!!২য় পর্ব!!
'মন মানে না বৃষ্টি হলো এত
সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পাড়ে
আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল
স্পর্শ করি জলের অধিকারে'
____________________
উৎপলকুমার বসু
হলুদ পাঞ্জাবি পরতে দারুণ ভালো লাগে আমার। একটা নয়, তিন-তিনটে হলুদ পাঞ্জাবি পরি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। কোনোটার রং কাঁচা হলুদ, কোনোটা কমলা-ঘেঁষা, কোনোটা বাসন্তী। তবুও আমি হিমু নই। আমার হলুদ পাঞ্জাবিতে পকেট থাকে, একাধিক। পকেটে সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, রুমাল। এমনকি একটা জেল-পেনও পাওয়া যেতে পারে, কখনও কবিতা উঁকি দিলে লিখে ফেলার জন্য। অথচ একটুকরো কাগজ হামেশাই থাকে না! অনেক কবিতা হঠাৎ এসে হঠাৎই হারিয়ে গেছে এভাবেই। ইদানীং তাই মুঠোফোনে লিখে রাখি স্বপ্নের ভুবন ও দুর্বিষহ বাস্তব।
কথা হচ্ছিল হিমুর। শুধু পাঞ্জাবির পকেট আছে বলেই যে আমি হিমু নই, তা নয়। হিমু বরাবরই বিকর্ষে যেতে চায় রূপার থেকে। আর আমি তোমার আসঙ্গলিপ্সায় বাঁচি প্রতিদিন। কিন্তু আমার মধ্যে যে একটা ভবঘুরেও আছে, তাকেও আমি চিনি। অথচ আমি নীলুও নই। আমার কোনো দিকশূন্যপুর নেই! আমার কিছু গন্তব্য আছে, এবং কী আশ্চর্য, তার প্রতিটিতেই কোনো-না-কোনোভাবে তুমি জড়িয়ে আছো!
কথা হচ্ছিল কবিতার। বইপাড়া-তুতো এক দাদা, তিনি প্রোলিফিক একজন গদ্যকার, এবং অনিয়মিত কিন্তু সিরিয়াস কবিতাপ্রয়াসীও। আমার কবিতা খুবই পছন্দ করেন তিনি, পাশাপাশি আমার লেখাকে 'তুমি-আমি'-র এককেন্দ্রীকতা পরিহার করতে দেখার আগ্রহী। কলেজ স্কোয়ার সুইমিং পুলের পাশে দাঁড়িয়ে একদিন তাঁকে আমার 'অশ্রুকথন' পড়াই। যে-কথনের বহুমাত্রিকতায় আমিই তখন হয়ে উঠছি 'তুমি', এবং তুমি হয়ে উঠছো 'সে'। তাঁর অভিজ্ঞ চোখ তারিফ করে বলে, 'বাঃ, কবিতাটা দারুণ নামিয়েছিস!' অথবা সেই লিটল ম্যাগাজিন-তুতো অগ্রজতুল্য সম্পাদক, যিনি একদিন পরম বিশ্বাস থেকে আমাকে বলবেন, 'তোর কবিতার হাত খুব নরম। এটাকে রাজনৈতিক কবিতা লিখে নষ্ট করিস না!' এইসব পুরস্কার শিরোধার্য করেও যখন কবিতারা কড়া নাড়ে, তখন আর মনে থাকে না কোনটা রাজনৈতিক আর কোনটা নয়। তাছাড়া, জীবনের থেকে বড়ো রাজনীতি আর কী আছে!
কথা হচ্ছিল হলুদ পাঞ্জাবির। সে-রকম একটা পাঞ্জাবি পরে কোনো এক মধ্যাহ্নে দাঁড়িয়ে দরদর ঘামছিলাম ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে। একসময় নিজেকে আমার খুঁজে-পাওয়া লালপাড় হলুদ পাখিরালয়ে জড়িয়ে, দৃশ্যপটে ফুটে উঠলে তুমি। কালোয় ঢাকা বাহু, পিঠ ও কাঁধজুড়ে তখন রঙিন মাছের খেলা। এভাবে তোমার নিকটতর হওয়ার দৃশ্যটি হুবহু জেগে আছে আজও, কারণ জীবনে এমন প্রিয় দৃশ্য খুব কমই দেখেছি! ঠিক তার আগেরদিন দুর্গামন্দিরের প্রায় নির্জন দেউলে দেবীবরণের যে-দৃশ্যটি সংঘটিত হয়েছিল, তার চরিত্রদু'টি তো ছিলাম আমরাই। নাইটদের প্রথাগত রীতিতে হাঁটু মুড়ে নাই-বা বসলাম আমি। নিবেদন আর কবে প্রথা মেনে প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজেকে! অতএব দেবীবরণের অব্যবহিত পরের দুপুরে আমরা নিজেদের সঁপে দিয়েছিলাম প্রাচীন সভ্যতার আলো-আঁধারিতে। সেখানে উষ্ণতার চিরস্থায়ী স্বাদ বিনিময়ের পরে মগ্ন সন্ধ্যার অলিগলিতে তাপপ্রবাহকে হার-মানানো চলাচল আমাদের থিতু করলো প্রেমে ও প্রজ্ঞায়। আমরা অগ্রাহ্য করতে শিখলাম শারীরিক ক্লেশ। এই দুপুরে তাই তারই ভাব-সম্প্রসারণে রোদ থেকে চলো খুঁজে নিই ছায়া!
কবিতার কথা এলে গদ্যেরও কথা আসে। গদ্য আমার কালোঘোড়া। আমার কবিতার মতো অভিমানিনী প্রেয়সী নয় সে। তরতাজা যুবকের উৎসাহ নিয়ে লড়াকু যোদ্ধা। আর সেই যে কত অল্প বয়স থেকে সে আমার নিজস্ব মধ্যবিত্ত সচ্ছলতার যোগানদার, তুমি তো জানোই! এই গদ্যে আমি তাকে মাঝেমাঝে তোমার-আমার অর্গলমুক্ত করে দিতে চাই। একটু দূরত্ব থেকে দেখতে চাই আমাদের। আবার মাঝেমাঝে ফিরে আসা যাবে তোমার-আমার রোজনামচায়।
একটা জনহীন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। তিন না চাররাস্তার মোড় এটা? নাকি আরও বেশি! কোথায়? ঠাহর করতে পারছি না! অথচ খুব চেনা। মাঝরাতে শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড় অনেকটা এরকম। ওই তো গোলবাড়ি দেখা যাচ্ছে! কিন্তু আমার স্কুলের ১৬০ বছরেরও বেশি পুরোনো বাড়িটা তার পাশে আসবে কোথা থেকে, যেখানে রয়ে গেছে আমার শৈশব-কৈশোরের দশটি বসন্ত! তাহলে নিশ্চয় এটা বহরমপুরের জলট্যাঙ্ক মোড়। কিন্তু সেখানে এত প্রশস্ত রাস্তা কোথায়! প্রবল ধন্ধে জড়িয়ে যেতে থাকি ক্রমশ, আর এরকম অবস্থায় যা-করা অভ্যাস, পকেট হাতড়ে খুঁজি সিগারেট। পাই না একটাও! ক্রমশ আরও ঘামে লেপ্টে যেতে থাকে আমার হলুদ পাঞ্জাবি।
জনহীন রাস্তার অন্যদিক থেকে এগিয়ে আসছে যে, তার মুখ আমার চেনা। কোথায় যেন দেখেছি, মনে পড়ে না কিছুতেই! মৃদুপায়ে হেঁটে সে আমার খুব কাছে দাঁড়ায়। একদম সামনে। আর ততোধিক মৃদুগলায় প্রশ্ন করে, 'চেনা যাচ্ছে?'
নিরুত্তর আমাকে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য কিছুক্ষণ পরে আবার মুখ খোলে সে: 'নামটা মনে পড়ছে না, তাই তো? নামে কী এসে যায়! মনে নেই, শেক্সপিয়র কী বলেছিলেন---হোয়াটস ইন আ নেম? দ্যাট হুইচ উই কল আ রোজ বাই এনি আদার নেম উড স্মেল অ্যাজ সুইট...'
এই উচ্চারণভঙ্গিটিও বড়ো চেনা। তবু কেন যে চিনতে পারি না তাকে! একটু বিদ্রূপ খেলে যায় এবার তার ঠোঁটে: 'চিনতে পারলে না তো? আরে, নামে কী এসে যায়! কিছু একটা ধরে নাও না! এই যেমন ধরো, রোহিত। ঠিক আছে?'
এই বাচনভঙ্গিটুকুও খুবই পরিচিত লাগে। কিন্তু সেটাও খুলে বলতে পারি না তাকে। যেন বাক্যরোধ হয়েছে আমার!
রোহিত নিকটতর হয়। কোথা থেকে একটা সিগারেট বের করে আমার ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় সে। তারপর নিজেও ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে প্রশ্ন করে, 'তাকে কোনোদিন বলেছো তোমার পিছনে ফেউয়ের মতো লেগে থাকা অদৃশ্য কায়ার কথা?'
পরপর এমন বিস্ময়ের ধাক্কায় বোধহয় বোবাও কথা বলে উঠবে একসময়! অতএব বাক্যরোধ ভেঙে আমার গলার কোন ভিতর থেকে প্রশ্ন উঠে আসে, 'কাকে?'
সুচিন্তিত মতামত দিন