গৌতম বসু

আশ্রয়
এক ।

একলাফে বিছানা থেকে উঠে সোফার উপর ছুঁড়ে ফেলে রাখা জিন্সটা গলিয়ে নিয়ে অনিমেষ বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়।নিবেদিতা কোনোরকমে বিছানার চাদরটা জড়িয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বলে, "একটু বসে যাও, বিকাল থেকে তো কিছু খাওয়া হয়নি, আমি ফ্রেশ হয়ে এসে কিছু বানিয়ে দিচ্ছি, খেয়ে তারপর যেয়ো।" অনিমেষ দ্রুততার সাথে জবাব দেয়, "না, আর সময় হবেনা, এখনো একগাদা প্যাকিং বাকী।" তারপর ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায়, আস্তে আস্তে তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায়।নিবেদিতা আলনা থেকে মা'র একটা শাড়ি টেনে নিয়ে সেটা গায়ে জড়িয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসে।মা মামার বাড়ি গেছে, রাতে ফিরবেনা।কোলাপ্সিবল গেটে তালা দিয়ে ঘরে এসে ইতস্তত ছড়ানো জামাকাপড়গুলো তুলে নিয়ে সে ভাঁজ করে গুছিয়ে আলনায় রেখে দেয়, তারপর বিছানার চাদরটা তুলে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়।এখনই কাচাকুচিগুলো করে নিলে সারারাতের মধ্যে শুকিয়ে যাবে।স্নান সেরে এসে নিবেদিতা চুপচাপ বসে ভাবতে থাকে, ঘটনাটার আকস্মিকতা সে এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।তখনও পুরোপুরি সন্ধ্যে নামেনি, সে সবে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরেছে, হঠাৎই সশব্দে দরজা ধাক্কা দিতে দিতে অনিমেষের আগমন।একই পাড়ায় থাকা এবং নিবেদিতার বাল্যবন্ধু হবার সুবাদে এ বাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত।তাছাড়া নিবেদিতার মা মিনতিদেবী বাপ-মা মরা এই ছেলেটিকে ছোট থেকেই একটু বিশেষ স্নেহ করে থাকেন।আর তারও হাজার আবদার এই কাকিমাটির কাছে।সেই কোন ছোটবেলায় সে প্রায়ই দাদু-দিদাকে না বলে এ বাড়িতে চলে আসত কাকিমার কোলে বসে গল্প শুনতে শুনতে খাবার লোভে, আর তিনিও তাঁর কন্যার সঙ্গে তাঁর আদরের 'অনি'-র কোনো তফাৎ করতেননা।এমনকি এর জন্য অনেকসময় তাঁকে স্বামীর ঠাট্টাও হজম করতে হয়েছে যে, "তুমি তোমার দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে এতই ব্যস্ত যে আমার দিকে দেখার সময়ই পাওনা, যখন আমি থাকবনা তখন কিন্তু তোমার আক্ষেপের শেষ থাকবেনা।" মিনতিদেবী এই কথাটাকে কোনোদিনই গুরুত্ব দেননি, আর তা যে এত তাড়াতাড়ি এভাবে ফলে যাবে তা তিনি ভাবতেও পারেননি।

আজ প্রায় সাত বছর হতে চললো নিবেদিতার বাবা চলে গেছেন।শেষের দিকটায় বড়ই কষ্ট পেয়েছিলেন, কিছুই প্রায় খেতে পারতেননা, লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে স্টেজ থ্রীতে। হসপিটালে মাসখানেক চিকিৎসার পর ডাক্তার জানিয়ে দেন এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা।মিনতিদেবীও আর কথা না বাড়িয়ে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসেন, শেষের ক'টাদিন মানুষটার সেবা করে একটা সময়ে তাঁর স্ত্রীকে কাছে না পাবার অভিমান যদি কিছুটা দূর করা যায়, অন্তত মানুষটা যাতে উপেক্ষার ভুল ধারণাটুকু নিয়ে চলে না যায়।হাসপাতাল থেকে আসার পর যে সাড়ে পাঁচ মাস মত বেঁচেছিলেন নির্মলবাবু, সে সময়ে মিনতিদেবী সংসারের সমস্ত দায়িত্ব মেয়ের উপর দিয়ে শুধুমাত্র স্বামীর পাশে থেকে যথাসাধ্য তাঁর সেবা করে গেছেন।শেষ মাসে যখন তরল খাবারটুকুও রক্তবমি হয়ে বেরিয়ে আসছে তখনও চোখের জল চেপে রেখে তিনি পরম যত্নে শাড়ির আঁচল দিয়ে তাঁকে পরিষ্কার করে দিয়েছেন।নির্মলবাবুর তখন কথা বন্ধ হয়ে গেছে, খালি শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন, হয়তো বাহ্যিক জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগ একরকম ছিন্নই হয়ে গিয়েছিল।তবু মিনতিদেবী তাঁর হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চুপচাপ ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতেন।এইসময়ে তিনি উপলব্ধি করেন ভাষা আসলে যোগাযোগের একটা মাধ্যম বইতো আর কিছু নয়।এই যে দুটি নির্বাক হৃদয়ের মধ্যে নিঃশব্দে যে ভাবের আদান প্রদান ঘটে চলেছে, বহমান সময় যার একমাত্র সাক্ষী, সারাজীবনে পরস্পরকে বলা হয়ে ওঠেনি এমন তুচ্ছ কথাগুলোও যে শুধু স্পর্শটুকুর মাধ্যমে কোনও; অদৃশ্য জাদুতে অপরজনের হৃদয়তন্ত্রী ছুঁয়ে যাচ্ছে তা বোধকরি কেবল অন্তর্যামীই বলতে পারেন।শেষদিন ভোরের দিকটায় একটু চোখ লেগে গিয়েছিল, হঠাৎ একটা ঘড়ঘড় শব্দে চমকে উঠে মিনতিদেবী দেখতে পান বিছানার সাথে মিশে যাওয়া মানুষটা কোনোরকমে পাশ ফিরতে পেরেছে, শরীরটা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে আর মুখ দিয়ে ঝলকে ঝলকে রক্ত আর মাংসপিন্ডের মত ডেলা ডেলা কিছু বেরিয়ে আসছে।চিৎকার করে মেয়েকে ডাকার আগেই শরীরটা একবার মোচড় দিয়ে নিথর হয়ে যায়।

আদর্শবান স্কুলশিক্ষক নির্মল কুমার ঘোষ জীবিতাবস্থায় বিশেষ সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি।প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে লোন নিয়ে অনেক কষ্টে বাড়ীটুকু করেছিলেন আর শেষজীবনে দুরারোগ্য ব্যাধির জন্য সামান্য সঞ্চয়টুকু তো চলে যায়ই, উপরন্তু আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীর কাছেও মিনতিদেবীর প্রচুর ঋণ হয়ে যায়।এই অবস্থায় পেনশনের সামান্য ক'টা টাকা যার প্রায় পুরোটাই ধার শোধ করতে চলে যায়, তা দিয়ে আর যাই হোক সসম্মানে বেঁচে থাকা যায়না।তাই বাধ্য হয়ে মেয়েটার মুখ চেয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রতিমাসে দাদার থেকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের সাহায্য তাঁকে নিতেই হয়।তাও গ্র্যাজুয়েশনের পরে মেয়েটা ক'টা প্রাইভেট টিউশন করে যা উপার্জন করে প্রায় পুরোটাই মায়ের হাতে তুলে দেয়, তবুও প্রতিদিন যে হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে, সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠে যায়।দাদারও রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে এসেছে, তাঁর মেয়েটিও বিবাহযোগ্যা, তাই মিনতিদেবী ঠিক করেছেন দাদাকে জানাবেন যাতে সামনের মাস থেকে টাকাটা আর না পাঠান।কিন্তু সেটা ফোনে জানালে দাদা যদি দুঃখ পান তাই তিনি ঠিক করেছেন নিজে গিয়ে বুঝিয়ে বলবেন যে, এতদিন ধরে তিনি তো তাঁর সংসারটাকে ভেসে যাবার হাত থেকে রক্ষা করেছেন, মেয়েটাও আস্তে আস্তে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে, এবার তিনি যেন তাঁদের স্বাবলম্বী হবার অনুমতি দেন, মা-বেটিতে তাঁরা ঠিক চালিয়ে নিতে পারবেন।এইসব কথাবার্তা বলতেই আজ বহুকাল পরে তাঁর বাপের বাড়ি যাওয়া।রান্নাবান্না কাজকর্ম সেরে খেয়েদেয়ে বেরোতে বেরোতে দুপুর গড়িয়ে গেছে, অবশ্য মেয়েকে বলা আছে আজ আর তিনি ফিরতে পারবেননা, কাল ওখান থেকে ভোর ভোর বেরিয়ে পড়বেন যাতে দুপুরের মধ্যে বাড়ি চলে আসতে পারেন।একটা রাতের ব্যাপার তো, নিবেদিতা মাকে বলেছে তার কোনো অসুবিধা হবেনা।

বরাবরের অভ্যেস মত চিৎকার করতে করতে অনিমেষ ঘরে ঢোকে, "কাকিমা খেতে দাও, ভীষণ খিদে পেয়েছে।" নিবেদিতা ঈষৎ হেসে বলে, "মা নেই, মামার বাড়ি গেছে, তুমি একটু বসো, আমি চেঞ্জ করে এসে তোমাকে খেতে দিচ্ছি।" অনিমেষ তাকে জাপ্টে ধরে শূন্যে তুলে নিয়ে বাচ্ছাদের মত আনন্দে দুবার পাক খেয়ে বলে ওঠে, "দিতি, দিতি, আজ আমি ভীষণ খুশি, কি দেবে বলো?" "অনি, ছাড়ো! কি ছেলেমানুষি হচ্ছে? নামাও আমাকে, আমার মাথা ঘুরছে" নিবেদিতা কপট রাগ দেখায়।নিবেদিতাকে নামিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে অনিমেষ বলে যেতে থাকে, "পরশু ভোরের ফ্লাইট, ওরা টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছে, প্রথমে কোম্পানির গেস্টহাউসে উঠবো, তারপর মাসখানেকের মধ্যে একটা ফ্ল্যাট দেখে নিলেই হবে।" নিবেদিতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অনিমেষ মুখটা তার ঠোঁটের উপর নামিয়ে আনে।মৃদু অ্যালকোহলের গন্ধ এসে লাগে নিবেদিতার নাকে, সে অস্ফুট বলার চেষ্টা করে, "এত তাড়া কিসের?" কিন্তু ছোট থেকেই মা'র মতই অনি'র কোনো আবদারকে সেও কখনো ফেলতে পারেনি।ছোটবেলায় তাদের মধ্যে যতবার শিশুসুলভ মনকষাকষি হয়েছে, ততবার তাকেই যেচে ভাব করতে হয়েছে।বড় হবার পরেও তাকেই সবসময় মান-অভিমান মেটানোয় প্রতক্ষ্য ভূমিকা নিতে হয়েছে বা বলা ভালো সে নিজেই কখনো একদিনের বেশি অভিমান করে থাকতে পারেনি।তাই এক্ষেত্রেও অনিমেষের তীব্র আবেগের কাছে নিরুপায় আত্মসমর্পন ছাড়া তার বিশেষ কিছু করার ছিলনা।তাছাড়া অনিমেষের চলে যাবার দিনটা জানার পর থেকেই সেও ভেতরে ভেতরে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল, ফলে মুহূর্তের দমকা ঝড়টা তাকেও যে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো তা সে তখন অনুধাবন করতে পারেনি।

কিন্তু এখন ঘটনাটার কথা ভাবতে বসে তার মনের মধ্যে এলোমেলো অনেক কিছু ঘুরপাক খেতে থাকে।এমনিতে তাদের বিয়েটা দুই বাড়ি থেকেই ঠিক করা আছে, অনি'র দিদিমার ইচ্ছে ছিল নাতি বাইরে চলে যাবার আগে আশীর্বাদটা অন্তত সেরে ফেলার, কিন্তু তারা দুজনেই ঘোর আপত্তি জানিয়ে বৃদ্ধাকে নিরস্ত করেছে।অনিমেষ চেয়েছিল জয়েন করে একটু গুছিয়ে নিয়ে তারপর সংসার শুরু করতে আর নিবেদিতার বক্তব্য ছিল মাস্টার্সটা কমপ্লিট করে আগে সে একটা চাকরি জোগাড় করবে তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে।এতদিন মামা তাদের দায়িত্ব নিয়েছে, বিয়ের পর মা'র দায়িত্ব সে কারোর উপর চাপাতে চায়না, অনি'র উপরও নয়।আর তারা দুজনেই যখন দুজনকে ভালোবাসে, পরস্পরের এইটুকু ইচ্ছের মর্যাদা রাখাটাই তো উচিত, সুতরাং বিয়েটা বছরখানেক পরেই হবে ঠিক হয়।আজকের ঘটনাটা যে তার মধ্যে কোনোরকম পাপবোধের সঞ্চার করেছে ঠিক তা নয়, আসলে কোনো মেয়ে যখন কাউকে ভালোবাসে, তার সবটুকু দিয়েই ভালোবাসে, তাই সে জন্যে তার কোনো আক্ষেপও নেই।তবে আজকে অনি'র আচরণটা তার কাছে কিঞ্চিত অশোভন ঠেকেছে, সে কিছুটা কোমলতা প্রত্যাশা করেছিল।নিবেদিতা ভাবতে থাকে, যা কারো একান্তই নিজস্ব এবং অপরপক্ষ যখন তা উজাড় করে দিতে চায়, তখন তা গ্রহণ করার মধ্যেও একটা সৌজন্য তথা শিষ্টাচারের পরিমিতিবোধ থাকা উচিত।ঠিক সেই সময়ে অনি'র মধ্যে যে জান্তব ভঙ্গি সে লক্ষ্য করেছিল, তার সাথে প্রেমিক অপেক্ষা ধর্ষকের সাযুজ্যই অধিক।তার এত কাছের এত আপন অনি'র এই অচেনা রূপটা তাকে ভাবিয়ে তোলে — তাহলে কি প্রত্যেক পুরুষের অবচেতনেই একটা হিংস্র শ্বাপদ বাস করে, যা সুযোগ পেলেই নখ দাঁত বার করে একজন ধর্ষকের চেহারা নেয় ! মাথার মধ্যে চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে, শরীরটায় একটা অদ্ভ–ত অস্বস্তি হচ্ছে, খেতে ইচ্ছা করছেনা।আলোটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে নিবেদিতা।

দুই।

ইন্ডিগোর ফ্লাইটটা মুম্বাইয়ের সান্তাক্র–জ বিমানবন্দরে অবতরণ করে সকল দশটায়, ব্যাগেজ কালেক্ট করে বেরোতে বেরোতে সাড়ে দশটা বেজে যায়।অফিস থেকে গাড়ি পাঠানোর কথা আছে, ড্রাইভারের নাম্বারটা খুঁজে ডায়াল করতে করতেই অনিমেষ দেখতে পায় অ্যারাইভাল গেটের সামনেই তার নামের প্ল্যাকার্ড হাতে এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন।অনিমেষ গিয়ে নিজের পরিচয় দিলে তিনি তার ট্রলিটা নিয়ে রাস্তার উল্টোদিকের পার্কিং লটে নিয়ে আসেন অনিমেষকে।মিনিট পঁচিশ মত লাগল কুর্লা ইস্টে গেস্ট হাউসে পৌঁছাতে।চমৎকার ঘর, দোতলার ব্যালকনি থেকে সামনে একটা পার্ক দেখা যাচ্ছে।দুপুরের খাওয়ার পর লম্বা একটা ঘুম দিয়ে বিকেলে কফির মগ হাতে ব্যালকনিতে বসে অনিমেষ পার্কের দিকে চেয়ে ছোট ছোট বাচ্ছাদের খেলা দেখছিল, হঠাৎ একটা গাড়ির শব্দে চমক ভেঙ্গে সে সকালে তাকে নিয়ে আসা গাড়িটা থেকে একজন সুবেশী তরুণীকে নামতে দেখে।রাতে ডিনার টেবলে আলাপ হয় মেয়েটির সাথে, তার মতই নিউ জয়নী, নাম নিশা মেহতা, বাড়ী পাঞ্জাবে।প্রথম আলাপেই অত্যন্ত স্মার্ট, সুন্দরী ও সপ্রতিভ নিশাকে ভালো লেগে যায় অনিমেষের।নিশার ঘরটা অনিমেষের উল্টোদিকেই, ডিনারের পরে দুজনে বেশ কিছুক্ষন গল্প করে, নতুন শহরে কথা বলার মত কাউকে পেয়ে অনিমেষ কিছুটা স্বস্তি বোধ করে।পরের দিন সকvল আটটায় অফিসের গাড়ি আসবে পিক আপ করতে, তারা পরস্পরকে শুভরাত্রি জানিয়ে নিজেদের ঘরে চলে যায়।

অফিসের প্রথম দিনটা জয়েনিং ফর্মালিটিজ ও অন্যান্য কলিগদের সাথে পরিচয়ে কেটে যায়।ফাইনান্স এম বি এ অনিমেষ নিযুক্ত হয় টেকনিকাল অ্যানালিসিস টিমে, অন্যদিকে নিশা যোগদান করে এইচ আর ডিপার্টমেন্টে।মেধাবী ছাত্র অনিমেষ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই একজন দক্ষ অ্যানালিস্ট হয়ে ওঠে।এর মধ্যে নিশার সাথে বন্ধুত্বটাও বেশ গভীর হয়েছে, অচেনা শহরে প্রথম আলাপের কারণেই হোক বা ওয়েভ লেংথ ম্যাচ করার জন্যেই হোক, তারা দুজনেই পরস্পরের সান্নিধ্য বেশ উপভোগ করে।এইবার আস্তে আস্তে একটা আস্তানা দেখতে হবে।মুম্বাইয়ের এই এলাকায় থাকার খরচ আকাশ ছোঁয়া, ওরা দুজনে ঠিক করে আলাদা আলাদা থাকার চেয়ে একটা টু বি এইচ কে অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করলে খরচ কিছুটা কম পড়বে।সেইমতো একটা উইকএন্ডে কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাটে ওরা শিফট  করে যায়।

এই বছর কোম্পানীর ফাউন্ডেশন ডে অ্যানিভার্সারি পড়েছে শুক্রবার, পার্টির আয়োজন বান্দ্রার এক পশ নাইটক্লাবে।পরের দুদিন ছুটি থাকায় সকলেই বেশ রিল্যাক্সড, সোনালী সুরা আর সুগন্ধী শিশা পরিবেশে এক অদ্ভ–ত মাদকতার সৃষ্টি করেছে। খোলা চুল আর ক্রপ ট্যাঙ্ক টপে নিশাকে অসম্ভব মোহময়ী লাগছে, ডান্স ফ্লোরের মায়াবী আলো তার পেলব মসৃণ ত্বকের উপর দিয়ে যেন পিছলে যাচ্ছে।নিশাকে আলিঙ্গন করে নাচতে নাচতে অনিমেষ ক্রমশ তার শরীরের মধ্যে ডুবে যেতে চায়।অনেক রাতে ট্যাক্সি করে যখন তারা বাড়ি ফেরে দুজনেই বেশ টায়ার্ড। হঠাৎ এই সময়ে অনিমেষের গলা জড়িয়ে আবদারের ভঙ্গীতে নিশা বলে ওঠে, "ডোন্ট ফীল লাইক টু গো টু মাই রুম, উড ইউ মাইন্ড মি স্টেইং হিয়ার?" উত্তরের অপেক্ষা না করে অনিমেষের বিছানায় শরীরটাকে ছুঁড়ে দেয় সে।অনিমেষ আস্তে আস্তে তার স্টিলেটো দুটো খুলে দেয়, তারপর মুখে চোখে ঠান্ডা জলের ঝাপ্টা দিয়ে এসে শুয়ে পড়ে।নিশা ঘোরের মধ্যে অনিমেষের আরো কাছে সরে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে, আস্তে আস্তে দুটো শরীর এক হয়ে যায়।

প্রায় এক বছর হতে চললো অনিমেষ মুম্বাই এসেছে, কাজের চাপও খুব বেড়েছে, কর্তৃপক্ষ তার কাজে বেশ খুশি, সব ঠিকঠাক চললে নেক্সট সাইকেলে প্রমোশন পাকা।এর মধ্যে আর বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি, সত্যি কথা বলতে ছুটির সেরকম চেষ্টাও করেনি সে; একদিকে উন্নতির নেশা অন্য দিকে নিশার সাথে কাটানো নিবিড় মুহূর্তগুলোকে ফেলে রেখে কলকাতা যাবার কোনো ইচ্ছেই তার হয়নি, তাই দাদু-দিদিমা ফোন করলে সে বারবারই কাজের চাপের অজুহাত দিয়ে বাড়ি যাওয়াটা স্থগিত রেখেছে।প্রথম প্রথম ফোনে নিবেদিতার সাথে যোগাযোগ থাকলেও পরের দিকে অনিমেষের কথা বলার নিরুৎসাহ লক্ষ্য করে সে-ই আস্তে আস্তে ফোন করা বন্ধ করে দিয়েছে।নিশার সাথে একটা সুখী সচ্ছল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে দেখতে কেরিয়ারের ইঁদুর দৌড়ে সামিল হয়ে পড়েছে অনিমেষ, এখন তার প্রথম লক্ষ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অ্যাপার্টমেন্টটা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের একটা বড়সড় দেখে ফ্ল্যাট নেওয়া।

কোম্পানীর গ্লোবাল টেকনিক্যাল অ্যানালিস্টস মিটে ইন্ডিয়া থেকে অনিমেষ সিলেক্টেড হয়েছে, সামনের মাসে দু সপ্তাহের বিজনেস ট্রিপ স্টেট;সে।এর কিছুদিনের মধ্যেই আসে দুঃসংবাদটা, মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরার সময়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দাদুর কার্ডিয়াক ফেলিওর, পড়ে গিয়ে প্রচুর ব্লিডিং হয়, হসপিটালে নিয়ে যাবার সুযোগটুকু পাওয়া যায়নি।এদিকে যাবার আর পাঁচ দিন বাকি, অনিমেষ জানে এইসময় কলকাতা গেলে দিদিমা কিছুতেই তাকে দাদুর কাজ না করে ফিরতে দেবেননা, আর কোনোমতেই সে কেরিয়ারের এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায়না।ভাবতে ভাবতে একটা প্ল্যান আসে তার মাথায়, নিবেদিতাকে ফোন করে সে স্টেট;সে যাবার ব্যাপারটা জানিয়ে বলে, "দিতি, তুমি তো বোঝো এরকম সুযোগ বারবার আসেনা, তুমি যদি একটু দিদাকে বুঝিয়ে বলো, দিদা ঠিক বুঝবে।আমি ফিরে এসেই যত তাড়াতাড়ি পারি ছুটি নিয়ে বাড়ি যাব।" নিবেদিতা স্তম্ভিত হয়ে যায়, অনেকক্ষন চুপ করে থেকে শুধু বলে, "এইসময় তুমি না এলে দিদা খুব কষ্ট পাবেন।" অনিমেষ শান্ত গলায় বলে, "দেখ, যা হয়ে গেছে তা তো আর ফেরানো যাবেনা, মাঝখান থেকে শুধু শুধু আমার কেরিয়ারটা অনেকখানি পিছিয়ে যাবে, তুমি একটু ম্যানেজ করে দিও প্লিজ।আচ্ছা আমি রাখছি, আমার যাবার জন্য অনেক কেনাকাটা বাকী আছে।" ফোন কেটে দেয় অনিমেষ।বৃদ্ধা এই আঘাত সামলে উঠতে পারেননা, শোকে পাথর মানুষটা এই সময়ে নাতিকে ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন, খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ করে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।অবশেষে স্বামীর মৃত্যুর দশদিনের মাথায় তিনিও ইহলোক ত্যাগ করেন।অনিমেষ তখন আমেরিকায়, মুম্বাই ফেরার পর সে প্রথমে তাঁদের পারিবারিক সলিসিটর মিঃ মুখার্জীকে ফোন করে।দাদু তাঁর বিষয় সম্পত্তি সমস্তকিছু দেখাশোনার ভার তাঁর বাল্যবন্ধু অ্যাডভোকেট মুখার্জীকে আগেই দিয়ে দিয়েছিলেন, পাওয়ার অফ অ্যাটর্নিও তাঁকেই দেওয়া ছিল।অনিমেষ জানিয়ে দেয় সে আর কলকাতার বাড়িটা রাখতে চায়না, কোনো ভালো দেখে প্রোমোটারকে বিক্রি করে তিনি যেন সমস্ত টাকা অনিমেষের ব্যাঙ্কে ট্রান্সফার করে দেন।সমস্ত লিগাল প্রসিডিওর মিটতে মাস ছয়েক লেগে যায়, দাদুর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি মিলিয়ে অনিমেষ প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা পেয়েছে।এখন সে তাদের মনের মত একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারবে।

ইতিমধ্যে আর একটা প্রমোশন হয়েছে অনিমেষের, কোম্পানীর বিভিন্ন বিজনেস ডিসিশনে তার মত ইয়ং আর ডায়নামিক ম্যানেজারের ইনপুট অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়।আস্তে আস্তে কোম্পানীর বিজনেসের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় ইনভল্ভ হতে শুরু করে সে।প্রচন্ড মেধাবী, কেরিয়ারিস্ট এবং নতুন কিছু শেখার প্রবল আগ্রহ তাকে কোম্পানীতে প্রায় অপরিহার্য করে তোলে।এর সাথে নিশার সাহচর্য ও অনুপ্রেরণায় উন্নতির প্রবল নেশা তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে, ক্রমশ উপরে, আরো উপরে ওঠার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে সে।

তিন।

এম এ তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে নিবেদিতা মাসখানেক হলো একটা নামকরা বেসরকারী হাইস্কুলে ইংলিশ টিচার হিসাবে জয়েন করেছে।মিনতিদেবী এইবার তার বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন, রোজই তিনি মেয়ের থেকে অনি'র নাম্বারটা চান তার সাথে কথা বলার জন্য; নিবেদিতা নানা অছিলায় মাকে নিরস্ত করে।সত্যিটাতো তাঁকে বলা যায়না যে তাঁর আগের অনি এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে, কেরিয়ারের নেশায় সে পুরোনো সম্পর্কগুলোকে আর স্বীকার করতে চায়না।কিছুদিন যাবার পর একদিন অধৈর্য হয়ে নিবেদিতার অনুপস্থিতিতে তিনি তার মোবাইল থেকে অনিমেষের নাম্বারটা খুঁজে বার করে তাকে ফোন করেন।তিনি নিবেদিতার বিয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা মাত্রই অনিমেষ বলে, "কাকিমা, তুমি সব আয়োজন করে ফেলো, টাকাপয়সা নিয়ে কিছু চিন্তা করার দরকার নেই, আমি ছুটি পাবনা তাই যেতে পারবনা, কিন্তু দিতির বিয়ের সমস্ত খরচ আমি পাঠিয়ে দেব।" একথা শোনার পর আর কিছুই বলার থাকেনা, মিনতিদেবী অতিকষ্টে শুধুমাত্র বলতে পারেন, "ঠিক আছে, প্রয়োজন হলে জানাবো।" ফোন রেখে দিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন তাঁর আদরের অনি কতটা বদলে গেছে, এইজন্যেই মেয়ে তাঁকে নানা বাহানায় এড়িয়ে যাচ্ছিল।মেয়েটা সত্যি সত্যিই বড় হয়ে গেল, এখন আর নিজের কষ্টের কথাটাও মা'র কাছে মুখফুটে বলেনা।নিজের অজান্তেই তাঁর দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসে।

দেখতে দেখতে নিবেদিতার চাকরীরও এক বছর পূর্ণ হয়েছে, অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পড়ানোর জন্য সুশিক্ষিকা হিসাবে তার এখন যথেষ্ট খ্যাতি।একদিন স্কুলে লাঞ্চ আওয়ারে বিজনেস টাইমস চোখ বোলাতে গিয়ে একটা খবরে চোখ আটকে যায়— "টেকনিক্যাল অ্যানালিস্ট স্যাকড অ্যান্ড অ্যারেস্টেড ফর ইনসাইডার ট্রেডিং" — খবরটা পুরোটা পড়ে জানা যায়, বেআইনী ভাবে ইনসাইডার ট্রেডিং করে প্রচুর টাকা রোজগারের জন্য সেবি থেকে অনিমেষদের কোম্পানীর বেশ কয়েকজন সিনিয়র অফিসিয়ালসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, যাদের মধ্যে অন্যতম অনিমেষ চ্যাটার্জী।কোম্পানী কোনো দায়ভার নেয়নি, সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষকে স্যাক করে দেওয়া হয়েছে, সে এখন পুলিশ হেফাজতে।খবরটা পড়ে মাথা ঘুরে যায় নিবেদিতার, তার অনি পুলিশ হেফাজতে, অচেনা শহরে কারো সাহায্য ছাড়া কিভাবে এই বিপদ থেকে সে উদ্ধার পাবে? এক নিমেষে সমস্ত অভিমান কোথায় উবে যায়।শরীরটা ভালো লাগছেনা বলে প্রিন্সিপালের থেকে ছুটি নিয়ে সে দৌড়োয় অ্যাডভোকেট মুখার্জীর কাছে।সব শুনে মি: মুখার্জী তখনই মুম্বাইতে তাঁর পুরোনো এক জুনিয়রের সাথে যোগাযোগ করেন, সবার প্রথমে অনিমেষের জামিনের ব্যবস্থা করতে হবে।তাঁদের তৎপরতায় পরের দিনই অনিমেষের জামিন হয়ে যায়।সমস্ত প্রমাণই অনিমেষের বিপক্ষে, সুতরাং উকিলের পরামর্শমত একমাত্র সবকিছু স্বীকার করে নিয়ে বিশাল অঙ্কের পেনাল্টি দিলে তবেই হাজতবাস এড়ানোর একটা ক্ষীণ আশা আছে।এই বিপদ থেকে বাঁচতে গেলে অনিমেষকে তাদের কেনা ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দিতে হবে, এছাড়া তার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, এবং শেয়ার, বন্ড ইত্যাদি যা আছে সব বিক্রি করেও আরো কিছু টাকা কম পড়বে।বাড়ী ফিরে সে নিশাকে সব জানায়; অনিমেষ ভেবেছিলো বাকি টাকাটা নিশা যদি কোনো ভাবে তার বাড়ী থেকে অন্তত ধার হিসাবেও জোগাড় করে দেয়, তাহলে পরে সে আস্তে আস্তে শোধ করে দেবে।কিন্তু নিশা সরাসরি জানিয়ে দেয়, সে এই সম্পর্কটা আর বজায় রাখতে চায়না, আর ব্যাঙ্গের সুরে বলে এই অবস্থায় কার মাথা খারাপ হয়েছে যে অনিমেষকে টাকা ধার দেবে আর সেই বা বেকার অবস্থায় কিভাবে ঋণশোধ করবে! অনিমেষ ভেবে পায়না কি বলবে, একদিন এই নিশাকে সুখী করার জন্য সে যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত ছিল।

অ্যাডভোকেট মুখার্জীর মাধ্যমে সব শুনে নিবেদিতা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে, কাতরকন্ঠে অনুরোধ করে, "মুখার্জীদাদু, আপনাকে যেভাবেই হোক কোনো একটা ব্যবস্থা করতেই হবে, দরকার পড়লে আমাদের বাড়ীটা বন্ধক রেখেও যদি ঋণের ব্যবস্থা করা যায়, আমি যেভাবে হোক টাকাটা আস্তে আস্তে শোধ করে দেব।" ছোট থেকেই ভদ্র ও মিষ্টি স্বভাবের পাড়ার এই মেয়েটিকে আরো অনেকের মতই মি: মুখার্জীও অত্যন্ত স্নেহ করতেন, আর অনিমেষের দাদুর ঘনিষ্ট বন্ধু হবার সুবাদে তার সাথে অনিমেষের সম্ভাব্য বিবাহের কথাও জানতেন।আমূল বদলে যাওয়া অনিমেষের জন্যে এখনো এই মেয়েটির এত মায়া তাঁকে যারপরনাই আশ্চর্য করে তোলে।তিনি অনুভব করেন, সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে ক্ষমা করতে পারাই প্রকৃত ভালোবাসার ধৰ্ম; মনে পড়ে যায় সেই কবে পড়া 'শেষের কবিতা'-র কয়েকটি লাইন —

"যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি…"

তিনি সস্নেহে নিবেদিতার মাথায় হাত রেখে বলেন, "তোকে এত চিন্তা করতে হবেনা, আমি যতদূর সাধ্য চেষ্টা করব, তাছাড়া অনি তো আমারও নাতির মতই, আমি ভাবছি নিজেই একবার মুম্বাই যাব।তুই এখন বাড়ী যা আর তোর ফোন নাম্বারটা আমাকে দিয়ে যা, আমি তোকে ফোনে সব জানাবো।" 

কথামতো পরেরদিন সকালের ফ্লাইটেই মুম্বাই রওনা হয়ে যান প্রবীণ অ্যাডভোকেট সুধাংশু মুখার্জী।প্রাক্তন জুনিয়র অমিত মুম্বাই হাইকোর্টে প্র্যাক্টিস করে, অনিমেষের জামিনের ব্যবস্থা সেই করেছে।আগে থেকেই জানানো ছিল, এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা অমিতের চেম্বারে হাজির হন তিনি।সমস্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা যায় একমাত্র প্লী বার্গেনিং ছাড়া অনিমেষের হাজতবাস আটকানোর কোনো উপায় নেই।তাকে অমিতের চেম্বারে ডেকে সমস্তকিছু বুঝিয়ে দেন তিনি; স্থাবর অস্থাবর যা কিছু সম্পত্তি আছে সবই বিক্রি করে দিতে হবে, তারপর অমিতের প্রভাব এবং যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে যতটা সম্ভব কম অঙ্কে রফা করা যায়।অনিমেষকে আশ্বাস দেন তিনি যে, এরপরেও বাকি যে টাকাটা লাগবে সেটা তিনি জোগাড় করে দেবেন, আর কেসটা মিটে গেলেই অমিতকে সোজা কলকাতায় তাঁর কাছে চলে আসার পরামর্শ দেন।অ্যাডভোকেট অমিত বসুর তৎপরতায় খুব তাড়াতাড়ি অনিমেষের ফ্ল্যাটটা নিলামের ব্যবস্থা হয়ে যায়, এছাড়া তার সমস্ত সঞ্চিত অর্থ এবং অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে মোটামুটি পুরো টাকাটাই জোগাড় হয়ে যায় এবং মাস দুয়েকের মধ্যে কেসটা সেটল হয়ে যায়।প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় অনিমেষ ভাবতে থাকে কলকাতায় ফিরে গিয়ে আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে, এই অবস্থায় সে কোথায় চাকরী পাবে আর কতদিনই বা মুখার্জিদাদুর বাড়ীতে থাকবে! তার মনে হতে থাকে, সব হারিয়ে এই পৃথিবীতে আজ সে সম্পূর্ণ একা।হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে, স্ক্রীনে তাকিয়ে সে দেখে দিতির ফোন; ফোনটা ধরলে ওপাশ থেকে খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে নিবেদিতা বলে, "অনি, মা বলছে তুমি ফিরে এসে আমাদের এখানে থাকবে, না হলে মা কিন্তু খুব কষ্ট পাবে।" অনেকক্ষন চুপ করে থেকে অনিমেষ শুধুমাত্র 'আচ্ছা’ বলে সম্মতি জানায়।

হাওড়াগামী মুম্বাই মেলের স্লীপার বার্থে শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছেনা অনিমেষের, অজস্র স্মৃতি এসে ভীড় করছে মাথার মধ্যে।মনে পড়ছে বছরখানেক আগে নিশার সাথে দেখা 'টাইটানিক' সিনেমায় বৃদ্ধা রোজের সেই বিখ্যাত উক্তি, "আ ওম্যান'স হার্ট ইজ আ ডীপ ওশান অফ সিক্রেটস।" অনিমেষের মনে হয়, দিতির মত কতিপয় মেয়ের ক্ষেত্রে বরং বলা যায়, আ ওম্যান'স হার্ট ইজ দা সেফেস্ট শেল্টার আ ম্যান ক্যান হ্যাভ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন