ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

তিস্তা
বিজনেস স্কুলের সমাবর্তন অনুষ্ঠান । অডিটোরিয়ামে সাদায়-কলোয় রেশমী গাউনে আউটগোয়িং ম্যানেজমেন্ট স্টুডেন্টদের লাইন । একে একে তারা জনা পঞ্চাশেক ছাত্রছাত্রী আসন গ্রহণ করল। প্রধান অতিথি, ডিন সকলের গরম গরম বক্তৃতায় সরগরম প্রেক্ষাগৃহ। ফাইনাল ইয়ারে এবছর সকলের প্লেসমেন্ট পর্ব মোটামুটি শেষ মাস খানেক আগেই। ছেলেমেয়েগুলোর চোখেমুখে বেশ প্রশান্তির ছাপ। দু'বছর ধরে অনলাইন এসাইনমেন্ট, গ্রুপ ডিসকাশন, কেস স্টাডি নিয়ে কত চাপ ছিল তাদের ! সবকিছুর পর্ব আপাততঃ শেষ। রেজিষ্টার থেকে নাম ডাকার সময় দুটি ছেলেমেয়েকে দেখতে পেলনা কেউ। গতকাল ফোনে কন্ট্যাক্ট করা হয়েছিল কিন্তু তারা এসে পৌঁছায়নি।

তিস্তা রায় আর অনুপ ভরদ্বাজ চাকরী পায়নি এখনো। চিন্তায় আছেন ইন্সটিট্যুটের সকলেই। এসোসিয়েট ডিন অহোরাত্র কোম্পানিদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছেন এই দুটি ছেলেমেয়েকে প্লেস করার জন্য। কিন্তু এরা এত‌ই অল্প কথাবার্তা বলে আর এদের গ্রেড ও ফাইনালে গিয়ে বড়‌ই কম অতএব সেযাত্রায় সেবছরে চাকরী তাদের অধরা । তিস্তার বাবা বলেছেন কি হবে আর চাকরী না পেলে? কিন্তু তিস্তার মনে খচখচানি থেকেই যায়। বাবা পড়িয়েছে এমবিএ। মেয়ে ভালো চাকরী পাবে এই আশায় । হঠাত ক্যাম্পাস, হস্টেল জীবনযাত্রা আর সোশ্যালনেটে রাতযাপন, পড়াশুনোয় অনেকটা ঢিলেঢালা হয়ে গেছে তার এ দুবছর। এখন আফশোসের শেষ নেই। বন্ধুদের একে একে এমএনসি গুলোতে চাকরী হয়ে যাবার পর তিস্তার মনখারাপের বাঁধন লাগাম ছেড়ে দিয়েছে। অনুপের বাবার নিজের ব্যাবসা । অনুপের জন্য সবসময় খোলা কিন্তু তিস্তার কি হবে ? তিস্তার প্রাণের ক্যাম্পাস বন্ধুরা অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আসতে বলেছিল কিন্তু তিস্তা নারাজ। গাউন পরে, সেজেগুজে যে জন্য অভিজ্ঞান পত্র হাতে নেওয়া, যে জন্য পাঁচ-ছ' লাখ টাকা খরচা করে বাবা পড়ার সুযোগ দিল সেই সুযোগের সদ্ব্যাবহার সে করতে পারলনা।

আগের দিন রাত থেকেই সোশ্যালনেটে তিস্তার সাথে কোনো যোগাযোগ ছিলনা কারোর । মোবাইল বন্ধ । অনুপ সেই দেখে ভেবেছিল সেও যাবেনা ঐ কনভোকেশনে। পরে সার্টিফিকেটটা কখনো তিস্তার সাথে গিয়ে নিয়ে আসবে।

তিস্তা সকলের মাঝে, একরাশ আলোর ঝলকানির মাঝে দাঁড়াবেনা, কক্ষণো না। তিস্তা হেরে গিয়েছে। তিস্তার ঐ ডিগ্রিটা চাইনা। তার কাছে জীবন মূল্যহীন, ঐ ডিগ্রিটাও মূল্যহীন।

কলেজের বাগানে মস্ত এক আমগাছের নীচে দাঁড়িয়ে সকলে বাতানুকূল সমাবর্তন কক্ষে প্রবেশ করে গেছে দেখে নিয়েছিল তিস্তা। তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছিলনা। তিস্তাকে আপন খেয়ালে বয়ে যেতে হবেই। এই তো সুযোগ। এ সুযোগ সে হাতছাড়া কিছুতেই করবেনা। একতলায় ফ্যাকাল্টি লাউঞ্জ খালি। দোতলায় ক্লাসরুমে তালা। তিনতলায় কনভোকেশন সেরিমনি চলছে। পিনড্রপ সায়লেন্স । তিস্তা উঠে এল চারতলার ছাদে। সমাবর্তণের পর সকলে নীচে এসে হস্টেল বিল্ডিং পেরিয়ে মেসের দিকে চলল নৈশাহারের জন্য। এলাহী আয়োজন ছাত্রছাত্রী আর ফ্যাকাল্টি, স্টাফেদের জন্য। মেস থেকে সব সুখাদ্য আসবে মাঠের ওপর। ব্যুফে সাজানো টেবিলের ওপর। স্পিরিট ল্যাম্পের তিরতিরে আলোর ওপর রকমারি ধাতব পাত্র। পাশে কাঁচের গ্লাস, প্লেট..

অন্ধকার ছাদের আলসের ধারে দাঁড়িয়ে তিস্তা দেখছে নীচের আলো, আকাশের গায়ে ভেসে চলা ফানুসের রকমারী আলো। হঠাত তার মনে হল, এত রঙীন পৃথিবী, এত সুন্দর জগত..আর সে কিনা নিজেকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে চাইছে? বাবা বলতেন, বি পজিটিভ। তোর না ব্লাড গ্রুপ বি পজিটিভ । সবসময় ভাল ভাববি, দেখবি সুফল মিলবেই। কিন্তু নাহ! তিস্তার মন মানছে না তা।

তার বন্ধুরা সব জড়ো হয়েছে । আচমকা বিশাল শব্দ। সকলে এধার ওধার তাকায়...হৈ হৈ শুনতে পায়। ওদের কলেজ ক্যাম্পাসে প্রচুর গাছ। ডাব পড়েছে কয়েকটা। তাও আবার আচমকা, ঐ গার্ডেন পার্টির আনাচেকানাচেই। কারো কোনো ক্ষতি হয়নি, এই যা। তিস্তার মনের ভেতরের হাহাকার সেই পতনের শব্দে ভেঙেচুরে শেষ ততক্ষণে। জীবন তো একটাই তিস্তা! দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি...অনুপ বলে এখনো। নাই বা হল এবার চাকরী।

গুচ্ছের রঙীন চাইনিজ ফানুস উড়ছে গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে। হাওয়ার অনুকূলে বেলুন রা একে একে ঠিক পৌঁছে যাবে আলোকবর্তিকা হয়ে। কত পজিটিভ বার্তা বয়ে নিয়ে যাবে হয়ত কারো ঘরে, কারো মনের গভীরে।

ডিনারের ঘোষণা শুরু হল ফানুস উড়িয়ে । একে একে ক্রিমসন, পার্পল, ফিরোজা, ইন্ডিগো ব্লু উড়ে চলে গেল কলেজ ক্যাম্পাসের আকাশ থেকে ...উল্লসিত স্টুডেনটরা!




টুং টাং! হঠাত এসোসিয়েট ডিনের কাছে এক মেসেজ এল। তিস্তা প্লেসড হয়েছে এক কোম্পানিতে। স্যার খুউব খুশি।

আর তিস্তা ততক্ষণে ছাদের অন্ধকার থেকে নেমে এসেছে মনের অনেকটা জোর নিয়ে। বন্ধুদের সাথে, স্যারেদের সাথে ডিনার খাবে বলে। বি পজিটিভ তিস্তা! জীবন মানে হেরে যাওয়া নয়। চোখদুটো তার ভেজা ছিল। সে তো হতেই পারে। সে যে তিস্তা। তার বহমানতা কে না জানে?



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন