নাসির ওয়াদেন / ঈশ্বরের ছায়া, পোষা মৃতদেহ

ছায়াময় ঐশ্বরিক চিন্তা ভাবনার ভেতর জান্তব দেহে মননশীলতা ও মননবোধের অপমৃত্যুতে বেদনা সিক্ত চেতনার বহিঃপ্রকাশ
ছায়াময় ঐশ্বরিক চিন্তা ভাবনার ভেতর জান্তব দেহে মননশীলতা ও মননবোধের অপমৃত্যুতে বেদনা সিক্ত চেতনার বহিঃপ্রকাশ 
কবিতা রূপে ও আঙ্গিকে যা হোক না কেন, শব্দ ব্রহ্ম কি ব্রহ্মহীন তার বিশ্লেষণ করা নয় --একবিংশ শতকের প্রথম দশকের কবিতা নিয়ে কিছু কথা বলতে গিয়ে বলা যেতে পারে যে, কবিতা ছন্নছাড়া মেঘের মতো নীলিমায় ভাসমান । বিশ্ব শতকের তিরিশের দশক থেকে যে আধুনিক কবিতার পথ চলা তার ক্রমশ বিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, এপার বাংলা ওপার বাংলার যশস্বী কবিদের লেখার ভেতর দিয়ে বিষাদের মাঝে আলোর স্পর্শ অনুভূত হচ্ছে । আশির দশকের পর থেকে কবিতায় যে পরাবাস্তববাদের রমরমা দেখি, তার পূর্বে ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলনের সময়ে স্লাম ল্যাংগুয়েজ সাহিত্যে অনুপ্রবেশ ঘটে । যা নিয়ে মোকদ্দমাও হয়। সত্তরের দশকের শ্রুতি আন্দোলনের ভেতর দিয়ে কবিতার মনস্তাত্বিক দিকের বিস্তার ঘটে। এ যুগের কবিদের মধ্যে যে কবিতা রচনার প্রয়াস দেখি, তার মধ্যে নতুনতর কিছু কথা. কিছু বাঙ্ময় শব্দ, চমৎকারিত্ব বাক্য বিন্যাস ব্যতীত নতুন কিছু পাচ্ছি না । নামী দামী কাগজের মধ্যেও অকবিতা যে থাকছে না তা হলফ করে বলা যায়। হয়ত এর মধ্যে লবি কিংবা তৈলমর্দন যে থাকে তা নিশ্চিত । যাক্ ওসব আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে পরে না । এ প্রসঙ্গে আমার হাতে আসা দু'খানি কাব্য গ্রন্থের ওপর ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছি ।

ঈশ্বরের ছায়াএই দু জন কবি আমার পরিচিত । এঁরা গাঁটের কড়ি খরচ করে বই প্রকাশ করেছেন ।এঁদের বাহবা দেওয়া উচিত । কাব্যপ্রেমী হিসেবে, কবিতাকে ভালবেসে, কাব্যরসে সিক্ত হয়ে স্বল্প চিন্তা ধারণার বশবর্তী হয়ে আমার অনিমেষ মনে, হৃদয় আকাশে যে ছেঁড়া ফাটা বিনয়ী কিরণ উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে তাই লিখতে চাই ।"ঈশ্বরের ছায়া "র কবি অনিমেষ মণ্ডল --একজন তরুণ প্রতিভাবান কবি, পেশায় বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও বাংলা সাহিত্যে অনুরাগ প্রীতি মুগ্ধ করে ।কয়েকটা কবিতার বই বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ।সম্প্রতি "দৌড় " পত্রিকার পক্ষ হতে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ।এক আলাপচারিতার সময়ে কবি এই কাব্য গ্রন্থের নামকরণ নিয়ে আলোচনা করছিলেন ।তিনি জানান যে, ফেবুতে জনৈক কবি মায়াময় ঈশ্বরের ছায়া খুঁজে পেলেন না ।কবি তাঁর গ্রন্থের নামকরণের বিষয়ে নিশ্চিত যে, ঈশ্বরের ছায়া বলতে ছায়ার ভেতর মগ্নচৈতন্য রূপ কল্পনার কথা বলেছেন । " বিভিন্ন মেঘের মতো ঈশ্বর নেমে আসেন মাটিতে -"কথার মধ্যে প্রাকৃতিক প্রতিবিম্ব তুলিত ও ধ্বনিত করে তুলতে চেয়েছেন ।জীবন ও ঈশ্বরের সান্নিধ্য কবিতার মেলবন্ধনে সমাপন করতে চান । "দলছুট পাখির মতো পড়ে আছে হারানো দুপুর -" ধ্বনির দ্বারা কর্মব্যস্ত জীবনের একাকীত্ব ও মুখ থুবড়ে পরে নৈরাশ্যের মগ্নতার চিত্র অঙ্কিত করতে চেয়েছেন ।আবার "জোৎস্নার চাঁদ ভেঙে যায় "অথবা " কিছু কুয়াশা /এখনো রয়েছে শরীরে ।" মনের অস্পষ্টতা তাঁর সংস্কারের জাড্যকে ভেঙে বা অতিক্রম করে উঠতে পারছে না ।জীবন চেতনার মধ্যে কবির মনজগতে বিরাজ করছে হতাশা ও অতৃপ্তি। চিত্রকল্পধর্মিতা তার কবিতার অন্য রূপ --তাই কবি উৎফুল্ল হয়ে পড়েন "ঘাসের কিনারা ছুঁয়ে জেগে আছে শিশির বিন্দু "দেখে ।বিভিন্ন কথার মধ্যে আগামীদিনের সভ্যতার আলো দেখতে চান এবং সেই সাথে জাগতিক স্পৃহা দূর করে মনের ভেতরে জেগে ওঠে অবিনশ্বরতা। "পাখিরা ঠোঁটে করে গড়িয়ে দিচ্ছে সকাল "--কে ফিরে পাওয়ার অদম্য ইচ্ছা ।আশাবাদী কবি সাংসারিক জ্বালা, যন্ত্রণা, মায়াবী কান্নার ভেতর স্বল্পালোক ছড়িয়ে আবছা অন্ধকারে ছায়াময় শরীরে ঈশ্বরের আকাশ খুঁজে পেয়েছেন ।বিষাদে ভরা পৃথিবী এখন " শিয়রে অপেক্ষা করে মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি -" তার সুর শুনতে পাচ্ছেন ।হয়ত এরই মধ্যে মনলোকে দ্যোতনা বিম্বিত হবে ঈশ্বরের ছায়ার বিপরীতে ।

পোষা মৃতদেহ
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কবি দেবাশিস সাহার "পোষা মৃতদেহ "। মুর্শিদাবাদের মাটিতে বহরমপুরের জল হাওয়াতে বেড়ে ওঠা ও ব্যাঙ্কের কর্মব্যস্ততার মধ্যেও কাব্য সাধনা এক অন্য মাত্রা যোগ করে ।পাঠ প্রতিক্রিয়ার আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, কবির কবিতার ছত্রে ছত্রে মানবমনের ব্যথা, বেদনা, হতাশার কথা বলে চলেছেন । তাঁর কাব্য গ্রন্থের মধ্যেই ইঙ্গিতে বুঝে অসুবিধে নেই যে, মৃতপ্রায় জীবনে প্রেরণার উৎসস্থল কবিতা ।মৃতদেহ আগলে থাকার কাহিনী নতুন নয়, যারা এই কাজ করে তারা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ও প্রতিবন্ধী ।আমাদের জনজীবনের ক্ষেত্রে শব সাধনা, আত্মা নামক এক ধরনের অলৌকিক বস্তুর অনুসন্ধান নিতান্তই ব্যক্তিগত চিন্তা ভাবনার বিষয় ।দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে গিয়ে তিনি বলেন যে, "শহরের আঁচলে লেগে থাকা রক্ত "তাঁকে বিমর্ষ করে তোলে ।সেই বিষাদ থেকে উত্থিত ব্যথা, বেদনা মিশ্রিত "অভিমানগুলো শুকাইতে দেবো খোলা ছাদে "--বলে কান্না চেপে না রেখে "একটি বহিরাগত কান্না ঢুকে পড়েছে পোশাকে "--যার আশ্রয় থেকে নির্ভরশীল স্থান খুঁজে বের করতে চাইছেন এবং মনের গোপন অভিলাষ প্রতি ছত্রে ফুটে উঠেছে কবিতার শরীরে --" জল থেকে কুড়িয়ে নিচ্ছি তোমার গোপন ,"গোপনীয়তা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, তখনই পাথর হতে চেয়েছেন -"পাথর হলে /দুই পায়ের জানালায় ফোটাব ফুল "-বলে ফুল ফোটানোর ইচ্ছে প্রবল হলেও ফূল ফুটছে না, বসন্ত চলে গেছে জীবন থেকে, সেখানে খরার আধিক্য , ভেঙে পড়েছে ঋতুর সংসার --সেই ভাঙা সংসার জুড়ে দিতে চান তিনি -"ভালোবাসা দিয়ে সেলাই করো সংসার "।প্রচণ্ড  তাপ প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে জীবনে স্বস্তি নেই -তেমনি সমাজেরও বৃষ্টির অত্যন্ত প্রয়োজন -শান্তি বৃষ্টি, কিন্তু সেই বৃষ্টিও আটকে আছে জানালার ওপাশে ।কবি তাই "নদীর কান্না অনুবাদ করছে পাগল "বলে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন ।এ পাগলামি নিতান্তই মানসিক, ঐহিক চিন্তা চেতনার ঘাটতি আছেই মনের গভীরে ।জীবন দর্শনের নিগূঢ় রহস্যে মায়া মুকুরে   স্বচ্ছ ধ্যান ধারণার বিকাশ ঘটানোর বিস্তৃত সুযোগ আছে তার, তাঁকে সেই পথে অগ্রসর হওয়া জরুরি সেই বোধ থেকে স্বল্প পরিসরে পাঠ প্রতিক্রিয়া উপস্থাপন "কবিতা না বুঝে ওঠা কিংবা বুঝতে না পারার "ভেতর দিয়ে কবিতার মনস্তাত্বিক ও দার্শনিক তত্ত্বের ব্যাখ্যাত করে বলতে পারি যে, কবিদের আরও বেশি বেশি যত্নবান হওয়া উচিত ।আশাবাদী কবিকুলের প্রতি বিনম্র আবেদন তাঁদের কাব্য সন্তান যেন সুকুমার ও সুস্বাস্থের অধিকারী হয় । "বৃষ্টির গান স্রোতে অভিমান ডেকে আনে সুবাতাস ।" কবির শূন্য মনে শব্দের ব্যবহারে চিত্রকল্পের সমন্বয়ে কবিতার অবয়ব গঠিত হোক । Theory of nothingness means it involves not particularly but everything. কবির বোধে states of nothingness না হলে কবিতার বুনন বা তন্তু সমবায় ঘটে না ।


পাঠ প্রতিক্রিয়া
 নাসির ওয়াদেন 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন