ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

পক্ষীজন্ম
স্বপ্ননীল স্বাধীনতা দেখেনি। স্বপ্ননীল কোনোদিন স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। স্বপ্ননীল স্বাধীন হতে চেয়েও পারেনি। ছোটবেলায় মায়ের অধীনে থেকেই তার শৈশব, কৈশোর কেটেছে হুড়মুড়িয়ে। সবকিছুতেই মায়ের শুল্ক আরোপিত শাসন আর লেখাপড়ার গন্ডী পেরিয়ে যখন চাকরী পেয়েছিল তখুনি অরুণিমা এসেছিল তার জীবনে। বিয়ের আগেভাগেই অরুণিমার কড়া শাসন শুরু হয়েছিল। কিন্তু ঐ যে, ভালোবাসার ফাঁদটা যে যৌবনে বড় মধুর লাগে আর মায়ের হাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে খড়কুটোকে আঁকড়ে ধরে মনে হয় সব পেয়েছির দেশে পৌঁছেছি । স্বপ্ননীলেরো তাই হয়েছিল।

মায়ের পর জীবনের দ্বিতীয় নারী অরুণিমা এসেছিল। আর তার সঙ্গে প্রেমের কেমিষ্ট্রিটা জমেও গেছিল সেই মূহুর্তে। মায়েরো অরুণিমাকে পছন্দ হয়ে গেল কি ভাগ্যি। বিয়েটাও হয়ে গেল মসৃণভাবে। দুজনের চাকরীবাকরী, সুখের সংসার। তবে এ জীবনটাতেও স্বপ্ননীল স্বাধীন হল না।

এখন তো আর মা নাক গলায় না তাদের সংসারে। দুটি পৃথক সংসার। বাবা-মা বিশ্বের অন্যতম জেরিয়াট্রিক নগর কলকাতায় থাকে আর তারা কপোত-কপোতী হাইটেক সিটি হায়দ্রাবাদে। কিন্তু স্বাধীনতা বড়োই অপ্রতুল স্বপ্ননীলের জীবনে। বিয়ের দশবছর কেটে গেছে। স্বপ্ননীল বাবা হতে চেয়েছিল। আর্জিও জানিয়েছিল সেইমত । ভেবেছিল বাবা হয়ে যদি নিজের জীবনে একটুকরো স্বাধীনতার আলো আসে। স্বাধীনভাবে মানুষ করবে নিজের অপত্যটিকে। অরুণিমা চায়নি সেই স্বাধীনতা দিতে। কেরিয়ার সর্বস্বতা গ্রাস করেছে অরুণিমাকে।

যে কোনো কারণেই হোক স্বপ্ননীল স্বাধীন হতে পারল না। অরুণিমা সন্তান চায় না। সে চায় একের পর এক প্রোমোশান। তাই অযথা পায়ে বেড়ি পরে স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করতে নারাজ সে। কি প্রয়োজন সন্তানের? এই তো বেশ আছে সে। সন্তান হলেই কি মানুষের জীবনের পূর্ণতা আসে? ছেলেপুলে নিয়ে বন্ধুবান্ধবেরা সমস্যায় জর্জরিত। স্বাধীন জীবন তার। অফিস ট্যুর সর্বস্বতায় ভরা।

সংসারের সিংহভাগ সামলায় স্বপ্ননীল। স্বপ্ননীলের ট্যুর হয় না। স্বপ্ননীল মনে মনে ভাবে অফিসের কাজে ট্যুরে গেলেও দুটোদিন স্বাধীন হতে পারত সে। কিন্তু বিধি বাম। তার অফিসে বসে কাজ। সেদিক থেকে অরুণিমা অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী। বিন্দাস আছে অফিসের কাজে মশগুল হয়ে। একদম স্বাধীন জেনানা যাকে বলে। স্বপ্ননীলের বাজার করারো স্বাধীনতা নেই। সে পছন্দ করে চুনোমাছ আর চিকেন আনে। অরুণিমা বড়মাছ আর মাটন না আনলে রাগারাগি করে । অতএব বাজার করতে গিয়েও নিজের খুশিমত বাজার করে অরুণিমার শান্তিভঙ্গ বা স্বাধীনতা কোনোটাতেও সে হস্তক্ষেপ করেনা।

পার্টিতে পরার শার্টটাও বেছে দেবে অরুণিমা। একদিন কুর্তা পায়জামা পরার স্বাধীনতা পায়না স্বপ্ননীল। স্বপ্ননীলের এক আধবার, মাঝেমধ্যে মদ্যপান? সেখানেও ট্যাক্স বসিয়েছে অরুণিমা। স্বপ্ননীল জানায় মধ্যবয়সে এক আধ পেগ হুইস্কি হার্টের পক্ষে ভাল। অরুণিমা তা মানতে নারাজ। ছুটির দিনে বাজার করে এসে নিজের ইচ্ছেমত গান শোনা? সেখানেও কর বসিয়েছে তার ব‌উ। অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত-দ্বিজেন্দ্রগীতি চলিয়ে দিলেই অরুণিমা এসে গজলের সিডি চালিয়ে দেয়।

এভাবেই চলতে থাকে তাদের জীবন। অরুণিমা স্বাধীন, স্বেচ্ছাচারী। স্বপ্ননীল স্বপ্ন দেখে স্বাধীনতার। এতদিনের সম্পর্ক। বৌটার সব ভাল শুধু একরোখা। রোজগেরে বৌ তো অনেকেরি থাকে তাই বলে এতটা জেদ? হুটহাট কলকাতায় বাবা মায়ের কাছে যাবার স্বাধীনতা ছিল না । একসময় তারাও মুক্তি দিয়েছে ছেলে বৌ কে। কিন্তু স্বপ্ননীল তো মুক্ত হল না। মিডিয়া সর্বত্র নারী স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার কিন্তু পুরুষদের স্বাধীনতার কথা তো কেউ বলে না। পুরুষেরা আজন্ম স্বাধীন বুঝি? তোলপাড় হতে থাকে স্বপ্ননীলের মন।

সিনেমা দেখার প্ল্যান করলে সেখানেও স্বাধীনতা নেই স্বপ্ননীলের। সেবার অনলাইন টিকিট ফেলে কি যন্ত্রণা হল। হায়দ্রাবাদে বাংলা ব‌ই বড় একটা দেখবার সুযোগ হয়না। তাই বলে জুলফিকার? ইংরেজী কিম্বা হিন্দী মুভির টিকিট তো কাটলে পারতে। একরাশ উষ্মা প্রকাশ করেছিল অরুণিমা। তারপর যাও বা মুভি সে যাত্রায় দেখা হল, হল থেকে বেরিয়েই পিত্জা না চাইনিজ সেই বিতর্কে উত্তাল মাল্টিপ্লেক্স চত্ত্বর। অবশেষে ঠিক হল বিরিয়ানি। এভাবে বারেবারে আর হারতে ভাল লাগেনা স্বপ্ননীলের।

ঠিক কবে যে সে স্বাধীনভাবে সবকিছু করেছে তার মনে পড়েনা। আর তার ইচ্ছেগুলোকে কবে যে কেউ আর প্রাধান্য দেবে সে বিষয়ে ঢের সংশয় তার। মুখ ফুটে কিছু বলে না। ভেতরে ভেতরে চাপা একটা ক্ষোভ তাকে দমিয়ে দমিয়ে ভেতর ভেতর শেষ করে দেয়। সে ভেবেছিল অরুণিমা তার স্বাধীনতাকে প্রশ্রয় দেবে। মায়ের মত তার বিরোধিতা করবে না। কিন্তু সে ভাবে এক, হয় আরেক। স্বাধীনতার কাঙাল হয়েই জীবন কাটিয়ে দেবে সে? নাহ! স্বপ্ননীল তার স্বপ্নগুলো আঁকড়ে ধরেই শেষ হয়ে গেল একদিন।

মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হল তার। এবার বুঝি সে স্বাধীন হল।

স্বপ্ননীলের শ্রাদ্ধ সেদিন। অরুণিমা কলকাতায় গেছে শ্রাদ্ধশান্তি করতে। ভোরেবেলায় তার বেডরুমের জানলার ধারে হঠাত একটা পাখির ছানা এসে পড়ল। কাজের মাসী তাকে হাতে করে এনে ছাতু মেখে জল দিয়ে খাওয়াতেই সে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। ঝুড়ি চাপা দিয়ে বারান্দার কোণে দিব্য ছিল সে। কুচকুচে কালো কোকিলের ছানা, উড়তেও শেখেনি। কুঁচফলের মত টুকটুকে চোখদুটো কত না বলা কথা বলতে চাইছিল। শ্রাদ্ধবাসরে নিমন্ত্রিত যারা আসছে একবার করে ঝুড়ি খুলে তাকে দেখে আবার চলে যাচ্ছে। স্বপ্ননীলের পিন্ডদান সমাপ্ত হল। হঠাত ঝুড়ি খুলতেই পাখির ছানা সটান সেই পিন্ডের কলাপাতার ওপরে উড়ে এসে বসল। আচমকা। যেন সদ্য উড়তে শিখেই সাপের পাঁচ পা দেখেছে সে। তারপরেই ঠুকরে একটু কালো তিল মাখা ভাতের মন্ড মুখে দিয়েই আবার উড়ে এসে বসল জানলার ওপরে। সকলেই বলা কওয়া করল সে নাকি স্বপ্ননীলের আত্মা। নিজেই এসেছে স্বপ্ননীল আজ, নিজের বাড়িতে পাখীর ছানার বেশ ধরে। প্রকৃত শ্রাদ্ধ শান্তি হয়েছে তার। সকলেই স্বীকার করল সেই কথা ।

আর কেউ বুঝুক না বুঝুক অরুণিমা বুঝতে পারল সেদিন মুক্ত বিহঙ্গের উপস্থিতির যথার্থতা। এদ্দিনে সত্যি‌ই স্বপ্ননীল স্বাধীনতা পেল। শুরু হল তার স্বাধীন পক্ষীজন্ম।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.