হুহু করে বাস এগিয়ে চলেছে। ঘড়ির কাঁটা বেলা বারোটা এখন ও স্পর্শ করেনি কিন্তু এরই মধ্যে গরম হাওয়া এসে ছোবল বসাচ্ছে। পাটুলির সিগন্যালে বাসটা দাঁড়িয়ে আছে। জানলা দিয়ে দেখি দূরে বৈষ্ণবঘাটা ফায়ারব্রিগ্রেডের ফুটপাথে চা-ওয়ালা খদ্দেরের অভাবে ঢুলছে। এক পাল ছেলে- মেয়ে রাস্তা ক্রশ করছে। খুব সম্ভব কোন কোচিংসেন্টার থেকে ফিরছে, মুখে কারোর এক চিলতে হাসি আবার কারো কারো মুখ হাসিতে ভাসছে। তারা হৈহৈ করতে করতে আমার বাসেই উঠে পড়ল।
বাস এবার সবুজ সংকেত পেয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রত্যেকের হাতেই চলমান দূরভাষ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেলফি তুলছে। আবার কেউ কেউ গভীর আলোচনায় মগ্ন। আমি যেখনে বসে আছি তার থেকে খুব দূরে বসে নেই এরা। আলোচনার বিষয় কানে যেতেই বড্ড আবাক হলাম। পড়াশুনো নয়,বন্ধুবিচ্ছেদ নয়, ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচারে কটা লাইক আর কটাই বা কমেন্ট এটাই আলোচ্য বিষয়। হাইল্যান্ড পার্কে ছেলেমেয়েগুলো বাসের ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল আর এক মধ্য বয়স্ক দম্পতি আর তাদের কিশোরী কন্যা বাসে উঠল। বাসে মখোমুখি সিটে তাঁরা বসল। কেউ কারোর সঙ্গে কথা বললনা, যে যার মোবাইল নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেল। বৃহৎ বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে আমরা সম্পর্কের গাছগুলোতে জল দিতেই ভুলে যাচ্ছি। আমরা অধিকাংশ মানুষ এক নাম না জানা ওয়েটিং রুমে বসে কিন্তু কিসের প্রতীক্ষায় কেউ জানিনা। সেখানে এক মাকড়শা সম্পর্কের জাল বুনে চলেছে।আমি হয়ত অন্য দেশের কোন মানুষের সঙ্গে কথা বলছি, সেই মানুষটা আমার সঙ্গে , আবার আমার “কাছের মানুষ” আবার অন্য কারোর সঙ্গে। এই ভাবে এক অদৃশ্য জাল বনা চলছে আর মনের ঘরে ঝুল বাসা বাঁধছে।
মুকুন্দপুরে এক বৃদ্ধ দম্পতি বাসে আমার সহযাত্রী হলেন। একজন আমার পাশে বসছেন আর আরেকজন পিছনের সিটে । খুব আসতে তাঁরা কথা বলছেন। শুনে যেটুকু বুঝলাম, ভদ্রমহিলার চোখে অপারেশন করতে হবে। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার জন্য চিন্তিত আর ভদ্রমহিলা চিন্তিত পেনশন আর ব্যাংকের সুদের নাম মাত্র টাকা থেকে আবার তাঁর অপারেশন হবে বলে । বাস সিগন্যালে দাঁড়িয়ে । কারোর মোবাইল বেজে চলেছে।এক কাঁচাপাকা চুল –ওয়ালা ভদ্রলোক কথা বলছেন “ হ্যাঁ হ্যাঁ রক্তের জোগার হয়ে যাবে। এক্ষুনি আমি ফেসবুক আর whats app এ আমার সব গ্রুপে জানাচ্ছি । ঠিক ব্যবস্থা হবে ।” আমি মনে মনে ভাবলাম যে কোন দিকের একটা ভালো আর একটা খারাপ দিক থাকে। কাকে আমরা গ্রহণ করব সেটা আমদের উপর নির্ভর করছে।
সুচিন্তিত মতামত দিন