হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
তৃতীয় পর্ব
গ্রীষ্মের প্রতিটি মুহূর্ত আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। ঘরের চৌকাঠ পেরোলেই আমি অন্য মানুষ। খোলা আকাশের নিচে রোদের হাত ধরে বেরিয়ে পড়া। কখনও মনে হয় রোদেই তো আমার জন্ম। রোদেই তো আমার কথা বলা। তাই যখন রোদের শরীর জুড়ে ঘোরাফেরা করি তখন মনে হয় কোথায় রোদের প্রখরতা? রোদ তো তখন আমার চোখে ছবি আঁকে। সাদা পাতায় গনগনে অক্ষরে লিখে যায় একের পর এক কবিতা। রোদের ভেতর সাঁতার দিতে দিতে আমি তখন কবিতার কথা শুনতে ব্যস্ত। কোনো কোনো কথা এমনই রহস্যময় যেন চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। কোনো কোনো জায়গায় এসে পথ ভুল করে ফেলি। আবার কখনও রোদের রঙই আমার কবিতার দিশা হয়ে চোখের সামনে প্রতিভাত হয়।
গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে যখন রোদের শরীরে আমি কবিতা নিয়ে ব্যস্ত তখন আমি দেখতে পাই কবি তাঁর ঘরের চৌকাঠ পেরোলেন। কাঁধে ব্যাগ। চোস্তা পাঞ্জাবিতে সেজে কবি এখন মধ্যাহ্নে। কবির তো বয়স নেই। তিনি চিরযৌবনের পাখি। তাই তিনি এখন মধ্যাহ্নে। কবি সনৎ দে। আমার দুপুরের সঙ্গী। দিগন্তের রোদ্দুরের দিকে চেয়ে তিনি কবিতা পড়েন ------
" রোদ্দুরে রোদ্দুরে লুপ্ত তুমি রোদ্দুর ------
সুন্দরে সুন্দরে বিলীন ।
বাতাসে বাতাসে শূন্যতায় শূন্যতায়
জলে স্থলে আকাশে আকাশে
সবুজ সবুজ পাতায় তুমিই সঞ্চারিত ।
তোমাকেই আমি বলি কবিতা । "
২।
বাইরে বেরিয়ে আসি। ঘরের বাইরে। চারদেয়ালে কি তাকে ছোঁয়া যায়? বাইরে সকাল। সকালের আলোয় পাখিরা ডাকছে। সকালের রোদ্দুর যেন কথা বলছে। পাখির গান, রোদ্দুর ------ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। প্রকৃতির জল, হাওয়া, মাটি ---- এতো সুন্দরেরই উপাদান। পাখির গান তো সুন্দরেরই গান। রোদ্দুর তো সুন্দরেরই কথা।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, " আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া / বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া। " বাইরে আসতেই হয়। ঘরের জানলা দিয়ে কতটুকু পৃথিবীকে দেখা যায়? খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে চিরচেনা জগৎ সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয়। নিজেকে বের করে না আনলে, নিজেকে ছড়িয়ে না দিলে তাকে ছুঁয়ে দেখবো কিভাবে? সনৎ দে-র কবিতাতে বাইরে আসার ডাককেই যেন অনুভব করি ------
" বাহির দুয়ারে
এসে দাঁড়ালাম
সকাল হচ্ছে
সকাল হচ্ছে শুধু
পাখি ডাকছে
পাখিরা ডাকছে ।
আশ্চর্য তোমার
বাহির বিশ্ব !
স্থির সুন্দরকে
স্পর্শ করলাম ।
স্পর্শ করলাম তোমাকেও । "
৩।
সনৎ দে-র কবিতা সুন্দরের মধ্যে অবগাহন। সুন্দরের ধ্যান। তাঁর কবিতায় প্রতিটি শব্দ যেন সঙ্গীতের মতো বেজে ওঠে। শুনতে পাই পাখির গান। রোদ্দুরের কথায় তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দ যেন এক অদ্ভূত তাপে উষ্ণ। সে উষ্ণতা শরীর পোড়ায় না। প্রকৃতি পরিভ্রমণের নেশাকে যেন শতগুণ বাড়িয়ে দেয় -------
" হাঁটি পরিব্রাজকের মতো । স্পর্শ করি প্রাণ ----- জলের,
বাতাসের পাথরের, সকালের । দেখি একক, নির্জন,
অপরূপ ------- অনন্তকে
আর ডাকি আমার হৃদয়ে অন্তর্লীন ------- তোমাকে ।
৪।
সনৎ দে-র জীবন প্রবাহটাও বড় অদ্ভুত। তাঁর দিনের শুরু খুব সকালে। শরীর রাখার জন্য যেটুকু কাজ না করলে নয় সেটুকু করেই তিনি বেরিয়ে পড়েন। একদিক থেকে দেখতে গেলে ঘরের মধ্যেই তাঁর বেরিয়ে পড়া। আর সশরীরে বের হন মধ্যাহ্নে। সারাটা দুপুর টো টো করে ঘুরে বেড়ান। বেশিরভাগ দিনই তাঁর সঙ্গে পথে দেখা হয়ে যায়। তখন আর আমাদের পায় কে! রোদ্দুরকে সামনে রেখে চলে আমাদের কাব্যচর্চা। আমি বলি সুন্দরের গান। রোদ্দুরের প্রবাহে কবিতার ঢেউ এসে আমাদের গায়ে লাগে। আমরা দু'হাতে সেই কবিতা নিয়ে শরীর মনে মেখে নিই -------
" চারিদিকে
সুদূরের অপরূপতা ।
পাখির ডাক
ছুঁয়ে
সকাল ক্রমশ
আরো গভীর
সকাল হচ্ছে ।
তোমার দৃশ্যাতীত সৌন্দর্য
নৈঃশব্দ্যে বিলীন ।
আর আমি
স্পর্শ করতে পারছি
প্রবহমান মুহূর্তের
দিব্য স্পন্দনগুলি । "
কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন