নীপবীথি ভৌমিক

দাও ফিরিয়ে আবার সেই শৈশব
কিছুদিন আগে একটা দরকারে বাচ্চাদের স্কুলে গিয়েছিলাম। মনটা হঠাৎ করে এত ভালো হয়ে গেলো না, সকাল সকাল ছোট্ট ছোট্ট ফুলের মত ফুটফুটে শিশুদের দেখে। ওরা সবাই মিলিয়ে সুরে, বেসুরে কিংবা আপন সুরে গাইছে বিদ্যালয়ের প্রার্থনা সঙ্গীত,”এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়”। দিদিমণিরাও সকলেই ওদের সাথে গলা মেলাচ্ছেন। গান শেষ হলে বিদ্যালয়ের বড় দিদিমনি এই গানের তাৎপর্য বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন এই সকল ছোট্ট ছোট্ট শিশুদেরকে। বেশ ভালোই লাগছিলো, ভাবছিলাম এখনো বোধহয় কিছু স্কুল বা কিছু অভিভাবক আছেন, যারা চান এইসব নিষ্পাপ শিশুদের প্রকৃত অর্থে মুক্তি হোক বা তারা মানুষের মতোন মানুষ হোক। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ভালোলাগা বা ভালো ভাবা সবই যেন ফানুসের মতোন মিলিয়ে গেল গতিশীল সমাজ গাড়ীর চাকায় পিষ্ট হয়ে। প্রার্থনা সঙ্গীত সেই প্রার্থনার সময় সীমায় আবদ্ধ হয়ে হয়তো নীরবে ব্যঙ্গের হাসি হেসেই চলেছে…

আসলে কি চাই বলুন তো আমরা একজন অভিভাবক হিসাবে ? অভিভাবক মানেই কি শুধু গ্র্যারজিয়ন গিরি করা, খবরদারি ফলানো এইসব নরম কোমল প্রাণগুলোর ওপরে? আমরাই তো তাদের মা,বাবা। আমরাই তাদের জন্মদাতা, এই পৃথিবীর আলো আমরা তাদেরকে দেখিয়েছি। বাবা মা হিসেবে তাদের বলি, তোমাকে অনেক বড় হতে হবে, অনেক অনেক ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। না হলে তুমি এগিয়ে যেতে পারবে না সামনের দিকে ।সবাই তোমাকে হারিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলে যাবে অনেক দূরে। বলাবাহুল্য, এই বড় হওয়া সেই সাথে সামনে এগিয়ে যাবার নিয়মের যাঁতাকলে আমরা পেষাই করে চলেছি শিশুদের এই শৈশবকাল। সকাল থেকেই পিঠে ভারি বইয়ের বস্তা চাপিয়ে দিয়ে ছেড়ে দেই তাকে জীবনের রেসের ময়দানে। একটাই মন্ত্র আজ তাদের কানে বাজে-বড় হও ,এগিয়ে যাও। 

অবশ্য আজকাল আর আমাদের কাছে বড় হওয়া কথাটার অর্থ মানুষ হওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয় না। বড় হওয়া মানে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া এছাড়া আরও সব বড় বড় নামওয়ালা পেশার পেশাদার হওয়া অর্থে বোঝানো হয়। আর সেই পথের পথিক বানাতে গিয়ে আমরা এই ছোটো ছোটো কাঁধ গুলোর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি সীমাহীন নিয়ম কানুনের বোঝা। সত্যি কথা বলতে কি, এই শিশুদের কি এখন খেলার মাঠে তাদের নিজেদের মত করে দেখতে পাই? হয়তো পাই আমরা দেখতে তাদের খেলার মাঠে, কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আরো একটা সার্টিফিকেট লাভের উদ্দেশ্যে ।আরও একটা শচীন কিংবা আরো একজন সানিয়া মির্জা তৈরির উদ্দেশ্যে। যে বাচ্চার যত বেশি সার্টিফিকেট, সেই বাচ্চার নাকি মেধাশক্তি ততই বেশি! কি অদ্ভুত ধ্যান ধারণায় আবদ্ধ আমরা! কতজন বাবা কিংবা মা আমরা বলি যে, তোমরা তোমাদের মতো বড় হও। যা মনে হয় কিংবা যেভাবেই নিজেকে বড় হয়ে দেখতে চাও সেভাবেই এগিয়ে চলো। কতজনই বলতে পারি তাদের যে তোমরা তোমাদের মত বেড়ে ওঠো,আমরা পাশে আছি সর্বদা। 

তাই এখনকার শৈশব কৈশোরকে আর সেভাবে টানে না টেনিদা, ঘনাদা,কিংবা ফেলুদারা। ল্যাপটপ, মোবাইল গেমেই হারিয়ে গেছে ওদের শৈশব। আর এভাবেই ছোট্ট ছোট্ট মস্তিষ্কের কুঠুরিগুলোতে ধীরে ধীরে জমতে থাকে পাপের শয়তানির বোঝা। একে একে অপরকে যেনতেন প্রকারেই হোক টেক্কা দেওয়ার প্রচেষ্টা। ক্লাসের অন্য বাচ্চার থেকে সামান্য অর্ধেক নাম্বার কম পেলে বলুন তো আমরা এই মুহূর্তে কজন বাবা মা সেটাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারছি? ক্রমশ মানসিক যন্ত্রণায় কি বিদ্ধ করি না তাদের ?

সত্যি বলতে কি তখন আমরা গ্র্যারজিয়ন, ভুলে যাই আমরাই তাদের পিতা মাতা। আসলে নিজেদেরই অপিরিমিত চাহিদা, আশা আকাঙ্খা সবকিছুই চাপিয়ে দিয়ে চলেছি আমরা তাদের পবিত্র পিঠের উপরে। ফলশ্রুতিতে জন্ম নিচ্ছে অপবিত্রতার ছাপ, জন্ম নিচ্ছে হিংসা, একে অপরের সাথে শত্রুতা, হয়তো বন্ধু আছো তুমি, কিন্তু সেটা সামনাসামনি পিছনে তুমিই আমার শত্রু; এমন সব ভয়ংকর ধ্যান ধারণা। সর্বোপরি একে অন্যের সাথে স্বাভাবিক ভাবে মেশার পথটাই আমরা বন্ধ করে দেই, কিন্তু ভুলে যাই একটা কথা চারাগাছ যেমন জল, বাতাস,আলো ছাড়া বাড়তে পারেনা, একটা শিশুও তাই। তারও প্রয়োজন স্বভাবিক পরিবেশ, মাটি, আলো জলের সান্নিধ্য। আর সেই কারণেই হয়তো,”এই আকাশে আমার মুক্তি “ গানটা প্রার্থনা সঙ্গীত হয়ে থাকলো, প্রকৃত অর্থে মুক্তি মনে হয় এই নেট যুগের অভিভাবকদের তৈরী আকাশে আর হলোনা। কারণ আমাদের তো মূলমন্ত্র তাদের প্রতি, এগিয়ে যাওয়া সামনের পথে, আকাশ ছোঁয়ানো স্বপ্ন তৈরী করতে শেখানো…তাই স্বপ্ন ছুঁতে ছুঁতে তারা আজ আমাদের স্বপ্নে তৈরী রোবট হয়ে উঠেছে। 

শৈশব তাই নীরবে চোখের জল ফেলে বদ্ধ দেওয়ালের আড়ালে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.