''এখনো যদি একটি গান আকাশে ভেসে আসে
কিংবা কেউ অনেক দূরে বাজায় মৃদঙ্গ
তোমার বুকের মধ্যে নাকি হাত রাখেন ঈশ্বর
মুখের ওপর উপচে পড়ে আলোর তরঙ্গ ---
যারা নিত্য দেখে তোমায় ,তারা বলে ।''
পাঠ করছি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের '' এখনো নজরুল কবিতা । নিত্য দেখেছি তোমায়, প্রতি অনুভবে। স্মৃতির সরণী বেয়ে চলে গেছি শৈশবে । রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালিত হবার পর আজ নজরুল জন্ম জয়ন্তী। ভেসে আসছে ... '' কারার ওই লৌহকপাট খুলে ফেল কর রে লোপাট '' .... বাজছে ড্রাম । উদ্বুদ্ধ হচ্ছি আমি বা আমরা স্বাধীনতার গানে ,সাম্যের গানে। এত সুরে, এত বিচিত্রে, রাগ রাগিনীর ছোঁয়ায় তিনি লিখে গেছেন এত কবিতা, এত গান । প্রায় তিনহাজার গানে জীবনের জয়গান গেয়ে গেলেন তিনি । অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছি তাঁরই গানে । সমাজের কোন শ্রেণী অচ্ছুৎ নয় তবুও অন্ধ কুসংস্কারে আজকেও দেশ নিমজ্জিত ।
'' জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া ''
হিন্দু মুসলমান একসাথে বড় হয়ে উঠেছি ,এক স্কুলে পড়াশোনা , গেয়েছি --
''মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু মুসলমান ''
আজ জাতীয়তাবাদ না মানবতাবাদ বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে । ওপারে একের পর এক ব্লগার হত্যা , মুক্তমনা শিক্ষক ,ছাত্র , অধ্যাপককে হত্যা সর্বোপরি হিন্দুদের ওপর অত্যাচার নজরুলের এই সাম্যবাদকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। এপারেও চলছে সাম্প্রদায়িক অসাম্প্রদায়িকতার নব নিত্য নাটক।
''অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ
কাণ্ডারি আজ দেখিব তোমার মাতৃ মুক্তি পণ
হিন্দু না ওরা মুসলিম ? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন ?
কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার ।''
সবাই এক মায়ের সন্তান তবুও এত যুদ্ধ বাধায় কারা ? নজরুলের কবিতা আজকেও সমান প্রাসঙ্গিক ,তীব্র কশাঘাত ।
সম্প্রতি বাংলা কবিতা একাডেমীতে দেখা হল কবি জিয়াদ আলির সাথে । কবি বিষণ্ণ সুরে বললেন -- দেশ আজ চরম সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে । কবির লেখা একটি নিবন্ধ --''ওপার বাংলার ; প্রতিরোধ ও প্রত্যয় '' প্রকাশিত হয়েছে শারদীয়া মাতৃশক্তি পত্রিকায় । সেখানে তিনি লিখছেন -- বাংলাদেশের সোনার টুকরো ছেলেরা হয়ে উঠছে আত্মঘাতী জঙ্গি । খুনের নেশায় উন্মাদ । ইসলামি জঙ্গিপনার টানে চলে যাচ্ছে সিরিয়ায় । কিভাবে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মানুষ মারা যায় সেই ট্রেনিং নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে । চপার দিয়ে খুন করা হচ্ছে প্রগতিশীল মানুশকে , কবি ,লেখক , অধ্যাপক , ব্লগার । তবে আমরা কি নজরুলের সেই চেতনাকে গ্রহণ করতে পেরেছি যার জন্য কবি আমরণ লড়াই করে গেছেন ।
নজরুলের সেই বিখ্যাত লাইন কোথায় ? কোথায় সেই ''গাহি সাম্যের গান -- / যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান । ''
সেই সময়, অপমানিত বিক্ষুব্ধ সময় । অগ্নিবীণা হাতে যে চেতনা তিনি জাগাতে চেয়েছিলেন দেশ তার কিছুই গ্রহণ করতে পারেনি। মানুষে মানুষে আজ এত বিভেদ , এত প্রভেদ -- তার পিছনে ধর্মীয় কারণ বা রাজনৈতিক কারণ যাই হোক না কেন ,অবিলম্বে এই সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বন্ধ হোক ।
সমাজের বাস্তব রূপটি আজও জ্বলন্ত ! শিশুমৃত্যু , অনাহারে যখন তিনি চাবুক তুলেছিলেন --দুটো ভাত আর একটু নুন দিতে বলেছিলেন --
'' কেঁদে বলি , ওগো ভগবান তুমি আছ কি ?
কালি আর চুন কেন ওঠে না ক ' তাহাদের গালে
যারা খায় ওই শিশুর খুন '' ।
আজকের শিশু বাক্স বন্দী হয়ে পাচার হয় , অনাহারে মরে তখন লেখনী সরব হোক । আর কতকাল মুখ বুজে সব মেনে নেওয়া ? সারাজীবন দারিদ্রতা , অর্থসঙ্কট , কারাগার , জীবনের নানা সঙ্কট স্বত্বেও কবি দমে যাননি । ঐক্য সাম্যের গান গেয়ে কবি মানুষকে উদার হতে বলেছেন ।
রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলে কোন তফাৎ দেখি না । একজন বিশ্বকবি অন্যজন জাতীয় কবি। রবীন্দ্র -নজরুলে সম্পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা আছে। রবীন্দ্র নজরুল তথ্যের সন্ধানে ইউ টিউবে সার্চ করে অবাক হয়ে দেখি, কি অদ্ভুতভাবে সেখানে সম্প্রচার করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের নিন্দা। মর্মে ব্যথা বাজে। ধুমকেতু পত্রিকা যখন নজরুল বার করেছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে প্রেরণা দিয়ে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন । কোথায় নজরুলের সেই মেঠো সুরের গান ? অসংখ্য গান আছে কৃষ্ণ প্রেমের , কালি ,শিব স্তুতিতে । কখনও তিনি নীলকণ্ঠ , কখনও তিনি নটরাজ --
''সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচ নটরাজ হে মহাকাল
প্রলয়তাল ভোল ভোল ---''
ভক্ত নজরুলের সেই গান কতবার সেই গেয়েছি , তাঁর কথায় , ভাবে ভক্তিরসে স্নাত হয়েছি , ইয়ত্তা নেই । আজ যখন দেখি মানুষ ধর্ম ভুলেছে , ভগবানে বিশ্বাস হারিয়েছে , তখন ভক্ত নজরুলকে আর একবার স্মরণ করিয়ে দিই --
''গগনে কৃষ্ণ -মেঘ দোলে ; কিশোর কৃষ্ণ দোলে বৃন্দাবনে '' কিংবা
''শ্মশানকালির রূপ দেখে যা ,
মুণ্ডমালা দুলছে গলে
সে চরণে পদ্ম ফোটে ,
সেই পায়ে আজ দানব দলে ।
কোথায় সেই প্রেমের গান ? ভক্ত নজরুলের কোন আদর্শ আজকের পৃথিবী গ্রহণ করছে ? দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আলো প্রবেশ করেনি । আজ উঠুক ঝঙ্কার অগ্নিবীণায় । তাঁর আদর্শ , চিন্তায় ,ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হই একত্রে ।
''আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল
আকাশে বাতাসে ধবনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রনভুমে রনিবে না ,
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত , সেই দিন হব শান্ত ।''
আমার পরম শ্রদ্ধার ,জাতীয় কবি , বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামের দুখু মিয়াঁ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন বারবার ,তাঁর ভাবাদর্শে ,চেতনে সমৃদ্ধ হয়ে যেন কবিকে মর্যাদা দিতে পারি , প্রণত হই বার বার ।
''তুমি আমায় যবে জাগাও গুনী তোমার উদার সঙ্গীতে
মোর হাতদুটি হয় লীলায়িত নমস্কারের ভঙ্গীতে ।।''