ঐশ্বর্য্য চ্যাটার্জি

পুরোনো বসন্ত।
এমিলি ম্যাথারস। কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কলোনি পার্ক স্ট্রিটের বাসিন্দা। মা বাঙালি। নামকরা গাইনোকলজিস্ট। বাবাকে দেখেনি কোনও দিন এমিলি। শুনেছে মা এফ আর সি এস করতে লন্ডন গিয়ে নাকি বাবার সাথে আলাপ।  রবার্ট ম্যাথারস এর সাথে লিভ ইন থাকত মা আয়ুশী ব্যানার্জি। তাদেরই লাভ চাইল্ড নাকি সে। পরে কেরিয়ার সূত্রে পারেনি তার মা সাংসারিক জীবন জড়িয়ে পড়তে, তাই ইন্ডিয়া ব্যাক করে আ ভেরি সাকসেসফুল ডক্টর হয়েছে। ভারতীয় সংস্কৃতি মানতে পারেনি কোনওদিনই সে। তাই মেয়ে কে বাবার স্বীকৃতি দিয়ে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কলোনির ফ্ল্যাটেই থাকে সে। 

ছোট বেলায় লা মার্টিনের স্টুডেন্ট এমিলি বাবা কে খুব মিস করত। পেরেন্ট টিচার মিটিং থেকে সব জায়গায় শুধু মা। তাও থাকত না সবসময়। গভর্নেস এর কাছে বড় হয়েছে। এখন অভ্যাস সেটা যদিও কলেজ এ পড়ছে। আর্টস এর স্টুডেন্ট। মা কোনোদিন চায়নি ডাক্তার হোক সে। নিজে চেয়েছিল লেখিকা হতে কিন্তু পারেনি। তাই মেয়েকে ছোট থেকেই আর্টসকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। বাংলা তার মায়ের ভাষা আর ইংরেজি তার পিতৃত্ব। দুইয়ের সংমিশ্রণে অসম্ভব লেখনী শক্তি তার। সেক্সপিয়ার থেকে জীবনানন্দের কম্বিনেশন আর লা মার্টস থেকে নন্দন চত্বর কোনওটাই অধরা নয় তার কাছে। মা চেয়েছিল ইংলিশ লিটরেচর এ সীমাবদ্ধ থাকুক সে, কিন্তু দুটো সাহিত্যেই মেয়ে মায়ের মুখ উজ্জ্বল বরাবরই করছে। ইংলিশ লেখায় এমিলি আর বাংলায় মিলি এই ছদ্মনামে ছোটোখাটো লেখিকা বললে তাকে খুব একটা ভুল হবে না। কিন্তু  জীবনের ঐ একটাই আক্ষেপ বাবা নেই তার যে। 

#
মায়ের টেবিলে একদিন পেন নিতে গিয়ে অজান্তেই একটা অনেক পুরোনো ডায়েরি পড়ে যায় টেবিল থেকে। মা প্রাইভেসি পছন্দ করে তাই মায়ের ঘরে খুব একটা ছোট থেকেই যেত না সে। কিন্তু সেদিন কালো পেনের রিফিল না থাকায় মায়ের ঘরে একবার যেতেই হল তাকে দরকারে। মায়ের টেবিলে পেন খুঁজতে গিয়ে এটা কি পেল সে।।।।। অসম্ভব।। 

কুড়ি বছর আগের কোন এক অজানা বসন্তের কথা লেখা তাতে - 

মেডিক্যাল কলেজের স্টুডেন্ট আয়ুশী আর সুহৃদ অন্যতম সেরা কলেজ কাপল। রঙিন স্বপ্নে বসন্ত ঘেরা জীবন তাদের। কিন্তু না স্থায়ী হয়নি সেটা। ভেঙে যায় কলেজ শেষের পর। আয়ুশীর অত্যাধিক উচ্ছাকাঙ্খা আর সুহৃদ এর সরল গ্রাম্য জীবনের সরল সমীকরণ ওদের জীবনকে এক হতে দেয়নি। মা চলে যায় বিদেশে আর সুহৃদ চলে যায় গ্রামে। সেটলড হয় কোনো এক গ্রামের মেয়ের সাথেই। মা লিভ ইন থাকে রবার্ট অর্থাৎ তার বাবার সাথে।

কয়েকটা পাতা লেখা পড়ে প্রতিটা লাইনে এটাই বুঝতে পারে এমিলি, রবার্ট তার বাবা হলেও মায়ের সব হৃদয় জুড়েই সুহৃদ। তাকে ভুলতেই যেন রবার্ট এর আগমন তার জীবনে।

হঠাৎ এতদিনে মায়ের ওপর জমা অভিমান কেমন যেন দুঃখে পরিণত হল তার কাছে। আচ্ছা কোথায় এখন সেই সুহৃদ আর রবার্ট অর্থাৎ তার বাবা সেই বা কোথায়?  ফেসবুকে অনেক সার্চের পর রবার্ট ম্যাথারস এর অস্তিত্ব পায় সে। ওয়াইফ চিল্ড্রেনস নিয়ে ভরা সংসার তার। না সেখানে এমিলি বা তার মায়ের কোনও অস্তিত্ব নেই। চোখ ফেটে জল চলে আসে তার। আর এই বাবার কথা এতকাল ভেবে কেঁদেছে সে?

আর সুহৃদ? মায়ের প্রাক্তন? কোথায় সে? ফেসবুকে পেল না তার অস্তিত্ব। কিন্তু আজ সে নাছোড়বান্দা সবটুকু জেনে থামবে। পরের দিন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের রেজিস্টার এর সাথে দেখা করতে গেল এমিলি। না খুব একটা সুরাহা হল না। কুড়ি বছর আগের রেজিস্টার নতুন করে খুঁজে পাওয়া এত সোজা নয়। তাহলে উপায়? আর পেলেই বা কি হবে, সুহৃদ তো ঘোরতর সংসারী এখন। এমিলির মা র জন্য তার মনে কেন জায়গা থাকবে এখনও আর তারই বা কি এসে যায় মায়ের প্রাক্তনকে নিয়ে। কিন্তু ডায়েরির পাতাগুলো থেকে এটা খুব ভালো বোঝা যায় কতটা ভালোবাসত তারা একে অপরকে। কিন্তু এখন আর কি। তাও যেন মন সায় দিচ্ছে না এমিলির। একবার দেখতেই হবে তাকে। আ্যংলো ইন্ডিয়ান যার অস্তিত্ব লন্ডন সে এই মানুষটিকে নিয়ে কেন এত চিন্তা করছে? উত্তর পেল না নিজেই। 

পরের দিন আবার রেজিস্টার এর কাছে গেল। না নাছোড়বান্দা সে ঠিকানা চাই তার। অনেক কষ্টে বেশ কিছু টাকা ঘুষ খেয়ে রেজিস্টার রাজি হল অত পুরোনো ফাইল খুঁজতে। অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল সেই ঠিকানা। শিলিগুড়ির এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা ছিল সুহৃদ। সেই ঠিকানাটা দেওয়া। 

বিশেষ এক কৌতুহল এ রওনা দিল শিলিগুড়ি সে তার বয়ফ্রেন্ড রিচার্ড এর সাথে। রিচার্ড আর্ট কলেজের প্রফেসর।সেও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। সবাই জানে সম্পর্কের কথা তাই আর কেউ আপত্তি করেনি। কিন্তু শিলিগুড়ি যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য ছিল অন্য সেটা বোধহয় জানত না কেউই। 

এক সপ্তাহ পর, 

হঠাৎই এক পার্টির আয়োজন করেছে এমিলি আর রিচার্ড। মা কে সেদিন কিছুতেই চেম্বার যেতে দিল না সে। একটু রেগে আছে ডা. আয়ুশী ব্যানার্জি। দিন দিন মেয়েটা বড্ড বেয়াদপ হয়ে উঠছে। দোষ দিয়ে লাভ নেই সে নিজে ও এই বয়সে যথেষ্ট উচ্ছৃঙ্খল ছিল। নিয়মের বাইরে যাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য ছিল তার আর তাই সুহৃদ কে পারেনি মানতে। দ্যট কাওয়ার্ড। এ কি এসব এতদিন পর কি ভাবছে সে। চমকে উঠল নিজেই। পার্টি বলল এমিলি কিন্তু কই কেউ তো আসেনি। 'এসব কি মজা আর ইউ জোকিং উইথ ইওর মম? ইউ নো আই হেট দ্যট।' চেঁচিয়ে বলে উঠল আয়ুশী।

'নো মম আম রিটার্নিজ ইউ সামথিং' ... 
এসব কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছে না আয়ুশী। 

'কাম পাপা। '
' হোয়াট?? পাপা? হ্যভ ইউ গন ম্যাড?' চেঁচিয়ে উঠে চমকে গেল আয়ুশী। 
সামনে দাঁড়িয়ে সুহৃদ। তার প্রথম প্রেম। প্রথম ছোঁয়া, প্রথম চুম্বনের সাক্ষী.... না পারছে না দাঁড়িয়ে থাকতে মাথা ঘুরছে তার। এ কি করে সম্ভব। 

নিস্তব্ধতা সুহৃদই ভাঙল। 'তুই চলে যাওয়ার পর আমি ভেঙে পড়েছিলাম আয়ুশী। রবার্ট আর তোর কথা শুনে আর সহ্য করতে পারিনি। গ্রামে ফিরে বিয়ে করি শুধুমাত্র তোর ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য। সুখী হতে পারিনি রে। শারীরিক নির্যাতন করেছি প্রতি রাতে মেয়েটির ওপর। তোর ওপর রাগ মেটাতে ওকে বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হতে হত বলতে পারিস। চলে যায় সে ডিভোর্স করে তার প্রেমিকের হাত ধরে আবার আমায় একা করে দিয়ে। আর জড়ায়নি কোনও সম্পর্কে। গ্রামের গরিব মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা আর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাকরি এই নিয়ে চলেছে দিন। একবার খবর ও নিসনি কেমন আছে তোর সেই টিউবলাইট, ইডিয়ট টা।। কি করে ছেড়ে গেলি? কেরিয়ার, তোর লেখালেখি সেদিন সব ছিল তোর কাছে। আমি ছিলাম তুচ্ছ।

এমিলি রবার্ট এর সন্তান তাই অন্তত তোর মত অমানুষ যান্ত্রিক হয়নি। কি বলেছে জানিস ও আমায় খুঁজে পেয়ে সবটা জানার পর?? 'উইল ইউ বি মাই ড্যাড?' আমি রেগে তাড়িয়ে দি ওকে। ঘেন্না করতাম তোকে। পারিনি রিচার্ড এর সন্তানকে সহ্য করতে। কিন্তু ও যে নাছোড়বান্দা।  আমাকে বাধ্য করে আবার নরম হতে। আবার কিসের টানে ফিরিয়ে আনে কলকাতা জানি না আমি। '

চোখের জল সামলাতে পারছিল না আয়ুশী। এতগুলো বছর আগের এক ভুল, সুহৃদকে ছেড়ে বিদেশে চলে যাওয়া কেরিয়ার আর তার প্যাশন লেখালেখি। আজ বড্ড নীচ মনে হচ্ছে নিজেকে।

' আর একবার ক্ষমা করে দিবি ইডিয়ট প্লিজ? এমিলি ম্যাথারস থেকে মিলি সেন ব্যানার্জি করে দেওয়ার শেষ একটা সুযোগ দিবি? 'আয়ুশী কেমন যেন ঘোরের মধ্যে বলে গেল কথাগুলো। 

চোখে জল অথচ অদ্ভুত এক শীতল গলায় সুহৃদ বলে উঠল,' আমি যা বলার এমিলিকে বলে দিয়েছি। '

' ফিরিয়ে দিচ্ছিস ইডিয়ট? 'কেঁদে উঠলেন নামকরা গাইনোকলজিস্ট, সমাজের নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান চরিত্রের।  চোখে জল আজ এই পাথরের ও। 

' নো মম হি ইজ নট লিভিং ইউ লাইক ইউ ডিড বিফোর। আমায় মেয়ে বলে মেনে নিয়েছেন উনি, শুধু এটাই বলেছেন ড্যাড হতে পারবেন না, উনি আমার বাবা হতে চান। মাই পাপা। '

বাচ্চাদের মত হেসে উঠল আয়ুশী, এক রাশভারী, প্রতিবাদী ডাক্তার আজ বড্ড যেন বাচ্চা হয়ে উঠল তার ইডিয়ট এর কাছে। 

পাশে কোথাও একটা বেজে উঠল -
but when I’m cold, cold
oh when I’m cold, cold
there’s a light that you give me when I’m in shadow
there’s a feeling you give me, an everglow.....

আর কোথাও যেন একটা কোকিল ডেকে জানান দিল - বসন্ত এসে গেছে।।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন