বেশ কিছুদিন ধরেই সমস্তটা এলোমেলো,অবিন্যস্ত। চোখের সামনে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখেও অনেক সময় মানুষের কিছু করার থাকে না। এতদিনের সাজানো সংসার,গোছানো স্বপ্ন-মুহূর্তের ঝড়ে ভেঙে যেতে বসেছে তবুও চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আমার কিছুই করার নেই। সামনের পথ হয়তো আরো অনেক কঠিন হতে চলেছে। বুঝতে পেরেও সেই কঠিন পথেই এগোতে হবে আমাদের, এছাড়া আর উপায় হয়তো নেই। তবুও শিকড়ের টান ভোলা বড় কঠিন। এই বাড়ি আমাদের নিজেদের হাতে তৈরি। বিয়ের পর যখন অনিন্দ্য ট্রান্সফার হয়ে প্রথমবার এই শহরে তখন এই কোয়ার্টারেই উঠেছিলাম দুজনে। অনিন্দ্যর বরাবরই ভাড়াবাড়ি, কোয়ার্টার অপছন্দ। এসে থেকেই তাল তুলছিল একটা জমি কিনে নিজে বাড়ি করবে। আমি কখনো ওর কোনো ইচ্ছায় বাধা দিইনি। নিজেও একটা স্কুলে কাজ পেয়ে গিয়েছিলাম। সামর্থ্য কিছুটা হলেও ছিল-তাই এগিয়ে ছিলাম। তারপর বাড়ি হল, সেই বাড়িতে আমরা এলাম, তারপর আমাদের বাবিন এল, সে উপুড় হল, বসল,হামাগুড়ি দিল, হাঁটল, কথা বলতে শিখল-স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির গণ্ডিও পার করল এই বাড়ি থেকেই। বাড়িটার প্রত্যেকটা কোণাতে ধুলোর সাথে কত স্মৃতি যে জড়িয়ে আছে গুণে শেষ করা যাবে না। তবুও এ বাড়িতে আমাদের আর বেশিদিন থাকা চলবে না। চলে যেতে হবে দিন কয়েকের মধ্যেই-বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হবে, বাবিনের তেমনই ইচ্ছে, আমাদের আর ওদের ফ্ল্যাট আলাদা হবে। আমরা বুড়োবুড়ি-বাতের ব্যথায় কষ্ট হবে বলে-একতলায়, আর বাবিন,মধুরিমা আর আমাদের একমাত্র নাতি ঋজু, থাকবে দোতলায়, দক্ষিণ-পূর্ব ফ্ল্যাটে। একসাথে এবাড়িতে এক সংসারে থাকলে, ঘটিবাটির বড্ড ঠোকাঠুকি হচ্ছে-তাই এই ব্যবস্থা করেছে বাবিন। আমাদের কোন অসুবিধা হবে না-এটা ভালো করে বুঝিয়েছে ও। উপর তলাতেই ও থাকবে, ডাকলেই চলে আসবে। তাছাড়া রান্নার লোক, ঠিকে কাজের লোক,সর্বক্ষণের লোক-সবই রেখে দেওয়া হবে আমাদের সুযোগ সুবিধার কথা ভেবে। এত ভালো প্রস্তাবে আপত্তি করার কোন কারণ নেই-তাই আমিও আপত্তি করিনি। জোর করে কিছু ধরে রাখা যায় না বলেই সে চেষ্টা করা উচিৎ নয়। এমনিতেই আমাদের সাথে একসাথে থাকলে ওদের অনেক অসুবিধা হত। বিশেষত অনিন্দ্যর স্ট্রোকের পর থেকে, যখন ওর বাঁ হাত-পা টা একটু কমজোরি হয়ে গেল-বৌ মার কাজের হ্যাপা বড্ডই বেড়েছিল। যদিও আমি অনিন্দ্যর সমস্ত কিছু নিজের হাতেই করতাম-তবুও সারাদিন একটা অসুস্থ মানুষকে চোখের সামনে দেখা-যথেষ্ট বিরক্তির কারণ বটে। অল্প বয়সে মানুষ নিজের মত করে থাকতে চায়। আমি তো বিয়ের পর থেকেই অনিন্দ্যর সাথে স্বাধীন। নিজের মনের মত করে চলেছি। মধুরিমাও সেই স্বাধীনতা চাইতেই পারে। যখন তখন বাড়ি থেকে কাউকে না বলে চলে যাওয়া,কচি ছেলেকে খেতে দিতে ভুলে গিয়ে ফোন হাতে ব্যস্ত থাকা,সপ্তাহে তিন-চারদিন শপিং-এ,পার্লারে চলে যাওয়া,বারবার ফোন করলেও ফোন না ধরা-এসব স্বাধীনতা কিনা অনিন্দ্য প্রশ্ন করতে চাইত। “তুমিও তো একা ছিলে। আমার তিনকুলে কেউ ছিল না,তবুও কেমন সুন্দর করে একসাথে সমস্তটাকে ধরে ছিলে-এখনো রয়েছ। ঘরে,বাইরে সমস্তটা,ছেলেকে মানুষ করা-এসব তো তুমিও করেছ। স্বাধীনভাবেই করেছ। কিন্তু স্বাধীনতা মানে কি এইরকমই...” আমি অনিন্দ্যকে থামিয়ে দিতাম। এখন অনিন্দ্য একেবারেই থেমে গেছে। আর কিছু বলে না। কার জন্যই বা বলবে? মধুরিমার এই আচরণে বাবিনের যে পূর্ণ সমর্থন আছে-সেটা অনিন্দ্য বেশ বুঝে গেছে এখন। বাবিনেরও অনেক বন্ধু হয়েছে আজকাল। অফিস কলিগ,ব্যবসার পার্টনার। তারা প্রায় সন্ধ্যাতেই বাড়িতে আসতে চায়, বসতে চায়। খানাপিনা সব কিছুই করতে চায়। আমরা থাকলে সেটা সম্ভব নয় বলেই বাবিন, মধুরিমাকে বাধ্য হয়েই প্রায় দিনই তাদের বাড়িতে যেতে হয় আর সেটা রোজ রোজ দৃষ্টিকটু লাগে। এটা আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। অনিন্দ্য বুঝতে একটু দেরি করছিল। বাবিন যেদিন প্রস্তাবটা দিল-সেদিন থেকে একেবারেই চুপ হয়ে গেছে মানুষটা। বিরোধিতা করবার কোন জায়গা ছিল না। তাই চুপ হয়ে যাওয়াই শ্রেয় ভেবেছে।
আজকাল অনিন্দ্য বড্ড নস্টালজিক হয়ে পড়ছে। বাড়ি ভাঙার দিনটা যত কাছে চলে আসছে-ততই ওর মনে পড়ে যাচ্ছে নানান কথা। রান্নাঘরের ডিজাইনটা আমি কেমন করে শুধরে দিয়েছিলাম,না হলে ওর মত নামজাদা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারও কত বড় ভুল করে ফেলত-বারান্দার কোণে পাতাবাহার গাছ রাখবে বলেছিল ও আর আমি বেগনভেলিয়া,আমাদের ঘরের খাটের মাথার পিছনের দেওয়ালটায় বাবিন কবে তিমি মাছ এঁকেছিল-এসব কথা বলে চলে অনর্গল। থামতে চায় না। আমি ওকে বাধা দিই না। ও যা বলে সমস্তটা শুনি। ওকে দেখাই যে ও না বললে আমার হয়তো মনেই ছিল না এ সমস্ত কিছু। অথচ আমার চোখের সামনে আজো সবকিছু স্পষ্ট। দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর হয়ে যায় অবিকল-সিনেমার মত। বাবিন যে তিমি আঁকেনি-জ’স্ দেখে হাঙর এঁকেছিল-অনিন্দ্যর এই ভুলটা আমি আর শুধরাই না। আজকাল ও বেশ হাঁটতে পারছে। নিজের কাজ নিজে করতে পারছে। কথা দিয়েছে আমরা যখন ভাড়াবাড়িতে চলে যাব-যতদিন না ফ্ল্যাট গাঁথা হয় আমরা সেখানেই যখন থাকব-ও ওষুধগুলোও মনে করে খাবে। আমাকে একা হাতে সব করতে হবে,তাই-আমাকে কোন কষ্ট দিতে চায় না ও। আমি জানি ও মনে করে ওষুধ খেতে গেলে ভুলের কোন শেষ থাকবে না। তবুও ওর ইচ্ছেতে আমি বাধা দিই না। ও যদি এটা বলে শান্তি পায় তো ভাল। ওর কোন ইচ্ছাতেই আমি বাধা দিইনি কোনদিন। আবার অনেক ইচ্ছা রাখতেও পারিনি। এই যে ওকে চলে যেতে হবে বাড়ি ছেড়ে-এটা ওর ইচ্ছা নয় আদৌ। তবুও ওর এই ইচ্ছাটা আমি রাখতে পারছি কই?
একটা স্মার্ট ফোন এসে বেশ ভালো হয়েছে অনিন্দ্যর। একা একাই ওটা নিয়ে বসে সময় কাটিয়ে দেয়। মধুরিমা এটাও ভালো চোখে দেখেনি। ঠারেঠোরে বলে, ‘বাবার বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে।” আমার তেমন কিছু মনে হয় না। সারাজীবন অনিন্দ্যকে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতেই দেখেছি। যেহেতু শূন্য থেকে শুরু করেছিল- কোথায় একটা পৌঁছাবার তাগিদ ওর মধ্যে ছিল বরাবর। বাবিন আসার পর তার ভবিষ্যৎ কি করে ভালো থেকে আরো ভালো করে গড়া যায়-এ নিয়ে সবসময় ব্যতিব্যস্ত থাকত ও। ভালো স্কুল,ভালো কলেজ-ভালো চাকরি-যতদিন না ছেলেও ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ-এ সফল হয়ে অনিন্দ্যর মতই যোগ্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, অনিন্দ্যকে দম ফেলতে দেখিনি। কোথাও বেড়াতে যাইনি আমরা তেমন। ঐ এক-আধবার দীঘা। ছেলের পড়ার ক্ষতি হবে বলে বাড়িতে টিভিও চালাইনি তেমন। সিনেমা দেখতে যাওয়া,ঘোরা,খেতে বেড়োনো-এসব ভাবনার বাইরে। অথচ বাবিন-মধুরিমা প্রায়ই বেড়িয়ে যায়। তিন বছরের ছেলেটাকে ফেলেই বেড়িয়ে যায় বেশিরভাগ সময়। ঋজু ঠাম্মাম আর দাদুন এর কাছে থাকতে পারবে-এটা ওরা ভালো করেই জানে। তবুও ঋজু তো ছোট। ওর মন মা-বাবাকে চায়। বেরবো বলে ঘ্যানঘ্যানে করলে বাবিন নরম হলেও মধুরিমা বলে, “ঋজু ইজ আ গ্রোণ আপ বয় নাউ। ও থাকুক বাড়িতেই কাম অন আর্য,ইউ ডু হ্যাভ আ লাইফ অফ আওয়ার ওন।” লাইফ শব্দটা কানে বাঁধে আমার, অনিন্দ্যরও। রাতে একে অপরের পাশে শুয়ে কেউই ঘুমোই না। কেবল ভাবি লাইফটা যে নিজেদের সেটা আমরা দুজনের কেউ-ই কি বুঝেছি কখনো?
অনিন্দ্যর কথা শুনে অবাক হই আমি। কাল আমাদের ভাড়া বাড়িতে যাওয়ার দিন। অনিন্দ্য ভাড়া বাড়ি পছন্দ করে না-এটা জানি আমি। কিন্তু তা বলে...
-কি বলছ? বাবিন তো বলল...
-বাবিন মিথ্যা বলেছে মাধবী।
-তুমি কি করে জানলে?
অনিন্দ্য মৃদু হাসে। ওর হাসিতে স্নেহ,করুণা,মায়া না ভালোবাসা মিশে থাকে আধোঅন্ধকার ঘরে আমি বুঝতে পারি না,
এতদিন তো স্কুলে পড়িয়েছ। ভালো,মন্দের ফারাক চেনো না,সেটা বলব না,কিন্তু নিজের মানুষদের ক্ষেত্রেও যাচাই করে নেওয়া ভালো।
যাচাই! যাচাই কাকে করব? অনিন্দ্যকে? সারাজীবন তো ওর প্রতিটা কথা চোখ বুজেই মেনে চলেছি-ঠকিনি কখনো,তাহলে বাবিনকে? সে যে আমার নিজের...
-বাবিন যে ঠিকানাটা দিয়েছিল,সেটা কোন ভাড়াবাড়ির নয়। একটা ওল্ড এজ হোমের,আজ কি মনে হল ঠিকানাটা নেটে সার্চ করে দেখলাম...আর...
হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে আমার। তার মানে,তার মানে কি...
-বাবিন আমাদের একেবারেই রেখে আসত,মাধবী,আমি অসুস্থ-এই ধাক্কা নিতে পারব না-ও জানে। আর তোমাকে চাপ দিয়ে বাড়ি লিখিয়ে নেওয়া খুব সম্ভব,এটাও ওরা জানে,
-ফ্ল্যাট করবে বলছিল যে...
হঠাৎ করে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল আমার। অনিন্দ্য ঘাড় নাড়ল।
-নাহ,ফ্ল্যাট আর হত বলে মনে হয় না।
দৃশ্যগুলো আবার চোখের সামনে ভাসে আমার। অনিন্দ্যর ইচ্ছা,বাবিনের প্রথমবার এ বাড়িতে আসা,বাবিনের হাঁটা,চলা,দৌড়ানো...বাবিন...বাবিন...
-যাক্,কাল আমরা চলেই যাচ্ছি,মাধবী।
চলে যাচ্ছি মানে? কোথায়? কত অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর চিন্তা গ্রাস করে আমায়,আমি কি অনিন্দ্যর উপর ভরসা হারাচ্ছি? না,না...তা কি করে হয়...
-কোথায়?
-ভরসা করো তো আমায়?
অনিন্দ্যর প্রশ্নে আমি নিরুত্তর থাকি,এ প্রশ্নের জবাব ও জানে।
-ফাদার জোসেফকে ফোন করেছিলাম। হাজার হলেও বাবিনকে ওখান থেকেই তো এনেছি আমরা।
অনিন্দ্য আর আমি একটা ভুলে যাওয়া সত্যি উচ্চারণ করি। বত্রিশ বছর পর সত্যি উচ্চারিত হয় আমাদের সাধের এই বাড়িতে-এই ঘরের তলায়।
-ওনাদের একটা ওল্ড এজ হোম রেয়েছে এখন। আমরা তো ওখানকার ট্রাস্টি-তাই ফাদার শুনেই বললেন...আমাদের যাওয়ার জায়গা এখনো শেষ হয়ে যায়নি মাধবী।
এই অনিন্দ্যকে অচেনা লাগে আমার। কয়েক ঘণ্টা আগেও তো ও বাড়ি ছেড়ে যাবে বলে কষ্ট পাচ্ছিল,ভুগছিল স্মৃতিমেদুরতায়...আজ হঠাৎ নিজে থেকেই সব ছেড়ে চলে যেতে চাইছে
-তোমার বাড়ি...এত সাধ করে বানিয়েছিলে,ফিরে এসে ফ্ল্যাটেই উঠবে...
বিস্মৃতকাল পর বিভ্রান্ত লাগে আমার গলা। নিজের কানেই অন্যরকম মনে হয়। অনিন্দ্য অশক্ত বাঁ হাতটা আস্তে আস্তে তুলে আমার হাতটা ধরে। যতটা শক্ত করে ধরা যায়,ততটাই ধরে ...
-আমার বাড়ি,তোমার সাথেই,মাধবী। যেখানে দুজনে থাকব,সেটাই আমাদের বাড়ি,তাই না?
অনিন্দ্যর এই একটা কথায় হঠাৎ করেই আমার সব না পাওয়া পাওয়া হয়ে যায়।
Tags:
অণুগল্প