রিয়া চক্রবর্তী

আরনেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল
১৮৫৪ সালে, 'school of industrial art ' এর প্রতিষ্ঠার সময়। ১৮৯৬ সালের ৬ই জুলাই, আরনেস্ট হ্যাভেল এসে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে শিক্ষক পদে যোগদান করেন। এই দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে বাংলার প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প শিক্ষা যে আদর্শকে সামনে রেখে অগ্রসর হয়েছে, সেই আদর্শ হল - ইউঁরোপীয় শিল্প রীতি পদ্ধতিতে এদেশের শিল্প শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে তোলা।

সে সময় ব্রিটিশ রাষ্ট্রের অধীনে থাকার দরুন, ইউঁরোপীয় জীবন চর্চার প্রতি আগ্রহী এদেশের প্রায় সকল শিক্ষিত মানুষ। তাছাড়া তখন ইউঁরোপীয় চিত্রকলার সম্পর্কে সবাই পরিচিত ছিলো নিঃসন্দেহে। তাঁরা মনে করতেন যে স্বদেশের চিত্রকলার বিকাশ ইউঁরোপীয় চিত্রকলার অনুবর্তনের মধ্যে দিয়েই হবে। এই সময় আর্ট স্কুলের কর্ণধার হ্যাভেল তাঁর এতোদিনে প্রচলিত ও পরীক্ষিত শিক্ষাধারা সম্পর্কে প্রশ্ন তুললেন এবং তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো পাশ্চাত্য শিল্পের অনুকরণ নয়, ভারতীয় শিল্প পরম্পরার দিকেই ভারতীয় শিল্প ফিরে আসুক। এবং তিনি সফল হলেন। ভারতীয় শিল্পকলার ঐতিহ্যর প্রতি হ্যাভেল এর ছিলো গভীর শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস।

ভারতীয় শিল্পের প্রতি হ্যাভেলের শ্রদ্ধা অর্জিত হল, কোলকাতায় আসার পর থেকেই। ১৮৮৪ সাল থেকে প্রায় দশ বছর তিনি ছিলেন মাদ্রাজ গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে শিক্ষক হিসেবে। সে সময়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের হয়ে তিনি দক্ষিণের কয়েকটি প্রদেশের পরম্পরাগত শিল্প, বিশেষ করে কারুশিল্পী সম্পর্কে অনুসন্ধানের কাজ করেছিলেন। সেই সূত্রেই ভারতীয় চারু ও কারুকলার সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে। তিনি যেভাবে ভারতীয় শিল্পের নিজস্ব চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তা তাঁর আগে কোন বিদেশী কলারসিক পারেন নি।

হ্যাভেল, সাউথ কেন্সিংটন স্কুলের অ্যাকাডেমিক রীতিতে চিত্রশিক্ষা গ্রহণ করেন। সেই শিক্ষা অনুযায়ী বেশ কিছু তেলরং এর নিসর্গচিত্র এঁকেও তিনি তাঁর আত্মতৃপ্তি খুঁজে পানি নি। তাই তিনি তাঁর নিজ্বস্ব অন্বেষণাতেই অ্যাকাডেমিক প্রকৃতি অনুকারী বাস্তবতার অতিরিক্ত ভাব ও ভাবনার জগতের কলাশিল্পের দিকে ঝুঁকেছিলেন। তাছাড়া উনিশ শতকের শেষ দশকগুলিতে British royal academy -র নির্ধারিত শিল্পাদর্শের প্রতি যে অনাস্থা রাস্কিনের অনুগামীরা, বিশেষ করে গ্যাব্রিয়েল ডান্টে রোসোটি, এডওয়ার্ড বার্ন জোন্সের মতো চিত্রকরেরা এবং উইলিয়াম মারিশের মতো পরম্পর জাত ব্রিটিশ কারুশিল্পের পুনরুজ্জীবন পন্থীরা ব্যক্ত করেছিলেন, তার দ্বারাও তিনি প্রভাবিত হতে পারেন।

ভিক্টোরীয় অ্যাকেডেমিক কারুশিল্পের তৃপ্ত না হয়ে বরং তার আত্মিক দৈন্য লক্ষ্য করে তিনি যে শিল্প বিপ্লবপূর্ব বা কলাশিল্পের আধ্যাত্মিকতার দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। দেখা যায় আর্ট স্কুলের দ্বায়িত্ব গ্রহণের পরের একবছরের মধ্যেই স্কুলের পঞ্চবার্ষিকী রিপোর্টে তিনি লিখেছেন - "সকল শিল্পের ভিত্তিস্বরূপ যে ডিজাইন তার শিক্ষা সম্পূর্ণ ভাবে অবহেলিত হয়েছে। এবং ড্রয়িং ও পেইন্টিং এর সাধারণ শ্রেনীগুলোতে আগাগোড়া চল্লিশ বছরের পুরনো ইংরেজি প্রাদেশিক শিল্পরীতি অনুসৃত হয়েছে। ব্যাবহারকারী, জ্যামিতিক, কারিগরিক, রেখাঙ্কন ও পরিপ্রেক্ষিত শেখানোর সাধারণ ক্লাসের ব্যবস্থা ছিলো না। প্রাচ্যের কলাশিল্প হয়েছে অবহেলিত। তার ফলে ভারতীয় ছাত্ররা ভুল পথে চালিত হয়েছে। "

এই সমালোচনার মধ্যে দিয়ে হ্যাভেল আর্ট স্কুল নতুনভাবে ঢেলে সাজালেন। তিনি সমস্ত শিল্প শিক্ষাকে দুভাগে ভাগ করলেন - ১) কারুশিল্পী বা industrial art ২) চারুশিল্পী বা fine art। প্রথম বিভাগেই প্রাচ্য শিল্প বা Oriental art শেখানোর ব্যবস্থা করা হল। ফাইন আর্ট বিভাগে ইউঁরোপীয় চিত্রকলার শিক্ষাক্রমকে হ্যাভেল আধুনিকীকরিনের মধ্য দিয়ে উন্নত করতে প্রয়াসী হলেন।

হ্যাভেলের এইভাবে আধুনিকিকরনের ফলে আর্ট স্কুলে প্রাচ্যদেশীয় কলাশিল্পের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে যার দরুন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলো। বিশেষ করে তিনি যখন কারুশিল্পে স্বল্প বেতনহার চালু করলেন তখন এই বৈষম্যতার কারনে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠলো। এরপর তিনি যখন আর্ট স্কুলের সংলগ্ন গ্যালারিটি সংস্কার করতে গিয়ে ইউঁরোপীয় ভাস্কর্যের প্লাস্টার কাস্ট কপি ও চিত্রের অনুলিপি প্রধান নিদর্শন গুলোকে বেঁচে দিয়ে তার জায়গায় ভারতীয় পরম্পরাগত কারু ও চারু শিল্পের নিদর্শন রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন ছাত্রদের অসন্তোষ কলকাতার পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ল। দেশী পত্র পত্রিকাগুলিতে এই মর্মে সমালোচনা হল যে হ্যাভেল ভারতীয় শিল্প, শিক্ষার্থী ছাত্রদের ইউঁরোপীয় কলাশিল্প শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে তাদের এবং এদেশের শিল্পকলা চর্চার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং হ্যাভেল লিখেছিলেন - "আমি antique ক্লাস তুলে দিয়ে ভারতীয় শিল্পকে শিক্ষার ভিত করে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা নতুন ভাবে সাজিয়েছিলাম। এর ফল হয়েছিল মারাত্মক। বাঙালিরা চরিতগত ভাবে রক্ষনশীল দলে দলে ছাত্ররা স্কুল থেকে বেড়িয়ে যায়। ময়দানে সভা করে। সরকারের কাছে আমার বিরুদ্ধে গণ স্বাক্ষরিত প্রতিবাদ পত্র দেয়। সেইসঙ্গে 'প্রগতিশীল ' সংবাদপত্র গুলি আমার বিরুদ্ধে অগ্ন্যুদ্গার করতে থাকে। "

সরকার পক্ষ যে হ্যাভেলের নতুন পদক্ষেপ সমর্থন করেছিলেন তা কিন্তু নয়। কিন্তু আর্ট স্কুলের শিক্ষাক্রমের আগেই যেভাবে তারা মেনেছেন এইবারও সেইভাবেই মেনে চললেন। কিন্তু ছাত্রদের ব্যপার আলাদা। তারা দলে দলে বেড়িয়ে যেতে লাগলেন। হ্যাভেলের কার্যকলাপ বন্ধ করতে না পেরে, অনেকেই স্কুল ছেড়ে ওই সময়ে আর্ট স্কুলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রণদা গুপ্তের নেতৃত্বে, মহারানী ভিক্টোরিয়ার শাসনকালে হীরকজয়ন্তী বছরে প্রতিষ্ঠিত, জুবিলি আর্ট অ্যাকেডেমিতে ভর্তি হলেন। রণদা গুপ্তের পরিচালনায় জুবিলি আর্ট পরবর্তী তিন দশক ধরে কলকাতার বুকে ইউঁরোপীয় রীতির চিত্র ও ভাস্কর্য অনুশীলনে অব্যাহত রাখতে সক্ষম হন। এখানে থেকে পাশ করা বহু শিল্পীই পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়েছিলেন। শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে সেইসময় ইউঁরোপীয় চিত্রকলায় সমাদর এমনই ছিলো যে, কাশীমবাজার রাজবাড়ির মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী সহ কলকাতার বহু ধনী ব্যক্তিরা এবং Calcutta municipality ও জুবিলি আর্ট অ্যাকাডেমীর প্রতিষ্ঠার সময়ে অর্থদান করেন।

কিন্তু প্রতিবাদ বা বিরোধিতা কোনটাই হ্যাভেলকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। তিনি আর্ট স্কুলের চত্বরে ভারতীয় শিল্পকলার পুনরুজ্জীবনের ভিত্তি স্থাপনে প্রয়াসী হন। আর তাঁর এই ব্রতে সহযোগীরা ভুমিকা নেবার জন্য তিনি আহ্বান জানান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির উদীয়মান শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তাঁর ডাকেই গিলার্ডি অবসর নিলে সেই জায়গায় আর্ট স্কুলের উপাধ্যক্ষের পদে ১৯০৫ সালে ১৫ আগস্ট যোগদান করলেন অবনীন্দ্র নাথ ঠাকুর।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন