বন্ধুত্ত শুরু হয়েছিল নিজেদের ইচ্ছেতে কিন্তু প্রেম এসেছিল অজান্তে। দুজনেই বুঝতে পারিনি তার আসা। বুঝলাম তখন যখন মন চাইত সবসময় দুজন দুজনকে কাছে পেতে। আমরা রোজ তো দেখা করতে পারতাম না কারন আমাদের পড়াশোনার ব্যাস্ততার মাঝে সময় কমই পেতাম। এইভাবেই প্রায় বছর দুই পার করলাম। তারপর চাকরি পাবার পর আমাদের বিয়ে হল। বিয়ের একটাই শর্ত ছিল তোমার-- পূর্ণিমার রাত। বাসরে সবাইকে রেখে আমরা দুজন ছাদে চলে এসেছিলাম। সবাই বলেছিল, ‘কি নির্লজ্য এরা’। তারপর তোমার ইচ্ছে অনুসারেই আগ্রা গিয়েছিলাম হনিমুনে। শা-জাহান কে বলেছিলে, ‘আমরাও তোমার মতোন এক প্রেমের মহল বানাব তবে বাইরে নয় আমাদের মনের মাঝে’। লেখা তুমি সত্যিই প্রেমের ঘর বানিয়েছিলে। খুশি আর আনন্দ ঘরের প্রতিটা কোনেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকত। চলা ফেরার মাঝেই জড়িয়ে ধরতো আমাদের। দিন কাটছিল আনন্দে। কিন্তু সুখ যে ক্ষনস্থাই।
কিছুদিন পর থেকেই তোমায় কেমন অন্যমনস্ক দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল কিছু যেন তুমি লুকোতে চাইছ। তোমায় জিজ্ঞেস করেও সদুত্তর পাইনি। তাই আমার মনেও বেড়ে চলল কৌতুহল। আমি তিনদিন ছুটি নিলাম অফিস থেকে আর তোমায় বললাম অফিসের কাজে যাচ্ছি। দুপুরে দেখলাম একটি ছেলে আমাদের বাড়ি এলো আর বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েই তোমরা বসেছিলে। অটো করে তোমাদের বার হতেও দেখলাম। একদিনতো দেখলাম ওকে জড়িয়ে তোমার কান্না। সেই রাত্রেই ফিরলাম আমি। জানতে চাইলাম ছেলেটা কে? তুমি পুরোটাই অস্বিকার করে আমার সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিলে। আমি রাগে জ্বলতে থাকলাম। নানা কুচিন্তা মাথাটাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত এক রাতে দুহাতে চেপে ধরলাম তোমার গলা। তুমি প্রথমে ভেবেছিলে আদর পরে অবাক হয়ে ঠিকরে বেড়িয়ে এসেছিল তোমার আশ্চর্য্যে ভরা দুটো চোখ। অর্থবল আর লোকবলে আজকালকার দুনিয়ায় সব অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেয়। তাই কোনো ঝামেলায় পড়তে হলনা আমায় তোমার প্রাণ শুন্য দেহটা নিয়ে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই দুটো ব্যাগ তৈরী করে ফেললাম বাইরে যাব বলে। যাবার ঠিক আগের দিন সেই ছেলেটি এসে দাঁড়াল। দেখেই মাথাটা টং করে জ্বলে উঠল।
‘দিদির কিছু চিঠি’ বলে চিঠির খামটা আমার হাতে দিয়েই সে বেড়িয়ে গেল। প্রথমে নিজের কানকে বিশ্বাস করলাম না তাই দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে জিজ্ঞেস করলাম ‘কে তোমার দিদি’?
চোখের জল মুছে সে বলল, ‘আপনি জানেন না লেখাদি আমার মামাতো দিদি! আমি পুরো ভালো হয়ে উঠলে তবেই দিদি আপনাকে জানাতো। তাইতো এই চিঠিগুলোতে সব লিখেছিল আমার সম্বন্ধে। আমি খুব বাজে হয়ে গিয়েছিলাম, সবাই যখন আমাকে দুরে সরিয়ে দিয়েছিল তখন একমাত্র দিদিই আমায় কোলে টেনে নিয়েছিল। আমার অনুরোধেই দিদি আপনাকে কিছু জানায়নি। আজ আমি ভালো হয়ে কি লাভ হল, দিদিতো নেই’। বলেই চোখের জল মুছতে মুছতে সে চলে গেল আমার বুকে হাজারটা ছুরি চালিয়ে।
লেখা আমি তখন চুপ, হ্যা একদম চুপ করে শুধুই তোমায় একটু ধরতে চাইছি। অনেক চেষ্টা করেও যখন পারলামনা তোমায় ধরতে তখন চিৎকার করে বলতে চাইলাম ‘আমি খুনি আমায় ফাঁসি দাও’। তাও বলতে পারলামনা। আমার গলার আওয়াজ শেষ, আমি কিছুই বলতে পারলামনা। আকুল কান্নায় মাথা ঠুকে মৃত্যু চাইলাম তাও পেলাম না। তারপর মেনে নিলাম নিজের প্রায়শ্চিত্তের পথ। অনেক কষ্ট সয়ে এতোগুলো বছর একলা পার করেছি। কথা তো বলতে পারতামনা তাই তোমায় চিঠি লিখতাম, অনেক চিঠি। আমি চাই চিঠি গুলো প্রকাশিত হোক খবরের সাথে। সবাই জানুক সন্দেহ মানুষের জীবনকে কোন পথে নিয়ে যায়।
লেখা আজ এতোদিন পরে হয়তো আমার পাপ শেষ হয়েছে। ওপারের ডাক শুনতে পাচ্ছি। জানলা দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ ছড়িয়ে দিয়েছে জোৎস্না ঘরের মধ্যে। হয়তো আজকের এই চিঠিই শেষ চিঠি। আমাকে নিতে পারবে কি আগের মতোন? আমি আসছি, আসছি তোমার কাছে লেখা।
ইতি বিমান