তার মন ভেসে গেছে প্রলয়ের জলে
তবু এখনও সে মুখ দেখে চমকায়
এখনও সে মাটি পেলে প্রতিমা বানায়'
- বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
রাস্তার বাঁক থেকে লাল আলোটা শেষ পর্যন্ত মিশে গেল অজস্র গাড়ির মিছিলে। আর জ্বালা করে উঠলো চোখ। আবার শহরের রং ফিরে এল বিষের মতো নীলে, শূন্যতার মতো সাদায়। গলার কাছটা এখন চাইছে খুব কড়া একটা সিগারেট। জিনসের পকেটে হাতড়ে মনে পড়লো, তোমার কথায় চারমিনার ছেড়েছি তাও বছরখানেক। এখন আমার কাছে সিগারেট মানে সোনালি ধোঁয়ার নরম-রেশম। জীবনও যদি ততটাই নরমসরম হতো!
ট্রামডিপোর দিকটা ক্রমশ অন্ধকার। এখানে দাঁড়িয়ে আমাদের কত দীর্ঘ সংলাপের আসা-যাওয়া হাওয়ায় হাওয়ায়। তোমার তখন বৈকালিক ঘুমভাঙা আড়মোড়া বিছানায়। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো হয়ে গেলে নাকি এই ডিপোটাই থাকবে না! তাহলে কি ময়দানের সবুজ চিরে, একদিকে ইডেন আর অন্যদিকে ভিক্টোরিয়া রেখে অকেজো পড়ে থাকবে প্রিয় ট্রামলাইন! অফিসফেরত আমিই-বা কোথায় দাঁড়িয়ে এই কথোপকথন দীর্ঘতর করে ছাড়তেই থাকবো একটার পর একটা মেট্রো!
সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে ছোটো হয়ে আঙুলে ছ্যাঁকা দিয়ে মনে করাচ্ছে, ফেরা দরকার এবার। শেষ মেট্রো এখান থেকে যেন ক'টায়? মনে পড়ছে না। কিন্তু বুকের বাঁদিকে পরপর কয়েকটা মৃদু স্পন্দন বলছে, চলন্ত জানলার পাশ থেকে অবাধ্য চুলের ঢেউ সামলে কিছু লিখছো তুমি।
'খুব খুব কষ্ট হচ্ছে গো!'
'রাতে ঠিকমতো খেয়ো কিন্তু! হোটেল থেকে কিছু কিনে নিয়ো।'
'চিন্তা কোরো না, কিচ্ছু হবে না! ঠিক যেতে পারবো।'
মোবাইল স্ক্রিন তখনও তোমার নামের পাশে দেখাচ্ছে, টাইপিং। কিন্তু চোখদুটো খুব জ্বালা করছে আবার! ক্রমশ সব কিছু ঝাপসা। আরও কী যে লিখছো তুমি, না-হয় দেখে নেবো পরে!
অনেকক্ষণ বন্ধ থাকা ঘরের দরজা খুললেই ঘরের একটা নিজস্ব গন্ধ আসে। কিন্তু আজ দরজা খোলামাত্র শুধু তুমি! কোনোরকমে নিজেকে বিছানায় টেনে এনে দেখি, এখানে এখনও ভরপুর হয়ে আছো! অথচ ক্রমশ দূরবর্তী তোমার ফোন বারবার আসে, থেমে থেমে যায়। এত উন্নতি কমিউনিকেশন সিস্টেমের, তবু পথেঘাটে নামলেই 'ডিজিটাল ইন্ডিয়া' আজও এত প্রাগৈতিহাসিক কেন! বিনিদ্র রাত্রি অবশ্যম্ভাবী অতএব! ফোনের রেকর্ডেড ধ্বনি 'নট রিচেবল'-এর হতাশা তাড়িয়ে তোমার বার্তায় মাঝেমাঝে আলো করে উঠছে স্ক্রিন। কিন্তু তাতে কি আর উদ্বেগ কমে! বরং জিজ্ঞাসা বাড়ে। রাতেরও বয়স বাড়ে এভাবে।
এভাবেও চলে যাওয়া যায় জেগে থাকা ঘোরে। সেই ঘোর টেনে নিয়ে চলে অনায়াস পিছনে; যেখানে একটা একটা করে খুলে যাচ্ছে আমাদের আগল, সতর্কতার ঘেরাটোপ। আমরা ক্রমশ খুলে দেখাচ্ছি যাবতীয় বিষাদ। আমরা ক্রমশ ভালোবাসছি পারস্পরিক নির্ভরতা। ঘরপোড়া গরুর মনে ঢুকে থাকা সিঁদুরে মেঘের ভয় পেরিয়ে, অকৃত্রিম নারীপ্রকৃতির কাছে অজান্তেই সমর্পণ রাখছি আমি। অবিশ্বাসিনী তুমি তখন দ্বিধান্বিতা। অতএব ভিতু শামুকের মতো খোলবন্দি করছি নিজেকে। আমি কি প্রগলভ হয়ে উঠছিলাম স্বভাববিরুদ্ধ? যাবতীয় ইঙ্গিত অথবা ইশারা কি চোখের ভুল আমার, অথবা মনের? তা কী করে হয়! এইসব সংলাপ অন্য কথা বলে:
'আমাকে এভাবে দূরে সরিয়ে রাখলে ভালো থাকবে তুমি?'
'না। কিন্তু তুমি ভালো থাকবে!'
তবু কোনো প্রগলভতা নয় আর! নিজেকে এভাবে শাসন করার মধ্যে মায়ামাখানো একটা অদ্ভুত কষ্ট লেগে থাকে।
অথচ জীবন যে কী প্রবল টানে আমাকে! যত বেশি ঋজুতায় মুড়ে ফেলতে চাই নিজেকে, ততই বেশি টানে। কোনোদিন তুমি লিখলে, 'আমাকে বোধহয় তোমার সঙ্গে কথা বলারও যোগ্য মনে করো না!' একই সঙ্গে তুমুল হাসি আর অবিশ্বাসের জলোচ্ছ্বাস ফুলে-ফেঁপে উঠলো আমার ভিতরে। নিজের যোগ্যতা নিয়েই যে-মানুষের সন্দেহ বিস্তর, সে কখন করবে অন্যের যোগ্যতার বিচার! হোক অকারণ, তবু এই অনুযোগ কীভাবে যে পলিমাটি করে আমাকে! কথোপকথন আবার নিবিড় ও দীর্ঘ হতে থাকে তাই।
কিন্তু আমি আর কিছুতেই জড়াতে চাই না জীবনের কুহকে। তাই খুব সাবধানে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে আসি। তবে জীবন আর কবে প্রস্তুতির সময় দিয়েছে আমায়! অতএব অভাবিত একদিন সে-ই তোমাকে দিয়ে বলিয়ে নেয়, 'সাতদিনের জন্য কলকাতা যাচ্ছি। এই ক'দিন একটুও কথা হবে না।'
বিস্ময় থেকে একটা ছোটোখাটো ধাক্কা জন্মায়। এটাও তাহলে একটা কারণ হতে পারে যোগাযোগহীনতার! কিন্তু প্রগলভ হওয়া চলবে না আর কিছুতেই। অতএব নিজেকে ভাবলেশহীন রাখি যতটা সম্ভব। অথচ ভিতরে প্রবল ঝঞ্ঝা লাফিয়ে উঠছে তখন !
'আচ্ছা, আমি তো তোমার বাড়িতে গিয়েই দেখা করতে পারি! একবার বললেও না!'
কিন্তু এই ক'দিন কথাই বলা যাবে না যার সঙ্গে, তার বাড়িতে যাওয়া যাবে কী করে! এই বিস্ময় প্রশ্ন হয়ে ফুটে উঠলে অসঙ্গত হয় না কোনোমতেই। অথচ ভিতরের ওই ঝঞ্ঝা আমার হয়ে অন্য কথা বলে তখন: 'আসলে আমি বাড়িতে কাউকে আসতে বলি না।'
এইসব কথা একেবারেই তিরের মতো। ছুঁড়ে দিলে ফেরানো যায় না, যদি-না সে ব্যুমেরাং হয়ে দ্বিগুণ বেগে সুদ-সহ ফেরে। এইসব কথা তাই সুদে-আসলে ফিরে এল তিক্ত-কষায়। যেহেতু ভাঙবে তবু মচকাবে না, আপাত-নিস্পৃহতার চাদরে তখন নিজেকে মুড়ে ফেলছো তুমি। আর সেটা বুঝে কোথাও একটা অচেনা ভয় গুমগুম শব্দ করে উঠছে আমার বুকের ভিতর। সেই ভয়টাকে তাড়ানোর জন্য বলি, 'এরকম হয়ে আছো কেন তুমি?'
'কীরকম? ঠিকই তো আছি!'
'না, এই যে কীরকম অচেনা আচরণ করছো! এভাবে কথা বলো তুমি!'
'আমি ঠিকই আছি। আমার যেরকম থাকা মানায়!'
খুব বড়ো একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে কোথাও। খুব দামি কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে আমার। ঘটনাচক্রে সেদিনই মহানগর ছেড়ে ছোটোবেলার মফসসলে পাড়ি দিতে হয় এই উচাটনকে সঙ্গী করে। সন্ধের এই শহর এখনও আমাকে আত্মগোপনের জায়গা করে দিতে জানে। দিগন্তমেশা মাঠের বুকের উপর একলা বসে চুপকথা লিখি। কলেজঘাটে গিয়ে নেমে যাই সিঁড়ির শেষ ধাপে। ভাগীরথীর জলে দেখি ম্লান চাঁদের সঙ্গে নিজেরও ভৌতিক আবছায়া। ঠোঁটে চেপে ধরা জ্বলন্ত সিগারেটের লাল আগুনের ছবি আমাকে জল থেকে ছুঁড়ে দেয় তীব্র উপহাস। নিজেকে নিজের এত অসহ্য আগে কখনও লাগেনি আর!
এরপরে যখন রাতের বয়স বেড়ে পাল্টে ফেলবে তারিখ, আকাশ-বাতাস জুড়ে বাজবেন রবীন্দ্রনাথ, 'হে নূতন, দেখা দিক আরবার...' আর আমার মনে পড়বে পঁচিশে বৈশাখ আজ। একটাও অনুষ্ঠানে যাওনি তুমি নিশ্চয়! শুধু বলেছো, 'তোমার খুব কাছেই আছি। কিন্তু ভেবো না আমায় দেখতে পাবে!' আমার পঁচিশে বৈশাখ কবে কেটেছিল এত বিবর্ণ গুমসুম, মনে পড়ে না! আজকের দিনে জগৎ আলো করে এসেছিলেন তিনি, আর আমার চরাচরে আজ এত অন্ধকার! কিন্তু 'ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন'। অথবা এমন দিনে আঁধার বেমানান বলেই ধীরে ধীরে ভেঙে পড়বে তোমার প্রাচীর। রাত ফুরোবার আগেই যেন জন্মান্তরের কোন অতল থেকে তুমি অস্ফুটে ডাকবে, 'এসো...'
এই যে গোড়াপত্তনের ইতিহাস, এমন ইতিহাস তো লম্বা ইনিংসের কথা বলে। এই যে এক নিবিড় আয়োজন নিশ্চিন্ততার। শুরুতে উতল হাওয়া ছিল, আবেগ-উচাটন ছিল, তবু কত সুপ্রোথিত হয়েছিল ভিত্তিপ্রস্তর! আজ তাই শত ঝঞ্ঝা পেরিয়ে আমরা এখানে। আজকের বিষাদ অনিবার্য, কিন্তু অজানা তো ছিল না! বরং এ-বিষাদ থেকে খুঁজে নেওয়ার কথা ছিল আশা-অপেক্ষার অগ্রিম দিনক্ষণ। অথচ এই নির্ঘুম রাত আমাকে এত হতাশ করছে কেন! সে কি কেবল বিষাদ, নাকি আমার পিছনে ফেউয়ের মতো লেগে থাকা সেই অদৃশ্য কায়া, যে আমাকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার গোপন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় মাঝেমাঝেই!
(ক্রমশ)
Tags:
ধারাবাহিক