন অপরাহ্ণে অমাবস্যা তিথি লাগিয়াছে। আমোদিনীর পায়ে আলতা পড়াইয়া লালচেলী পড়াইয়া দিল দাসী।ঢাক বাজিতেছে। আমোদিনী একবার তাকাইল বৃদ্ধা দাসী টির দিকে । তাহার মুখ খানি করুণ,চোখ ফাটিয়া জল বাহির হইতেছে। দুইহাত বুকের কাছে জোড়করিয়া সে বিড়বিড় করিয়া বলিতে লাগিল, “ মা কালী গো এরে তুমি দেখো।” আমোদিনীর স্বামী তাগাদা দিতে আসিল। আমোদিনীর রূপ দেখিয়া কিঞ্চিৎ থমকাইয়া গেল। রাতের অন্ধকার ব্যাতিত নিজের স্ত্রী কে দেখিবার ফুরসৎ পাই নাই। আমোদিনী নিজে সকল কিছু বুঝিতে পারিতেছে তেমন নহে।সন্তানবতী হইলেই কি সব কিছু ঠিক হইয়া যাইবে? আবার মন তাহার শক্ত হইয়াছে। বুঝিয়াছে পিতা মাতা কেহ আসিবে না ।স্বামী তাহার কেহ নহে। আমোদিনীর স্বামীর বাসগৃহ হইতে যাত্রা শুরু হইল। বেশ কিছু দাসদাসী , একজন ঢাকি,একটি ছাগশিশু, একটি নবম বর্ষীয়া বধূ, আর বংশরক্ষা হইবে এই আশায় একটি পুরুষ। ছাগশিশুটি উদ্বেল হইয়া আমোদিনীর পায়ে পায়ে চলিতেছে।
কালী মন্দিরে জন সমাগম হইয়াছে। লোকমুখে বংশরক্ষার খবর গ্রামান্তরে ছড়িয়া গিয়াছে। বৃক্ষগুলি তে সন্ধ্যার অন্ধকার নামিয়া আসিয়াছে। ধূপ আর গঞ্জিকার গন্ধে শ্বাসের কষ্ট হইতে পারে বলিয়া আমোদিনীর স্বামী মুখে চাদর চাপিয়া ধরিলেন। যোগমায়া বোধহয় হাসিলেন। লজ্জা লুকাইবার এ হেন নাটক দেখিয়া প্রমোদ স্বাভাবিক। আমোদিনীর সব কিছু গুলাইয়া যাইতেছে। উঠানে হাড়িকাঠ দেখিয়া সে ত্রস্ত হইয়া গেল। ছাগশিশু টিও বোধ হয় মৃত্যুর গন্ধ পাইল।সে হঠাৎ দড়ি ছাড়াইবার জন্যে আকুলি বিকুলি করিতে লাগিল। আমোদিনী কে লইয়া গুরুদেবের নিকট নতজানু হইয়া প্রনাম করিল আমোদিনীর স্বামী। আমোদিনী কেও আদেশ করিল। নতমুখী আমোদিনী প্রনাম করিবার কালে দেখিল এক বিরাট শরীরের জটাজুট ধারী মানুষ।যাহার চোখ দুখানির দিকে দৃষ্টিপাত করিতে কষ্ট হয়।লোমশ চেহারা বিকট ভুঁড়ি।
তিনি দুজন কে মন্দিরের মধ্যে আহ্বান করিলেন। মন্দিরস্থিত মা কালীর পুরাতন বিগ্রহটির সামনে উভয়ে প্রনাম করিয়া উঠিলে। দুইখানি নির্দিষ্ট আসনে একটি তে গুরুদেব অন্যটিতে আমোদিনীর স্বামী বসিল।“ তুই কায়মনোবাক্যে সকল আমারে দিয়া দে, আমি তোর সকল পাপ গ্রহণ নিলাম।তোর স্ত্রী আজ আমার ধর্মপত্নী”। গুরুদেব এই বলিয়া কারণবারি তে চুমুক দিলেন। পটপট করিয়া ধুনীর আগুনে কাঠ ফাটিবার আওয়াজ আর কোন আওয়াজ নাই। আমোদিনী আজ সব বুঝিতে পারিতেছে,তাহার বুক ঢিপ ঢিপ করিতেছিল। সন্মুখস্তিত মা কালী কে কেবল ডাকিতে লাগিল। কিন্তু আজ তাহার চোখ হইতে কোন অশ্রু পাত হইতেছে না। গুরুদেব আমোদিনীর স্বামী কে কারন দিলেন। প্রসাদ পাইয়া সে ধন্য হইল। “এইবার তুই মন্দির ত্যাগ কর ।সামনের নয়মাস এই কন্যা তোর মাতা। মুখের দিকেও দৃষ্টিপাত করিবি না।সন্তান হইলে যোগমায়া কে জোড়া পাঁঠা দিবি ।যা বাড়ি যা ।এক মনে যোগমায়া কে ডাক”, বলিয়া গুরুদেব মা মা বলে হুংকার করিলেন। বাহিরে ঢাক বাজিতেছে। আমোদিনীর স্বামী নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল।গুরুদেব মাটিতে পা মুড়িয়া বসিয়া থাকা আমোদিনী কে তাহার প্রসাদী কারন পান করিতে দিলেন। আমোদিনী ইহা কি জানে না।পান করিতে গিয়া বমন উদ্যোগ হইল । তাহার সন্তান হইলে জীবনে খুব আনন্দ আসিবে। তাই সে তাহা পান করিল। মাথা কিঞ্চিৎ আছন্ন হইল। তাহার হাত ধরিয়া গুরুদেব গর্ভগৃহের পিছনে একখানি ঘর আছে সেটিতে লইয়া গেলেন। আমোদিনী কিছু বুঝিতে পারিতেছে না। তান্ত্রিক উৎফুল্ল হইয়া হাসি হাসি মুখে ছোট চারপায়া টি তে আমোদিনীকে বসাইল।এখন বলি দান ক্রিয়া টি হয়নি। তান্ত্রিক কে বাহিরে যাইতে হবে। নেশাগ্রস্ত আমোদিনী কে সে বলিল, এই স্থলে বিশ্রাম কর। আমোদিনী ফিক করিয়া হাসিল।
তান্ত্রিক বাহিরে আসিয়া ছাগশিশুটি কে হাড়িকাঠে রাখিবার আদেশ করিলেন। দেবী মূর্তির সামনে হুংকার ছাড়িয়া মন্ত্র উচ্চারণ করিলেন। ছাগশিশু তার বিপদ বুঝিতে পারিয়া চিৎকার করিতে লাগিলেো।আমোদিনীর কর্ণে ছাগশিশুটির চিৎকার পৌঁছাইল। তার সমস্ত চেতনা ফিরিয়া আসিল। সে তৎক্ষণাৎ তীব্র গতিতে ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল। উঠানে যাহারা ছাগটি কে হাড়িকাঠে বদ্ধ করিতে উদ্ধত হইয়াছিলেন তারা চমকাইয়া গেল। আমোদিনী দুহাত দিয়া ছাগশিশু টিকে জড়াইয়া বসিল। তান্ত্রিক ঘোরতর রুক্ষ গলায় তাহাকে আদেশ করিল উঠিয়া আসিবার। আমোদিনী ছাগশিশু টি কে মুক্ত করিল। ছাগশিশু অতি দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করিল। জন সমাগমে রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। তান্ত্রিক তাহাকে হাত ধরিয়া মন্দিরের ভিতরে লইয়া যাইল। লাল চেলী খানি লুটাইয়া পড়িল। একটি অবলা কন্যাকে বশ করিতে না পারার অপমানে তান্ত্রিক ক্ষুব্ধ হইয়া গালি দিতে লাগিল।মন্দিরের ভিতর আসিবার আগেই আমোদিনী বুঝিল তাহার লালচেলি খানি খুলিয়া পড়িয়া গেছে। সে চমকিয়া উঠিল। তাহার এই তান্ত্রিক কে গুরুদেব বলিয়া কোন শ্রদ্ধা হইল না। আমোদিনী দেখিল একখানি চিমটে ধুনীর আগুনের উপর রাখা । সে অতি দ্রুততার সহিত সেই টি তুলিয়া লইল। লাল গণগণে সেই চিমটে হাতে লইয়া তান্ত্রিকের প্রতিরোধ করিল। মন্দিরের উঠানে দাঁড়ানো লোকজন স্তব্ধ হইয়া দেখিল যোগমায়া নিরাবরণ হইয়া লাল আগুনের মতো চিমটা হাতে দাঁড়াইয়া আছে। সামনে তান্ত্রিক হস্তবদ্ধ।জনসমাবেশ `জয় মা` বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল।
সাদপুর ইস্তেসন থেকে ভ্যানে চাপিয়া “ ন্যাংটা মায়ের থান” বলিলেই যাওয়া যায়।ছাগলগরুর রোগ হইলে লোকে গিয়া তাঁর কাছ হইতে নিরাময় লইয়া আসে। আমোদিনীর বয়স প্রায় অষ্টাশি হইয়াছে। শুভঙ্কর ডাক্তার আসিয়া তাহাকে বলে এই সব চিকিৎসা বিজ্ঞান মানে না। আপনি বুজরুকি করিয়া থাকেন। আমোদিনী কাহাকেও নিজের মুখ দর্শন করিতে দেয় না। নগ্ন দেহে পিছন ফিরিয়া বসিয়া হাসিয়া ফেলে। “ ঠিক বলেছ বাবা।”তাহার পরে আরও অনেক কথা বলিয়া ছিল।অধুনা লোকমুখে শোনা যায় ডাক্তার কোন বন্ধ্যা নারীকে চিকিৎসার জন্যে লইয়া আসিলে তাহার স্বামীর অগ্রে পরীক্ষা করিয়া থাকে।
Tags:
ধারাবাহিক