মৃণাল চক্রবর্তী

আজি প্রণমি তোমারে
" আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান ! 
না জানি কেনরে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ, 
ওরে উথলি উঠেছে বারি, 

ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি " ।


আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও..... এ বেদগাথাকে পিছনে রেখে চলতে পারি কই ? কেন রবীন্দ্রনাথ নাম উচ্চারিত হতে সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগে ! যে নামের জাদুতে সোজা হয় বাঁকা মেরুদণ্ড। ক্ষয়িষ্ণু বাঙালির বেঁচে থাকার রসদ জোগায় । জীবন হয় আলোময় ।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের যাপনকথায় জন্ম থেকে মৃত্যু । রবীন্দ্রনাথ আমাদের চলমানতায় সকাল থেকে ভোর । শৈশবের সেই " কাল ছিল ডাল খালি / আজ ফুলে যায় ভরে / বল দেখি তুই মালি / হয় সে কেমন করে "। কেন জানি না, কতকাল আগের অভিভাবকদের সরবপাঠের সঙ্গে কণ্ঠ মেলানো....... আজও চেপে বসে ।

তারপর প্রাইমারির গণ্ডিতে " এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে "........... পায়ে পায়ে একদিন " রাশি রাশি ভারা ভারা ধান - কাটা হল সারা, / ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা------- / কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা " ।

অবশেষে ধান কাটা সম্পূর্ণ । গোলাজাত পরে অন্তরমহলে । যেখানে রবীন্দ্রনাথ এক অন্যভূবন! "পৃথিবী, কিনু গোয়ালার গলি হয়ে আফ্রিকা । ক্যামেলিয়া, সাগরিকা, বাঁশিওয়ালা হয়ে হঠাৎ - দেখা "।

আর একটু এগিয়ে " ছুটি, পোস্টমাস্টার, কাবুলিওয়ালা, ক্ষুধিত পাষাণ, অতিথি, নষ্টনীড়, ইচ্ছাপূরণ, স্ত্রীর পত্র পরে........ 

এবার রবীন্দ্রনাথ মেধা ও মনন খুঁড়ে......... "বউ ঠাকুরানীর হাট, নৌকাডুবি, রাজর্ষি, গোরা "কে পাশে রেখে " পৌঁছে যায় " শেষের কবিতা "-য় । সে এক উন্মাদনা । রাতের পর রাত জাগা শেষ হলে..... মন নাচে তার নিজের খেয়ালে...... " মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে / তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ "। " আমাদের চাহিদা যেন ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলে....... কিন্তু এ সমুদ্র যে অথৈ........ কেবল আঁজলা ভরে তুলে নাও, তুলে নাও........ " প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে / মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ "। এমনি করে "ছেলেবেলা, জীবনস্মৃতি, আত্মপরিচয়, শিক্ষা, রাশিয়ার চিঠি, ছিন্নপত্র " । 

এতদূর এসে হঠাৎ মনে হয়...... এও কী সম্ভব ? কেমন ছিলেন মানুষটি ! কেমন করে চিনব তাঁকে ! জানবই বা কেমন করে ? এমন ভাবনা আমাকে প্রায়শ তাড়া করেছে ..... জ্ঞান হয়ে অবধি...... যদিও এ জবাব আমার অজানাই থেকে গেছে । 

ফলে তাঁর বাগান থেকেই ফুল তুলে তাঁকে তর্পণ করা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো উপায় নেই দেখে বলি-- " তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী, / আমি অবাক্ হয়ে শুনি কেবল শুনি "।।

এ জানাও যে অনেক পরে । কারণ আমার জন্মের প্রায় এক দশক আগে প্রয়াত হয়েছেন তিনি। সুতরাং মূলধন বলতে........ সেই যে স্কুলের দিন গুলো....... ২৫শে বৈশাখে শিক্ষক মশাইদের রবীন্দ্র চর্চা আর শিক্ষার্থীদের কাঁপা গলায় মাইকে আবৃত্তি। কয়েকটা বে-সুর সঙ্গীত " তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে "....... প্রতি জন্মদিবসে নির্ধারিত ওই কয়েকটিই...... আর সংলাপ ভুলে যাওয়া নাটক.... সম্বলটুকু সাথে নিয়ে তাঁকে জানতে চাওয়া । আর দেখা বলতে তো সীমিত কয়েকটা ছবিতে । 

তবে এ কথা ঠিক, মানুষটিকে চিনতেই পারতাম না...... প্রথাগত শিক্ষার বাইরে যদি না বই- এর সঙ্গে আমার অবৈধ যোগাযোগ ঘটত ।

শিল্প - সংস্কৃতির এই মহাসমুদ্রকে জানতে গিয়ে হাবুডুবু খেয়ে ফিরে এসেছি। এ আমার কম্ম নয়! খুব বেশি হলে আজ এটুকুই বলতে পারি......

" আজি প্রণমি তোমারে চলিব, নাথ, সংসারকাজে 
তুমি আমার নয়নে নয়ন রেখো অন্তর মাঝে "।।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন