মুকুল বসু

মুকুল বসু
তিনি বলতেন, ঠিক অর্থে আমি কিন্ত লেখক নই। মাঝে মাঝে কেউ লিখতে বললে লিখি। বলতেন, তবে রোজই এক যন্ত্রণায় জ্বলি, পুড়তে থাকি। এই যন্ত্রণাটা পরিবেশের সাথে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে। জননী যন্ত্রণা। একটা বজ্রমুখর আলোড়নের পরিণতি। বড়ো যন্ত্রণাদায়ক। তাই লেখার জন্ম হলে আমি কোনদিন তা কখনো পড়ি না। কিন্ত তার আগে সুন্দরের নিয়ম মানি। কবিতাকে কবিতা করতে চাই, পোস্টার নয়।রচনাকে সাজাতে চাই আভরনে। আমাদের যন্ত্রণা যেন সঞ্চারিত হয়। সকল মনের আকাশেই একটা স্বর্গলোক থাকে, যা জীবনের সাথে মেলে না! আপোষ করতে করতে আমরা ধূপের মতো একসময় শেষ হয়ে যাই। অথচ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বপ্ন জমে থাকে। এই স্বপ্নই বুঝি আশা। কাঁদতে কাঁদতে সেই আশাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরি। অন্যকে হাত ধরতে বলি। 

এই তিনি'ই তাই বলতে পারেন - আমি আনন্দের জন্য লিখিনা, যন্ত্রণায় লিখি। তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ রচনায় লিটল্‌ ম্যাগাজিনের জগতে স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বর পরিচয় বহন করে। সামগ্রিক জীবনবোধ মানবচেতনার অখন্ড প্রবাহে ব্যষ্টি ও সমষ্টির সংহতিতে যে বিশ্ববোধ, তাঁর লেখা তার সহজ সততায় উত্তীর্ণ। 

যার লেখা কবিতা প্রবন্ধে মানুষের রিক্ত জীবনের ব্যর্থতার মধ্যে চিরন্তন মঙ্গলের কথা প্রত্যয়ের সঙ্গে বার বার উচ্চারিত হয়েছে, এই তিনিই মুকুল বসু।  জন্ম ১১ বৈশাখ ১৩৪২, পাবনা, রতনগঞ্জ, বাংলাদেশ । ১৯৪৮ এ ভারতে চলে আসেন । দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের স্মৃতি বিজড়িত আত্রেয়ী নদীর ধারেই গড়ে ওঠে তাঁর বসত বাড়ি। এখান থেকেই তাঁর পড়াশুনা, বেড়ে ওঠা ।  ছাত্রাবস্থা থেকেই সরাসরি রাজনীতিতে। সমাজতন্ত্রের আদর্শে  পি এস ইউ থেকে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলে ( আর এস পি )  । প্রায় ১০ বছর জেলা সম্পাদক। ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সদস্য । স্কুল জীবন থেকেই লেখা লেখি শুরু । হাতে লেখা পত্রিকা ' ছাত্র ' সম্পাদনা, ' অন্যদিন ' পাক্ষিক পত্রিকা পরে ' প্রতিলিপি ' সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য । লেখক সমবায় - এর মুখপত্র ' কিছুকথা'র সম্পাদক । 

১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা শহর বালুরঘাটের ললিতমোহন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন । সাহিত্য, সমাজসেবার পাশাপাশি ছাত্র দরদী শিক্ষক হিসেবে জেলায় তুমুল জনপ্রিয় । নতুন লেখকদের তিনি ছিলেন আশ্রয়স্থল এবং অভিভাবক । প্রকাশিত তাঁর প্রথম গ্রন্থ ''মুকুল বসুর সাহিত্য সংগ্রহ'' । কাব্যগ্রন্থ জবানবন্দী, শেফালিকা চন্দনের দেশ, মিছিলের মাঝপথে।

নিরহঙ্কারী, বন্ধুবৎসল, সাহিত্যপ্রাণ এই মানুষটি  খুব সহজ বোধে, সহজ বাক্যে তাই লিখতে পারেন । - 

 চলে যাচ্ছি 
বেদনার মালা রাস্তায় ছড়িয়ে 
চলে যাচ্ছি, 
ঘৃণার দরজা টলমল করে 
চলে যাচ্ছি ।
লেনিনের ছবি 
রবি ঠাকুরের গান 
চলে যাচ্ছি, 
তুলসীমঞ্চে সাঁঝের প্রদীপ 
চলে যাচ্ছি ।

ভালোবাসারে ! 
নিরালায় বসে কাঁদো ।

শীতের পূর্ণিমার মতো 
চলে যাচ্ছি ।


মানুষটি সত্যি'ই চলে গেলেন ঘুমের দেশে ( ৩রা মার্চ ২০১৭ ) । একাধারে সমাজকর্মী, রাজনৈতিক আন্দোলনের বীর সেনানী আবার আজীবনশিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সেবক! আদর্শ শিক্ষক থেকে প্রাবন্ধিক; কবি থেকে সমাজসেবী; কত বিভিন্ন পরিসরে তাহার অবাধ চলাচল আমাদের বিমোহিত করে। বিগত শতক থেকে এই অন্তর্জাল শতকের আধুনিক দিগদর্শনের নতুন যুগেও তিনি চির যৌবনেরদূত! এয়ুগের যৌবন বাউলও তার স্বরসঙ্গতির সহযাত্রী হতে পারে অন্তর সৌকর্যে । আর সেখানেই তিনি সকল কালেই স্থাপন করেছেন আপন আসন। খুব কম ব্যক্তিত্বই এই উৎকর্ষতায় উত্তীর্ণ হতে পারেন নিজনিজ জীবন সাধনায়! 

আমরা সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই, বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই  সেই সংগ্রামীসত্ত্বার অকুতোভয় বীর সেনানী শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক, আদর্শ শিক্ষক, অনুপ্রাণিত সমাজসেবক কে । 






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন