শুক্রবার, জুন ৩০, ২০১৭
রুমকি রায় দত্ত
sobdermichil | জুন ৩০, ২০১৭ |
অণুগল্প
| মিছিলে স্বাগত
সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তুহিন যখন মুখ ধুচ্ছিল তখনও কি জানতো আজ ওর জীবন কোন পথে বাঁক নিতে চলেছে? অফিসের ব্যস্ততা,বাড়ির দায়িত্ব,আর পাঁচটা ছাপোষা বাঙালি ছেলের জীবনই কাটাচ্ছিল। সকালে উঠে বৌ এর হাসিমুখ দেখা কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট্ট রিমলির পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে,বিরক্তির বাণী শুনতে শুনতে হারিয়ে গিয়েছে প্রেমের তলানি টুকুও। এখন শুধু কেজো জীবন বাঁচার জন্যই বাঁচা। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে তুহিন। মনটা কটা দিনের ছুটি কাটাতে চায়। বাড়িতে বাচ্চার দৌলতে প্রাপ্য ছুটিও কম পড়ে,ঘুরতে যাওয়ার চিন্তাও করেনা তুহিন। শুধু মাঝে মাঝে যখন মনটা উতলা হয়ে ওঠে তখন অফিসের তিমির বসু,অশোক রায়,এদের দিকে তাকিয়ে থাকে। বয়স পঞ্চান্ন হবে,কোনো অভাব অভিযোগ নেই। সারা জীবন একই ভাবে মুখ গুঁজে কাজ করে চলেছে।
কিন্তু আজ কিছুতেই ওর মন শান্ত হল না। মাঝ দুপুরেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। দশতলা টাওয়ারের, নয় তলায় ওর অফিস। লিফটের সামনে এসে আগেই প্রার্থনা করে বলল ‘ঠাকুর আজ যেন লিফটে ঝুলতে না হয়’। বলেই জিরো টিপে লিফটে উঠে পড়ল। আট তলায় জনা পাঁচেক লোক উঠল,তাদের মধ্যে দুজন মহিলা। সাততলা আর ছয় তলায় চারজন নেমে যেতেই লিফট ছয়তলা আর পাঁচতলার মাঝে ঝুলে গেল। সহযাত্রীটি মহিলা। লাজুক তুহিন মনে ইচ্ছা থাকলেও মুখের দিকে তাকাতে পারলো না। মাথা নিচু করেই মহিলার উদ্দেশ্য বলল ‘এই এক যন্ত্রণা হয়েছে,আপনি আগে কখনও এমন ভাবে লিফটে ঝুলেছেন’?
গলার আওয়াজে মহিলা ঘুরে তাকাল তুহিনের দিকে। কিছুটা অবাক বিস্মিত! অস্ফুটে বলে উঠলো, ‘তুহিন তুমি’?
তুহিনও বুঝে গেছে এ আওয়াজ কার! এযে ভোলার নয়! হৃদয়ের তালে তালে মিশে আছে এ আওয়াজ। মুখ তুলে বলল, ‘দেবযানি তুমি?’
মহিলা, ‘যাক,মনে রেখছো তাহলে?’
দীর্ঘ পনের বছর পর দেখা দুজনের। দেবযানি মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল, যেন বেরিয়ে আসা আবেগটা লুকাতে চায়ছে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো---
‘কেমন আছ? বিয়ে করেছ নিশ্চয়। তারপর কিছুক্ষণ নিরিবতা। নিরিবতা না অভিমানের চোরা স্রোত!
এখনও সেই পনের বছর আগের মতই আছ? নাকি বৌকে সময় মত বলতে পেরেছো, মনের কথা?
তুহিন নিশ্চুপে বলল, ‘তুমি কেমন আছ দেবযানি?’
দেবযানি নিজের মুখের উপর একটা সুখী চাদর চাপিয়ে নিয়ে,হাল্কা হেসে বলল, ভীষণ ভাল! তুমি যদি সেদিন সময় মত মনের কথাটা বলে দিতে, তবে বোধহয় আমার এত ভাল থাকা হয়তো হতো না’!
তুহিন কিছু বলার আগেই লিফট ধপ করে এসে নামলো গ্রউন্ড ফ্লোরে। অসমাপ্ত মনের কথা নিয়ে আবার দুটি মানুষ ভিরে মিশে যাচ্ছে। থমকে গেল দেবযানি। পিছন ফিরে ডাকলো তুহিন......
সত্যিই তুমি একই আছো এখনও শুধু বদলে গিয়েছি আমি। আমার পরিচয়টার সাথে সাথে স্বভাবটাও বদলে গিয়েছে। এখন আমি মিথ্যা বলতে পারি খুব সাবলীল ভাবে। তোমার কি মনে হয় তুহিন, চাঁদের আলো কি সত্যিই দিনের বেলায় নিভে যায়?
আস্তে আস্তে দেবযানি দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে যাচ্ছে। ঠাঁ ঠাঁ রোদ্দুরে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা তুহিনের অস্তিত্ব জুড়ে তখন শৈত্য প্রবাহ,চেতনা জুড়ে নৈঃশব্দ।আচ্ছন্ন হয়ে আছে সদ্য ফেলে আসা মুহূর্ত গুলির মধ্যে।

