এই যে জঞ্জালের মধ্যে থেকে কোন এক বীজের পড়ে থাকার অজুহাতে একটি গাছ জন্ম নিয়েছে, আমি তার বেড়ে ওঠার দিকে তাকিয়ে থাকি। কীভাবে সর্বশক্তি দিয়ে এক আপাত মেরুদন্ডহীন লতানে গাছ হামাগুড়ি দিয়ে একে আঁকড়ে, ওকে আঁকড়ে তরতর করে বেড়ে চলেছে, বাড়তে বাড়তে তার সমস্ত জড়তা কাটিয়ে উঠে যাচ্ছে এক উঁচু মাচায়, যেখানে সে ফুল দিচ্ছে, ফল দিচ্ছে, পূর্ণ হচ্ছে, বীজ হয়ে আবারও শূন্যে মিশছে – এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সেই দুর্বল গাছটির কোন উচ্চকিত স্বর শোনা যায় না, যেন এই স্বাভাবিক ঘটনা। তার মত সামান্যর আসামান্য হওয়া মানায় না জেনে নিজের কাজটি মন দিয়ে করে যাওয়া, প্রাণপণে বাঁচার তীব্রতাকে উপভোগ করে যাওয়াই তার আনন্দ। আর এই জন্যই আমি সেই মাটিতে ভর দিয়ে চলা গাছটিকে মনে মনে প্রণাম করি। এরাই শেখাতে পারে সামান্যর অসামান্য হওয়াকে কীভাবে স্বাভাবিক দেখানো যায়, কীভাবে বেঁচে থাকার রসদ নিজেকেই জোগান দিয়ে যেতে হয়।
আর মাতৃভাষাকেও আমি এভাবেই দেখি। কোন প্রয়াস ছাড়াই একটি শিশু শুনে শুনে একেকটি শব্দ রপ্ত করতে থাকে, ক্রমশ সে গড়গড় করে তার মাতৃভাষায় কথা বলতে শিখে যায়। এরপরের ধাপ হল, সেই ভাষায় লেখা। এবং এখানে প্রচেষ্টা আসে, প্রয়াস আসে। ধীরে ধীরে সে শিখতে থাকে ব্যাকরণ, ভাষার গঠন শৈলী। তার ভাষার ইতিহাসের একটু হলেও সে যদি না জানে সম্ভবত তার সেই ভাষা শিক্ষা অর্থহীন হয়ে যেতে পারে। সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে তখনই, যখন সে নিজেই সেই ভাষার গঠন শৈলী নিয়ে কোন নতুন পথ অর্থাৎ ইতিহাস তৈরি করতে পারবে।
আর যে তুলসী গাছটা বাড়ির বাইরে পড়ে থাকে, যত্নআত্তি ছাড়াই বেড়ে ওঠে, তাকে আমি আটপৌরে ভাষার মত ভাবি। যে ভাষা মুখের ভাষা, যে ভাষায় সব সময়ে লেখা যায় না, লেখার ভাষায় চাই একটু পলিশের ছাপ, নইলে যেন তাকে মানায় না। যেভাবে এক ছাপা শাড়ি পরা গৃহবধূ রান্নার সময়ে আঁচলে হলুদ মাখা হাতটি মোছে, সেভাবেই আমাদের কথ্য ভাষা নেহাতই কেজো চরিত্রের। সেই বধূটিই বাড়ির বাইরে গেলে পাটভাঙা শাড়ি পরে, মুখে হালকা মেক-আপের ছোঁয়ায় অনন্যা হয়ে যায়, কথ্য ভাষাকে সেভাবেই সাজিয়ে গুজিয়ে আমরা লেখার ভাষায় নিয়ে আসি। এই বিভাজনে অবশ্য ভাষা একই থাকে, সেই বউটিও যেভাবে থেকে যায় একই মানুষ হয়ে। শুধু পরিবেশনের রকমফেরে বদলে যায় ছবিটা।
আর যে ঝোপঝাড় অযত্নে জন্মায়, যেসব আগাছাকে আমরা কেটে ফেললেও আবারো বাড়ে, আমাদের বিরক্তি বাড়ায়, দেখতে না চাইলেও ঠিক চোখে পড়ে যায়, সে ধরণের ভাষাকেই বোধহয় স্ল্যাং বলে থাকি আমরা। আমাদের বোধের বাইরে থাকলেও এই শব্দ গুলো ভেতর থেকেই আসে কিন্তু। আজকাল যেমন পথেঘাটে সর্বত্র কথার মাত্রা হিসেবে কলকাতা ও আশেপাশের এলাকার বাচ্চা থেকে বুড়ো (পুরুষ অবশ্যই) লিঙ্গের অপভ্রংশ হিসেবে ‘বাঁড়া’ শব্দটি নির্বিচারে ব্যবহার করে, শুনলে তাজ্জব হতে হয়। আমার সাধারণ বুদ্ধিতে এইরকম ব্যবহারকে পুরুষতন্ত্রের চিৎকৃত উচ্চারণ ছাড়া আর কিছু মনে হয় নি। এছাড়া জেলায় জেলায় নানারকম স্ল্যাং ব্যবহার করার রীতি আছে। ‘শালা’ শব্দটি যেমন স্ল্যাং হিসেবে তার মর্যাদা খুইয়ে জলভাতের মত ব্যবহার হয়, এমন আরও কত শব্দ যে দিনে দিনে আমরা মূল ভাষায় স্থান দিয়েছি, তার শেষ নেই।
বুল ফাইটিং-য়ে যেমন দেখি, লাল কাপড় উড়িয়ে এক যোদ্ধা ক্ষ্যাপা ষাঁড়কে আহ্বান করছে, তার মৃত্যু হতে পারে জেনেও সে পিছপা নয়। সে জিততে চায় যে কোন মূল্যে। এই ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের আক্রমণে মৃত্যুও কিন্তু হামেশাই ঘটে। ঠিক যেভাবে আমাদের বাংলা ভাষায় হিন্দি, ইংরেজি প্রবেশ করে ভাষাটাকেই শেষ করে দিচ্ছে। আমরা স্মার্ট হতে গিয়ে, অর্থাৎ বিশুদ্ধ বাংলা বললে লোকে আমাদের গেঁয়ো বলবে, এই জন্য হিন্দি, ইংরেজি মিশিয়ে শহরের মানুষরা বাংলা ভাষাটাকে একটা খিচুড়ি ভাষায় পরিণত করেছে। বিদেশী শব্দের আগমন নতুন কিছু না, বহুযুগ ধরেই আরবী, ফারসী, উর্দু বা ইংরেজির মিশেল ঘটেছে বাংলা ভাষায়। কিন্তু তার ফলে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধই হয়েছে। এভাবে মৃত্যুর মুখে পড়ে নি। যেমন একটা ইনডোর প্ল্যান্টকে ঘর সাজানোর জন্য আমরা সুন্দর টবে ঘরের ভেতরে রেখে দিই, আবার সপ্তাহে দুএকদিন রোদ-জল খাওয়ানোর জন্য তাকে বাইরের বারান্দায় রেখে আসি, তেমনি ভাবে ওই বিদেশী শব্দ আমাদের ভাষাকে রোদ-জল দিয়েছে। মেরে ফেলে নি। আর এই মৃত্যুকে ডেকে আনছি আমরাই। প্রতিকার? প্রতিকার রয়েছে আমাদের হাতেই। নিজের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। এরপর কী হবে, তার উত্তর দিতে পারে সময়।
ভাষার বহিঃপ্রকাশ একেক জনের একেক রকম। কেউ সংযত, কেউ বা উচ্ছসিত। মনের ভাষা আর মুখের ভাষারও রকমফের প্রায়শই ঘটে। আর রয়েছে ভাবনার ভাষা। ক্রোধের জ্বলন্ত ভাষা। দুঃখের মূক ভাষা। আর যারা সত্যিই বোবা, তাদেরও ভাষা আছে বই কী! সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের বাইরেও রয়েছে তাদের শরীরের ভাষা। আর এই শরীরের ভাষাই বোধহয় মূক বা বাচাল – প্রত্যেকেরই বেশী মাত্রায় সরব। নৈঃশব্দের ভাষা বোঝে ক’জন? যারা বোঝার বোঝে, অবুঝ লোকরাও তাদের নিজস্ব ভাষাতে নিজের নির্বুদ্ধিতার কৈফিয়ৎ দিতে থাকে। ভাষা শুধু মুখের না, ভাষা মনেরও। ভাষার ব্যবহার বন্ধ হবে না, এটুকু অন্তত হলফ করে বলা যায়।