খুব ছোটবেলা থেকেই ঠাকুর পরিবারের আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলে রবীন্দ্রনাথের অন্তরে যে আধ্যাত্মচেতনার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল তা দিনে দিনে শাখা প্রশাখা ফুল ফলে পল্লবিত হয়ে চরম পূর্ণতা লাভ করে তার অনন্য সাধারন কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলির মধ্যে দিয়ে ।
গীতাঞ্জলি এবং তার ইংরেজী অনুবাদ song offerings এ সংকলিত বেশিরভাগ কবিতাই ১৩১৭ এবং ১৩১৮ সালে রচিত ।এই রচনা কালের ঠিক অব্যবহিত আগেই ১৩১৩ সালে কবি রচনা করেছেন একের পর এক আধ্যাত্মিক প্রবন্ধ । গীতাঞ্জলি বা তার ইংরেজী সংকলন song offeringsএর কবিতা গুলি যেন জীবনদেবতার পায়ে তার পুষ্পাঞ্জলি, তার অন্তরের পূজার নৈবেদ্যের নিঃশর্ত সমর্পন।
শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গানগুলিই নয় তার বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দিয়েই কবিগুরুর চিত্তের যে অসাধারণ আধ্যাত্মবোধের উন্মেষের পরিচয় আমরা পাই সেই আধ্যাত্মবোধই যেন পরম পূর্ণতা লাভ করেছে গীতাঞ্জলি এবং তার ইংরেজী সংকলন song oferings এর মধ্যে দিয়ে । তিনি যেন তার জীবনদেবতা ও হৃদয়দেবতাকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছিলেন , অহংসত্ত্বাকে সমর্পন করেছিলেন তুমি ত্বম বা তুমির চ্ররণতলে।গুরুদেব তার জীবনদেবতাকে একক, অখন্ড ব্রক্ষান্ড রাজ্যের পরম রাজরাজেন্দ্র বেশে অবলোকন করেছেন । তিনি উচ্চকন্ঠে জয়গান করেছেন সেই ঈশ্বররূপী জোর্তিময়ের যিনি সকল বন্ধ দুয়ারের আগল খুলে তার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছেন।
গীতাঞ্জলির ১২১ নং গানে কবি লিখেছেন "তাই তোমার আনন্দ আমার পর/তুমি তাই এসেছ নীচে / আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে / এখানে ভগবান ভক্তের হৃদ্য় লাগি নেমে এসেছেন এই মাটির পৃথিবীতে, ভগবান ছাড়া যেমন ভক্তের ভক্তি অসম্পূর্ন তেমনি ভক্ত ছাড়াও ভগবানের প্রেম অসম্পূর্ন ।সেই জ্যেতির্ময় সত্ত্বা সেই রাজরাজেশ্বর দেবতা ভক্ত হৃদয়ের অপরূপ মাধুর্য্যের সন্ধানে সব বন্ধন ভেঙ্গে চলে এসেছেন ।"তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে /তবু আমার হৃদয় লাগি/ ফিরছো কত মনোহরণ বেশে/ প্রভু নিত্য আছ জাগি/"
song offerings কে গীতাঞ্জলির আক্ষরিক অনুবাদ বলা যায় না , ভাবানুবাদ বলা যেতে পারে ।তাই song offerings এ গীতাঞ্জলির ৫৪টি কবিতা , গীতিমাল্যের ১৫টি নৈবেদ্যের ১৬টি খেয়ার ১১টি শিশুর ৩টি চৈতালি , কল্পনা ,উতসর্গ ও অচলায়তন থেকে ১টি করে মোট ১০৩ টি কবিতা সংকলিত ও অনূদিত হয়ে অর্ন্তভূক্ত হয়েছে । song offerings তাই গীতাঞ্জলির আক্ষরিক অনুবাদ নয় বলা যেতে পারে কবির স্বীয় রচনার ভাবানুবাদ ।
গীতাঞ্জলির প্রথম কবিতাটিতেই করুণাময়ের কাছে তার আন্তরিক প্রার্থনার প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই ... "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলির পরে / সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে ।"লৌকিক অহংকারের সমূল উৎপাটন করে তার জীবন দেবতা তথা হৃদয় দেবতার শ্রীচরণতলে যে নিঃশর্ত সমর্পন যে তিনি করতে চেয়েছেন এর থেকে আকুল প্রার্থনা গভীরতর আধ্যাত্মিক চেতনা আর কি হতে পারে ?এই প্রসংগে উপনিষদ বলেছেন,"যাহা কিছু প্রকাশ পাইতেছে তাহা তাঁহারই অমৃত আনন্দরূপ। তাহার মৃত্যুহীন ইচ্ছাই এই সমস্তরূপে ব্যক্ত হইতেছে ।ঈশ্বরের এই যে প্রকাশ উপনিষদ ইহাকে তিন ভাগ করিয়া দেখিয়াছেন । একটি প্রকাশ জগতে আর একটি প্রকাশ মানবসমাজে আর একটি প্রকাশ মানবাত্মায় । একটি শান্তং , একটি শিবং, একটি অদ্বৈতং
ঋষিরা বলেছেন , " আনন্দং ব্রক্ষ্মণো বিদ্বান ন বিভেতি কুতশ্চন " অর্থাৎ ব্রক্ষ্মের আনন্দ যিনি জানিয়াছেন তিনি কিছু হইতেই ভয় পাননা ।সুতরাং করুণাঘন ঈশ্বরের কাছে আমাদের একটিই প্রার্থনা---
অসতো মা সদগময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মামৃতংগময়।
আবীরাবীর্ম এধি।
রুদ্র যত্তে দক্ষিনং মুখং
তেন মাং পাহি নিত্যং
অসত্য হইতে আমাকে সত্যে লইয়া যাও , অন্ধকার হইতে আমাকে জ্যোতিতে লইয়া যাও , মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও । হে স্বপ্রকাশ আমার নিকটে প্রকাশিত হও। রুদ্র তোমার যে প্রসন্ন মুখ তাহার দ্বারা আমাকে সর্বদাই রক্ষা করো।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিশেষতঃ পূজাপর্্যায়য়ের গীতি কবিতাগুলির মধ্যে দিয়ে আমরা এতখানি উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক বোধের পরিচয় পাই যখন দেখি তিনি জগত জুড়ে উদার সুরে আনন্দ গান শুনতে পেয়েছেন আর প্রতীক্ষা করে আছেন কবে সেই গান গভীরভাবে তাঁরও হিয়ায় বাজবে । কবি হৃদয়ের করুণ আর্তি ঝরে পড়ে তার প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে ...
চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে /নিয়ো না নিয়ো না সরায়ে / জীবন মরণও সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে ।" জীবনদেবতার সংগে রবীন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছিলেন এক মধুর সম্পর্ক । সেই সম্পর্কের ভিতর দিয়ে কখন যেন প্রেম ও পূজা একাকার হয়ে গিয়েছে ।
"তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষনে ক্ষনে
ও মোর ভালবাসার ধন
দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন
ও মোর ভালোবাসার ধন "
song offerings এর মুখবন্ধে বিখ্যাত কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস লিখেছেন , These lyrics which are in the original , my Indians tell me , full of subtlely of rythm of untranslatable delicacies of colour , of material invention ...display in their thought a world I have dreamed of all my life long . কখনও বা তিনি লিখেছেন , " I read Rabindranath every day , to read one line of his to forget all the troubles of the world .তার লেখার এই যে ব্যপ্তি যা আমাদের প্রতিদিনকার দুঃখ , বিপদ, তুচ্ছ করার অদ্ভুত মানসিক প্রেরণা জোগায়;প্রকৃতির নানা ঘটনার অন্তনির্হিত যে আনন্দের অনুষঙ্গ তাকে প্রতিনিয়ত নতুনভাবে উপলব্ধি করার যে আন্তরিক প্রচেষ্টা তার লেখায় ফুটে ওঠে এ সবই তার নিগূঢ আধ্যাত্মচেতনার ফল।
After that his art grew deeper , it became religious and philosophical all the aspirations of mankind are in his hymns . He is the first among our saints who has not refused to live , but has spoken out of life itself and that is why we give him our love.
ধর্ম ও ঈশ্বরকে তিনি জীবন থেকে পৃথক করে নয় , বরং জীবন উৎসবের জয়গান গেয়ে এই বিশ্বপ্রকৃতির অনন্ত রূপ রস বর্ণ গন্ধের মাঝে পরমাত্মার যে সৃষ্টির মুল সুর ধ্বনিত হচ্ছে তাকে উপলব্ধি করে জীবন দেবতার পায়ে তিনি তার ভক্ত হৃদয়ের নৈবেদ্যের ডালি সমর্প্ন করেছেন ভক্তের আকুল প্রার্থনায় ভগবানকে ডেকেছেন অহর্নিশ । যেমন ৩৪ নং কবিতায় ...
"তোমায় আমার প্রভু করে রাখি
আমার আমি সেইটুকু থাক বাকি
তোমায় আমি হেরি সকল দিশি
সকল দিয়ে তোমার মাঝে মিশি
তোমারে প্রেম জোগাই দিবা নিশি
ইচ্ছা আমার সেইটুকু থাক বাকি
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি ...।
ভগবানের পায়ে ভক্তের আন্তরিক আকুল সমর্পন , জীবনের প্রতিটি কাজে , প্রতিটি অনুভূতিতে ঈশ্বর অস্তিত্বের এই পূর্ন প্রকাশের অবলোকন তার গভীর আধ্যাত্মচেতনারই ফলশ্রুতি । জীবন দেবতার এই পূজা জীবনকে বাদ দিয়ে নয়, জীবনের পরেও নয় , বরং জীবনের সব রূপ রস বর্ণ গন্ধ থেকে প্রকৃত নির্যাস নিয়ে তার অর্চনা করার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর চেতনার সার্থকতা।
তিনিই বলেছেন ,
"বিপদে মোরে রক্ষা কর / এ নহে মোর প্রার্থনা / বিপদে যেন না করি আমি ভয়/ দুঃখ তাপে ব্যথিত চিত্তে নাই বা দিলে স্বান্তনা / দুঃখকে যেন করিতে পারি জয় / ঈশ্বরের কাছে তিনি সেই অন্তরশক্তির উন্মেষ চেয়েছেন যার সাহায্যে আমরা সকল দুঃখ বিপদকে অতিক্রম করতে পারি ...
জীবন যখন শুকায়ে যায় /করুণা ধারায় এসো / সকল মাধুরী লুকায়ে যায় / গীতসুধারসে এসো/ শুধু জীবনেই নয় জীবন মরণের সীমানা অতিক্রম করে মৃত্যুকে সহজ সুন্দরভাবে গ্রহন করার মধ্যে দিয়েও রবীন্দ্রনাথের এই আধ্যাত্ম চেতনা পরিস্ফুট হয়েছে ...
"পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহ ভাই
সবারে আমি প্রনাম করে যাই
ফিরায়ে দিনু দ্বারের চাবি
রাখি না আর ঘরের দাবি
সবার আজ প্রসাদ বাণী চাই
সবারে আমি প্রণাম করে যাই ...।"
Tags:
বিশেষ পাতা