শুক্রবার, জুন ৩০, ২০১৭
পিনাকি চক্রবর্তী
sobdermichil | জুন ৩০, ২০১৭ |
গল্প
| মিছিলে স্বাগত
উত্তরাখণ্ডের রাজধানী শহর দেরাদুনের মালসি মহল্লায় খুব অল্প সংখ্যক মানুষ থাকেন । পাহাড় উপত্যকার খুব কাছেই ঝরঝরে একটা সরু সুতোর মতন নদী বয়ে চলেছে । সেই নদীর ধার ঘেঁষে শহর। খুব সকালেই জীবন নিজের চঞ্চলতা শুরু করে দেয় । খুব ভোরে যখন, শুভ্র রোদ আঁচলের মতন ছড়িয়ে থাকে, পাখি ডাকে ,আর মানুষজন ঘুরে বেড়ায় । তাঁদের মনে হিংসা নেই । চাহিদা খুব অল্প মাত্র। দিনেরবেলায় কাজ করে , রাতে ঘুম । এই সরল রেখার মতন মানুষ গুলো শুধুই হাসতে জানে ।
উধম সিং উঁচুর পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচে ঢালুতে নেমে আসছে । তিনি বিশেষ কিছু করে না , কাঠের দোকানে আছে , ফার্নিচার তৈরি করে । সেই ফার্নিচার এই শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে , উত্তরাখণ্ডের বাকী বড় শহরে চলে যায় । বলতে গেলে এই দোকানের সাথে তাঁর কয়েক পুরুষের যোগ । আগে ঠাকুরদা চালাতেন । তারপর বাবা । এখন উধম নিজেই বসছে ।
দোকানের পাল্লা তুলে গণেশের পাথরের মূর্তির সামনে লাড্ডু আর ধূপ জ্বালতেই , উধম দেখল ময়লা কাপড় পড়ে বৃদ্ধ বয়স্ক মহিলা এসে দাঁড়িয়ে । তাঁর চোখ লাড্ডুর দিকে । তাঁকে উদ্দেশ্য করে হিন্দিতে বলল -
-নেবেন ?
-না ।
-আপনি নিন না মা ।
-তুমি কোথায় থাকো ?
সামনে সূর্যের দিকে আঙুল দেখিয়ে , বলল - বিপরীতে একটা রাস্তা ডানদিক চলে গিয়েছে । হেঁটে পাঁচ কিমি হবে , সেইখানে থাকি । আপনি ?
-কখনো এই এখানে । কখনো দূরে আবার ধর্মশালায় থাকি ।
-দাঁড়ান , আপনাকে লাড্ডুটা দিচ্ছি ।
হাতে নিয়ে দামি বনস্পতিতে ভাজা , হলুদ রঙের লাড্ডুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে । বলল ...
-তুমি নেবে না ।
-আপনি নিন , আমিতো প্রতিদিনই খাই ।
এমন সময় দোকানের ভিতর রাখা টেলিভিশনে নিউজ চ্যানেলে বলতে শুরু করল, প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সিজ্ ফায়ারিং ! অতর্কিতে বিশ্বাস ঘাতকের মতন আক্রমণ । ওঁরা দুজনেই তাকিয়ে দেখছে । বৃদ্ধা বলল ...
-আমি যাই বাবা । কাল আসব ।
-মা আপনি কাল অবশ্যই আসবেন ।
মাথা নেড়ে বৃদ্ধা চলে যাচ্ছেন । তাঁর ফিরে যাওয়া খুব মন্থর ! তাড়া না থাকলেও ফিরে যেতে হয় , সে ফেরায় বাধ্যবাধকতা থাকে । তেমন ভাবেই বৃদ্ধা হাঁটতে হাঁটতে সীমানা পেরিয়ে গেলেন ।
উধম দেখছে । বৃদ্ধার মাথার উপর মধ্য সকালের আলোর রেখা গুলো কাটাকুটি খেলছে !
#
-আরে , উধম ভাই ...
উধম পিছনে তাকাতেই দেখল পণ্ডিত ঝতুলাল শর্মা । সৌগন্ধের জন্য নির্ঘাত আবার পাত্র এনেছে ।
-চাচা বলুন ।
-কি আর বলব । বলি এইবার আরও ভালো পাত্র এনেছি । তোমাদের বিরাদারির মধ্যেই । ছেলের দোকান আছে। তুমি রাজি হয়ে যাও ।
-চাচা আমি , আপনাকে কি বলেছি ? কথা আমার রাজি হওয়া নিয়ে নয় । কথা হল যার বিয়ে তাকে রাজি হতে হবে । আমি জবরদস্তি করতে পারিনা ।
-সে কি বলছে ?
-বলছে এখন বিয়ে নয় । পড়াই করে নেবে তারপর ।
-আরে ভাই মানলাম পড়ালেখা দরকার তাই বলে এত্ত বয়স অব্দি কুমারি রেখে দিবি !
-চাচা মেয়েটা যদি শাদি না করতে চায় আমি কি ভাবে তাঁকে জবরদস্তি করি ।
-তোর বউ । তাকে বল ।
-বিয়ের পর আমাদের কোন সন্তান হয়নি । আপনি সবইতো জানেন । মিছলি , আমার ছোট বোনটাকে নিজের মেয়ের মতন মানুষ করেছে । দোকানে আমার কথা চলে । ঘরে ওদের । আপনি যদি গিয়ে আপনার বৌমাকে রাজি করাতে পারেন , তবে এককথা ।
-আমি ! তোর বোন খুব ফটর ফটর করে । থাক । বলেছিলাম , বাড়ি গিয়ে দেখ । যদি রাজি থাকে ।
ঝতুলাল চলে যেতেই । উধম ভাবল , সত্যিই মেয়েটার বয়স কুড়ি হল । ওর সমবয়সী অনেকের বিয়ে হয়ে গিয়েছে । আজই বাড়ি গিয়ে কথাটা বলব ।
#
উধম সিং রাতে বারান্দায় খেতে বসে মিছলিকে বলল – তুমি একটু ওকে বোঝাও । ভালো পাত্র । ছেলেটাকে দেখতেও সুন্দর ছবিতো দেখলে ।
-তা দেখলাম । মেয়েকে বোঝাবে কে ? আরেকটা বছর কাটুক , তারপর দেখা যাবে ।
-চাচা বলছিলেন , এইবার বয়স বেড়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না ।
-আমাদের মেয়ে ফেলনা নয় । কৃষাণজীউর আশীর্বাদ থাকলে নিশ্চয় হবে । এখনতো একটু ঘুরুক । আমি ওকে সংসারের কাজ শিখিয়ে দিচ্ছি ।
-ঘরে দেখছি নাতো , সে কোথায় ?
-গেছে মিনুর সাথে ।
-ঘড়িতে রাত আটটা । অনেক রাত হয়েছে । লোকে খারাপ বলবে ।
-কিচ্ছু বলবে না । মিনু আছে । তাছাড়া ওর উপর আমার বিশ্বাস রয়েছে , আমাদের মুখ কালো হয় এমন কাজ করবে না ।
-আচ্ছা , তা নাহয় বুঝলাম । ঠাণ্ডা নামছে । এত রাতে ঘোরাঘুরি শরীরের জন্য ঠিক নয় ।
খাওয়া হয়ে যেতেই মুখ ধুতে উঠে গেল । মিছলি ভাবল – মেয়েটা ঘরে ঢুকলে বকতে হবে ।
#
পাহাড়ি এলাকায় এক বাঁক থেকে অন্য বাঁকে যেতে হলে, কিছুটা পথ অন্ধকারে হাঁটতে হয় । বাঁকের মুখে আলোর ব্যবস্থা রয়েছে । সৌগন্ধরা দুজন । পাশের এলাকায় এক সহেলীর বাড়ি গিয়েছিল । পাথুরে টিলা , ধারে ধারে কাঁধে অন্ধকারের ঝোলা নিয়ে পাইন বাচ ওকের সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে । অন্ধকারেও তাদের অভ্যর্থনায় এতটুকু খামতি নেই । মাঝে মাঝে আলো জ্বলা পোকা উড়ে উড়ে যাচ্ছে । আকাশে সাদা মাখনের ড্যালার মতন চাঁদ , সেখান থেকে আলো রাস্তায় গড়াগড়ি খায় । ওড়নাটা ভালো মতন মাথায় প্যাচিয়ে নিল । বাতাসে ঠাণ্ডা এসে মিশছে ।
মিনু বলল – ভয় লাগছে তোর ?
সৌগন্ধ বলল – ভয় লাগবে কেন ? মাঝে মাঝে এই অন্ধকার রাস্তাটায় কিছুটা বুক কেঁপে উঠছে ।
ওরা দুজনে বড় টিলাটা পেরিয়ে বাঁদিকে যেতেই , উল্টো দিকে একটা ছায়া দেখতে পেল । সেই অন্ধকারের ভিতর ছায়াটার হাতে লাঠি , আলো নেই , তাঁর উসকোখুসকো চুলের ফাঁকে , আকাশের ভাঙা অন্ধকার আটকে রয়েছে । শীতের জায়গা , জনশূন্য রাস্তায় এই ছায়া দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল । সৌগন্ধ আঁতকে উঠল । মিনুর কনুই ধরে বলল – দেখ , ওই ছায়াটা কে !
মিনু কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল , রাস্তার অন্ধকারে পাছে তাদের অসুবিধা না হয় , হাতের টর্চের আলো মুখে ফেলল ।
-আরে ও তো বুড়ি ! পাশের পাড়ায় থাকে । একমাত্র ছেলে মারা যাওয়ার পরই ওইরকম , ঘুরে ঘুরে বেড়ায় ।
- ঘুরে বেড়ায় ! কেন বাড়ির লোক কোথায় ?
-বুড়ির স্বামী অনেকদিন আগেই মারা গিয়েছে । ছেলেটাকে বুকে করে মানুষ করেছিল । আমি শুনেছি । তারপর একদিন খবর পেল , ছেলেটা মারা গেছে ।
-কি ভাবে !!
- সেনাবাহিনীতে কাজ করত । শত্রুর সাথে লড়াই করতে করতে শহীদ হয়েছে ।
-শহীদের মা ?
- হ্যাঁ বলতে পারিস । সবাই সেই নামেই ডাকে ।
বৃদ্ধা ওদের সামনে এগিয়ে এসে বললেন – কি রে বেটিরা , এখনো বাড়ি যাসনি ? যা অনেক রাত হয়ে গেল ।
দুজনে কিছু বলল না । হাসল ।
#
বাড়ি পৌঁছাতে রাত নটা । সুনসান রাস্তায় উধম পায়চারি করছিল । সৌগন্ধকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে বলল – এত রাত হল ! আমরা চিন্তা করছিলাম ।
-দাদা , বুঝতে পারিনি এতটা রাত হয়ে যাবে ! জানতো রাস্তাটা বেশ লম্বা । গল্প করতে করতে খেয়াল নেই । ভিতর থেকে উধমের বউ বেরিয়ে এল । বলল – আগে খেয়ে নেবে চল।
খাওয়ার সময় , সৌগন্ধ বৌদিকে অনেক কথা বলল । বহুদিন বাদে দেখা । গল্প । মজা । রাস্তায় ফিরবার পথে সেই বুড়িটার কথাও । ছেলে হারিয়ে তাঁর সহায় সম্বলহীন অবস্থা ।
রাতে , বিছানায় শুয়ে শুয়ে , সেই মুখটাই মনে পড়ে যাচ্ছিল। ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে, আজ সেই শহীদের মায়ের পাশে কেউ নেই ! প্রতিদিন এই এত দেশভক্তির কথা, তাও শহীদের মাকে একাই ঘুরতে হয় ।
#
উধম দোকানেই ঠিক করে ফেলল । আর দেরী করা ঠিক হবে না। মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিতে হবে । সত্যিই দিনকাল যা পড়েছে , যদিও এলাকার পরিচিতরা এখনো কিছু বলেননি কিন্তু বলতে কতক্ষণ ! মনে মনে বলল –চাচাকে খবর দিতে হবে ।
সামনে সেই বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে । হাসল । মুখে বলিরেখা । দাঁতকটা পোকায় কাটা । হাসছে । পোশাকটা ছিঁড়ে গিয়েছে ।
বৃদ্ধা বলল – বেটা এত চিন্তা করছিলিস , আমকে খেয়াল করিসনি !
-তা নয় । মাথার উপরে কেউ নেই । বাপ মা অনেক আগেই চলে গিয়েছে । বোনটাকে নিয়ে চিন্তায় আছি ।
-কিসের চিন্তা ।
-শাদী করে দিতে পারলে , সবচেয়ে ভালো । সেই নিয়েই ভাবছিলাম মাইঝী । আপনি আসুন না , এসে বসুন ।
-বেহেন কি শাদীতে রাজি নয় ?
-ওকে এইবার বিয়ে করতেই হবে । অনেক হয়েছে । আর নয় । আমার বয়স হচ্ছে ।
-সে ঠিক বলেছিস ।
-আচ্ছা আপনার বাড়িতে কে আছে ?
কথাটা শুনেই বৃদ্ধা অন্যমনস্ক হয়ে গেল । বলল – ঘরের টান না থাকলেই , মানুষ ঘর ছাড়া হয় । আমার টান ছিল । এই তোর মতন একটা ছেলে ।
-কি হয়েছিল ?
-শত্রুদের হাতে শহীদ হয়েছে ।
-জওয়ান ছিল ?
- হু...
বৃদ্ধার চোখের দুই কোণে পাতলা জলের রেখা চকচক করছে , সেই জলীয় স্থানে সূর্যের আলো মেখে গিয়েছে , মুখের আঁকাবাঁকা পথে মিশে যাচ্ছে অনন্ত উষ্ণতা । বৃদ্ধা উঠে দাঁড়ালো । হাতের লাঠিটা শক্ত করে ধরে , কিছু না বলেই পিছনে হাঁটা লাগিয়েছে ।
উধম বুঝতে পারল , সে মস্ত ব্যাথার জায়গায় আঘাত করেছে ।
#
একটা দিন ঠিক হয়ে গেল । সৌগন্ধকে দেখবার জন্য পাত্র পক্ষের লোক এসেছে । মেয়েকে দেখেই তাদের পছন্দ হয়ে গেল । মেয়েটা যখন সরবতের গ্লাস নিয়ে ঘরের ভিতর এল উধম সিং তাকিয়ে ছিল । সেই ছোটবেলায় মা মরা মেয়েটাকে বড় করে তুলেছে । আজ সে পরীর মতন দেখতে হয়েছে । ঘাগরা , কানে দুল , গলায় হার , যেন রাজপুত দুলহানি । সব কিছু আছে , বাবামায়ের অভাব বোধ করছে। কিন্তু উধম এই শুভ দিনে মায়ের আশীর্বাদ চাইছে । সে ব্যবস্থা সেই করে রেখেছে ।
পাত্র পক্ষ চলে যেতেই , রাস্তায় নেমে উধম ঘোরাঘুরি করছিল ।
মিছলি বলল – কি হয়েছে বলতো ?
উধম সামনের গলির দিকে তাকিয়ে বলল – না । একজনের আসবার কথা ছিল ।
সৌগন্ধ বলল – দাদা তুমি কার জন্য অপেক্ষা করছ ?
উধমের কানে কোন কথা ঢুকছে না। সামনে সরু গলির মুখ , সাদা আলোয় আলোকিত । সেখানে তাকিয়ে বিড়বিড় করল – আছে কেউ । যে না এলে , আমার বোনের শুভদিন ভেস্তে যাবে। আমি ওঁকে আসতে বলেছিলাম । কথা দিল আসবে। আমি তাঁর জন্য সালোয়ার এনেছি । সে পড়বে। যেমন করে ছোটবেলায় মা পড়ত ।
সৌগন্ধ বুঝতে পারছে না। দাদা আবার কাকে ধরে আনল। সামনে তাকাতেই কোমর ঝোঁকা, সেই শহীদের মা কে দেখতে পেল! সেই বুড়ি । এরকথাই দাদা বলছিল !
উধম উৎকণ্ঠিত গলায় বলল ...
-এত দেরী করলে কেন ?
- বাপু , আমি বুড়ি মানুষ পাশের শহরে গিয়েছিলাম । আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে গেল । তা বিটিয়াকে পছন্দ তো ।
-হ্যাঁ মা। ওঁরা বলে গেছে । সামনের মাসেই বাগদান করে ফেলবে ।
-ভালো আমায় খাওয়াবিনা ।
উধম বৃদ্ধাকে ঘরের ভিতর নিয়ে এলো । খাবার দিল । বৃদ্ধা বলল ,- রাতের অন্ধকারে ওরা এলো । শয়তানরা । আমার ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটাকে মেরে দিল । কোন যুদ্ধ ছিল না। মানুষের হিংসা আমার ব্যাটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে ।
উধম বলল – তুমি কিছু সাহায্য পাওনি ?
-না । সরকার পক্ষের লোক নাকি আমায় খুঁজছে । ওদের একটা লম্বা পক্রিয়া আছে । আর কিছু পেয়েও বা কি হবে , কেউ তো নেই !
উধম , বৃদ্ধার কাঁপা হাত , নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল – আমি তোমায় একটা কিছু দেব , নেবে?
বৃদ্ধা বলল – দে , কি দিবি ?
উধম একটা মোলায়েম ফুলহাতার সালোয়ার কামিজ দিল । বলল – বাগদানের দিন এইটা পড়ে আসবে। মা পড়ত। আমাদের ছোটবেলায় , এখনো চোখে ভাসছে । আমি যত্নে রেখে দিয়েছি । তোমায় দিলাম ।
#
বাগদানের দিন , পাত্রপক্ষ দেনা পাওনা নিয়ে বসে পড়ল । হিসেব মতন পাওনার অগ্রিম তিন লক্ষ টাকা চাইছিল । উধম দিতে পারেনি । সঙ্গে সঙ্গে বাগদান পর্ব বন্ধ হয়ে গেল । বলা যায় পাত্র পক্ষের এই জুলুম নতুন কিছু নয় । এই তল্লাটে এমনটাই হয়ে চলেছে ।
যখন সবাই চলে গেল , শহীদের মা উধমের দেওয়া সালোয়ার কামিজ পড়ে ঢুকল । এই খালি হয়ে যাওয়া ঘর , বারান্দা , আর উধমদের মুখ দেখে বলল – কি হয়েছে ?
ঘরের ভিতর সৌগন্ধ কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল । মিছলি মেয়েটাকে সামলাতে লাগল । উধম দাওয়ায় বসে , মাথাটা দেওয়ালে হেলানো । উধম বলল – আমি কি করব বলো ? টাকা চেয়েছিল । আমি বলেওছিলাম বাগদানের পর । তখন কিছু বলল না। আচমকাই আজ এই সব ...
২।
সাতদিন বাদে , এক সকালবেলা পিওন এসে উধমের বাড়ির দরজা ধাক্কালো । এই তল্লাটে বাগদান পর্ব ভেঙে যাওয়ায় , উধমরা বাড়ির বাইরে বেড়াতো না। সে নিজেও দোকানে যায়নি ।
-উধম সিং ?
-হ্যাঁ ।
-তোমার নামে সরকারি চিঠি আছে । এইখানে সই করে দাও ।
উধম সই করে দিল ।
পিওন চলে যেতেই , সৌগন্ধকে ডাকল , বলল পড়তো ।
চিঠিতে ইংরাজির নীচে , হিন্দি বয়ানে লেখা ...
-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত , দেশ সেবক উমর আলিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হবে । দেশ সেবার জন্য পুরুষ্কৃত করা হবে ।
উধম বলল – কবে রে ?
-দাদা পরশুদিন । চিঠিটা দেরীতেই এসেছে । কিন্তু আমাদের বাড়ির ঠিকানা কেন ?
- বুড়ির নিজের বাড়ি বলতে ওই ভাঙা ঘর । তাও সবসময় থাকে না । তাই আমিই পোষ্ট অফিসকে বলে রেখেছিলাম, ওর নামে চিঠি আসলে জানাতে । যাই আজ একবার গিয়ে খোঁজ নেব । এতদিন বাদে ওঁর আশা পূরণ হবে । ছেলেকে সম্মান জানাবে ।
#
সন্ধ্যায় , উধম সিংকে দেখে মিছলি বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে । উধম বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ।
মিছলি বলল – কি হয়েছে ? তোমার মুখটা শুকনো লাগছে কেন ?
উধম বাচ্চার মতন কাঁদতে শুরু করেছে । বলল – বাগদানের দুদিন বাদে , জ্বর এসেছিল । আমরা তো ব্যস্ত ছিলাম । বুড়িকে দেখবার মতন কেউ ছিল না । তিনদিন বেহুঁশ ছিল । তারপর সব শেষ । ওঁর এলাকার লোকেরাই চাঁদা তুলে কবর দেয় । আমি শেষ দেখা অব্দি , দেখতে পেলাম না ...
মিছলির কথা গুলো বিশ্বাস হচ্ছিল না। একজন মানুষ এমন ভাবে চলে যাবে !
৩।
এই তল্লাটের সবচেয়ে বড় মাঠ । এখানেই সম্মান দেওয়া হবে শহীদের মা কে । মরবার আগে , সরকার পক্ষের লোকেরা খোঁজ খবরের জন্য এসেছিল । শহীদের মা তাঁদের জানিয়েছিল , তাঁর এই সমস্ত টাকা যেন সরাসরি উধম সিংয়ের নামে করে দেওয়া হয় । উধম জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে জানতে পারল ।
প্যান্ডেল । সামনে শতাধিক শ্রোতার মাথা । সবাই হাততালি দিচ্ছে । জেলা প্রশাসক আর সেনাবাহিনীর উচ্চ পদকর্তারা মঞ্চে বসে আছেন । সরকার পক্ষের একজন পঞ্চাশ লক্ষ টাকার চেক তুলে দেবে । উধমকে ডাকা হল ।
উধম মাইকটি হাতে নিল । হাসতে হাসতে বলল – ছেলের মৃত্যুর পর একবছর , একটা মা একা একাই ছিল । আমরা কেউ তাঁকে দেখতে আসিনি । সরকারের একবছর লেগে গেল ! আমার বোনের বিয়ে আটকে গিয়েছে টাকার জন্য। পণের টাকা। এই টাকা আমার খুব দরকার । বিশ্বাস করুন আমরা খুব সাধারণ মানুষ । টাকা আমাদের খুব দরকার । আমি হাতজোড় করে বলতে চাই এই টাকা আমি নিতে পারব না । যে মা নিজের জোয়ান ছেলের মৃত্যু দেখেও , প্রতিদিন নতুন করে বাঁচতে থাকে । আমি গর্বিত , আমি সেই মাকে পেয়েছি । আমার বোন নিজের পায়ে দাঁড়াবে । পণ দিয়ে বিয়ে দেবো না । এই টাকা নিলে , সেই মায়ের বলিদানকে ছোট করবে । টাকা দিয়ে মানুষকে সাহায্য করা যায় , তাঁকে সম্মানিত করা যায়না ......
এই প্রথমবার সভায় হাততালি পড়ল না। তামাশা হল না । সবাই মৌন হয়ে রইল ।

