শুক্লা মালাকার

 ভুলে যাওয়া কবিতা
পুজো পুজো গন্ধ কলকাতার বাতাস থেকে এবছরের মতো বিদায় নিয়েছে। আস্তে আস্তে রাস্তার বড়ো বড়ো হোর্ডিং, ল্যাম্পপোস্টের গায়ে মেলা মেলা গন্ধ মাখা জামা চড়ছে। গত বছর এসময় দীর্ঘ আটমাসের অক্লাত ঘোরাঘুরির পরও সিলিং ফ্যানগুলোর অবসর ছিল না। এবছর সেরকমটা নয়। শীতের আমেজ অল্প সল্প ঢেউ খেলছে। কাজের চাপ প্রচুর। অথচ আমি আজ হঠাৎ কেমন বিষাদ সাম্রাজ্য হয়ে আছি। নিরর্থ লাগছে আমার বেঁচে থাকা। 

মাঠাবুরুর রেস্ট হাউসে রক-ক্লাইম্বিং প্র্যাকটিস সেশনে নিয়ে গিয়েছিল আরোহী ক্লাব। আমি তখন সদ্য রক-ক্লাইম্বার, উত্তেজনায় ফেটে পড়ছি। গোটা ষোল-সতের ছেলেপুলের সঙ্গে হইহই করে গিয়ে পড়েছিলাম পুরুলিয়ার জঙ্গলে। মাঠা বুরু, পাখি পাহাড় চষে ফিরছি। বেঁটেমতো একটা লোক একমুখ গোঁফদাড়ি, বিড়ি আর বিড়বিড় করা দুটো ঠোঁট নিয়ে আমাদের সঙ্গে জুড়ে গেল। বোটকা গন্ধ মাখা বিশাল এক চাদর জড়িয়ে চলন্ত এক উদাসীনতা পিছু পিছু ঘুরছে দেখে প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি! কিছুঘন্টার মধ্যেই আবিস্কার করলাম ওর ঠোঁটদুটো কবিতার মতো কিছু বলছে। এ অঞ্চলে থাকে যখন অজানা সাঁওতালি ভাষাতেই বলছে। শব্দ-অর্থ কিছুই বুঝছি না তবুও, অচেনা এক ভালোলাগার মোহনজাল ছড়িয়ে পড়ল মনে। তখন থেকে আমিই সেঁটে গেলাম ওর সঙ্গে। রক-ক্লাইম্বিং মাথায় উঠলো। 

দুয়ারসিনি, খয়রাবাধ, পলাশের জঙ্গল- টীম দৌড়চ্ছে সঙ্গে আমি আর সে। টীমগেম ছেড়ে আমি খুঁজে চলেছি তার অজানা ইতিহাস। ঘুরে ঘুরে সাঁওতাল গ্রামে গিয়ে মহুয়ার হাঁড়ি আর কুল নিয়ে ব্যস্ত দলের থেকে দূরে আমি শুনেছি তার কবিতার ইতিহাস। হাইস্কুলে পড়তে গিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের এক মেয়েকে ভালোবেসেছিল। বাড়ির লোক মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দেয়। শশুড় বাড়ি যাবার পথে এই লোক রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল ভালোবাসার মানুষটিকে শেষবারের মতো দেখবে বলে। তাঁকে দেখে মেয়েটি দৌড়ে কাছে আসে। বুকে জড়িয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ধুতুরার বিষ খেয়ে বেরিয়েছিল সে। তারপর থেকেই এই মানুষ এমন হয়ে আছে। অল্প বয়স থেকেই গান বাঁধতে পারতো। সেই থেকে তার গান রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়েছে। ওই ভাবে বিড়বিড় করে কত গান সে বেঁধেছে। গানের দলের লোক তাঁকে বসিয়ে সেই গান শুনেছে, পালা তে কাজে লাগিয়েছে। এভাবেই তার কবিতা লোকের মুখে আর সে পাহাড় জঙ্গলের চলন্ত বিষাদ।

রাতটা পূর্নিমার। মাঠা টপে বসে দেখছি দূরের সাঁওতাল গ্রামের টিমটিমে হাতছানি। অচেনা সুরে কোথাও মাদল বাজছে, সঙ্গে রিনিরিনি এক সুর। চরাচর জুড়ে ঝরে পরা চাঁদের আলোতে অদ্ভুত বুনো গন্ধ। একহাত দূরে হাঁটু মুড়ে বসে বিড়ি ফুঁকছে চাদর জড়ানো ভালোবাসার কবিতা। আজই এখানে আমাদের শেষ রাত। কি যে হল! হাত বাড়িয়ে চাদরের ঢিপি থেকে হাত টেনে নিলাম। আমার সমস্ত কাব্যিক উষ্ণতা বাহিত আবেগ দিয়ে ভরে দিতে চাইলাম ওই সর্বাঙ্গ মুক্ত পুরুষের মন। থরথর করে কেঁপে গেল শরীর, তারপর ঠোঁট- অদ্ভুত ভাষায় কবিতা ঝরে পড়ল। আমার মাতৃভাষায় পড়া বিখ্যাত কবিদের কবিতারা হার মেনে পালিয়ে গেল পাখি পাহাড়ের দিকে। বন্ধনহীন জ্যোৎস্নায় উন্মুক্ত আকাশের নীচে এরপর শুধুই কবিতা, একটার পর একটা, বিড়বিড় করে নয়- সুস্পষ্ট উচ্চারণে, মিঠে সুরে। অজানা অচেনা দুই নারী পুরুষের যূথবদ্ধ হাত। একটি পরিস্কার পরিশীলিত নাগরিক- অন্যটি মেঠো দূর্গন্ধযুক্ত চরম বুনো। প্রথম প্রহর পেরিয়ে রাত চতুর্থ প্রহরে গিয়ে নতুন দিনের হাতে নিজেকে সঁপে দিতে দিতে বলে গেল আর নয় এবার যেতে হবে। 

ফিরে এলাম একরাশ বিষাদ নিয়ে। কিছুতেই কজে মন বসাতে পারিনা। একজন মানুষের ভালোবাসা, তার কাব্যকে কতখানি ধনী করতে পারে দেখে এসেছি। চোখের সামনে শান্ত দুই চোখ আর বিড়বিড়ে ঠোঁট ছাড়া কিছুই আসে না। বহুবার পথচলতি ভালোলাগা আমাকে সিক্ত করেছে। এতদিন আমার লেখায় সেই ভালোলাগা উজার করে দিয়েছি। এবার আমি পুরোপুরি ঘেঁটে গেছি। আমার মতো চূড়ান্ত শহুরে নারী এক পাগলের জন্য এতখানি বিচলিত হতে পারি কক্ষনো ভাবি নি। মন ছুটে যেতে চাইছে সেই পাহাড়ে, জঙ্গলে, ঝরে পড়া কবিতাদের উৎসস্থলকে আরো একবার দেখতে। 

সময় সব আকুলতার উপশম। মাসখানেকের মধ্যে ধাতস্থ হলাম। আবার শহুরে জীবনে মিশে গেলাম। অনেকদিন অব্দি সেই ভালোলাগা রেশ বুকে নিয়ে ছিলাম। তারপর নতুন ভালোলাগা, নতুন কবিতাদের ভীড়ে মাঠাবুরুর সেই রাত জীবন ইতিহাসের গভীরে তলিয়ে গেল। আজ ফেসবুকের নিউজফিডে সাঁওতালি এক কবির কবিতা সংকলন নিয়ে আলোচনা করেছেন বিশিষ্ট কবিসম্প্রদায়। মৃত সেই কবির সঙ্গে দীর্ঘদিন ঘুরে ঘুরে অন্য এক কবিবন্ধু নথিভুক্ত করেছেন সব কবিতা। বাংলাভাষায় অনুবাদ করেছেন। 

অপরাধবোধের চাপে সকাল-দুপুর গড়িয়ে গেল। এই সেই কবি যার জন্য আমি আমার জীবনের অনেকগুলো উত্তালদিন কাটিয়েছি। অথচ তার কাছে গিয়ে তার কবিতা সংগ্রহ করিনি। আমার কাছে সে তার কবিতা উজাড় করে দিয়েছিল আমি তা ধরে রাখিনি। আমার মাতৃভাষার বাইরে অন্যভাষার কবিতার মানে খুঁজে দেখিনি। শুধুই ছেলেমানুষের মতো ভালোলাগার ফ্যন্টাসি নিয়ে উথালপাথাল করেছি। 

এখন বিকেল। চেষ্টা চরিত্র করে কবিতা সংকলনটির স্ক্যান কপি জোগাড় করেছি। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ল্যাপটপ খুলে সেটা নিয়ে পড়া শুরু করলাম। প্রথমেই হোঁচট খেলাম। কবির নির্দেশে সংকলনটি উৎসর্গ করা হয়েছে সেই নারীকে, যার হাতধরে একটা গোটা চাঁদ-রাত কবি কাটিয়েছেন মাঠাবুরুর মাথায়, যার কাব্যিক আকুলতা অজস্র কবিতা ভুমিষ্ট করেছে ঝরা পলাশের বনে। 

ধ্বসে গেলাম আবার। আমার কাব্যিক ভালোবাসার মৃত্যু হল এখুনি...। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন