একদিন মেয়ে বলল – মা, তুমি যা লেখো সেসব একটা ব্লগ করো। পাব্লিশ করো। লজ্জা পেলুম। সেকি! নিজের ব্যক্তিগত আলাপচারিতা জনসমক্ষে ঢাক বাজিয়ে প্রকাশ করব! কেন? সে হেসে বলল – তুমি কিচ্ছু জাননা। নিজের বোকামিতে আমি নিজেই খুব খুশি হই। কেউ কিছু আশা করতে পারবেনা আমার থেকে। চালাকের মত, বুদ্ধিমানের মত, বড়দের মত, প্রাপ্তবয়স্কদের মত। কিন্তু সে ছাড়বার পাত্রী নয়। বললে – নিজেকে জানাতে হয়। এ তোমার সেই বন্ধুর বাণী নয়। বনে ফুল ফুটলে মধুকর আপনি আসে। ফুল ফোটার সংবাদ দিতে হবে বই কি! নিজের বন্ধুবান্ধব আত্মীস্বজনের সঙ্গে বিনিমাগনা ছবির মত বার্তালাপ চলবে সেই লোভে বহু আগেই মুখবইয়ে ঢুকে পড়েছি। বোকা বোকা কিছু লিখেও ফেলেছি। সেসব অনেকদিন হল। এখন আমিও দিব্যি সড়গড়। এখানে ওখানে দু একটি পাতা লেখা পাঠাই। ছাপা টাপা হয়। খুশি হই। অন্য অনুভূতি। আর এরই মধ্যে হঠাত ফিরে আসে সেই অদ্বৈত মুক্তি। নিজের মনেই টেনে নিয়ে বসি বইপত্র। পুরাকালের ইতিবৃত্ত পড়তে বসি। জানতে ইচ্ছে করে কেমন করে বদল এসেছিল। সমাজ বদলের ডাক ত চিরনুতন! প্রতিকালে তার আহ্বান শোনা যায়। যার কান আছে সেই শোনে। যারা আহ্বান জানান তারা তো সেই প্রথম রঙ আনার মতই বৈপ্লবিক! সকলে দূরে টেনে ফ্যালে। সাদাকালো রঙ চাপায়। ছির ছির রেখা টানে। বিমূর্ত ছবিতে তাঁদের প্রকৃত মুখ ঢাকা পড়ে যায়। আবার বহুকাল পর কোনও এক আত্মজা বলে ওঠে, মা, রঙ খুঁজে দেখো। ঠিক মুখটা মেলে ধরো। দেখো, ওটা চাপা ছিল। ওকে প্রকাশ করে দাও।
শুক্রবার, জুন ৩০, ২০১৭
অনিন্দিতা মণ্ডল
sobdermichil | জুন ৩০, ২০১৭ |
আত্মকথা
| মিছিলে স্বাগত
যখন সতেরো তখন প্রাণে এক অদ্ভুত দোলা লেগেছিল। কোনও কারণ ছাড়াই। পাত্রনির্ভর ছিল বলে এখন আর মনে হয়না। সে যেন নিজেকেই আবিষ্কার। নিজের গহনে কত শত অনুভূতির আধার। আবিষ্কারের আনন্দে বিহ্বল। অথচ কতই তো পড়েছি গল্পে উপন্যাসে! সেসময়টা গল্প উপন্যাসেরই ছিল। নাটক নভেল। দূরদর্শন বিভীষিকা। সাদাকালোর সম্বন্ধে যখন বর্তমান প্রজন্ম নানা নস্টালজিয়াতে ভোগে, বিখ্যাত সব স্থিরচিত্রশিল্পীর ছবিতে বাহবা দিয়ে নিজের রুচির কথা জানান দেয়, তখনই আমার মনে পড়ে সেই সাদাকালোর কথা। ভুতের মতন কালো হয়ে যাওয়া, কোথাও বা প্রিন্টে ছিরছির করে রেখা বইছে, মাঝেমাঝে সাদার ঝলকানি, সেইসব চিত্র ও নাট্য দেখার চেয়ে পড়তে বসে শিউড়ে ওঠা ভালো – ‘তোমার মন নাই কুসুম?’ আর সোজা ত ছিলনা দেখতে বসা! রবিবারের সকালে ডিফারেন্ট স্ট্রোক্সের সূক্ষ্ম মজা দেখা ছাড়া মনে করতে পারিনা কিছু আর। পেলের খেলা দেখা যাবে। তিনি কলকাতা সফরে আসছেন। নিতান্তই বালিকা। কিন্তু ওইযে জয়জয়ন্তী ছবির গান, ফুটবলের রাজা পেলে, সেই দেখার ইচ্ছে জেগে উঠল। যদিও কিছু আনুভূমিক রেখার ওঠানামা দিয়ে তৈরি চলমান চিত্রের মধ্যে পেলের মুখাবয়ব বিমূর্ত ছবির মত মনে অন্যরকম ছাপ ফেলেছিল। তাই বইয়ের মধ্যে ছাপার হরফে পড়া অনুভূতি যখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে শুরু করলাম তখন যেন অদৃশ্য ডানা গজাল মনে। উড়ে গেলাম অন্য এক আকাশে। বাড়িতে কখনই শাসন বারনের আবহাওয়া পাকাপোক্ত ভাবে ভিত গড়তে পারেনি। ফলে মুক্ত হতে মনে মনে কোনও বাধা ছিলনা। কল্পনায় কোনও সীমারেখা নির্ধারিত থাকেনা। স্বপ্নের পোলাওয়ে যত পারি ঘি ঢেলেছি। যখন নির্ধারিত পাত্রকে বরণ করে নিতে হল নিজের অনুভূতির অংশীদার হিসেবে তখন ভেতরের সাথে বাইরেও একটা বদল হয়ে গেছে। সেসব বদল ধীরে ধীরে ঘটছিল বলে সাগরজলে হাঙরের পা কেটে নেওয়া যেমন টের পাওয়া যায়না, সেরকম বদলের অভিঘাত টের পেতে সময় লাগল । দেখা গেলো সেই অদ্বৈত মুক্তির আর সুযোগ নেই। এবার থেকে শুধুই দ্বৈত মুক্তির খোঁজ। তখনই কষ্ট পেলামনা। সে বেশ সুখের সময়। তারপর আরও এলো। দূরদর্শনের সেইসব সাদাকালোর দিন শেষ হয়ে রঙিন হয়ে উঠল জীবন। আস্তে আস্তে এক ঝাঁক রঙ ঢুকে পড়ল বৈঠক খানায়। সংবাদের রঙ, সঙ্গীতের রঙের সঙ্গে সেরা সাহিত্যের রঙও বাদ পড়লনা। বেশ লাগল। তবে গোল বাঁধল যখন মনের মধ্যে যেসব কল্পনার রঙগুলো আমার মননকে রাঙিয়ে রেখেছিল তার সঙ্গে বাহ্যিক রঙ মিললনা। কিভাবেই বা মিলবে? অত অনন্ত রঙের সন্ধান বাস্তবে আছে নাকি! নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেললাম আমার সেই জগতকে। নির্দিষ্ট মাপে নির্দিষ্ট ছাঁটে কেটে মগজে ঢুকিয়ে নেওয়া গেলো আজকের জগত। বলা বাহুল্য সে আমার নিজের হাতেই তৈরি। হবেনাই বাঁ কেন? আমিও যে সেই সাদাকালোর থেকে বাইরেও মুক্তি চাইছিলুম। এরপরও শেষ নয়। বদল ঘটল আরও। দূরদর্শনের গতিপ্রকৃতিও পাল্টে গেলো। এলো আধুনিক আন্তরজাল। এবার কিন্তু সুনামির চেয়ে তীব্র হল বদল। ঢেউয়ের মত আছড়ে পরতে লাগল একে একে। আমি নিমজ্জিত হতে হতে হঠাত ভুস করে ভেসে উঠলাম। ডুবে যাবার সময়ে মনে হয়েছিল , এই ভালো। যে সাদাকালোকে অবজ্ঞা করেছি সেই সাদাকালো এবার সর্বশক্তি দিয়ে শেষ ছবিটি আঁকবে। এঁকে প্রমাণ করে দেবে আসলে আমার অস্তিত্ব ওই সাদাকালোনির্ভরই। বীজের কোনও রঙ হয়না। প্রাণ শুভ্র শুক্ল নিখাদ। চন্দ্রালোকের মত। সন্তুষ্ট মনেই হারাচ্ছিলাম নিজের মধ্যে। কিন্তু দেখলাম একাল আমার হাত ধরে টান দিয়েছে।
একদিন মেয়ে বলল – মা, তুমি যা লেখো সেসব একটা ব্লগ করো। পাব্লিশ করো। লজ্জা পেলুম। সেকি! নিজের ব্যক্তিগত আলাপচারিতা জনসমক্ষে ঢাক বাজিয়ে প্রকাশ করব! কেন? সে হেসে বলল – তুমি কিচ্ছু জাননা। নিজের বোকামিতে আমি নিজেই খুব খুশি হই। কেউ কিছু আশা করতে পারবেনা আমার থেকে। চালাকের মত, বুদ্ধিমানের মত, বড়দের মত, প্রাপ্তবয়স্কদের মত। কিন্তু সে ছাড়বার পাত্রী নয়। বললে – নিজেকে জানাতে হয়। এ তোমার সেই বন্ধুর বাণী নয়। বনে ফুল ফুটলে মধুকর আপনি আসে। ফুল ফোটার সংবাদ দিতে হবে বই কি! নিজের বন্ধুবান্ধব আত্মীস্বজনের সঙ্গে বিনিমাগনা ছবির মত বার্তালাপ চলবে সেই লোভে বহু আগেই মুখবইয়ে ঢুকে পড়েছি। বোকা বোকা কিছু লিখেও ফেলেছি। সেসব অনেকদিন হল। এখন আমিও দিব্যি সড়গড়। এখানে ওখানে দু একটি পাতা লেখা পাঠাই। ছাপা টাপা হয়। খুশি হই। অন্য অনুভূতি। আর এরই মধ্যে হঠাত ফিরে আসে সেই অদ্বৈত মুক্তি। নিজের মনেই টেনে নিয়ে বসি বইপত্র। পুরাকালের ইতিবৃত্ত পড়তে বসি। জানতে ইচ্ছে করে কেমন করে বদল এসেছিল। সমাজ বদলের ডাক ত চিরনুতন! প্রতিকালে তার আহ্বান শোনা যায়। যার কান আছে সেই শোনে। যারা আহ্বান জানান তারা তো সেই প্রথম রঙ আনার মতই বৈপ্লবিক! সকলে দূরে টেনে ফ্যালে। সাদাকালো রঙ চাপায়। ছির ছির রেখা টানে। বিমূর্ত ছবিতে তাঁদের প্রকৃত মুখ ঢাকা পড়ে যায়। আবার বহুকাল পর কোনও এক আত্মজা বলে ওঠে, মা, রঙ খুঁজে দেখো। ঠিক মুখটা মেলে ধরো। দেখো, ওটা চাপা ছিল। ওকে প্রকাশ করে দাও।
সব কালেরই তাই ক্রিয়া থাকে একটি। সে নৈর্ব্যক্তিক ক্রিয়াটি হোল এগিয়ে যাওয়া। এগিয়ে গিয়ে দেখা পিছন ফিরে। সঠিক ছবিটি তুলে ধরা। সমকালে দাঁড়িয়ে যাকে খুব মন্দ মনে হয়েছিল তা আসলে মন্দভালোর সীমানায় পড়েনা। তার নিজস্ব কাজ ছিল কিছু। সে তাই করেছে। সমকালের যে বিপ্লবটিকে মনে হয় আদর্শে সেরা, সেটি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে প্রমাণ করে আদর্শ ফাঁকা বুলি আওড়ে ঠিক প্রতিষ্ঠা করা যায়না। সে এক জীবনব্যাপী সাধনা। নইলে কাল তার হিসেবে কোনওভাবেই একে ইতিবাচক ভুমিকায় রাখবেনা। এভাবেই প্রতিনিয়ত ভাসতে থাকি। মনে ভাবি কতই দেখলাম! জীবন এত ছোট কেনে? আরও যে জানতে ইচ্ছে করে! কিন্তু সম্ভব হয়না। সেই ধাবমান কাল, জড়ায়ে ধরিবে মোরে, ফেলি তার জাল। তাই আগেভাগেই গৌরচন্দ্রিকা গেয়ে রাখি। সবার দৃষ্টি অবারিত হোক। আচ্ছন্নতা ঘুচে যাক।

