নাসির ওয়াদেন

 নবজাতকের কাছে দৃঢ় অঙ্গীকার,বুকে দুরন্ত উচ্ছ্বাস
" সন্ধ্যার আকাশ তলে পীড়িত নিঃশ্বাসে 
বিশীর্ণ পাণ্ডুর চাঁদ ম্লান হয়ে আসে "---

রোমান্টিকতার উর্ধ্বে পার্থিব জগতের নিটোল যন্ত্রণা আর ক্ষুধার হাতছানি যখন বাংলার বাতায়নে প্রতিনিয়ত ঘূর্ণি ঝড়ের মতো আছড়ে পড়ছিল, সেই সময়ে অপরিণত কবির " পূর্বাভাস " -এর কবিতাও,আজকের মাটিতে জ্বলন্ত অঙ্গার। 

কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯২৬ সালের ১৫ই আগষ্ট (১৩৩৩~১৩৫৪) জন্ম গ্রহণ করেন কোলকাতা শহরে । বাল্যকাল থেকে আর্থিক অসচ্ছলতা তাঁর পরিবারকে ছিন্নভিন্ন করে দিলেও, কালক্ষয়ী মহারোগে আক্রান্ত হয়েও কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মুহূর্তেও বিদ্রোহী ধ্বজা উড়িয়ে গেছেন-আর্তের জন্য, নিপীড়িত জনতার জন্য --

" জাগবার দিন আজ, দুর্দিন চুপি চুপি আসছে 
যাদের চোখেতে আজো স্বপ্নের ছায়াছবি ভাসছে "

সকলের মতোই তিনি সাম্যবাদের স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কবি বুদ্ধদেব বসু বলছিলেন, ' সুকান্ত কবি হতে পারতো, কিন্তু রাজনীতির কারণেই তা সে হতে পারেনি ।' সুকান্ত কতটা কবি, আর কতটা কবি নয়, সে তর্কে না গিয়ে বলতে পারি যে, সুকান্ত নিঃসন্দেহে সংবেদনের কবি --মানবতার কবি --সত্যের কবি। রাজনীতির লক্ষ্য সমাজের দুর্নীতি, মলিনতা, রক্ষণশীলতা দূরে ঠেলে সত্যের উপর, ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠা করা। রাজনীতি নীতির রাজা, অর্থে শুদ্ধতা, অমলিনতা,আর শৃঙ্খলার প্রতিচ্ছবি। প্রশ্ন আসে, তাহলে আজ ভারতের এই দৈন্যদশা কেন? কথায় আছে, সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই --রাম তো আছে, কিন্তু অযোধ্যা আছে কি? বিশুদ্ধতা ন্যায়ের বাহন, অমলিনতা সত্যের বিজয় ধ্বজা, সেখানে রাজনৈতিক রক্ত পিপাসু হাত সভ্যতার গলা টিপে ধরলে অবাক হই না। কেননা দুর্নীতি, স্বজন-পোষণ, আত্মকেন্দ্রিকতা, আত্মসুখ, সংসদ সর্বস্বতা দৈনন্দিন কার্য। যে যতটা বেশি বেশি টাকা লুণ্ঠন করতে পারল, জনগণকে ভাঁওতা দিতে শিখল, কড়ি পকেটে পুরে ফেলতে পারল, বাহুবল দিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করতে শিখল, মিথ্যের বুলি দিয়ে ঝুলি ভরে ঘৃণা ছড়াতে পারল আজকে সে জননেতা --তরুণ তাজা ছেলে --গোদের সেরা।

সুকান্ত ভট্টাচার্য পার্টি অন্ত প্রাণ ছিলেন, পার্টির জন্য জীবন দিতেও পিছু পা হননি ~বিনিময়ে শূন্য ~জীবন ক্ষয় ~মৃত্যু। " একটি মোরগের কাহিনী "কিংবা " ভাল খাবার " --কবিতার বিষয়বস্তু যা আমাদের বিবেক নাড়া দিয়ে গেছে, তার অপেক্ষা রাখে না।

" ধবধবে সাদা দামী কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে 
অবশ্য খাবার খেতে নয়
খাবার হিসেবে ।"

-- আমরা আজকেও দেশের নাগরিক হয়েও অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে মুক্ত হতে পারিনি। বিকাশময় ভারতেও প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ শিশু একবেলা খেয়ে, অর্ধ পেটে দিনাতিপাত করে। না খেতে পেয়ে উড়িষ্যার কালাহাণ্ডির মতো জায়গায় মানুষ বেঁচে থাকতে শালুক গুড়ি, পাঁক মুল খেয়ে থাকে। গাছের মুল খেয়ে আমাদের পূর্বপুরুষ একদিন বেঁচে ছিল, আজকেও তার অন্যথা কোথায়? সাম্রাজ্যবাদী লোলুপ দৃষ্টি থেকে আমাদের মতো গরিবদের দেশ মুক্ত নয়। ফেসবুক ওয়ালে কথাটা ভেসে ওঠে, ভারত গরীব দেশ নয়,বরং গরিবদের দেশ। দেশে যে, সম্পদ আছে, কৃষিজ, খনিজ, বনজ, সাংস্কৃতিক সবকিছুই অবাধে লুটপাট হয়ে যাচ্ছে,ফলে ভারত গরীব দেশ রূপে নগ্ন হচ্ছে। আমরা ধবধবে কাপড়ে জড়িয়ে থাকা মোরগের মাংসপিণ্ড, সাম্রাজ্যবাদী লোলুপ জিহ্বা আমাদের দেহ চেটেপুটে খাচ্ছে। কবি তাই সতর্ক করে দিয়েছেন --

" আর মনে করো আকাশ আছে এক ধ্রুবতারা 
নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ, 
অরণ্যের মর্মর ধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা 
আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন।"

--- বার্ষিক গতির মতো পৃথিবী আবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সূর্য ওঠে, আবার ডোবেও চাঁদ আসে এবং মিলিয়েও যায়,তেমনি রাজা আছে, রাজত্ব ধ্বংস হয়।

কবি বলেন : "আর সম্রাট হুমায়ূনের মতো 
একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন।"

পতন তো হবেই । ইতিহাস সাক্ষী। মানুষের উত্থান আছে, আবার পতনও অনিবার্য। জৈবিক সত্তার প্রকাশ আছে, বিনাশও ঘটবে । বিশ্বাস আর ভরসা মানুষকে বাঁচতে শেখায়, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়। তিনি ক্ষয় রোগাক্রান্ত জেনেও বিচলিত নন,অবিচল ভঙ্গিতে শিরদাঁড়া উঁচু করে উদাত্ত কণ্ঠে বলে গেছেন ---

" প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত 
দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত 
তাদেরই দলের পেছনে আমিও আছি 
তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি-বাঁচি।" 

তাঁর স্থির ধারণা যদিও তাঁর আয়ুষ্কাল ক্রমে ক্রমে নিঃস্তব্দের দিকে --হয়ত বেশি দিন থাকতে পারবেন না, নতুন প্রভাতের নবীন সূর্যের আলোক তাঁর মাথা স্পর্শ হয়ত করতে না --তবুও প্রত্যয় নিয়ে অঙ্গীকার করতে ভুলে যাননি ---

" এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে, যাব আমি 
নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।" 

তিনি দেখেছেন আর মনে মনে কষ্ট নিয়ে মরে-বেঁচে থেকেছেন যে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও•••••
পরিশ্রম করেও কেউ কেউ এক মুঠো অন্ন জোগাড় করতে পারে নি, আবার কেউ পরিশ্রম না করেই উদ্বৃত্ত মূল্যের শরিক হয়ে মুনাফার পাহাড় জমিয়ে ফেলছে। সুবিধাবাদ, সংশোধনবাদ, শোষণবাদী সমাজ চোখের তারার ভেতরে প্রতিফলিত হচ্ছে প্রতিদিন। তাই, আক্ষেপ  করে বলেছেন, --
           " আমি একটা ছোট দেশলাই কাঠি,
           এত নগন্য, হয়তো চোখেও পরি না,
           তবুও জেনো
           মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ ---
          বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস ।" 

কবির মুক্তি আন্দোলনের গতি দুর্বার হলেও, স্বাধীনতা ফিরে এলেও, ইংরেজ দেশ টুকরো করে ছেড়ে চলে গেলেও, তিনি স্বচক্ষে দেখে যেতে পারলেন না। সমাজমনস্ক ও সাম্যবাদী কবি গভীর ক্ষোভ, দুঃখ, যন্ত্রণা, বেদনা ও জ্বালা বহন করে চলে গেলেন সুদূর --আমাদের ছেড়ে। "পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি " হয়ে প্রতিদিন আমাদের আকাশে বিরাজ করে। আলোকমালায়, চন্দ্রসুষমায় মোহগ্রস্ত হই, স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি --যে স্বপ্ন কবি দেখাতে চান নি, দেখাতে চেয়েছিলেন জলের সমানশীলতা যদি থাকে, তবে কেন সমাজের সমানশীলতা থাকবে না?  এটা কি শুধু ভাগ্যের বিষয়, না প্রকৃতির নির্মমতা!

কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর বার্তা মানুষের মধ্যে জাগানোর সংকল্প প্রত্যেককে নিতে হবে, তবেই কবির ১৮ এবং স্বাধীনতা সার্থক হবে। কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিবেদন --

        ' তুমি চেয়েছিলে, এক শোষণহীন সুস্থ সমাজ 
        সাম্যবাদের বাণী ঘোষিত তোমার ইস্তাহারে 
        মুখ ঢাকা বিনগ্ন সামাজিকতা করে বিরাজ 
        রক্ষণশীলতা জেগে আছে পরিবারে পরিবারে ।।'

অনুভূতি মাখানো সোনালী স্বপ্ন জগতের কল্পনা চেয়ে কবি আফসোস করে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে --ঠোঁটে স্পন্দন জাগিয়ে --"অবাক পৃথিবী!  সেলাম, তোমাকে সেলাম ।"




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.