“আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।।“…না,না কোনো কোথাও যাইনি, যাবই বা আর কোথায়? বসন্ত বেলায় এই মাতাল সমীরণের আহ্বান ছেড়ে! ঘর দুয়ার যে আজ ভেসে যায় ফাগুন চাঁদের অপরূপ মহিমায়, এই “নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এল প্রাণে।“ যাওয়া কি সত্যিই যায় বল আর এই উদাস হাওয়ার ফাগুনী শান্তিনিকেতন ছেড়ে!
আসলে, পূর্ণিমা তো সারা বছরেই ঘুরে ফিরে বারবারই আসবে রবি ঠাকুরের স্নেহ ধুলোর বুকে। কিন্তু ফাগুন চাঁদ আর প্রকৃতির অপার প্রাণের উচ্ছ্বাস নিয়ে গড়ে ওঠা বসন্ত পূর্ণিমা...না,না শান্তিনিকেতনে এমন দিনে কি বাইরে যাওয়া যায়! ---বন, জঙ্গল ,প্রকৃতি সবাই যে আমার ঘরের আপনজন! অথচ, বসন্তের কোকিল তো বাংলাদেশের সব জায়গাতেই তার সুমধুর ধ্বনি সাজিয়ে দিয়ে যায়, এ আবার নতুন কি ? কিন্তু শান্তিনিকেতনের এই বসন্ত পথে কোকিলের কুহুস্বর, পলাশ বিছানো পথের স্পর্শ, মাথার উপর শিমুল ফাগুন বৌ এর ফুলেল আশ্রয় –আহা! সত্যিই “এ কি লাবণ্যে পূর্ণ , প্রাণেশ হে, আনন্দবসন্তসমাগমে।।”
বস্তুত ,শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবের মূল লক্ষ্য প্রকৃতির সাথে মানুষের অপরূপ মেলবন্ধন ঘটানো। বসন্ত ঋতুকে ঘিরে শান্তিনিকেতন আশ্রমে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ “ বসন্তোৎসব’’ অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করেন। গুরুদেব চেয়েছিলেন, দেশ বিদেশ থেকে আগত প্রতিটি মানুষের সাথেই যেন প্রকৃতির এক সহজাত ভালোবাসা গড়ে ওঠে। গুরুদেবের দেখানো পথেই আজও শান্তিনিকেতন বসন্ত পূর্ণিমায় ভেসে যায় প্রকৃতির রূপ,রস গন্ধ আহরণের সাক্ষী হয়ে। বাতাসে পলাশের নেশা দিগন্তে চন্দ্র মহিমা! কার মন না রেঙে ওঠে এই মুহূর্ত কাল ছুঁয়ে ! সত্যিই বুঝি তাই মন গেয়ে ওঠে --
“বউকথা কও তন্দ্রাহারা বিফল ব্যাথায় ডাক দিয়ে হয় সারা আজি বিভোর রাত।
দুজনের কানাকানি কথা দুজনের মিলনবিহ্বলতা,
জ্যোৎস্নাধারায় যায় ভেসে যায় দোলের পূর্নিমাতে।’’
কবি তো বলেই ছিলেন রাঙিয়ে দিয়ে যেতে। বৈতালিক দিয়ে শুরু হয়ে গৌর প্রাঙ্গণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে চৈত হয়ে যে বাতাস ডাক ছড়িয়ে দিয়ে যায় আশ্রম মাঠের মূল অনুষ্ঠান মঞ্চে সকালের শোভাযাত্রা সহযোগে,সেই বাতাসের শ্লোকে শ্লোকে জাগে কেবল জেগেই ওঠে নবজাগরণের ডাক ‘খোল্ দ্বার খোল্ লাগলো যে দোল’ সুরে সকল প্রান্তরে প্রান্তরে –সে যে ভালোবাসার হাতে ফুলের সুগন্ধ নিয়ে অনন্ত ভালোবাসা প্রেম-ময়তা ছড়িয়ে দিয়ে যায় সকলের অন্তরে অন্তরে। জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যে রাঙিয়ে নিতে চায়,দিতে চায় রাঙিয়ে ভালোবাসার পবিত্র বন্ধনে! আবীরে আবীরে গোটা আকাশ বাতাস জল স্থল গেয়ে ওঠে ‘‘ রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও গো এবার যাওয়ার আগে...’’।
এই কাতরতায় কি গৃহবাসী দ্বার না খুলে বসন্ত আবীরের কাছে নিজেদের সমর্পণ না করে পারে! হয়তো গোপনে গেয়ে ওঠে ...
‘‘ যেটুকু কাছেতে আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে ,
চকিত মনের কোণে স্বপনে ছবি আঁকে।’’
বসন্ত যে এভাবেই দোলা দিয়ে যায় রবিধন্য ভূমিতে। উনিশো পঁচিশ সালে শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব শুরু হয়। প্রথম থেকেই উৎসব হত আম্রকুঞ্জ এবং গৌড় প্রাঙ্গণে। মাঝে একবার অবশ্য নিরাপত্তা জনিত কারনে উৎসবকে স্থানান্তরিত করা হয় মেলার মাঠে। পলাশ সাজে সজ্জিত হয়ে অসংখ্য নর নারীর একত্রে বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার এই অপরূপ সৌন্দর্য বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও নেই। কেবলমাত্র বিশ্বভারতীর ছাত্র ছাত্রীরাই না, তাদের সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত মানুষের যেন এই উৎসব! পুরুষদের প্রত্যেকের পরণে প্রায় সাদা পাঞ্জাবী,মেয়েরা হলুদ সবুজ শাড়িতে সজ্জিত হয়। মুখে সবারই ভালোবাসার আবীর। না, অন্য জায়গার মত রঙ পিচকারি বা আরও প্রচলিত অনান্য রঙের উপদ্রব নেই এখানে। স্থানীয় মানুষজন থেকে শুরু করে আগত দর্শনার্থী প্রত্যেকেই একে অপরকে ভালোবেসে আবীর সাজে রাঙিয়ে দিয়ে যায়। এ বসন্ত অন্য বসন্ত , প্রাণের ভালোবাসার বসন্ত। বিভাজন নয়,বরং সেতু বন্ধনের উৎসব। এমনকি, নিজেকে যিনি চান না রাঙিয়ে নিতে , তাকে রঙ মাখিয়ে বিব্রত না করাই এখানকার সংস্কৃতি। সন্ধ্যায় বসন্ত ফাগ জোছনা আর চাঁদ কে সাক্ষী রেখে মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় রবি ঠাকুরের কোনো নৃত্যনাট্য বা নাটিকা। এই যেমন ‘ তাসের দেশ’র আমেজে মেতেছি এই বসন্তে...
তাই চাঁদ কে সাক্ষী রেখে পলাশ নেশায় মাতাল হয়ে যাবো কোথায়, এই পুণ্যভূমি ছেড়ে! এ যে আমার তীর্থ ভূমি, আমার আজন্মের জন্নত!
Tags:
মুক্ত গদ্য