বাথরুমে স্নান করতে করতে বেদব্যাস,হঠাৎ শুনতে পেল টেলিফোনটা বিচ্ছিরি ক্রিং—ক্রিং শব্দ করে বেজে চলেছে। চারিদিক নিঃস্তব্ধ,কাঠের বাড়ির হাল্কা দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে শব্দটা গমগমে আকার নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। শুনলেই কেমন যেন গা টা ছমছম করে ওঠে। কলটা বন্ধ করে স্নান থামিয়ে চুপচাপ শুনতে লাগলো শব্দটা। কেমন যেন আলাদা একটা গন্ধ আছে শব্দটার মধ্যে। অনেক পুরানো ফোনের রিসিভারটা, ইংরেজ আমলের হলেও হতে পারে। মনে মনে ভাবলো, ফোন ফোনের কাজ করছে করুক, আমি আপাতত আমার কাজটা সেরে নিই। কল চালিয়ে ঝপাঝপ গায়ে জল ঢালতে লাগলো। বাথরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে এসে দাঁড়ালো টাবিলের পাশে। গতকাল মায়ের যে চিঠিটা এসেছে ওটা তখনও পড়া হয়নি। শীতকালের শীতটা শিমলায় বেশ উপভোগ্য। মাস দুয়েক আগেই নতুন পোস্টিং নিয়ে শিমলায় এসেছে। তা এখানে থাকতে মন্দ লাগছে না। শিমলায় পোস্টিং শুনে যে মন খারাপটা হয়েছিল, এখন আর সেটা নেই। যে বাড়িটায় আছে তার ঠিক পাশেই অনন্ত বিস্তৃত খাদ। জানালা দিয়ে নিচে তাকালেই গাটা কেমন ছমছম করে ওঠে। আসলে বেদব্যাস মানুষটা একটু রহস্য রোমান্টিক ধরণের। পোড়ো বাড়ি দেখলেই ভূতের ওঝারা যেমন গন্ধ শুঁকে বেড়ায়, সেও সব কিছুতেই রহস্যের গন্ধ পায়, কারণ অবশ্য একটা আছে। রহস্য বা ভূতের গল্পো লেখায় তার কলম বেশ পটু। একটু অন্যরকম কিছু দেখলেই মস্তিস্ক জাল বিছাতে শুরু করে। শিমলায় পোস্টিং এর খবরটা শোনার পর থেকেই মনে মনে ভেবে রেখেছিল, এমন একটা বাড়িতে থাকবে যার পরিবেশটা ভূতের গল্পো লেখার সহায়ক হবে। এখানে যে বাড়িটায় আছে সেটা শিমলা কালিবাড়ি রাস্তার ধারে, মাল রোডের ঠিক পাশেই। একটা পুরানো কাঠের তৈরি দোতলা বাড়ি, রাস্তার গা ঘেষেই দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক রাস্তার লেভেল থেকেই দোতলাটা শুরু হয়েছে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় একতলা বাড়ি। প্রথম যেদিন বাড়িটার খবর পেয়ে দেখতে আসে, ঠিক সন্ধ্যে তখন। বাড়ির দরজায় টোকা মারতেই চমকে ওঠে। একটা ভয়ানক থমথমে ভারি গলার আওয়াজে। এক রহস্যময়ী দৃষ্টি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় এক পৌড়া, এবাড়ির মালকিন মিসেস গোমস্। প্রথমে কটা সিঁড়ি কালো অন্ধকারে নিচে নেমে গেছে। কিছুটা নেমেই আবার উপরে উঠে এসেছে। বেদব্যাস মহিলাকে অনুসরণের চেষ্টায় সিঁড়িতে পা রেখেছে সবে, অমনি সিঁড়িটা আতর্নাদের মত ক্যাঁচ্ করে উঠলো। এরপর যত গুলো সিঁড়ি উঠে,প্রতি সিঁড়িতেই মচমচ একটা কাঠের ঝরঝরে শরীরের আওয়াজ। ঘরটা ঠিক আড়াই তলায় একটা মাঝারি আকারের শোয়ার ঘর, কিচেন, টয়লেট, ল্যাট্রিন। ওর মত ব্যাচেলারের জন্য যথেষ্ট। ঘরটির অপর একটি আকর্ষণ হলো সন্ধ্যের পর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে জ্বলতে থাকা আলোর জোনাকি দেখা যায় সুন্দর।
দু’দিন ধরেই ওর মাথার ভিতরটা বোঁ বোঁ করছিল। বেশ বুঝতে পারছিল মস্তিষ্ক তার জাল বিছাতে চায়ছে। ক’দিন ধরেই মনে মনে একটা ভীষণ ইচ্ছা কাজ করছে, একটা সেই ইংরেজ আমলের চৌকো টেবিলল্যাম্প পেলে খুব ভালো হতো। রাতের অন্ধকারে ঐ ল্যাম্পের টিমটিমে আলোয় কল্পনা যে ঠিক ঠিক কাজ করবে,তাতে ওর কোনো সন্দেহ নেই। মনে মনে ভাবলো মিসেস গোমসের কাছে খোঁজ করলে কেমন হয়? এই বাড়ির চেহারা বলছে অমন একটা জিনিস এখানে থাকলেও থাকতে পারে। ঠিক সন্ধ্যে বেলায় রোজকার মত চা-পানের উদ্দেশ্যে গিয়ে বসেছে সামনের চায়ের দোকানে। গরম ধোঁয়া ওঠা চা, সাথে এলাচের সুগন্ধ। হঠাৎ ই চোখ পড়লো ওর বর্তমান বাসস্থানের উপর। দেখলো পাহাড়ের খাদ থেকে চাপচাপ ধোঁয়ার মত কুয়াশা ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে বাড়িটাকে। গাঢ় বাদামি বাড়িটা কেমন যেন নিশির ডাকের মত টানছে ওকে। বিভোর হয়ে তাকিয়ে আছে সেই দিকে, হঠাৎ দেখলো মিসেস গোমস দরজা খুলে বেরোলেন,তারপর চারপাশে হাল্কা চোখ বুলিয়ে বাড়িটির পিছনের দিকে খাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালেন। চমকে উঠলো বেদব্যাস, ওনার হাতে ঝোলানো ল্যাম্পটা দেখে। অবিকল সেই আলো যা ওর মন চায়ছে ‘ইউরেকা’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণে মাথায় এলো মিসেস গোমস এই সন্ধ্যেবালায় ওখানে কি করছেন? দু’পা এগিয়ে দেখলো, উনি আলোটা বেশ খানিকটা উঁচুতে তুলে ধরে বিড়বিড় করে কি সব বলে চলেছেন। ও চুপচাপ ঘরে ফিরে এলো মনে বেশ কিছু প্রশ্ন এবং ঠিক ডিনারের আগে দেখা করতে গেল মিসেস গোমসের সাথে। কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা বলার পর সরাসরি পৌঁছে গেল ল্যাম্পের প্রসঙ্গে কিন্তু আশ্চর্য উনি ল্যাম্পটার অস্তিত্ব সম্পর্কে পুরো অস্বীকার করলেন। কথা বলার ফাঁকেই আড়চোখে পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নেয় বেদব্যাস, সত্যিই কোথাও তো ল্যাম্পটা চোখে পড়ল না। অথচ ও নিশ্চিত যা দেখেছে সেটা কিছুতেই ভুল হতে পারে না।সে মনে মনে স্থির করলো, দেখেছে যখন তখন ওটা এ বাড়িতে অবশ্যই আছে আর যেমন করে হোক ওটা ও পেয়েই ছাড়বে। এ এক অদ্ভূত স্বভাব ওর,একবার কোনো জিনিস মাথায় ঢুকলে না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। পেতে হবে কিন্তু কি করে?...ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে আসতেই আবার চোখ পড়লো মায়ের চিঠির দিকে। চিঠিটা খুলতে খুলতে ভাবলো, রাতের মধ্যে ল্যাম্পটা জোগাড় করবে এবং লিখতেও বসবে। কারণ ও একশ শতাংশ নিশ্চিত ওটা পেলেই ও লিখতে পারবে ঠিক যে ভাবে গল্পটা লিখতে চায়ছে।
মা’র চিঠিটা পড়তে লাগলো। মা বিবাহের জন্য পাত্রী দেখা শুরু করেছেন, তা মন্দ নয় ব্যাপারটা। বয়স তো সাড়ে বত্রিশ হলো। মা লিখেছেন চিঠির ভিতর আরেকটি খামে মেয়েটির ছবি পাঠিয়েছে। বেদব্যাস খাম থেকে ছবিটি বের করে একবার ঘুরিয়ে দেখতে গিয়েও ভালো করে না দেখেই রেখে দিল, পরে ভালো করে সময় নিয়ে দেখবে। ল্যাম্প সমস্যার সমাধান না হলে কোনো কাজেই মন দেওয়া যাচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ওর মনে পড়লো ঘরের ঠিক নিচেই একটা ঘর আছে যেটাই মিসেস গোমসকে কখনও যেতে দেখিনি, অথচ ঘরের দরজায় তালাও নেই। ঘরটা কিসের কখনো জানার জন্য কৌতূহলও হয়নি। মনে মনে ভাবলো একবার সেখানে দেখলে কেমন হয়?
মিসেস গোমস রাত ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। ঠিক রাত দশটা বাজে তখন বেদব্যাস আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে একটা টর্চ হাতে গিয়ে ঢুকলো সেই ঘরে। দরজা খুলতেই একটা বাদুর বাদুর গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলো ওর। মুখে রুমালটা বেঁধে টর্চের আলোয় দেখলো গোটা ঘরে ভাঙা জিনিস ছড়ানো ছিটানো পড়ে আছে। হাতের স্পর্শে বুঝলো ধুলোর পরত জমে। ভালো করে আলো ফেলে দেখেতেই একরাশ হতাশা নেমে এলো ওর মনে! কি করবে ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বেরিয়েছে সবে, হঠাৎ চোখ পড়লো সিঁড়ির নিচে একটা বড় লেটার বক্সের মত কাঠের বাক্স দেয়ালে টাঙানো। ভাবলো, লেটার বক্স ঘরের ভতরে কেন হবে? ধীরে ধীরে ওটার কাছে যেটেই দেখতে পেল ভিতরে সাদা কাপড় মোড়ানো কি যেন একটা রয়েছে। হাত দিয়েই আবার চেঁচিয়ে উঠলো একটু চাপা গলায় ‘ইউরেকা’ বলে। ঠিক করলো রাতে লেখার সময় ওটা ব্যবহার করবে আর সকালে মিসেস গোমস ওঠার আগেই আবার স্বস্থানে রেখে যাবে। ল্যাম্পটি ঘরে এনে আলো জ্বাললো। তারপর সব আলো বন্ধ করে ল্যাম্পের টিমটিমে আলোতে চোখ স্থির করে লিখতে বসলো টেবিলে। যেন ওর হাতে বাঁধভাঙা জোয়ার নেমেছে। রাত তখন কত ঠিক হিসাব নেই, টেলিফোনের বিকট আওয়াজে ঘোর ভাঙতেই হেলতে দুলতে উঠে এসে রিসিভার কানে বললো, ‘হ্যালো’।
#
উফ্! কি বিরক্তিকর। লেখাটা এমন জায়গায় থেমে আছে, অথচ অফিসের নির্দেশে প্রায় দশঘন্টার পথ যেতে হবে ওকে। মানে আজ আর কোনো মতেই ফিরতে পারবে না। যেখানে যাচ্ছে, সেখানে রাতে থাকার জন্য একটা পুরানো ইংরেজ আমলের সার্কিট হাউস আছে। বেজার মুখে প্রস্তুত হতে শুরু করলো। ঠিক ন’টায় অফিসের গাড়ি আসতেই বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ মনে হলো ল্যাম্পটা তো রেখে আসা হয়নি! ওটা স্বস্থানে এই মুহূর্তে রাখতে যাওয়া বোকামি, ওটার সামনে যেতেই কেমন যেন একটা লোভ হলো, ভাবলো সঙ্গে নিয়ে গেলে কেমন হয়?...পুরোপুরি তো নিয়ে নিচ্ছি না। ভাবা মাত্রই কাজ, সোজা একটা হাত ব্যাগে চালান করে গাড়িতে গিয়ে বসলো। গাড়ি ছাড়ার আগে একবার দেখে নিল অসমাপ্ত লেখাটা আর মায়ের চিঠির সঙ্গে পাঠানো ছবিটা নিয়েছে কিনা । প্রতিদিন যে ড্রাইভার অফিস নিয়ে যায়, আজ কিন্তু সে আসে নি, অন্য একজন। গাড়িতে বসতে বসতেই বলে উঠলো... ‘ও ভাই নামটা কি তোমার?... এত দীর্ঘ যাত্রায় কথা বলার কেউ নেই, তোমার সাথেই কিন্তু মাঝে মাঝে বকবক করবো’।
সে মাথা নাড়লো তারপর বললো—‘ স্যার জি মেরা নাম দিনেশ নেগি’।
বাঃ! সুন্দর নাম।
গাড়ি এগিয়ে চললো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে। প্রতিটা বাঁকের মুখেই যেন দম বন্ধ হওয়ার জোগার। নির্জন রাস্তা, যেন কোনো পাহাড়ি জঙ্গলের পথ,একটা অদ্ভূত নিঃস্তব্ধতার চিৎকার, যেন শোনা যাচ্ছে। এই দুই মাসে শিমলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়েছে, কখনো এত নির্জনতা তো চোখে পড়েনি। বুকের ভিতরটা যেন কেঁপে উঠলো। শিমলা থেকে বেশ অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছে। এই দিকে যে ওদের অফিসের কোনো শাখা আছে আগে কখনো শোনেনি। তবু যেতে হবে উপায় তো নেই! হঠাৎ দেখলো, চারপাশ থেকে ঘন কুয়াশা যেন গিলে খেতে আসছে ওদের গাড়িটা কে। সামান্য খোলা গাড়ির কাচের ভিতর কুয়াশা ঢুকে যেতে এক হাত দূরের দিনেশও প্রায় অদৃশ্য তখন। যতই ভূতের গল্পের লেখক হোক না কেন, প্রাণের ভয় নেই এমন মানুষ কি আছে? ...মুখটা শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল ওর। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ। ভয়ে চিৎকার করে উঠলো বেদব্যাস ‘ দিনেশ-শ, গাড়ি রোকো’।
ও কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠলো ‘ গাড়ি ইধর নেহি রুকেগা’।
‘কেন?...তুমি গাড়ি রোকো, তাড়াতাড়ি, জলদি’।
দিনেশ বেদব্যাসের কথায় কোনো রকম কর্ণপাত নয়া করে নিজের মতই চলতে লাগলো। কিছুদূর যেতেই চোখ পড়লো বাইরে। তখনো গুঁড়ি গুঁড়ি কুয়াশা, আকাশে ঘন কালো মেঘ। অসময়েই যেন সন্ধ্যা নেমে আসছে। হঠাৎই শুরু হলো বৃষ্টি। গাড়ির কাচ বেয়ে নেমে যাচ্ছে জলধারা। অনেকদিন আগে কার কাছে যেন শুনেছিল পাহাড়ে বৃষ্টি নাকি ভয়ঙ্কর!...যখন তখন ধস নামতে পারে বা দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। কোথাও যে দাঁড়াব দু’দণ্ড তেমন উপায় নেই। একেই শীতের বেলা তার ওপর ঘন মেঘে তাড়াতাড়িই অন্ধকার নেমে এলো। দু’পাশে ভেজা চাপচাপ অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলেছে গাড়ি। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় শুধু সামনের রাস্তা টুকু দেখা যাচ্ছে মাত্র। হঠাৎ সামনে তাকিয়েই চমকে উঠলো বেদব্যাস। এক মহিলা মাথার ছাতায় স্পষ্ট মুখ দেখা যাচ্ছে না,খাদের একেবারে কিনারায় দঁড়িয়ে রহস্যময় মূর্তির মত। দিনেশকে গাড়ি থামিয়ে মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে নেওয়ার কথা বলতেই, দিনেশ কেমন অবাক চোখে ওর দিকে ঘুরে একবার তাকিয়ে বললো—‘ কাঁহা স্যার, উধার তো কোই নেহি হ্যায়।
ধমকের সুরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘আমি দেখা, আভি থা, তুম ভালো করে দেখো’। কিন্তু কথাটা বলেই নিজেই অবাক হয়ে গেল। একটু আগেই যেখানে মেয়েটি কে দেখেছিলাম, সেখানে তো কেউ নেই! মনে ভাবতে লাগলো, তবে কি আগেই কোনো গাড়িতে উঠে গেছে সে!...আর ঠিক তখনি মনে হলো এই এতটা পথের কোথাও তো একটি গাড়িও চোখে পরেনি, অনেক মনে করার চেষ্টা করলো,নাহ্! আর এই চেষ্টায় আরো কতগুলো বিষয় মাথায় উঠে এলো যে, পুরো পথে শুধু গাড়ি নয়, দোকান, বাজার, বাড়ি বা গ্রাম এমকি কোনো একটি মানুষেরও তো দেখা মেলেনি! ভাবতেই ভিতরটা কেমন শুকিয়ে গেল।
অকারণেই প্রায় চিৎকার করে উঠলো,’দিনেশ সামনে কই চা দোকান পেলে গাড়ি রুকবে, বড্ড চা তেষ্টা পেয়েছে’। দিনেশ কথার কোনো জবাব না দিয়ে কলের পুতুলের মত গাড়ি চালাতে লাগলো। বরফ পড়তে শুরু করেছে। রাস্তার দু’ধারে বরফের সারি।
ক্যাঁ—এ—চ্ আওয়াজ করে থেমে গেল গাড়িটা। বেদব্যাস নিজের অজান্তেই লুকিয়ে নিয়ে আসা ল্যাম্পটার দিকে আড়চোখে তাকালো। কেমন যেন জীবন্ত লাগছে ওটাকে। চেষ্টা করতে করতে হঠাৎ গাড়িটা স্টার্ট নিয়ে নিতেই দিনেশ যেন গাড়ি নিয়ে ছুটতে লাগলো।
‘দিনেশ ইয়ে জাগা ইতনা ফাঁকা ফাঁকা কিঁউ’? লোকজন থাকে না?
দিনেশ হিসহিসে স্বরে বলে উঠলো, ‘রহেতা থা, মগর আভি শ্মনশান। পুরা গাঁও উজার গ্যায়া’। এরপর মিনিট পাঁচেক শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা।বাইরে বৃষ্টির ঝনঝন আওয়াজ। গাড়ি ঘন পাহাড়ি জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করেছে তখন, কিছুটা এগোতেই হঠাৎ গাড়িটা হোঁচট খেয়ে থেমে গেল। সামনে যাওয়ার পথ বরফে বন্ধ। এমন ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে গাড়িতে বসে এই পাহাড়ি রাস্তায় রাত কাটানো বেশ ভয়ের। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হিসেব করে দেখলো গন্তব্যের প্রায় কাছাকাছিই ওরা এসে পড়েছে। দিনেশ গাড়িটা দাঁড় করিয়ে হেডলাইট টা জ্বালিয়ে দিল। ভিতরে বসে ভাবছে ,ঠিক তখনি কড়কড় শব্দে ভীষণ জোরে দুটো বাজ পড়লো আর বিদ্যুতের আলোয় ওরা স্পষ্ট দেখলো,কিছুটা দূরে পাহাড়ের গায়ে একচিলতে আলো।
‘দিনেশ একটা চান্স নিতেই হবে, চলো’।
ল্যাম্পটা কাজে লেগে গেল ওটাকে জ্বালিয়ে ঝোপঝাড় ভেদ করে যেখানে পৌঁছালো ওটা একটা ইংরেজ আমলের পুরানো বাংলো কিন্তু সামনের রাস্তাটা বরফে পুরো ঢাকা। কোনো রকমে বাংলোর দরজার সামনে এসে নক্ করতেই খুলে গেল দরজাটা। বেদব্যাস দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লো। এমন দুর্যোগে একটা আস্তানার খোঁজ পাওয়ার আনন্দে মশগুল বেদব্যাসে হঠাৎ দিনেশের কথা খেয়াল হতেই পিছন ফিরে চারিদিকে তাকিয়ে দিনেশকে খুঁজতে লাগলো, দেখতে না পেয়ে ভাবলো বাইরে থেকে যায়নি তো?...দরজার কাঁচ দিয়ে বাইরে দেখে নিল না, নেই। কাছাকাছি ঘরগুলোও দেখলো খুঁজে পেল না। অজানা আতঙ্কে গা শিরশির করে উঠলো ওর। তবেকি গাড়িতেই থেকে গেল দিনেশ! কিন্তু এই দুর্যোগে বাইরে বেরিয়ে ওকে খুঁজতে যাওয়া নিছকই বোকামি। বৃষ্টিতে পোশাক পুরো ভিজে। সামনেই একটা ওয়ারড্রব দেখে ওটা খুলতেই দেখলো একটা কালো লং কোট আর হ্যাট রাখা সেখানে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম, কার জিনিস ভাবার সময় কোথায়? পড়ে নিল। ব্যাগ থেকে দিস্তা কাগজ আর কালি কলমটা বার করে টেবিলে রাখলো। সামনের টেবিলটার ড্রয়ার খুলতেই দেখলো কয়েকটা সিগার পড়ে আছে, পেটে হাল্কা খিদেও আছে কিন্তু খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই ভেবেই একটা সিগার ঠোঁটে গুঁজে আগুন দিল। আ—হা! সুখটান। যেটুকু গতকাল রাতে লিখেছিল সেটায় চোখ বুলিয়ে সিগার খেতে খেতে প্লট সাজাতে লাগলো। হঠাৎ দপ্ করে আলোটা নিভে গেল আর ওই ল্যাম্পটা জ্বলে উঠলো। একটা অস্ফুট স্বর বেরিয়ে এলো ওর মুখ থেকে।ওর স্পষ্ট মনে আছে একটু আগেই ফুঁ দিয়ে ল্যাম্পটা নিভিয়ে ছিল...। জ্বললো কি করে? ছমছম করে উঠলো গা। বাইরে আবার তুফান শুরু হয়েছে, সবে লিখতে শুরু করেছে হঠাৎ ‘ঠক –ঠক’ ... শব্দ শুনতে পেল যেন। ফিরে তাকিয়ে, ভাবতে লাগলো, দিনেশ নয় তো!... সে বেটা সেই লাপাতা আর তো কোনো খবর নেই। নিশ্চয় মাল টেনে ঘুমাচ্ছে। আবার লিখতে যেতেই দরজায় আওয়াজ। ল্যাম্পের আবঝা আলোয় মনে হলো কেউ যেন বাইরে দাঁড়িয়ে। উঠে দরজার কাছে যেতেই দেখলো, সাদা গাউন পড়া একটি মেয়ে প্রচন্ড জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। অবয়বটা চেনা মনে হলো। মনে মনে ভাবলাম, একেই কি রাস্তার ধারে দেখে ছিলাম?...দরজার ছিটকিনি খুলতেই মেয়েটি হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো। ভীষণ আতঙ্কের চিহ্ন ওর মুখে চোখে। ওকে দেখেই বলে উঠলো, ‘ পাওয়া যাচ্ছে না, সাইলককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আমি এখন কি করবো বলুন তো মিঃ হোমস্?’
বেদব্যাস ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ তার দিকে। কি বলছে মেয়েটি?
প্লিজ আপনি একটু স্থির হয়ে বসুন।
‘না, আমার হাতে সময় ভীষণ কম, ভোর হওয়ার আগেই সাইলককে খুঁজে পেতে হবে’।
কিন্তু আমিতো মিঃ হোমস্ না?...আমি একজন বাঙালি লেখক, ভুতের গল্প লিখি। আমার নাম মিঃ ঘোষ।
মেয়েটি প্রচন্ড রেগে গিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো... ওর দিকে আঙ্গুল তুলে বললো--- ‘মাইন্ড ইট, সাইলকের কিছু হলে আমি কিন্তু আপনাকে ছাড়বো না’। বলেই ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো মিঃ হোমস্---মিঃ হোমস্, আর ইউ দেয়ার?---প্লিজ হেল্প মি’। যেন গোটা ঘর জুড়ে একটা গমগমে প্রতিধ্বনি। ঠিক তখনই বাইরে আবার কড়কড় করে বাজ পড়তেই মেয়েটি কেমন শান্ত হয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। ল্যাম্পটা দপ্ দপ্ করে দু’বার জ্বলেই নিভে গেল। পকেট হাতড়াতে বেদব্যাস দেশলাইটা খুঁজতে লাগলও। মনে পড়লো ল্যাম্পটা জ্বালানোর জন্য কিছুক্ষণ আগেই ওটা পকেট থেকে বাইরে রেখেছে। টেবিল হাতড়াতে লাগলো, ঠিক তখনই আবার ল্যাম্পটা দপ্ করে জ্বলে উঠলো আর প্রায় ওকে চমকে দিয়ে ঘর জুড়ে গম্ভীর একটা কন্ঠস্বর ভেসে এলো—‘ গুড় ইভিনিং ফ্রেন্ডস্’। বেদব্যাস উদ্ভ্রান্তের মত চারদিকে চোখ ঘোরাতে লাগলো। হঠাৎ দেখল, ঠিক ওরই মত গড়ন, উচ্চতা বিশিষ্ট একটি লোক পরনে কালো লং কোট মাথায় কালো হ্যাট, মুখে চুরুট ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। খুব চেনা চেহারা, অদ্ভূত একটা মিল!...
হ্যালো মিঃ ঘোষ। হাঁ করে তাকিয়ে লোকটাকে দেখতে দেখতে বিস্ময়ে ঘুরে তাকালো দরজার দিকে। নাহ্, দরজা তো বন্ধ! কি করে এলো লোকটা, ভিতরে কি তবে কোনো গোপন দরজা আছে! ভাবতে ভাবতেই কাঁপা গলায় বলে উঠলো ‘হু—হু—উ আর ইউ?’
মুখচাপা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো গোটা ঘরটা।--- হু এ্যম আই? আই এ্যম দ্যা গ্রেট শার্লক হোমস্। হাসতে হাসতে লোকটি ওর চারপাশে ঘুরতে লাগলো তারপর মেয়েটির মুখের সমনে গিয়ে বললো, ‘ সাইলক, ইয়োর সাইলক...’।
প্লিজ হেল্প মি মিঃ হোমস্।
লোকটি হঠাৎ ও মাই ডার্লিং বলতে বলতে ছুটে গিয়ে মেয়েটির কপালে চুমু খেয়ে বললো ---ইউ নো... হু ইজ দ্যা কালপ্রিট?... আঙুল ঘুরিয়ে ওর দিকে নির্দেশ করলো। আতঙ্কে দু’পা পিছাতেই ধাক্কা খেল, ঘুরে তাকিয়ে দেখলো ওর ড্রাইভার দিনেশ পিছনে দাঁড়িয়ে হাসছে, ওর হাতে চকচক করছে প্রায় দেঢ় ফুট লম্বা চাকু। ভয় পেয়ে এগোতে যেতেই মেয়েটি লাফিয়ে ওর পথ আটকালো। ব্যাগের ভিতর থেকে চকচকে একটা ছুঁরি বের করে একপা একপা করে ওর দিকে এগোতে এগোতে বলতে লাগলো...সাইলককে তুই খুন করেছিস, আমি তোকে ছাড়বো না... তোর হৃৎপিন্ড থেকে একপাউন্ড মাংস আমি কেটে নেব আজ’। ল্যাম্পটা দপ্দপ্ করছে তখন,আর্ত চিৎকার করতে লাগলো বেদব্যাস, ‘বাঁচাওওওও’।
#
এই ঘটনার পর মাসখানেকের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল বেদব্যাস। ওখানে থাকতেই খবর পেয়েছিল, মিসেস গোমসের নাকি কোনো খোঁজ নেই, তাই আপাতত বাড়িটি সরকারী গেস্টহাউস। বেদব্যাস তালা খুলে তার পুরানো ঠিকানায় ঢুকতে যাবে, ঠিক এমন সময় একটা সাদা বিড়াল লাফ দিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকলো মিসেস গোমসের ঘরে। বেদব্যাস বিড়ালটিকে তাড়ানোর উদেশ্যে দু’হাতে দরজা ঠেলেই বিস্ময়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো দেয়ালে টাঙানো একটি ছবির দিকে তাকিয়ে। অবিকল সেই বাংলো আর সামনে দাঁড়িয়ে সেই হ্যাট-কোর্ট পড়া মিঃ হোমস আর ওই মহিলা যার মুখের আদলে স্পষ্ট মিসেস গোমসের প্রতিচ্ছবি, হাতে ঝুলছে সেই ল্যাম্পটি। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো ওর, মনে করার চেষ্টা করলো সেদিন কি ছবিটি দেখেছিল?...না এখনো দুর্বলতা কাটে নি, মনে করার চেষ্টায় মাথায় বেশ চাপ অনুভব করলো। দরজা বন্ধ করে ধীর পায়ে উপরে উঠে এসে ব্যাগ থেকে লেখার সরঞ্জাম গুলোর সাথে অসমাপ্ত লেখাটিও রাখলো। হাতে অনেকটা সময়, লেখার কাগজ খুলতেই বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। লেখাটা শেষ করলো কখন?...ওর সামনে পড়ে আছে একটি সুন্দর শিরনাম যুক্ত সম্পূর্ণ লেখা “ শার্লোক হোমসের ল্যাম্প”।
সুচিন্তিত মতামত দিন